সোনালী মিত্র

মায়াজম
0
    এক চামচ ভর্তৃহরি আধা চামচ গোরক্ষ



জার ব্যাপার হলো -স্কুলে "নরঃ,নরৌ;নরাঃ" পড়া ছেলেটি সংস্কৃতে ফেল করার কারণ হিসাবে  ধার্য করেছে,তার মাথায় পন্ডিতজনিত টিকিটি অনুপস্থিত।সংস্কৃতের খাতা ভর্তি রসগোল্লা- বৃষ্টির দরুন  এই সংস্কৃত ভাষার সৃষ্টকারীদের প্রতি বিড়বিড় করে গালাগালি দিয়ে চলেছে সে।এহেন অবস্থা স্কুলের নিচের ক্লাসের দিকে হলেও আমরা উঁচু ক্লাসে গিয়ে এডিশনাল সাব্জেক্ট হিসেবে নাম্বার তোলার জন্য বেছে নিচ্ছি এই সংস্কৃতকেই। এই ভাষাতেই অনার্স পড়ে ফেলে দিব্য স্কুল মাষ্টারি জুটিয়ে নিচ্ছি। আর মনে মনে সেই সংস্কৃত পন্ডিতদের ধন্যবাদ দিচ্ছি কারণ বর্তমানে সেই শব্দ ভাঙিয়ে খাওয়া পরাটুকু চালিয়ে নেওয়ার জন্য।

আসলে "ভাষা" আমাদের ঘামজল ও আত্মার পরিমিত অথচ বেগবান রূপ।শব্দের বুকে ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি ওঠে।বর্তমানে ক্লাসে অতিবড় কনফিডেন্ট ফাস্টবয়  সব বিষয়ে সম্পূর্ণ নম্বর পেলেও নিজ ভাষা বিষয়েই দেখা যায় বেশ মন্থর তার গতি।কেন হয় এমন!  আমাদের পূর্বজদের (কোন ভাবেই বাঁদর বা হোমোসাপিয়েন্স ভাববেন না) হাত ধরে যে ভাষার বিস্তার অখন্ড ভারত জুড়ে আধুনিকত্বের দ্বার উন্মোচিত করেছিল,বর্তমানে সেই ভাষাতেই পরিক্ষার্থীদের ভাসাভাসি অবস্থা।এই ভাষার কি অপার ক্ষমতা! যে সকল বৈয়াকরণীক শব্দের বুক থেকে শব্দভেদী দৃষ্টি তুলে নিলেন তাদের মধ্যে "ভর্তৃহরি" বিশেষ ভাবে চর্চিত একটি নাম।তবে এই প্রাচীন ধারাটি পরিপুষ্ট হয়েছে যাদের পাণিগ্রহে তারা হলেন,পঞ্চম খ্রিষ্টপূর্বের যাস্ক,চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্ব সময়কাল ধরা যায় পাণিনিকে,দ্বিতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ সময়ে পতঞ্জলির অবদান কাল ধরা হয়ে থাকে।পরবর্তী চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্ব কাল ভর্তৃহরি কাল হিসাবে চিহ্নিত হয়। তবে কবি ভর্তৃহরি বৈয়াকরণীক হিসাবে যতখানি প্রসিদ্ধ ছিলেন তারচেয়েও বেশি রোমাঞ্চিত বিষয় তার কিংবদন্তীর ব্যক্তিগত জীবন চরিতটি।আমরা রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হয়ে ওঠার গল্পটি জানি।রাজা ভর্তৃহরি থেকে কবি ভর্তৃহরি হয়ে ওঠার গল্পটি বাল্মীকি অধ্যায়ের থেকে কম রোমাঞ্চিত নয়।

কবি ভর্তৃহরির জীবনে তার গুরু গোরক্ষনাথের প্রভাব প্রবলভাবে গ্রন্থিত হওয়ার কারণেই জীবনের মধ্যযামে এসে তিনি নাথ ধর্মে (মতান্তরে বৌদ্ধ )দীক্ষিত হয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ-সিং (I-tsদর) এর ভারত ভ্রমণ কাহিনী থেকে জানা যায়,তিনি সম্পূর্ণ ভাবে সংসারের মায়া ত্যাগ করে না উঠতে পারার জন্য সাতবার তিনি সংসার জীবনে ফিরে এসে পুনরায় আশ্রমে ফিরে যান।এই জন্য আশ্রমের বাইরের একটি ঘোড়ার গাড়ি সর্বদা প্রস্তুত থাকতো।এই গুরু গোরক্ষনাথকে অতিক্রম না করে কবি ভর্তৃহরিতে অবগাহন করা খানিকটা অসম্ভব বলেই আমার অন্তত মনে হয়।তাই গোরক্ষনাথ ও নাথ ধর্ম সম্পর্কে খানিকটা বলে নিয়ে ভর্তৃহরি-আলোচনায়  আসা ভালো।

গোরক্ষ কথা
--------------
মুহম্মদ শহীদুল্লাহের "বাংলাভাষার ইতিবৃত্ত" গ্রন্থ থেকে জানা যায়,গোরক্ষনাথের হাত ধরেই নাথ ধর্ম ভারতবর্ষ তথা নেপাল,সিকিম হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তার লাভ করেছিলো।এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি এই নাথ ধর্ম?তৎকালীন সময়ে এই ধর্মের প্রয়োজনীয়তা কেন উপযোগী হয়ে উঠেছিল?

ঐতিহাসিক ব্যক্তি হয়েও গোরক্ষনাথ ভক্তের চোখে কিংবদন্তি পুরুষে পরিণত হয়েছিলেন।  পরে জনসাধারণের চোখে একজন দেব পুরুষে রূপান্তরীত হন। তাঁরই  চেষ্টায় নাথ ধর্মমত দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে এবং বঙ্গদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের নানা প্রদেশে প্রচার লাভ করে। এজন্য পরবর্তীতে  গোরক্ষপন্থীরা তাঁকেই নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করে। এই নাথ ধর্মতন্ত্র হল হঠযোগ,  সহজিয়া, শৈবাচার, ধর্মপূজা প্রভৃতি মতের সমন্বয়ে একযোগে উদ্ভূত একটি সাধনমার্গ। পূর্ব ভারতে এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। অনুমানিক দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে  মৎস্যেন্দ্রনাথ মতান্তরে মীননাথ  নামে একজন বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য ছিলেন এই ধর্মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা।যে সকল ধর্ম, গুরু নির্ভর অবস্থানের উপর দাঁড়িয়ে তাদের মধ্যে নাথ ধর্মমত অন্যতম।এই ধর্মের গুরুদের মধ্যে মৎস্যেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ, চৌরঙ্গীনাথ, জালন্ধরীপাদ প্রমুখ সিদ্ধাচার্য ছিলেন প্রধান। মৎস্যেন্দ্রনাথ চন্দ্রদ্বীপে বাস করতেন,আবার অনেক গবেষক বলেছেন তিনি বংলাদেশের খুলনা জেলায় অবস্থান করতেন এবং পেশায় ছিলেন ধীবর। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার পাঁচটি গ্রন্থ নেপালে পাওয়া যায়। গোরক্ষনা্থই হলেন  নাথ সম্প্রদায়ের অন্তিম প্রধান গুরু। 


