কলকাতার বারবণিতা সমাজ, যাঁদের এখন পরিচয় যৌনকর্মী, তাঁরা এখন দুর্গাপুজো করছেন। শুরুতে তাঁরা বিরাট বাঁধার মুখে পড়েছিলেন। সমাজ তো চালান সেই সব বাবুরা, যারা সময়ে-অসময়ে এঁদের ঘরে আসেন, বসেন, কাউকে কাউকে পোষেন। তো যৌনকর্মীরা, যাঁদের তাঁরা ‘পতিতা, বেশ্যা’ইত্যাদি নামে বলে থাকেন; তাঁরা যদি দুর্গাপুজো করবে, তাহলে আর বাবুদের ‘মর্যাদা’ থাকে না কি! অতএব, তাঁদের পুজোয় আপত্তি এল।
সমাজের চালকরা তো একটু বেশিই বিচক্ষণ। তাঁরা খারাপ কাজটা নিজেরা করেন না, করান। করে দেয় তাঁরা, যাদের হাত-পা সমাজচালকদের কাছে বাঁধা থাকে। তাই বাধা এসেছিল পুলিশের থেকে। কত যুক্তি! আইনশৃংখলার প্রশ্ন, রাস্তা জুড়ে পুজো করায় আপত্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি। যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি’ আদালতে প্রমাণ দিল যে, প্রস্তাবিত জায়গায় পুলিশ এর আগেও পুজোর অনুমতি দিয়েছে। আদালত পুলিশের সব যুক্তি নাকচ করলে আবার পুলিশ যুক্তি দেখালো – সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে। কলকাতার ঐতিহ্য এটা নয়। এই শহরের পার্ক সার্কাসে একাধিক পুজোয় মুসলিমরা সক্রিয়ভাবেই যুক্ত থাকেন। তাঁদের কেউ কেউ শাসক দলের বিধায়ক, সাংসদ। গার্ডেনরিচে, ভূকৈলাশে মুসলিমরা পুজোয় সক্রিয় থাকেন। খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজেও বেশ কয়েকটা দুর্গা পুজো হয়। কোনওদিন তা নিয়ে ঝামেলা হয় নি। সোনাগাছির পাশেই পুজো হয়, সেখানেও কোনওদিন ঝামেলা হয় নি। তাঁরা প্রশ্ন তুললো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবে, পুলিশ ধরে নিল কি করে? সম্ভবত, পুজোর দিনগুলিতে যৌনকর্মীরা পুজোয় মেতে থাকলে কারও কারও আনন্দ-বিনোদনে সমস্যা হতে পারে বলেই কি বাঁধা? নাকি এরা যৌনকর্মী বলেই এদের পুজো করার অনুমতিও দেবে না পুলিশ?
হিন্দুই বলুন আর সনাতন, মন্দিরে মন্দিরে একসময় যারা ‘দেবদাসী’ ছিলেন, তাঁরা কারা? নানা সমীক্ষা, নানা প্রবন্ধ তো বলছে যে, দেবদাসীরা আসলে ধর্মের আড়ালে বাধ্য হওয়া যৌনকর্মীই। তাঁরাও কিন্তু পুজোর অধিকারে বঞ্চিত ছিলেন না। যৌনকর্মীদের পেশার কারণে তাঁদের পুজোর অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে সেটা ঘোর অন্যায়ই হতো। সেটা অনুভব করেই আদালত পুলিশের অন্যায়কে রুখে অনুমতি দিয়েছিল যৌনকর্মীদের দুর্গাপুজোয়। কলকাতার যৌনকর্মীদের আরেকটা লড়াইয়ে জয় এসেছিল।
