সরোজ দরবার

মায়াজম
0

        বহুরূপে সম্মুখে শক্তিরূপেণ সংস্থিতা





ল্পনা করি সেই দ্বীপটিকে। বড় নির্জন। চারপাশে খেলা করছে বিস্তীর্ণ সমুদ্রের বিপুল জলরাশি। মৃদু গর্জন ছাড়া দ্বিতীয় কোনও শব্দ নেই। দুনিয়ার ভিতর সে এক আলাদা পৃথিবী।চেনা প্রকৃতিও তাই সেখানে যেন অদ্ভুত ঠেকছে।নারীটিও এখানে তাই উতলা হলেন। তাঁর মনে হল, এই সেই ক্ষণ, যখন মুখ ফুটে মনের কথাটি বলে ফেলা ভাল।মনে হল, সমাজ সংসার মিছে সব, যে বাসনাকুসুম তিনি লালন করে চলেছেন, তা এবার পুরুষটিকে নিবেদন করাই শ্রেয়। করলেনও তা। চাইলেন তাঁর গর্ভে সামনের পুরুষটির সন্তান। ঠিক এইখানে আমরা জানতে পারব, এই নারী-পুরুষ হলেন যম ও যমী। কাহিনির পরিণতি অতএব আমাদের জানাই। নারাজ হবেন য়ম। সামাজিক শুদ্ধতার ধুয়ো তুলে, সহোদরা যে অগম্যা সে কথা প্রমাণ করে দেবেন তিনি। আগেও এ কাজ হয়নি, পরেও যাতে না হয়, সেই দৃষ্টান্তই হয়ে থাকবে তাঁর প্রত্যাখ্যান। প্রসঙ্গ অবশ্য যমের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বিচার নয়। ভাবি, সেই তিন সাড়ে তিন হাজার বছর আগের, সেই নারীটির ছক ভাঙার শক্তির কথা। এ কাহিনির অবতারণা সে কারণেই।

এখানেই অবশ্য একটা অভিসন্ধির গন্ধ মেলে গল্পের ভিতর। ব্যাপারটা এমন নয় তো, যে, এক নারীর মুখেই বাসনার কথা বসিয়ে, সে বাসনাকে দলিত করে, সমাজ রক্ষার ধুয়োয় নারীকেই সীমানায় বেঁধে দেওয়া হল! হতেও পারে।এরপর হয়তো নারীমাত্রই জানলেন, বুক ফাটলেও মুখ ফুটে কিছু বলে কোনও লাভ নেই। যদি তা হয়ও, নারীর মুখ ফুটিয়েই যদি নারীকে বাঁধার অভিসন্ধি কোথাও প্রচ্ছন্ন থাকে, তবে স্বীকার তো করে নিতে হয়, এ কথা মুখ ফুটে বলার শক্তি ও সম্ভাবনা মাত্র নারীরই ছিল। গল্পটা ঘুরিয়ে দিয়েও বার্তা একই রাখা হয়তো অসম্ভব ছিল না, কিন্তু এখানে আমাকে বিশেষ টেনে রাখে এই নারীটির ছক ভাঙার শক্তি। শক্তিরূপিণী বললেই যে অসুরদলনীর মূর্তি উজ্জ্বল হয় আমাদের ভাবনায়, এ নারীকে তার থেকে কিছুমাত্র কম শক্তিরূপিণী মনে হয় না আমার। কল্পনা করি, কী অসম্ভব সেই মানসিক জোর নিয়ে, সমাজের চেনা গুটি কেটে বেরতে চাইছেন তিনি এবং নিজের মতের পক্ষে একের পর এক অকাট্য যুক্তি খাড়া। যমকে সামনে রেখে সমাজ অবশ্য তা মান্যতা দেয়নি, তাতে অবশ্য এঁর কৃতিত্ব কিছুমাত্র খাটো হয় না আমার কাছে। বস্তুত শক্তির ধারনায় বিভিন্ন নারীরা নানা সময় অসাধারণ উদাহরণ রেখেছেন। সীতার বনবাসের ভিতর থেকে বিয়োগান্তক সুরটি সরিয়ে রাখলে দেখব, এক নারী কী দৃঢ়তায় নিজের মতে স্থিত আছেন। কৃষ্ণের প্রধান মহিষী কী কৌশলে ও সাহসে নিজের বিবাহ ইচ্ছা তুলে দিয়েছিলেন কৃষ্ণের কানে। অমন প্রতাপশালী শিশুপাল থাকতেও তাঁর ইচ্ছের জয় হল। দ্রৌপদী তো রীতিমতো ভর্ৎসনা করেছেন তাঁর স্বামী-সহ বস্ত্রহরণ পর্বে সভাস্থলে উপস্থিত রাজপুরুষদের। কৃষ্ণকেও কথা শোনাতে ছাড়েননি। নিজের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন শকুন্তলাও। গঙ্গাও তাঁর সিদ্ধান্তের জোর দেখাতে পেরেছেন। এঁদের কথা ছেড়েই দিলাম। কাব্যের সেই নায়িকাকেও কম শক্তিরূপিণী মনে হয় না, যিনি স্বীকার করেন, সেই রাত, চাঁদ, সুগন্ধী হাওয়া সব এক থাকলেও, আগে চুরি করে সঙ্গসুখ পাওয়ার মতো সুখ আর নেই।