কিংবদন্তী ও  জনশ্রুতি অনুসারে , শিবের অঙ্গ থেকে গোরক্ষনাথের জন্ম হয়েছিল বলে শিবলিঙ্গের মাধ্যমে গোরক্ষপূজা হয়ে থাকে।   তাঁর শিষ্য ছিলেন হাড়িপা ও ময়নামতী।ময়নামতীর পুত্র গোপীচন্দ্র ছিলেন হাড়িপার শিষ্য। মৎস্যেন্দ্রনাথ ও গোরক্ষনাথকে কেন্দ্র করে ‘গোরক্ষ-বিজয়’ এবং হাড়িপা-ময়নামতী-গোপীচন্দ্রকে কেন্দ্র করে ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’ বা ‘গোপীচন্দ্রের গান’ নামে লিখিত ও মৌখিক ধারার একাধিক বাংলা কাব্য পাওয়া যায়। ষোল শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ ‘গোরক্ষ-বিজয়’ নামে কাব্য রচনা করেন। এতে নাথগুরুর মাহাত্ম্য ও নাথ ধর্মমতের মহত্ত্ব প্রকাশিত  হয়েছে। নিষ্কাম কায়াসাধনা নাথধর্মের প্রধান সাধন।কায়াসাধনায় শরীর নিরোগ ও অধ্যাত্ম সাধনায় অমরত্ব লাভ সম্ভব বলে নাথধর্মীরা বিশ্বাস করেন। নাথ ধর্মাবলম্বীদের  যুগী নামেও অভিহিত করা হয়।নাথ যোগীদের মাথায় থাকে জটা, সর্বাঙ্গে ছাই-ভস্ম, কানে কড়ি ও কুন্ডল, গলায় সুতা, বাহুতে রুদ্রাক্ষ, হাতে ত্রিশূল, পায়ে নূপুর, কাঁধে ঝুলি । তাদের কুলবৃক্ষ হচ্ছে বকুল এবং প্রধান আহার্য কচুশাক। একসময় তাঁত বোনাই ছিল তাদের পেশা। নাথ সাহিত্য থেকে জানা যায়,নাথযোগীরা তিন দিন দীক্ষা নেন। প্রথম দিন গুরু শিষ্যের চুল কেটে দেন। দ্বিতীয় দিন তার কানে কুন্ডল পরিয়ে দেন। তৃতীয় দীক্ষা হলো উপদেশী। এতে প্রথমে হরপার্বতী,  ব্রহ্মা,  বিষ্ণু ও গণেশের পূজা হয়।পরে গোরক্ষনাথের পূজা এবং শেষে ভাঙ ও মদমাংসের সঙ্গে আকাশভৈরবের পূজা হয়। এসময় সারারাত দীপ জ্বলে এবং নানা অনুষ্ঠান হয়। একে বলা হয় ‘জ্যোৎ-জাগান’।

নাথযুগীরা মৃতদেহ কবর দিয়ে থাকেন, তবে সৎকারের ক্ষেত্রে হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে্ন।কবর দেওয়ার সময় মৃতের পা দুটি  ভাঁজ করে দেওয়া হতো,ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে মাটির নীচে বসিয়ে কবর দেওয়া হতো। তবে বর্তমানে স্থানাভাবে  মৃতদেহ সৎকার করলেও একমুঠো মাটি এরা মৃতের শরীরের উপরে ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন।নাথ সম্প্রদায়ের এই হঠযোগীদের ধ্যানের স্থানকে ‘গোফা’ বলে।এরা সকলেই যে সন্ন্যাস নিতেন তা নয়,গৃহীরাও এই ধর্ম পালন করতে পারতেন সংসারে থেকেও। আচার-অনুষ্ঠান এবং বিবাহের ক্ষেত্রে এরা হিন্দু রীতিরিবাজ  অনুসরণ করতেন।এদের মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল এবং বিবাহবিচ্ছেদের  কোনো রীতি নেই। স্ত্রী বন্ধ্যা কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে স্বামী অন্যত্র বিবাহ করতে পারবেন, অন্যথায় নয়। তাদের মধ্যে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ। 

বগুড়ার যোগীর ভবনের চারটি মন্দিরের মধ্যে একটি গোরক্ষনাথের বলে মনে করা হয়। দিনাজপুরের গোরক্ষকূপে এক চূড়াবিশিষ্ট তিনটি মন্দিরের একটি গোরক্ষনাথের মন্দির; এর অন্ধকার কক্ষে শিবলিঙ্গ ও কালীমূর্তি সংরক্ষিত আছে। দমদমের গোরক্ষ বাসুলীর তিনটি মন্দিরের মধ্যে গোরক্ষনাথের মন্দিরে গোরক্ষ কর্তৃক প্রজ্বলিত ধুনি আজও সংরক্ষিত আছে। ধর্মভীরু ভক্তের চোখে ঐতিহাসিক গোরক্ষনাথ এভাবে পৌরাণিক গোরক্ষনাথে পরিণত হয়েছেন।প্রাচীন ও মধ্য যুগে গোরক্ষনাথ যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, বাংলাদেশের ও ভারতের নানা স্থানে অসংখ্য মঠ ও মন্দিরের অস্তিত্ব থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোরক্ষ-বিজয় কাব্যে তাঁর বিজয় অর্থাৎ চারিত্র্যিক মাহাত্ম্যের কথা প্রচার করা হয়েছে। বাংলা কাব্য ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় গোরক্ষ-সংহিতা ও গোরক্ষ-সিদ্ধান্ত নামে দুখানি গ্রন্থ আছে।

গোরক্ষনাথের মঠ-মন্দির ও পূজারী মোহন্ত-যোগীর অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান। বাংলাদেশে রাজশাহীর যোগীর ঘোপা গোরক্ষনাথের স্থান বলে মনে করা হয়।ভারতের উড়িষ্যা থেকে পাকিস্তানের পেশোয়ার পর্যন্ত নাথযোগীদের আস্তানা ও তীর্থক্ষেত্র বিস্তৃত। গোরক্ষনাথ গোর্খা জাতি তথা সমগ্র নেপালে পূজনীয়। ধর্মনাথী, আইপন্থী, ধ্বজাপন্থী প্রভৃতি ১২টি শাখায় নাথরা বিভক্ত। কলকাতার দমদম অঞ্চলে এবং হুগলির মহানাদে চৈত্র মাসে গাজনের সময় এদের উৎসব হয়। নাথধর্ম ও নাথগুরুদের কাহিনী নিয়ে মধ্যযুগে এক বিশেষ ধারার  বাংলা সাহিত্য রচিত হয়, যা নাথসাহিত্য নামে পরিচিত।
গোরক্ষনাথ নিজেই ধোঁয়াসাবৃত কিংবদন্তীর একটি অধ্যায়।তাকে নিয়ে পরের সংখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। এখন আমাদের আলোচ্য কবি ও রাজা ভর্তৃহরির জীবনে গোরক্ষনাথের প্রভাব কতখানি বিস্তৃত ছিল !এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে প্রবেশ করতে হবে ভর্তৃহরির জীবনে।