পুজোর সঙ্গে যৌনকর্মীদের বা যৌনতার সম্পর্কের প্রসঙ্গ আসলেই সবার মনে পড়ে যায়, যৌনকর্মীদের ঘরের মাটি না হলে দুর্গার প্রতিমাই তৈরি হয় না। কুমোরেরা বলেন, ‘ওটা অতি আবশ্যিক। আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকেই এটা জেনে এসেছি। ব্যাস!’ কেন জরুরি, তা অবশ্য তাঁরা তা ব্যাখ্যা করতে পারেন না। তাদেরও কখনও জানান হয়নি, কেন এখানকার মাটিকে অতীতে এত পবিত্র গণ্য করা হতো।
অতীতে দেখা যাচ্ছে, পুজোর সময় বারবণিতাদের বিরাট ভূমিকা ছিল কলকাতায়। কলকাতায় বড় পুজো মানে ছিল বড় বড় জমিদার বাড়ির পুজো। ২০০-৩০০ বা তাঁর বেশি পুরানো পুজোয় বাঈজী, বারবণিতাদের লখনউ, বারাণসী থেকে ভাড়া করে আনা হতো। পুজোর দিনগুলিতে তাঁরা নাচ, গানে আসর জমাতেন।
হুতোম প্যাঁচার নকশা-য় উত্তর কলকাতার দুর্গা বিসর্জনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন, “ক্রমে শহরের বড়ো রাস্তা চৌমাথা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, বেশ্যালয়ের আলাপীতে পুরে গেল, ইংরাজি বাজনা, নিশেন, তুরুকসোয়ার ও সার্জেন সঙ্গে প্রতিমারা রাস্তায় বাহার দিয়ে বেড়াতে লাগলেন… … কর্মকর্তারা কেউ কেউ প্রতিমে নিয়ে বাঁচ খেলিয়ে বেড়াতে লাগলেন – আমুদে মিনসে ও ছোঁড়ারা নৌকোর উপর ঢোলের সঙ্গতে নাচতে লাগলো। সৌখিন বাবুরা খ্যামটা ও বাই সঙ্গে করে বোটে, পিনেস ও বজরার ছাতে বার দিয়ে বসলেন…।” কেবল ভাসানেই নয়, পুজোর দিনগুলিতেও অনেক বাবুর বাড়িতে বাঈজি নাচের আসর বসত। চুঁচুড়ার প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে লখণৌ থেকে বাঈজি আনিয়ে নাচের আসর বসত। সেখানে ইংরেজ আর ফরাসী সাহেবদের অঢেল মদ ও যৌনকর্মী দিয়ে সন্তুষ্ট করা হত। তাঁর প্রমাণ আছে। হুতোম নিজেই লিখেছেন, “”বাবুর বাড়ি নাচ, সুতরাং বাবু আর অধিকক্ষণ দালানে বসতে পাল্লেন না, বৈঠকখানায় কাপড় ছাড়তে গেলেন, এদিকে উঠনের সমস্ত গ্যাস জ্বেলে দিয়ে মজলিসের উদযোগ হতে লাগলো, ভাগ্নেরা ট্যাস্ল দেওয়া টুপি ও পেটি পরে ফপরদালালি কত্তে লাগলেন। এদিকে দুই-একজন নাচের মজলিসি নেমন্তন্নে আসতে লাগলেন। মজলিসে তরফা নাবিয়ে দেওয়া হল। বাবু জরি ও কলাবৎ এবং নানাবিধ জড়োয়া গহনায় ভূষিত হয়ে ঠিক একটি ‘ঈজিপ্সিয়ান মমী’ সেজে মজলিসে বার দিলেন – বাই সারঙ্গের সঙ্গে গান করে সভাস্ত সমস্তকে মোহিত কত্তে লাগলেন।” সেই সঙ্গে শহরের চেহারাটাও দেখিয়েছেন হুতোম– “পাঠকবর্গ, এবার শহরটার শোভা দেখুন – প্রায় সকল বাড়িতেই নানা প্রকার রং তামাসা আরম্ভ হয়েচে। লোকেরা খাতায় খাতায় বাড়ি বাড়ি পুজো দেখে বেড়াচ্চে। রাস্তায় বেজায় ভিড়। মাড়োয়াড়ী খোট্টার পাল, মাগীর খাতা ও ইয়ারের দলে রাস্তা পুরে গ্যাচে।”