এলোমেলো সময়কালের ভিতর থেকে আসলে খুঁজতে চাইছি, সেই নারী শক্তিকে যা পুরুষের আধিপত্যের বিস্তৃত ইতিহাসের ভিতরও থেকে গিয়েছে। মুছে যায়নি। আসলে তা সম্ভব নয় বলেই। দমন, পীড়ন, ভোগ্য, পণ্য ইত্যাদি বহু তত্ত্বের ভিতর সমন্ত্যক হয়ে রয়ে গিয়েছে এই সব শক্তির উদাহরণ। রণরঙ্গীণি মূর্তি যেমন শক্তির অদ্বিতীয় প্রকাশ, তেমনই মনে হয়, আরও বহুভাবে সম্মুখে নারী শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। বলতে চাইছি, চলতি প্রকাশের বাইরে গেলেও আমরা পাব নারীশক্তির অসামান্য প্রকাশ। অর্থাৎ নারীর ক্ষমতায়ন বললেই সাধারণত যে চিহ্নগুলি সামনে উঠে আসে, তার বাইরেও এক বিস্তৃত ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে, যেখানে নারী অসামান্যা শক্তিরূপিণী। আমার কথা খোলসা করতেই সমকালে দাঁড়িয়ে যেমন নিতে পারি, অরুণা মুখোপাধ্যায়ের নাম। কিরণ বেদি, সুষমা স্বরাজ, চন্দা কোচর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ললিতার মতো দেশের বিখ্যাত নারী তিনি নন। কিন্তু অদ্ভুত তাঁর শক্তি। টানা সত্তর বছর হতে চলল, চা বিস্কুট আর মরশুমে কমলালেবু ছাড়া মুখে কিছু তোলেননি। আজ যখন ঠান্ডা সিনেমাহলে পপকর্ন হাতে আমরা দেশভাগের কাহিনি চিবোই, ইনি তখন সে যন্ত্রণা ধারণ করে চলেছেন তাঁর প্রাত্যহিক যাপনে। সাতচল্লিশে দেখেছিলেন, উদ্বাস্তুদের হাহাকার। দেখেছিলেন, খিদের জ্বালা কাকে বলে। তাঁকে অবশ্য সে দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। কিন্তু তাতে কী! সেদিন ঠোঙা তৈরি করে বাড়তি উপার্জন করে উদ্বাস্তুদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে আর প্রয়োজনের তুলনায় কতটুকু। সে ব্যথা কিছুতেই ভুলতে পারেননি। সেদিন থেকেই মুখে আর খাবার তোলেননি বর্তমানে শতায়ু অরুণা। আজ নেতারা যখন দেশ নিয়ে আখের গোছানোর লোফালুফি খেলেন, তখন মনে হয়, এঁর মধ্যেই বেঁচে আছে সেই দেশ, যে দেশ একদিন ভাগ হওয়ার যন্ত্রণায় রক্তাক্ত হয়েছিল। এ ও তো কোনও পুরুষের কাহিনি হতে পারত। কিন্তু হয়নি। এই সেই রহস্যময়ী শক্তি যা যুগে যুগে প্রণম্য হয়ে এসেছে।
এই যখন রাস্তার উপর সিগারেটটা ফেলে দলা পাকালাম আমি, তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিক, তখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন ১০৫ বছরের কুনওয়ার বাঈ। ছত্তিশগড়ের এই বৃদ্ধা নিজের পোষ্য বিক্রি করে বাড়িতে শৌচাগার বানিয়েছেন। শৌচাগার নিয়ে আমাদের যাদের আলাদা করে ভাবতে হয়নি, তাঁরা অন্তত ঠাহর করতে পারি এই মানসিক জোরকে। এবং মানসিকতাকে। স্বচ্ছতার ধারণা এত স্বচ্ছ হলে আমরা তো অহরহ আমাদের প্রতিবেশে নোংরা ছড়াতাম না। প্রশ্ন করি নিজেকে, কুনওয়ার বাঈয়ের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমিও কি একই সিদ্ধান্ত নিতাম? উত্তরে উঠে আসে সেই শক্তি, যা কিরণ- কুনওয়ারে কোনও ফারাক রাখে না।