রাজা ভর্তৃহরি বনাম কবি ভর্তৃহরি
---------------------------------------------
মহান রাজ্য উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা রাজা ভর্তৃহরির জীবনযাত্রা এবং কিংবদন্তীর ইতিহাস লোকমুখে যুগযুগান্ত ধরে মুখরোচক হয়ে প্রচারিত হয়ে এসেছে।তিনি সংস্কৃত সাহিত্য ধারায়  ছিলেন একজন মহান পন্ডিত তথা কবি। সংস্কৃত সাহিত্যে বিশিষ্ট নীতিকার রূপে প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি।তাঁর রচিত শতকত্রয়(নীতিশতক,শৃঙ্গার শতক,বৈরাগ্যশতক )ভারতীয় জনমানসে বিশেষ রূপে পরিচিত ও প্রভাবিত। জনশ্রুতি অনুসারে,তার জন্মকাল ধরা যায় সন ৫৪৪,যদিও সঠিক সময় নিয়ে বিদ্বানদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।তিনি ছিলেন দ্বিতীয়  চন্দ্রগুপ্ত  বিক্রমাদিত্যের অগ্রজ।

জানা যায় তার পিতার নাম ছিলো চন্দ্রসেন।মতান্তরে গন্ধর্ব সেন(বীরসেন)। সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য রক্ষিত না হওয়ায় সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম কবি ভর্তৃহরির জীবন-চরিতের জন্যেও জনশ্রুতি-নির্ভর হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না। কিংবদন্তী অনুযায়ী- ভর্তৃহরি ছিলেন মালব দেশের অধিবাসী এবং জাতিতে ক্ষত্রিয়। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণকারী ভর্তৃহরির পিতার নাম ছিলো গন্ধর্ব সেন। গন্ধর্ব সেনের দুই স্ত্রী। প্রথমা স্ত্রীর পুত্র ভর্তৃহরি এবং দ্বিতীয়া স্ত্রীর পুত্র বিক্রমাদিত্য- যার নামে ‘সম্বৎ’ সন বা ‘বিক্রমাব্দ’ প্রচলিত হয়। উল্লেখ্য, বিক্রম সম্বৎ গণনা শুরু হয় ৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে।বিক্রমাদিত্যের মা ছিলেন মালব দেশের তৎকালীন রাজধানী ধারা নগরের রাজকন্যা। ধারারাজের কোন পুত্র সন্তান না-থাকায় উভয় দৌহিত্র অর্থাৎ ভর্তৃহরি ও বিক্রমাদিত্যকে তিনি তুল্যস্নেহে পরিপালন করেন এবং যথাসময়ে সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী করে তোলেন।স্বাভাবিক স্নেহবশতই ধারাপতি একসময় আপন দৌহিত্র বিক্রমাদিত্যকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করার অভিলাষ করেন এবং বিক্রমাদিত্যকে তাঁর সংকল্পের কথা জানান। জ্যেষ্ঠ বর্তমানে তিনি সিংহাসনে বসতে অনিহা প্রকাশ করায় তাঁর যুক্তি ও ঔদার্যে মুগ্ধ হয়ে ধারাপতি ভর্তৃহরিকেই সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন অনুজ বিক্রমাদিত্য। এর কিছুকাল পরে তাঁরা মালবের রাজধানী ধারানগর থেকে উজ্জৈন-এ স্থানান্তর করেন।




গল্পমালা 
-----------
ঐশ্বর্য,প্রাচুর্যে তৎকালীন উন্নত রাজ্য উজ্জয়িনী সেদিন সেজে উঠেছে আনন্দধারায়।আতসবাজীর ছটা মণিমুক্তয় কলকল নদী হয়ে বয়ে চলেছে প্রজাদের মন্দময় ভালো থাকা।রাজা অবশ্য তাতে বিচলিত নন মোটেই।সুরা আর সুরাইয়া নিয়ে লাস্য তান্ডবে মত্ত পুরুষসিংহের ন্যায় নিনাদে কম্পিত রাজ্যস্থল। অবশ্য আশার কথা রাজা ভর্তৃহরির ছোট ভাই বিক্রমাদিত্য,তিনি প্রজাহিত রক্ষার্থে ভূমিকা ত্রাতার্।সেদিন সানাইয়ের সুরে মিশে যাওয়া মদিরার নেশা। হাতীর দাঁতের সুচারু কারুকার্যখচিত মহলের দেওয়ালে চাঁদের ছটা পিছলে পড়ছে এসে সদ্য বিবাহিতা ছোট রানী পিঙ্গলার নবযৌবনে।অসম রাজ্যের অন্তর্গত  কামরূপের রাজকন্যা এই পিঙ্গলা।রূপযৌবনে অসামান্যা এই নারী।চৌষট্টীকলা শৃঙ্গারে সিদ্ধা তিনি,তার প্রমাণ রাজা ভর্তৃহরি পেয়েছিলেন প্রথম সঙ্গম রাতেই।পুরুষকে উত্ত্যক্ত ও কামাঘাতের মধ্যে দিয়ে কিভাবে সন্তুষ্টি দেওয়া যায়,সে পিঙ্গলার নখাগত ছিলো বলা চলে। সুরামোহে লিপ্ত রাজাও পিঙ্গলার কোমল তনের প্রেমে পড়েছিলেন।তবে বিধি বাম। রাজার অতিরিক্ত নারী প্রীতি রানী পিঙ্গলাকে করে তুলেছিলো প্রেমবিরোধী। একজন নারীর নিজের শরীরের উপর সম্পূর্ণ নিজের অধিকার রয়েছে।সেই অধিকার কয়েমের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা একা নারী পিঙ্গলা;যাকে ইতিহাস প্রতারক রানী হিসেবে লিখে রাখলো শতাব্দী থেকে শতাব্দী।রাজা ভর্তৃহরি তার সভার প্রধান গণিকা লাবণ্যের মধু আহরণে মত্ত ভ্রমর্।অন্যদিকে দাসী কৌশল্যার গর্ভেও প্রতিপালিত হচ্ছে রাজারই সন্তান।উজ্জয়িনীতে ঘরে ঘরে নারীরা শরীরে বহন করে চলেছেন রাজার ভোগের চিহ্ন।রাজসভার ঘোড়া পলক সুরথের উপর দেহরক্ষীর দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিলো  ছোট রানী পিঙ্গলার্। সুপুরুষ সুরথ। রানী পাঙ্গলা,দাস সুরথের পৌরষত্বকে উপভোগ করতেন ইচ্ছেমতো।কেন করবেন না! পুরুষ যদি তার নিজইচ্ছাকে সবাগ্রে রাখতে পারেন একজন নারীরও অধিকার আছে নিজেকে ইচ্ছে মতো পরিচালনার।নয় কি!