হুতোম যখন লিখছেন, কলকাতার সমাজে তখন ডিরোজিওর ‘ইয়ংবেঙ্গল’-এর প্রভাব পড়েছে বোঝা যায় এই অংশে – “এ-শহরে দু-চার এজুকেটেড ইয়ংবেঙ্গলও পৌত্তলিকতার দাস হয়ে পুজো-আচ্চা করে থাকেন - ব্রাহ্মণ ভোজনের বদলে কতকগুলি দিলদোস্ত মদে ভাতে প্রসাদ পান, আলাপী ফিমেল ফ্রেন্ডরাও নিমন্ত্রিত হয়ে থাকেন, পুজোর কিছু রিফাইন্ড কেতা।” শোভাবাজার রাজবাড়ির এমন নাচের আসরে উপস্থিত থেকেছেন স্বয়ং লর্ড কার্জনও। ইংরেজের গেজেটে ‘NAUTCH’-এর আসরের বিজ্ঞাপন দিয়ে ইংরেজ সাহেব-সুবোদের আমন্ত্রণ জানানো হত। শোভাবাজার রাজবাড়ির কর্ণধার আলোককৃষ্ণ দেব বলেছেন, আগের আমলে নাটক চলাকালে যৌনতাগন্ধী অংশে পরিবারের যুবকরা বারবার ‘এনকোর’ বলে সেই অংশ পুরাভিনয়ে বাধ্য করত৷ এমনও হয়েছে যে, একই দৃশ্য বহুবার অভিনয়ের ফলে ভোর হয়ে গেছে, কিন্তু নাটক শেষ হয়নি। শেষে মুরগি ডেকে নাটক শেষ করা হয়৷ দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘পল্লীচিত্র’ গ্রন্থের দুর্গোৎসব-এ, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা ‘পাঁচু ঠাকুর তৃতীয় কাণ্ড’-তেও এমন টুকরো টুকরো ছবি পাওয়া যায়। আসলে, ব্রিটিশ আমল থেকে ধনী পরিবারগুলির ‘ফুলবাবু’দের দ্বারা দুর্গাপুজোয় বিকৃত রুচির কুৎসিত রূপায়ন শুরু হয়৷ ব্রিটিশদের উৎসাহে পুষ্ট বাবু কালচারে সেই রুচি গিয়ে তলানিতে ঠেকে৷ এখনকার দুর্গাপুজোয় মদ্যপান ও অশ্ললীলতার বিস্তৃতির সঙ্গে সম্পর্ক আছে কেবল পণ্যায়নের দৌলতে সর্বনাশের পিচ্ছিল পথে ধাবিত রোমিওদের, যারা প্রতি পুজোয় পুলিশের হাতে ধরা পরে।
সেকালের কলকাতায় দুর্গা বিসর্জনের বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাইপো ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, “চিৎপুর রোডের এই অংশের দুই পার্শ্ব সেকালে বড় অধিক পরিমানে বারবণিতাদিগের অধিকৃত থাকিত৷ ...আরও মনে হয়, সেকালে একাল অপেক্ষা মদ্যপানের কিছু বেশি প্রাবল্য ছিল৷ যাঁহাদের গৃহের প্রতিমা বিসর্জন হইত, সেই সকল বাবু ও তাঁহাদের সাঙ্গোপাঙ্গো নকল বাবুরাও প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে নানাপ্রকার অঙ্গভঙ্গী করিতে করিতে কানে খড়কে দিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে চলিতেন৷ ... যাঁহাদের পয়সা ছিল, তাঁহারাই প্রতিমার সম্মুখে বাঁশের ময়ূরপঙ্খীতে খেমটার নাচ নাচাইতে কুণ্ঠিত হইতেন না৷’ সেই নর্তকীদের ‘নির্লজ্জ বা বেহায়া ভাব আছে’ সে কথা জানিয়ে তিনি লিখছেন, “তাঁহারা ও তাঁহাদের সাঙ্গোপাঙ্গো সকলেই ন্যূনাধিক মদ্যপান করিয়া বাহির হইতেন কেহ কেহ নেশার ঝোঁকে ঢলিয়া পড়িতেন৷ ... বাবুরা তো এইরূপে ঊর্দ্ধনেত্রে নানাবিধ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করিতে করিতে চলিতেন৷”