সিনেমায় অন্তরঙ্গ দৃশ্যে অভিনয়ের ক্ষেত্রে, বিশেষত অভিনেত্রীদের জন্য, সাহসী শব্দটি প্রায়শই ব্যবহার করা হয়। কারণটি সহজেই অনুমেয়। যৌনতা সম্পর্কিত দীর্ঘলালিত ধারনার শেকড়বাকড় রয়ে আছে এই প্রয়োগের মূলে। ঘটনা হল, যে সময় থেকে নারীর উপর কোপ পড়া শুরু হয়েছে, তখনও কিন্তু পুরুষ কামনা করেছে নারীর প্রগলভতা। চেয়েছে, স্ত্রীর অন্যান্য গুণের মতো সে যেন বিছানায় পতিতার মতো ছলাকলায় খেলুড়ে হয়। অন্যদিকে সম্পদ ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নে নারীকেই আটকানো হয়েছে। ফলত যৌনতা ব্যাপারটাই স্বাভাবিক পরিসর হারিয়ে দমবন্ধ কারাগারে পরিণত হয়েছে। এরকম একটা প্রেক্ষিতেই পর্দায় শারীরিক ক্রিয়াকলাপ উঠে এলে এখনও তাকে স্বাভাবিক না বলে সাহসী তকমা দেওয়া হয়। নিসন্দেহে তা মস্ত সাহসের কাজও বটে। তবে সেই মাকে যেন আমার আরও সাহসী মনে হয়, যিনি সন্তানের সামনে একবার নগ্ন হতে চেয়েছিলেন। বিশ্বায়নের দুনিয়া নারীশরীরকে বিপণনের স্বার্থে যে টানটান নিটোল সম্মান দিয়েছে, আদতে তা এজ ভুল ধারণা।সেই কল্পদুনিয়ার ভিতর এক পুরুষের বড় হয়ে ওঠা মানে, বাস্তবের সঙ্গে অহরহ সংঘাত। চাহিদা ও অপ্রাপ্তি, ফলত বিকৃতি। রিটা টেম্পলিটন নামে ওই মহিলা চাননি, তাঁর সন্তানও এই চলতি ফাঁদে পড়ুক। এই সিদ্ধান্তটুকুই এক অমিতশক্তির পরিচয় দেয়। যে দেশ যেমন খোলামেলাই হোক না কেন, সন্তানের সামনে নগ্নিকা মায়ের ধারণা বিরলপ্রায়। পণ্যায়ন তথা ভোগবাদী সমাজের একাংশকে হলেও ওই মহিলা একটা বার্তা তো দিয়েছিলেন। সে শক্তি সবার থাকে না। আরও একটা চলতি ধারণা, শারীরিক সক্ষ্মমতার জায়গায় নারীদের প্রকাশ সীমিত। সম্প্রতি দীপা কর্মকার এক সাক্ষাতকারে চমৎকার একটি কথা বলেছেন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাঁর বায়োপিক হলে কোন নায়িকা তাঁকে পর্দায় তুলে ধরতে পারবেন? দীপার জবাব ছিল, যে প্রোদুনোভা ভল্ট দিতে পারবেন, তিনিই বায়োপিক করবেন। এ জবাব অনবদ্য শক্তির প্রকাশ। বহু শক্তিশালী হয়েও কোনও পুরুষ তো এ শক্তি আয়ত্ত করতে পারেনি এতদিনে. আজ দীপা যখন এ কথা বলতে পারেন, আমরা অনুভব করি আক্ষরিক অর্থেই নারী শক্তি। দীপা আজ যেমন পরিচিত মুখ, তেমনটা নন সীমা রাও। আঠেরো বছর ধরে সেনাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন এই মহিলা। কোথায় পড়ে থাকে শারীরিক সক্ষমতার প্রশ্ন, যখন অরুণিমা সিনহা এক পা হারিয়েও মাউন্ট এভারেস্টে পৌঁছান। এই সব উদাহরণের কাছে গিয়ে বারবার মনে হয়, প্রিভিলেজড হিসেবে পুরুষের তো নজির গড়ার সুযোগ ছিল অনেক বেশি। তবু কিছু কৃতিত্ব আছে যা নারীরই। আর এখানেই আমরা বুঝতে পারি এক শক্তি আছে, যা শত প্রতিবন্ধকতা, দমনের ইতিহাসের ভিতরও জেগে আছে। যার নাগাল পাওয়া আমাদের সাধ্যাতীত বলেই আমরা তুলে রাখি আরাধনা-
দেবি প্রপন্নার্ত্তিহরে প্রসীদ,
প্রসীদ মাতর্জ্জগতোহখিলস্য।
প্রসীদ বিশ্বেশ্বরী পাহি বিশ্বং,
ত্বমীশ্বরী দেবি চরাচরস্য।।
সত্যিই চরাচর জগতের নিয়ন্ত্রণে যেন কোনও অধিশ্বরী শক্তির বাস। সে শক্তি প্রসন্ন হলে অসাধ্যসাধন হতে পারে। অসুরদলন তো স্রেফ একটা ইতিহাস মাত্র। অরুণা মুখোপাধ্যায় থেকে অরুণিমা সিংহরা তো প্রত্যেকেই একটি করে শক্তিরূপিণীর ইতিহাস রচনা করে রেখেছেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)