কিংবদন্তী থেকে জানা যায় গুরু গোরক্ষনাথ তার শিষ্যের এই অধপতন দেখে বড়ই দুঃখিত হন এবং এর থেকে মুক্তি দিতেই একটি দৈব আম্রফল রাজাকে দান করেন। আবার মতান্তরে, একদিন জনৈক ব্রাহ্মণ পুত্রলাভের আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে প্রসন্ন চিত্তে রাজা ভর্তৃহরিকে একটি দৈব ফল দান করেন- যে ফল ভক্ষণে আয়ু বৃদ্ধি পাবে এবং অনন্ত যৌবনের প্রাপ্তি ঘটবে। রাজা এই চমৎকারী ফলটি নিজে না খেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী পিঙ্গলাকে দিলেন।পিঙ্গলা আবার সেই ফল ঘোড়াপালক প্রেমিক সুরথকে প্রদান করলেন।  সেই প্রেমিক আবার পতিতা লাবণ্যের প্রণয়াসক্ত ছিলো, তাই ফলটি সে ওই পতিতাকে দিলো। সেই পতিতা আবার রাজা ভর্তৃহরির শুভচিন্তক ছিলেন। ‘এই ফল ভক্ষণে রাজা দীর্ঘায়ু হলে রাজ্যের লাভ’- এরকম চিন্তা করে সে তাই ফলটি রাজাকেই দিয়ে দিলো। স্ত্রীকে দেয়া ফলটি পুনরায় পতিতার হাত থেকে ফিরে পেয়ে ভর্তৃহরি যারপরনাই বিস্মিত হলেন। স্ত্রী পিঙ্গলাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। এতে ভর্তৃহরি হৃদয়ে মর্মান্তিক বেদনা বোধ করলেন। প্রাণাধিক প্রিয়তমা স্ত্রীর এরূপ বিশ্বাসঘাতকতায় মর্মাহত ভর্তৃহরি ভাবলেন-

যাং চিন্তয়ামি সততং মরি সা বিরক্তা
সাপ্যন্যমিচ্ছতি জনং স জনোন্যসক্তঃ।
অস্মৎকৃতে চ পরিশুষ্যতি কাচিন্যা
ধিক্ তাং চ তং চ মদনং চ ইমাং চ মাং চ।। ০২।। (ভর্তৃহরি নীতিশতক)

অর্থাৎ : আমি যার ভজনা করি সে আমার প্রতি বিরক্ত, অন্য পুরুষ তার মনের মানুষ। সেই পুরুষ আবার অন্য (বারবণিতা) নারীর প্রতি অনুরক্ত। আমাকে পেয়েও আনন্দ পায় সেই অন্য নারী। ধিক্ সেই নারীকে, ধিক সেই পুরুষকে, ধিক সেই বারবণিতাকে, ধিক কামদেবকে যার প্রভাবে এসব সংঘটিত হচ্ছে, এবং ধিক আমাকেও।
ভর্তৃহরি স্ত্রীকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। রানী নিজের কলঙ্কিত জীবনের ভার বইতে না পেরে আত্মহত্যা করে নিষ্কৃতি লাভ করেন। স্ত্রীর এই আত্মহত্যার ঘটনায় ভর্তৃহরির হৃদয় পুনরায় আহত হয়।ভাই বিক্রমাদিত্য বারংবার অগ্রজকে সাবধান করার চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু সেসময় রাজা প্রেমমত্ত হয়ে পিঙ্গলার প্ররোচনায় ভাইকে রাজ্য থেকে বহিস্কার করেছিলেন। ভর্তৃহরির এই দুঃসময়ে সত্যিকারের পতিভক্তি ও প্রগাঢ় বিশ্বাসের আধার হয়ে এগিয়ে আসেন তাঁর প্রথম স্ত্রী অনঙ্গসেনা। তার অবিরাম সেবাযত্নে ভর্তৃহরি ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং আবার যেন নতুন জীবনে পদার্পণ করে পরম সুখে কাটতে থাকে তাঁর দাম্পত্য জীবন।আবারও বিধি বাম ! এ সময়ে ঘটে তাঁর দ্বিতীয় মর্মান্তিক ঘটনা, যার কারণে তিনি সংসার-বিবাগী হয়ে যান এবং রচনা করেন ‘বৈরাগ্যশতক’।  জনশ্রুতি অনুযায়ী ঘটনাটি হলো এই রকম-

ভর্তৃহরি একদিন শিকার সন্ধানে বনে যান। সেখানে গিয়ে তিনি সাংঘাতিক এক দৃশ্য দেখতে পান। দেখেন- জনৈক ব্যাধ তার বাণ দ্বারা একটি হরিণকে বধ করেন। সে নিজেও সেখানেই সর্পাঘাতে মৃত্যুবরণ করে। তিনি আশ্চর্য বিস্ময়ে দেখলেন; কিছুক্ষণ পর হরিণীটি এসে মৃত হরিণটির মৃত শরীরের  উপর পতিত হয়ে প্রাণত্যাগ করে। শুধু তাই ই নয়, আরও কিছুক্ষণ পরে দেখা গেলো;ওই শিকারীর স্ত্রী এসে চিতাগ্নিতে স্বামীসহ ভস্মীভূত হয়ে যায়। এই দৃশ্য ভর্তৃহরির হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে এবং তিনি বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। মৃগয়া পরিত্যাগ করে তিনি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং রাণীকে অরণ্যের সেই বিস্ময়কর ঘটনা সবিস্তারে শোনান। রাণী অনঙ্গসেনা সমস্ত ঘটনা শুনে বলেন- পতির বিরহে সতী নারী আত্মাহুতি দেবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, বরং প্রকৃত সতী যে ,এরূপ আত্মাহুতিতে তার আগুনেরও নিষ্প্রয়োজন।


রানীর এ কথায় রাজা প্রকৃতই বিস্মিত হন।  তাঁর মনে এই  বিষয়ে ঘোর সন্দেহেরও সৃষ্টি হয়। তাই তিনি সঙ্কল্প করেন- রানীর পতিভক্তির পরীক্ষা নেবেন।পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজা কয়েকদিন পরে পুনরায় মৃগয়ায় বের হলেন। মৃগয়ায় গিয়ে নিজের পোশাক-পরিচ্ছদে রক্ত মাখিয়ে স্বীয় অনুচর দ্বারা রাজধানীতে রাণীর কাছে পাঠিয়ে দেন। অনুচর রাণীকে রাজার রক্তাপ্লুত পোশাক অর্পণ করে নিবেদন করে যে- বাঘের হাতে রাজার মৃত্যু হয়েছে, এই তাঁর রক্তাক্ত পরিচ্ছদ। সরলপ্রাণা রানী আকস্মিক এ মর্মান্তিক সংবাদে প্রথমে স্তব্ধ হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর শান্তভাবে রাজার রক্তমাখা পরিচ্ছদ হাতে নিয়ে সেগুলি মাটিতে রেখে অন্তিম প্রণতি জানান এবং ভূমিতে শায়িত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।রাজধানীতে ফিরে এসে ভর্তৃহরি এই হৃদয় বিদারক ঘটনা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। আপন দোষে তিনি রানীকে হারিয়েছেন,নিজেকে দোষী ভেবে তাঁর ব্যথা আরও বেশি করে অনুভূত হতে লাগলো। এবং বারবার নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন। দু দু’বার প্রিয়তমা স্ত্রীদের দ্বারা এভাবে মর্মাহত হয়ে সংসারের প্রতি ভর্তৃহরির মোহ কেটে যায়।