বাস্তবে, প্রাচীন সমাজে সুস্থ যৌনতা না নগ্নতা দোষের ছিল না। যৌনতার সঙ্গে অশালীনতার বিশেষ সম্পর্কও ছিল না। তাই, বহু প্রাচীনকাল থেকেই দুর্গার মূর্তিতেও আছে নগ্নতার প্রকাশ। প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার শোভন সোম লিখেছেন, “পঞ্চম শতকে বিদিশার উদয়গিরি গুহাগাত্রে খোদিত এক দুর্গামূর্তিতে আমরা দেখি, দশভূজা দশপ্রহরণধারিনী দেবী নগ্নবক্ষ। নিম্নে পতিত মিহিষাসুরের গায়ে বাম পদ রেখে দেবী আলীঢ় ভঙ্গীতে রয়েছেন;... সপ্তম-অষ্টম শতকে মহাবলীপুরমের বরাহমণ্ডপ গাত্রে খোদাই করা মূর্তিতে দেখা যায় সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা দেবগণসহ অসুরদলের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ করছেন। অসুরেরা পলায়নতৎপর। পলায়নরত মহিষমুণ্ডধারী মনুষ্যদেহী মহিষাসুর দুহাতে গদা ধরে আছে। এই দেবীরও বক্ষ নগ্ন। এঁর নিম্নাঙ্গে বস্ত্রের আভাস আছে কিন্তু সেটি শাড়ি নয়। ইলোরার কৈলাশমন্দিরেও আমরা দেখি, নগ্নবক্ষপার্বতী শিবের পাশে আলীঢ় ভঙ্গীতে রয়েছেন।”
যোগেশ চন্দ্র বিদ্যানিধির পূজাপার্বন বা ভারতীয় যাদুঘরের প্রাক্তন অধিকর্তা ডঃ শ্যামলকান্তি চক্রবর্তীর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে সবচেয়ে প্রাচীন যে প্রস্তরীভূতা ‘মহিষমর্দিনী’ মূর্তিটি পাওয়া গেছে সেটি প্রথম শতকের। রাজস্থানের নাগোরে পাওয়া এই মূর্তিটিতে একটি কৃষ্ণাঙ্গী বালিকা মোষের লেজ মুচড়িয়ে তাড়াচ্ছেন। লেজ মুচড়িয়ে বা মর্দন করে তাড়াচ্ছেন বলেই তিনি মহিষমর্দিনী। সেই বালিকাটিও কৃষ্ণাঙ্গী এবং নগ্নবক্ষা। তারপর সময় যত এগিয়েছে, ততই দেবীর গায়ে নানা রকমের পোষাক উঠেছে। কোথাও ঢাকাই বা তাঁতের শাড়ি, তো কোথাও বেনারসী, চোলি। যস্মিন দেশে যদাচারঃ আর কি।
কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’-এ দুর্গাকে শিবের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় পুত্র লাভের জন্য। অর্থাৎ, আর্য-সংস্কৃতির ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’। সেই কাহিনীতেও কালিদাস দেবীকে নগ্না না দেখিয়ে পারেন নি। কারণ, তৎকালীন সমাজে সেটাই তাঁর রূপ। তিনি তাঁকে নাম দিলেন অপর্ণা। অপর্ণা অর্থাৎ, যার শরীরে একটি পাতার পোষাকও নেই যা তাঁর লজ্জা নিবারন করবে। অবশ্য কালিদাস তাঁকে সেই সময় হিমালয়ের বরফঠাণ্ডা জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে তপস্যায় বসিয়ে লজ্জা বাঁচিয়েছেন।