 বিতর্ক পথ ছাড়ে না
---------------------------
রাজা ভর্তৃহরির দুই রানীর চরিত্র নিয়ে ধোঁয়াসা রয়েছে,"অর্বাচীন কোষ" অনুসারে প্রথমা স্ত্রীর নাম অনঙ্গসেনা যিনি প্রতারণা করেছিলেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী হলেন দেবী পিঙ্গলা,যিনি পতিভক্তির নিদর্শন হিসাবে নিজের প্রাণ ত্যাগ করেন ।অন্য তথ্য "কামসূত্র " মতে প্রথম স্ত্রী অনঙ্গসেনা,যিনি পতিভক্তিতে প্রাণ ত্যাগ করেন এবং দ্বিতীয় জন পিঙ্গলা,যিনি প্রতারণা করেন এবং শেষে নিজে আত্মহত্যা করেছিলেন।স্ত্রীদের মতো তার পিতা -মাতার পরিচয় নিয়েও নানা  মতভেদ রয়েছে। ভর্তৃহরির পিতা ছিলেন একজন গন্ধর্ব। তাঁর নাম বীরসেন। বীরসেনের স্ত্রী অর্থাৎ ভর্তৃহরির মা সুশীলা ছিলেন জম্বুদ্বীপরাজের একমাত্র কন্যা। ভর্তৃহরিরা ছিলেন চার ভাই-বোন, যথাক্রমে- ভর্তৃহরি, বিক্রমাদিত্য, সুভতবীর্য এবং ময়নাবতী। ধারণা করা হয় এই ময়নাবতীই ছিলেন বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজা গোপিচন্দের জননী। ভর্তৃহরির মাতামহ জম্বুদ্বীপরাজের কোন পুত্র সন্তান না থাকায় জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র ভর্তৃহরিকে তিনি তাঁর রাজ্য দান করেন। ভর্তৃহরি তাঁর রাজধানী জম্বুদ্বীপ হতে উজ্জয়িনীতে স্থানান্তরিত করেন। বিক্রমাদিত্যকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন এবং সুভতবীর্যকে তাঁর প্রধান সেনাপতি করেন।
পণ্ডিত শশগিরি শাস্ত্রী প্রবর্তিত অন্য এক প্রচলিত মতানুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত নামে জনৈক ব্রাহ্মণের চারবর্ণের চারজন স্ত্রী ছিলেন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে- ব্রাহ্মণ জাতীয়া ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়া ভানুমতী, বৈশ্যা ভাগ্যবতী এবং শূদ্রা সিন্ধুমতী। এই চার স্ত্রীর গর্ভে চন্দ্রগুপ্তের চারজন পুত্র জন্মে, যথাক্রমে- বররুচি, বিক্রমার্ক, ভট্টি ও ভর্তৃহরি। বিক্রমার্ক রাজা হন এবং ভট্টি (মতান্তরে ভট্টি ও ভর্তৃহরি) তাঁর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে নিযুক্ত হন।
উপরোক্ত এই তিন ধরনের পরস্পর-সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যময় তথ্যপুঞ্জি থেকে এখন পর্যন্ত কোন্ তথ্যটি সঠিক তা নির্ধারণ করা দুরুহ হলেও সাদৃশ্যটুকু থেকে আমরা অন্তত এটুকু ধারণা করতে পারি যে- ভর্তৃহরি হয়তো মাতামহের রাজ্য পেয়ে একজন রাজা বা রাজপুরুষ ছিলেন।

স্বয়ং ভর্তৃহরি ই ধোঁয়াসা
---------------------------------
স্বয়ং ভরতৃহরিকে নিয়েই এক তুমুল বিতর্ক রয়েছে। চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ-সিং (I-tsing) ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণে আসেন। জানা যায়, তিনি তাঁর বিবরণীতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে গেছেন যে, তাঁর আগমনের ৪০ বৎসর পূর্বে (৬৫১ খ্রিঃ) বৈয়াকরণ ভর্তৃহরি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি  ছিলেন একজন বৌদ্ধ । ‘বাক্যপদীয়’ নামক গ্রন্থটি তাঁরই রচিত।সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে ‘ভট্টি’ ও ‘ভর্তৃহরি’ নামে তিনজন ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায় এবং এই তিনজনই কবি। ভট্টির রচনা ‘ভট্টকাব্য’ বা ‘রাবণবধ’ একটি মহাকাব্য। প্রথম ভর্তৃহরির রচনা ‘শতকত্রয়’-  নীতিশতক ,শৃঙ্গারশতক এবং বৈরাগ্যশতক।  আর দ্বিতীয় ভর্তৃহরির রচনা হলো পতঞ্জলির মহাভাষ্যের উপর ব্যাকরণদর্শন জাতীয় গ্রন্থ ‘বাক্যপদীয়’। এ তিনজনই একই ব্যক্তি না কি পৃথক তিনজন কবি ছিলেন,তা নিয়ে পণ্ডিত-গবেষকদের মধ্য বিতর্ক রয়েছে।কেউ বলেন এঁরা তিনজন পৃথক ব্যক্তি ((-M.R.Kale), কেউ বলেন এঁরা তিনজন একই ব্যক্তি (-A.A.Mackonell ও ড. রামেশ্বর শ’)। আবার কারো মতে ভট্টি এবং শতকরচয়িতা ভর্তৃহরি এক এবং বাক্যপাদীয়কার ভর্তৃহরি ভিন্ন ব্যক্তি (ড. বিধানচন্দ্র ভট্টাচার্য)। এই  মতের বিরোধিতা করে আবার কেউ কেউ বলেন- ভট্টি এবং শতককার ভর্তৃহরি এক নন (-S.N.Dasgupta, S.K.De, Krishna Chitanya, জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী এবং জাহ্নবীচরণ ভৌমিক)। শতককার ভর্তৃহরি এবং বাক্যপদীয়কার ভর্তৃহরি একই ব্যক্তি বলেও মতামত প্রকাশ করেন কেউ কেউ (জাহ্নবীচরণ ভৌমিক, সুবুদ্ধিচরণ গোস্বামী এবং Krishna Chitanya)। আবার দুই ভর্তৃহরি এক- এই মতকেও স্বীকার করেন নি কেউ কেউ- (Prof,K.B.Pathak Ges K.T.Telang)। এভাবে বর্তমান সময় পর্যন্ত আরও অনেক গবেষকই এ বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ভট্টির মহাকাব্যের ( রাবণবধ) ঘটনা রামায়ণাশ্রয়ী এবং তার নায়ক স্বয়ং রাম- হিন্দু ধর্মের একজন আদর্শ পুরুষ। রাম হিন্দুদের কাছে বিষ্ণুর অবতার বলেই খ্যাত। তাছাড়া ভট্টির কাব্য-রচনার পেছনে প্রচলিত কিংবদন্তী থেকেও বোধা যায় যে তিনি একজন বেদজ্ঞ হিন্দু ছিলেন। অন্যদিকে বৌদ্ধরা বেদবিরোধী নাস্তিক।অতএব বলা যায় ভট্টি বা শতককার ভর্তৃহরি কেউ-ই বৌদ্ধ ছিলেন না। তাঁদের রচনায় এমন কথা বা প্রামাণ্য তথ্য নেই যার দ্বারা এটা অনুমিত হতে পারে যে, এই গ্রন্থের রচয়িতারা বৌদ্ধ । শতককার ভর্তৃহরি যে একজন হিন্দু ছিলেন এর বড় প্রমাণ হল তাঁর শতকত্রয়। নীতিশতকের শুরুতেই তিনি ব্রহ্মকে নমস্কার জানিয়েছেন ‘নম শান্তায় তেজসে’ বলে-