কিন্তু সেই দায় ছিল না ঋষী মার্কণ্ডেয়র। মার্কণ্ডেয়পুরাণেরই অঙ্গ দেবী ভাগবত, যার একটি অংশের নাম শ্রীশ্রী চণ্ডী। দেবীকে বলা হয়েছে ‘সর্বশবরানাং ভগবতী’। অর্থাৎ, সব শবরদের তিনি ভগবতী। শবরদের রয়েছে দুটি ভাগ – পর্ণশবর ও নগ্নশবর। প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ শ্যামলবাবু বলছেন, পর্ণশবরদের পরনে থাকত পাতার পোষাক, নগ্নশবররা দিগম্বর। দিগম্বর শবরদের দেবীই অপর্ণা বা নগ্নশবরী। তিনিই যখন পর্ণশবরদেরও দেবী হলেন, অর্থাৎ তাঁদের পুজো পেতে শুরু করলেন। তাঁরা তাঁকে পাতার পোষাকে সাজালেন, যেমন করে আজ আমরা আমাদের ঘরের মেয়েদীর পরিধেয় ঢাকাই বা বেনারসী বা চোলিতে সাজাই। পাতার পোষাকে সেজে দেবই হলেন পর্ণশবরী। এটি দুর্গার অষ্টোত্তর শতনামের একটি নাম। তিনি সব শবরদের দেবী হওয়া ওঠায় দুর্গা ভাগবতে তাঁকে বলা হল ‘সর্বশবরানাং ভগবতী’। তাঁর আগে পর্যন্ত তিনি নগ্নিকা। এই রূপটিই দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ - কালী রূপা। ঝাড়খণ্ডের বনবাসী শবর মেয়েরা এখনও দুর্গা মূর্তি বিসর্জনের শোভাযাত্রায় আকণ্ঠ মদ্যপানের পর উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রেখেই নাচতে নাচতে যান৷ এখনও এটাই দস্তুর৷
বাংলার লোক কাহিনীর দুর্গা তো আবার কুমারী অবস্থাতেই মা হয়েছেন। বাংলার গ্রামেগঞ্জে, বিশেষত পূর্ব বঙ্গে, এক দুর্গার পুজো হয়, তাঁর নাম বনদুর্গা। বনদুর্গার পুজো ওডিশাতেও হয়, তবে সেই দুর্গা জঙ্গলের ভয়ঙ্কারী দেবই। বাংলায় বনদুর্গা ঘরের মেয়ে, লৌকিক দেবী। বাঙ্গালী মায়েরাই তাঁকে ‘কুমারী মা’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অবশ্য পুরাণ মতে দেবী কুমারীই। তাঁর কোনও স্বামী নেই।
ময়মনসিংহের বনদুর্গার কাহিনীতে বলা হচ্ছে, বিয়ের আগেই দুর্গা শিবের সঙ্গে গোপনে মিলিত হতেন। সে মিলনে শারিরিক সম্পর্কও ছিল। এভাবে একদিন তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। গর্ভপাতের তখন চল ছিল না, তাই দুর্গা সঠিক সময়ে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। তারপর, লোকলজ্জার ভয়ে সেই কন্যাকে একটি গাছের গোড়ায় রেখে চোখের জলে ভাসিয়ে তিনি চলে গেলেন। সেই কন্যার গায়ে কোনও পোশাক নেই, তাই তিনি লজ্জা রক্ষায় বৃক্ষবাসিনী হলেন। মেয়েরা তাঁকে স্মরণ করে শেওড়া গাছের গোড়ায় বনদুর্গার পুজো করেন। তাঁর গোঁড়ায় মেয়েরা শাখা-সিঁদুর, আলতা-চিরুণী, লাল-হলুদ সুতো ইত্যাদি নিয়ে এসে পুজো দেন আর গাইতে থাকেন –
একজন গান- লাম লাম, বনদুর্গা, ষাইট শেওড়ার নিচে
বাকিরা দুর্গার হয়ে উত্তর দেন - কিমতে লামিবাম আমি শাড়ি নাই মোর সঙ্গে
একজন - সইয়ারে পাঠাইয়া দিছি নশিরাবাজারের শ’রে
শাড়ি যে আনিছেন সইয়ায় সিঙ্গিরায় বইলে।
আবার সকলে গান ধরেন লাম লাম, বনদুর্গা, ষাইট শেওড়ার নিচে
বাকিরা দুর্গার হয়ে উত্তর দেন - কিমতে লামিবাম আমি শঙ্খসিন্দুর নাই মোর সঙ্গে...
একজন সইয়ারে পাঠাইয়া দিছি সিদ্ধিগঞ্জের হাটে
শঙ্খ সিন্দুর আনছেন তিনি... ... ইত্যাদি ইত্যাদি\
এমন এক দেবীর দেখা পেয়েছিলেন তামিলনাডুর কোভালম-কান্নাগি দম্পতি। তামিল মহাকাব্য শিলপদ্দিকারম লিখেছিলেন পণ্ডিত ইলাঙ্গো আডিগাল। ইনি চের সাম্রাজ্যের রাজা সেঙ্গুত্তুভান-এর ‘ভাই’ হিসাবে পরিচিত। তামিলভাষায় প্রধান পাঁচটি মহাকাব্যের অন্যতম এবং ব্ল্যাঙ্ক ভার্স-এর প্রথম ফসল শিলপদ্দিকারম রচিত হয় আনুমানিক দ্বিতীয় শতকে। কোভালম-কান্নাগি-র তাঁর সৃষ্ট চরিত্র। আজও তামিলনাডুতে ভীষণ জনপ্রিয় এই দুই চরিত্র এবং শিলপদ্দিকারম মহাকাব্য। বহু অভিনয়ের পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা মকেনি।
শিলপদ্দিকারমে ধনী মৎসজীবীর পুত্র কোভালমের সঙ্গে কারুর বা তাঞ্জাভুরের কাছে এক ধনী ব্যবসায়ীর কন্যা কান্নাগি ওরফে কানাক্কির আশৈশব সখ্য ও প্রেম ছিল। কোভালমের সঙ্গে কান্নাগির জাঁকজমক করেই বিয়ে হয়। তাঁদের সুখের সংসারে হঠাৎই ছন্দপতন ঘটায় নর্তকী মাধবী। কোভালমের চোখ পড়ে মাধবীর দিকে৷ কান্নাগিকে ভুলে মাধবীর প্রেমে বিভোর হয়ে তার সঙ্গেই রাত কাটাতে থাকেন কোভালম। ধীরে ধীরে মাধবীর জন্য নিজের সব সম্পদও বিলিয়ে দেন। তারপর যখন সম্বিত ফেরে, তখন সে পুরোপুরি কপর্দকশূণ্য৷ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিওরে আসেন কান্নাগির কাছে। ক্ষমা চান। পতিব্রতা কান্নাগি না ফিরিয়ে স্বামীকে সম্মানের সঙ্গেই গ্রহণ করেন৷ লজ্জিত কোভালম স্ত্রীকে নিয়ে পরিকল্পনা করেন, অন্যত্র চলে গিয়ে নিজে ব্যবসা করবেন। কিন্তু পুঁজি নেই। তাই কান্নাগি নিজের পায়ের একটি মুক্তো-বসান মল (শিলপদ্দি) দিয়ে দেন৷ এবার শুরু হয় অজানার উদ্দেশ্যে পথ চলা।
তাঞ্জাভুর থেকে মাদুরাই যাওয়ার পথে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে একের পর দুর্গম বন পার হয়ে তাঁরা পৌঁছন শবর যোদ্ধা মারবারদের জঙ্গলে। রাতটা সেখানেই কাটানোর উদ্যোগ নেন। মধ্য রাতে বাজনা ও হৈ-হল্লায় আকৃষ্ট হয়ে কোভালম-কান্নাগি দেখেন, মারবার যোদ্ধারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যুদ্ধে রওনা হওয়ার আগে তাঁরা এক নগ্ন দেবীর পুজা করছেন৷ সেই নগ্নিকা দেবীর নাম ‘কোররাবাই’৷ সেই দেবীর দু-পাশে বাহন সিংহ ও হরিণ৷ দেবীর চার হাতে শূল, শঙ্খ, চক্র ও বরাভয়৷ যুদ্ধে বিজয় প্রার্থণা করে মদ্যপ যোদ্ধারা নিজেদের গলা চিরে স্ব-রক্তে দেবীকে অঞ্জলি দিচ্ছেন এবং অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছেন৷ এই দৃশ্য দেখে কোভালম-কান্নাগি ভয় পেয়ে যান। তাঁদের শীৎকারে মারবার যোদ্ধারাও তাঁদের দেখতে পান। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে অভয় দেন এবং সসম্মানে কোভালম-কান্নাগিকে নিজেদের বনভূমি এলাকা নির্বিঘ্নে পার করে দেন। তরুণি কান্নাগিকে পেয়ে তাঁরা তাঁকে ধর্ষণ করেননি, উলটে তাঁর সম্মান রক্ষাই করেছেন। কোভালম-কান্নাগির দেখা সেই মূর্তিই এখন পুজিত হয় তানজোরের পুণ্ডমঙ্গেশ্বর ও পুঞ্জইয়ের মন্দিরে৷
প্রাচীন স্মার্ত পুথি জিমূতবাহনের ‘কালবিবেক’, রঘুনন্দনের ‘অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব’, শূলপাণির ‘দুগোর্ৎসববিবেক’ থেকেও দেবীর নগ্নিকা রূপের ও তাঁর পুজোয় অবাধ যৌণাচারের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে বিহারের সহরসার রাজা শালিবাহনের পুত্র জিমূতবাহনের ’কালবিবেক’ আর চতুর্দশ শতকে নবদ্বীপের সন্তান শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) লেখা ১৫টি গ্রন্হের অন্যতম ‘দুগোর্ৎসববিবেক’৷ মাঝে রয়েছে রঘুনন্দনের ‘অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব’। এই তিনজনের লেখাতেই বলা হয়েছে, দুর্গা পুজোয় আমোদ-প্রমোদই প্রধান এবং মদ্যপান চলে অবাধে৷ তাঁরা সেই সন গ্রন্থে বলছেন, “আদিম রিপুর প্রবৃত্তি এবং অবাধ যৌনাচারের হুল্লোড় না থাকলে দেবী প্রসন্না হতেন না৷ বরং, কুপিতা এই দেবী উপাসকদের অভিশাপ দিতেন প্রাণভরে,” লিখেছেন প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদ শ্যাম কাশ্যপ। শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুযায়ী দেবী নিজেই মহিষাসুর বধের আগে ‘তিষ্ঠঃ তিষ্ঠঃ ক্ষণং তিষ্ঠঃ’ বলে মদ্যপান করে বলছেন,
‘গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম।
ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।।’
অর্থাৎ, রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধু বা মধ্যিপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন।। ‘আর্যাস্তব’-এ অনুযায়ী, এই ‘শিখীপিচছধবজাধরা’ ও ‘ময়ূরপিচছধবজিনী’ বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মদ্য ও মাংসে ছিল অপরিসীম আসক্তি৷ কবি সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’, সপ্তম ও অষ্টম শতকের বাণভট্ট ও বাকপতির লেখাতে বা জীমূতবাহনকথা-য় দেবীকে মদ্য ও মাংসে আসক্তবলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পশু ও মনুষ্যরক্ত-পিপাসু ছিলেন বলেও বলা হয়েছে।