দিক্কালাদ্যনবচ্ছিন্নানন্তচিন্মাত্রমূর্তয়ে।
স্বানুভূত্যেকমানায় নমঃ শান্তায় তেজসে।। ০১।। (ভর্তৃহরির নীতিশতক)

অর্থাৎ : দিক-কালাদি দ্বারা যাঁর পরিমাপ করা যায় না, যিনি অনন্ত; জ্ঞাময় যাঁর আকৃতি (শরীর) (এবং) আপন উপলব্ধি-ই যাঁর একমাত্র প্রমাণ (অর্থাৎ আপন উপলব্ধি-ই যাঁকে জানার একমাত্র উপায়) (সেই) শমগুণবিশিষ্ট জ্যোতির্ময় (ব্রহ্ম)-কে নমস্কার।

ভর্তৃহরির কাব্য প্রসিদ্ধতা
----------------------------------

মনে করা হয়,নীতিশতক ,শৃঙ্গারশতক এবং বৈরাগ্যশতক- এই শতক কবিশ্রেষ্ঠ ভর্তৃহরির মূল্যবান রচনাসমগ্র।তবে বিতর্কর সৃষ্টি হয় এইখানেই যে এই গ্রন্থের কোথাও তার নামটা উল্লেখ করা নেই। কয়েকজন বিদ্বানের মতে, ভর্তৃহরি শতকত্রয়ের রচয়িতা নন, সঙ্কলয়িতা মাত্র। তিনি অন্য কবিদের রচনা এবং জনমুখে প্রচলিত শ্লোকসমূহ বিষয়বস্তু অনুসারে তিনটি শিরোনামে বিন্যাস করেছেন বলে তাঁদের অভিমত। (Dr.Bohlen Ges Abraham Roger)।

এছাড়া শতকত্রয় ব্যতীত ভর্তৃহরির নামের সঙ্গে আরও কয়েকটি গ্রন্থের নাম যুক্ত করেছেন কেউ কেউ তাঁদের গ্রন্থে। সেগুলো হচ্ছে- ভট্টিকাব্য (বা রাবণবধ), বাক্যপদীয়, মহাভাষ্যদীপিকা, মীমাংসাভাষ্য, বেদান্তসূত্রবৃত্তি, শব্দধাতুসমীক্ষা ও ভাগবৃত্তি। তবে শতকত্রয় ভর্তৃহরির মৌলিক রচনা কি-না, এ সম্পর্কে তিনটি মত প্রচলিত আছে বলে জানা যায়। প্রথম মত হলো- শতকত্রয় ভর্তৃহরির মৌলিক রচনা নয়, সঙ্কলিত। দ্বিতীয় মত হলো- অন্য কোন কবি বা কবিরা শতকত্রয় রচনা করে ভর্তৃহরির নামে উৎসর্গ করেছেন। এবং তৃতীয় মত- শতকত্রয় ভর্তৃহরির নিজের রচনা।প্রথম মতের প্রবক্তাদের যুক্তি হলো- শতকত্রয়ের শ্লোকগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যসূত্র নেই এবং বিভিন্ন কবিদের রচিত শ্লোক এতে দেখা যায়। ত্রয়শতকের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যসূত্র না থাকলেও, প্রতিটি  শ্লোকসমূহের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত ভাব-সঙ্গতি বা বক্তব্যের ঐক্য পরিলক্ষিত হয়।সংস্কৃত কাব্যের নিয়মে শতককাব্যের শ্রেণীই হচ্ছে ‘মুক্তক’. যার বৈশিষ্ট্যই হলো প্রতিটি শ্লোক হবে পরস্পর অর্থনিরপেক্ষ। এতে কোন কাহিনী থাকবে না, থাকবে না ঘটনার ঐক্য। তাই একটির সঙ্গে অন্যটির ঐক্যসূত্র নেই বলেই যে শতকত্রয় মৌলিক রচনা না হয়ে সঙ্কলিত গ্রন্থ হবে- এ অনুমানের বাস্তব ভিত্তি নেই  মনে করা হয়। প্রতিটি শতকের শ্লোকগুলিকে তাই ভাব বা বক্তব্য ভিত্তিতে দশ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।সেগুলি হল-অজ্ঞনিন্দা , বিদ্বৎপদ্ধতি, মানশোর্যপদ্ধতি, অর্থপদ্ধতি, দুর্জনপদ্ধতি, সুজনপদ্ধতি, পরোপকারপদ্ধতি, ধৈর্যপদ্ধতি, দৈবপদ্ধতি ও কর্মপদ্ধতি। শতকত্রয়ের শ্লোকগুলো যে ঐক্যসমৃদ্ধ একথা অনস্বীকার্য।  তবে শতকত্রয়ের মধ্যে অন্য কবিদের রচিত শ্লোক যে পাওয়া যায় তা অনস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন- কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলে’র (পঞ্চম অঙ্ক-১২) শ্লোকটি দেখা যায় নীতিশতকের এই শ্লোকে-

ভবন্তি নম্রাস্তরবঃ ফলোদ্গমৈ-
র্নবাম্বুভির্ভূরিবিলম্বিনো ঘনাঃ।
অনুদ্ধতাঃ সৎপুরুষাঃ সমৃদ্ধিভিঃ
স্বভাব এবৈষ পরোপকারিণাম্ ।। ৭০।। (ভর্তৃহরির নীতিশতক)

অর্থাৎ : ফলাগমে বৃক্ষসকল অবনত হয়, মেঘসকল নবজলভারে বিলম্বিত (নিম্নগামী হয় এবং) সজ্জনেরা সম্পত্তি (ঐশ্বর্য) লাভে বিনীত (হন)। পরোপকারীদের এটাই স্বভাব।
বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকের (দ্বিতীয় অঙ্ক-১৭) শ্লোকটি পাওয়া যায় নীতিশতকের এই শ্লোকে-
প্রারভ্যতে ন খলু বিঘ্নভয়েন নীচৈঃ
প্রারভ্য বিঘ্নবিহতা বিরমন্তি মধ্যাঃ।
বিঘ্নৈঃ পুনঃ পুনরপি প্রতিহন্যমানাঃ
প্রারব্ধমুত্তমজনা ন পরিত্যজন্তি।। ২৭।। (ভর্তৃহরির নীতিশতক)

অর্থাৎ : অধমেরা (দুর্বলচিত্তেরা) বিঘ্নভয়ে (কোন কাজ) আরম্ভ করে না, মধ্যমেরা (সাধারণ জন) আরম্ভ করে(-ও) বাধাগ্রস্ত (হয়ে তা থেকে) বিরত থাকে, (কিন্তু) উত্তমেরা (সাহসীরা) বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েও আরম্ভকৃত (কাজ) কখনও পরিত্যাগ করেন না।

জানা যায়, M.R.Kale  সম্পাদিত নীতিশতক ও বৈরাগ্যশতকে মূল শ্লোক সংখ্যা যথাক্রমে ১০৮ ও ১০১টি। এ ছাড়াও দুটি শতকে অতিরিক্ত শ্লোক সংখ্যা যথাক্রমে ২৫ ও ৪৪টি। এই অতিরিক্ত শ্লোকসমূহেরই কোন কোনটি আবার শতকদ্বয়ের অপর সংস্করণে মূল শ্লোকসমূহের অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়।তাই ভাবা হয়,পরবর্তীকালে লিপিকরদের হাতে পড়ে শ্লোকগুলির যথেষ্ট কাঁটাছেঁড়া হয়েছে তা আর বলার বাহুল্য রাখে না। প্রমাণ  হিসাবে দেখানো যায়, শতককাব্যের নামের সার্থকতা বিচার করতে গেলে শতকত্রয়ের প্রত্যেকটিতে একশ্টি  করে মোট তিনশটি শ্লোক থাকা উচিৎ ছিলো।কিন্তু সেখানে আছে চারশোর কাছাকাছি শ্লোক। তাই কোনটা যে ভর্তৃহরির আর কোনটা লিপিকারদের সংযুক্ত তা নিরূপণ অসম্ভব বলেই মনে করা হয়। সংস্কৃত সাহিত্যসম্ভার এ শৃঙ্গারশতকে শ্লোক সংখ্যা একশটি। এ হিসেবে তিনটি শতকে মোট শ্লোক সংখ্যা দাঁড়ায় তিনশটি,কিন্তু পাওয়া যায় ৩৭৮টি।

এবার কবি ভর্তৃহরির শতকত্রয়ের স্বল্প আলোচনা করে লেখাটি সমাপ্ত করবো।


১ নীতিশতক
------------------
সংস্কৃত শতককাব্যের জগতে  ভর্তৃহরির শতকত্রয় সর্বোচ্চ আসন দখল করে আছে বলে রসগ্রাহী পাঠকরা মনে করেন। নীতিশতকে তারই মধ্যে দেখা যায় নীতিবোধের জাগরণ, নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা। সমাজ এবং  মানবজীবনের যথাযথ বিষয়ের যথার্থ চিত্রণ পাওয়া যায় তার রচনায়। ভাব, ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কারের উপর দক্ষতা আসলেই প্রসংশনীয়।ভর্তৃহরির সাবলীল রচনাশৈলী তার লেখাকে মনোগ্রাহী সুখপাঠ্য  করে তুলেছে পাঠকের দরবারে। তাঁর কাব্য সহজবোধ্য  এবং শ্লোকগুলিতেও দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদ খুবই অল্প দেখা যায়। এই কারণেই তার ভাষা সহজ-সরল ও সর্বজনবোধ্য । অর্থের দিক থেকে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ায় ভর্তৃহরির শতকত্রয় বিশেষ করে নীতিশতক অনুপম রচনা হয়ে উঠছে।
নীতিশতকের শুরুতেই তিনি বলেন-

‘যাকে (যার কথা) নিরন্তর চিন্তা করেছি (অর্থাৎ যাকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবেসেছি) সে (সেই প্রিয়তমা পত্নী) আমার প্রতি নিরাসক্ত, সে ভালোবাসে (বা কামনা করে) অন্য পুরুষকে; সেই পুরুষ (আবার) অন্যাসক্ত (অর্থাৎ অন্য স্ত্রীলোকে আসক্ত); আবার আমার কারণেও অনুশোচনা করে (অর্থাৎ দুঃখ পায় বা ধ্বংস হচ্ছে) (সে) অন্য কোনও এক স্ত্রীলোক। (তাই) ধিক্ সেই (পরপুরুষগামিনী) স্ত্রীলোককে, ধিক্ সেই পুরুষকে (যে একাধিক স্ত্রীজনে আসক্ত), ধিক্ এই (বারবণিতা) স্ত্রীলোককে এবং ধিক্ আমাকেও, (সর্বোপরি) ধিক্ সেই মদনকে (যার প্রভাবে এসব সংঘটিত হচ্ছে)’ ।। ০২।। (ভর্তৃহরি নীতিশতক)

কবির নীতিশতক শুধুই নীতির প্রচার করেছেন।রয়েছে নিজের মূর্খতা, অজ্ঞতা ও স্থূল বুদ্ধিবৃত্তির হীন পরিণাম। এসব হতে লোকে যাতে দূরে থাকে এবং আত্মমর্যাদা রক্ষা করে সবার শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে সংসারে টিকে থাকতে পারে, সেসব উপদেশ-নির্দেশনা তিনি দিয়ে গেছেন তাঁর নীতিশতকে। নিজ জীবনে দিয়ে যা অনুভব করেছেন,সেই শিক্ষাই যেন ছড়িয়ে রয়েছে তার এই নীতিশতকে।নিজ জীবন দিয়ে তিনি অপরের জীবন চলার পথ মসৃণ করতে চেয়েছেন তিনি।তাঁর এই শতকে তিনি বলে গিয়েছেন  সংসারে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য মানুষের করণীয় কী হবে তা সম্পর্কে  -

দাক্ষিণ্যং স্বজনে দয়া পরজনে শাঠ্যং সদা দুর্জনে
প্রীতিঃ সাধুজনে নয়ো নৃপজনে বিদ্বজ্জনেপ্যার্জবম্ ।
শৌর্যং শত্রুজনে ক্ষমা গুরুজনে নারীজনে ধূর্ততা
যে চৈবং পুরুষাঃ কলাসু কুশলাস্তেষ্যেব লোকস্থিতিঃ।। ২২।। (ভর্তৃহরির নীতিশতক)