বস্তুত, প্রাচীন কাল থেকেই দুর্গা শবরদের দেবী। তাঁদের শবরোৎসবই আজ শারদোৎসব। পুরাণে পুরাণে তাই দুর্গা কেবল যুদ্ধেরই দেবী নন, প্রজননেরও দেবী। দেবীর পুজার নানা উপাচারে প্রজননের সেই প্রতীকগুলি রূপক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এসেছে নয়টি গাছের চারার রোপন বা নবপত্রিকা প্রবেশ। তারপর জোড়া বেল গাছের ডালে বেধে দেওয়া হয়েছে স্তনভারাক্রান্তা নারীর চেহারা। চারটি বেল খুটির চৌহদ্দি টেনে তাঁকে লাল সুতোর ঘেরা করে বানানো হয়েছে সুতিকাগৃহ – অর্থাৎ যেখানে নারী তাঁর সন্তানের জন্ম দেন বা গর্ভগৃহ। পুজায় লাগে জলপূর্ণ ঘট, যা নারীর গর্ভের প্রতীক। লক্ষ্মীর ঝাঁপিও একই রূপক, যেখানে ধান অর্থাৎ বীজ (বীর্য) স্থাপন করা হয়। ঘটের উপর রাখা হয় সশীষ ডাব –মাতৃগর্ভজাত সন্তানের প্রতীক। সশীষ এই জন্যে যে, গাছ মায়ের সঙ্গে ডাবের সম্পর্ক শীষের মাধ্যমে, যেমন মায়ের সঙ্গে সন্তানের যোগ থাকে নাড়িতে বা প্লাসেন্টায়। শিষ এখানে প্লাসেন্টার প্রতীক। তাঁর উপর থাকে রক্তবস্ত্র, না ঋতুমতী নারীর চিহ্ন। কামাখ্যার দেবীর আশির্বাদ হিসাবে ভক্তদের এই রক্তবস্ত্রই দেওয়া হয়। আর লক্ষ্মীর ঝাঁপির উপর স্থাপন করা হয় উল্টানো কড়ি, যা উর্দ্ধমুখী যোনীর রূপক।
শিবের প্রতীক যেমন লিঙ্গ, দুর্গার প্রতীকও তাই যোনী। সারা পৃথিবীতেই তা ছড়িয়ে আছে। শ্রী শ্রীচণ্ডীতে সেই দেবীর আরাধনা করা হয়েছে এই শব্দে – “ইয়া দেবী সর্বভূতেষু লজ্জারূপেন সংস্থিতা/ নমোস্তসৈ নমোস্তসৈ নমোস্তসৈ নমোঃ নমোহ্।” এরাই পুরুষ ও প্রকৃতি, জন্মের মূল আধার। সন্তান প্রজননের এই কাজ প্রতি ঘরেই হয়, তাই দেবী সব ঘরেই পুজিতা। কিন্তু যে সব ঘরে অষ্টপ্রহর সন্তান প্রজননের প্রক্রিয়া চলে না। অষ্টপ্রহর প্রজননের প্রক্রিয়া চলে শুধুই যৌনকর্মীদের পল্লীতে। তাই সেখানকার মৃত্তিকাকেই সবচেয়ে ‘পবিত্র’ বলে মেনেছেন শাস্ত্রকারেরা। দুর্গার মূর্তি তৈরিতে তাই সেই ঘরের মাটিকেই আবশ্যিক করার বিধান দিয়েছেন।
চন্দ্রশেখর এক অতন্ত গবেষণাধর্মী নিবন্ধ রচনা করেছ তুমি। এ লেখায় ছড়িয়ে রয়েছে ঋদ্ধ হওয়ার প্রভূত রসদ। পড়ার ফাঁকে কুড়িয়ে নিলাম মুগ্ধ ও হৃষ্ট চিত্তে। চমৎকার।- গৌতম সেন।
উত্তরমুছুন