অর্থাৎ : আত্মজনের প্রতি ঔদার্য, ভৃত্যজনের প্রতি দয়া; শঠের প্রতি সদা শাঠ্য, সজ্জনের প্রতি প্রেম; রাজজনের (রাজপুরুষদের) প্রতি নীতি, পণ্ডিতজনের প্রতি সারল্য; শত্রুদের প্রতি বীরত্ব (শৌর্য), পূজনীয়দের প্রতি সহিষ্ণুতা; নারীজনের প্রতি ছলনা (শঠতা) ইত্যাদি কলাবিদ্যায় যে-সকল পুরুষ পারদর্শী তাদের উপরই সংসারের স্থৈর্য (বা স্থিতিশীলতা নির্ভর করে, অর্থাৎ এই জগৎসংসারে তারাই সুখে বসবাস করতে পারে)।


২শৃঙ্গারশতক
-------------------

নীতি শতকের ভর্তৃহরির সাথে শৃঙ্গারশতকের ভর্তৃহরির আসমান-জমিন মানসিকতার ফারাক লক্ষ্য করা যায়।শৃঙ্গারশতকে সম্ভোগক্রিয়ার চমৎকার বিবরণ পরিলক্ষিত হয় । শৃঙ্গারশতকে নারীদের প্রতি কবির নানারূপ ভাব ব্যক্ত হয়েছিলো।শৃঙ্গার সম্পর্কে কবির এই নিখুঁত বর্ণনা যে জীবন-অভিজ্ঞতা ব্যতীত সম্ভব নয়, তা সহজেই অনুমেয়।
শৃঙ্গারশতকে নারী সম্পর্কে কবি ভর্তৃহরি একদিকে যেমন লিখেছেন ঠিক কোন গুণবিশিষ্ট্য নারী যথার্থ পুরুষপ্রেমিকা হয়ে উঠতে পারেন, তেমনই অন্যদিকে শিঙ্গারকলার প্রকৃত শিক্ষাও প্রদান করেছেন। তবে নারীদের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা, অবিশ্বাস ও ঘৃণাও  প্রকাশ পেয়েছে এই রচনায়। যেমন এই শ্লোকটিতে দেখা যায় -

‘সংশয়ের আবর্ত, অবিনয়ের ভুবন, সাহসের নগর, দোষের আকর, শতকপটতার আধার, অবিশ্বাসের ক্ষেত্র, স্বর্গদ্বারের বিঘ্ন, নরকের দ্বার, সমস্ত মায়ার পেটিকা, অমৃতময় বিষ, প্রাণিজগতের বন্ধন এমন স্ত্রীযন্ত্র কে সৃষ্টি করলো ?’।। ৪৫।। (ভর্তৃহরির শৃঙ্গারশতক)


.
৩বৈরাগ্য শতক
------------------
বৈরাগ্যশতক পর্যায়ে দেখা যায়, তিনি বৈরাগ্য অবলম্বন করে সংসার ত্যাগ করেন। এই রচনায় তার মানসিক দোলাচল স্তিমিত হয়ে এসে বৈরাগ্য জীবনের পথ প্রশস্ত করে।এই তিনটি কাব্যের মৌল চেতনার রূপান্তরের মধ্যেই মূলত স্রষ্টা ভর্তৃহরির ক্রমবিবর্তিত মানস পরিভ্রমণের স্বাক্ষরই সমুজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে।বৈরাগ্যশতকে কবির যে মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে তা থেকে এটাই  বোঝা যায় যে, কবি  সংসারনীতি এবং শৃঙ্গারসুখ অতিক্রম করে এসেছেন এবং কাম ও নীতিজ্ঞান জগতের অসারতা,প্রাণহীনতা, বিশ্বাসহীনতা এবং আনন্দহীনতা তাঁকে পীড়িত করেছে। বৈরাগ্যশতকের কয়েকটি শ্লোকের মধ্যে দিয়ে বিষয়টি জ্ঞাত হয় -

‘ভোগসুখে রোগের ভয়, সদ্বংশে বিপরীত আচরণজনিত দোষে বিচ্যুতির (সম্মান নাশের) ভয়, ধনসম্পদের বৃদ্ধিতে রাজাদের ভয়, অভিমানে দীনতার ভয়, শক্তিতে শত্রুর ভয়, সৌন্দর্যে বার্ধক্যের ভয়, শাস্ত্রজ্ঞানে তার্কিক প্রতিবাদীর ভয়, বিদ্যা-বিনয় প্রভৃতি গুণের বিষয়ে দুষ্ট লোকের অপবাদের ভয়, দেহে মৃত্যুর ভয়- জগতে মানুষের কাছে সমস্ত বস্তুই ভীতিপ্রদ কেবলমাত্র বৈরাগ্যই ভয়শূন্য। (সুতরাং ভয়াবহ ভোগ্য বিষয়সমূহ ত্যাগ করে বৈরাগ্যই আশ্রয় করা উচিত)’।। ৩১।। (-ভর্তৃহরির বৈরাগ্যশতক/ সংস্কৃত সাহিত্যসম্ভার, ১৬শ খণ্ড)।

‘মৃত্যু সমস্ত প্রাণীর জীবন, বার্ধক্য উজ্জ্বল রমণীর যৌবন, ধনলাভের বাসনা সন্তুষ্টিকে, প্রগল্ভা নারীর বিলাস ইন্দ্রিয়-অনাসক্তিজনিত আনন্দকে, অসহিষ্ণু ব্যক্তিরা বিনয় প্রভৃতি গুণকে, দুষ্ট হস্তী এবং সর্প পবিত্র অরণ্যভূমিকে, কুমন্ত্রণাদাতা দুর্জনরা রাজাদের এবং নশ্বরতা ধনসম্পদকে অভিভূত করে- এই সংসারে কোন্ বস্তু অন্য কিছু দ্বারা আক্রান্ত (অভিভূত) হয় না ?’ ।। ৩২।। (-ভর্তৃহরির বৈরাগ্যশতক )


‘হে চিত্ত ! শ্রীশিবশম্ভুর প্রতি ভক্তিপরায়ণ হও, হৃদয়ে জন্মমৃত্যুর ভয় সর্বদা স্মরণ করো, পুত্র-পত্নী-বন্ধুর প্রতি মমতা ত্যাগ করো, কামনাজনিত বিকার অন্তরে স্থান দিয়ো না, সঙ্গদোষ শূন্য হয়ে (কাম-ক্রোধাদি প্রসঙ্গশূন্য হয়ে) নির্জন অরণ্যে বাস এই বৈরাগ্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কী প্রার্থনার যোগ্য বিষয় আছে ?’ ।। ৬৮।।  (-ভর্তৃহরির বৈরাগ্যশতক )



তথ্যসূত্র
চর্যাগীতি পরিক্রমা(নির্মল সেন)
বাংলাভাষার ইতিবৃত্ত(মুহম্মদ শহীদুল্লাহ)
ভর্তৃহরির নীতিশতক(রণদীপম বসু)
গুগুল সার্চ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)