যে নারী মনে মনে রূপকথা বোনে
কাল রাত তিনটের সময় হঠাৎ করে বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দিলো কবিতার বইখাতাপত্তর। এলোমেলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নিজেরাই নিজের নিজের জায়গা করে বসে আসর জমিয়ে তুললো কবিতার খাতায়। দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলাম বৃষ্টির ফোঁটাদের এই জমাটি আড্ডা কীভাবে পরের দিন সূর্যের আলো মেখে হয়ে উঠবে কবিতার রঙধনু। শান্ত এক নিশ্চিন্ত ঠাঁই। আমি বরাবরই খেয়াল করেছি সঙ্গীত এবং কবিতা --- এই দুই নিবিষ্ট প্রাণ আমার আশ্রয় হয়ে উঠেছে নিয়ত প্রবাহের কালে। সঙ্গীত দিয়েছে উদ্দাম উচ্ছ্বসিত বহির্জাগতিক প্রাণময়তা অপর দিকে কবিতা নিয়ে গেছে অন্তঃসলিলা সেই অলৌকিক আশ্চর্য প্রাসাদে যেখানে রসসমুদ্র তো রয়েছে ভরপুর অথচ তৃষ্ণা মিটিয়েও যা করে রাখে অনন্ত তৃষ্ণার্ত। তেমন গুরুমুর্শিদের জন্য অপেক্ষা জমিয়ে রাখি যিনি আমাকে শিখিয়ে দেবেন সে বিপুল রসসমুদ্রে অবগাহনের মন্ত্র। শব্দ থেকে শব্দে ভেসে যাবে আলতো অথচ গভীর চুমুক। কোনো অনন্য অভিজ্ঞ প্রাজ্ঞ মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকি যখন জীবনের পরিসরে বেজে উঠবে জীবনাতীত শিকড়ের গান। কী কথায় কী কথা চলে এলো, যেন ধান ভানতে গেয়ে রাখা শিবের গীত। পৌষের শীতে অবশ্য এটুকু গীতবাদ্য নিছক মন্দ নয়।
নারীবাদী না হয়েও নারী কেন্দ্রিক যে কোনো বিষয় যে আমার ভালো লাগে এ নিয়ে আমার অন্তত কোন সন্দেহ যে নেই তা আমি খুব জোরের সাথেই বলতে পারি। সুতরাং ‘মায়াজম’এর নারীসংখ্যা থেকে দূরে থাকতে পারবো না তা বলাই বাহুল্য। তাই শাশ্বতীর বার্তা যখন এলো ওর ‘সেইসব হরিণীরা’ সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার, সে অনুরোধে সাড়া না দেওয়া আমার পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই কঠিন শুধু নয় অসম্ভব হল। তবে আমি যেহেতু সমালোচক নই নিতান্তই পাঠকমাত্র তাই কোনো সমালোচনার ধারপাশের ছায়াও মাড়াবে না আমার এ লেখা। এ শুধু এক নারীর অনুভব নিয়ে অন্য এক নারীর ভাবনাকে ছোঁয়ার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। ব্যর্থ বললাম এ কারণেই যে প্রতিটা মন এক একটা সচল জীবনের প্রতীক এবং ব্যক্তি বিশেষে তা ভিন্ন ভিন্ন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে। কবিতা একারণেই সীমার মাঝে অসীমের ধারা বাহক। প্রতিটি পাঠক কবিতাকে আপন আপন মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তি অনুযায়ী চিনে নেয়, ব্যাখ্যা করে। শাশ্বতীকে দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠস্তরে চিনি বলেই ওর কবিতার প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টি রাখা আমার পক্ষে সোনারপাথরবাটির অস্তিত্বের সমতুল। কাজে কাজেই কবিতার চুলচেরা বিচারের ভার বরং তোলা থাক ভবিষ্যতের কোন শিক্ষিত সমালোচকের ওপর।
শাশ্বতীর কবিতায় চিরকালীন বহমান ঐতিহ্যের সুরটি খুব স্পষ্ট ভাবে ধরা দেয়। বর্তমান কবিতা ধারার যে দুটি রূপ আমাদের অত্যন্ত বেশি করে চোখে পরে তা হল ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টি রেখে সৃষ্টির জাল বোনা আর অন্যটি হল প্রথা বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে কবিতার বিমূর্তায়ন। অনেক সময় কবিতায় অতিরিক্ত বিমূর্তায়ন পাঠকের কাছে গোলকধাঁধা হয়ে ওঠে। পাঠক বিভ্রান্ত হন। এই বিমূর্তায়নের পথ আমাদের প্রথম দেখিয়েছিলেন ফরাসী প্রতীকবাদীরা। কিন্তু তাঁরা যা সৃষ্টি করেছিলেন তাতে একটা সৌন্দর্য ফুটে উঠত আর সে সৌন্দর্যের উৎস ছিল রহস্যময়তা। ফলে কবিতা রচনার মূল উদ্দেশ্যটি ব্যহত হত না। কিন্তু এখন এই ধরনের কবিতা শেষ পর্যন্ত কী বলতে চেয়েছে বা মূল প্রতিপাদ্যটি কী বিষয়ক, কী রয়েছে কবিতার মর্মমূলে তা বুঝে ওঠা বাস্তবিকই ভারী মুশকিল। শাশ্বতীর কবিতায় রহস্য অনুপস্থিত এ কথা বলা যাবে না বরং প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে তা বহুলাংশেই যেন বেশি বেশি চোখে পড়ে, কিন্তু তা কখনোই সৌন্দর্য সৃষ্টির পরিপন্থী হয়ে ওঠেনি, এখানেই রচনার সার্থকতা। কবিতাগুলি শুধুমাত্র কিছু পারম্পর্যহীন শব্দের ভারবাহী না হয়ে, হয়ে উঠেছে জীবনের দ্যোতনা। আমার ব্যক্তিগত ভাবে কেন যেন মনে হয় প্রতীককে যদি ঠিকঠাক দক্ষতায় ব্যবহার করার সক্ষমতা না থাকে তবে তা কবিতা না হয়ে চালাকিকৃত অপচয় হয়ে ওঠে। সেখানে ফাঁকিটা খুব সহজেই ধরা পড়ে যায় একজন প্রাজ্ঞ পাঠকের নজরে। এ অবশ্য আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত, একাধিক ক্ষেত্রে এ নিয়ে মতানৈক্য থাকতেই পারে। আমি প্রত্যেকের মতকেই তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে শ্রদ্ধা জানাই। আমি আসলে যা বলতে চেয়েছি তা হল শাশ্বতীর কবিতায় ওপরচালাকি বহির্ভূত একটা সৎ নিষ্ঠার ছাপ চোখে পড়ে --- আর কিছুই নয়।
ভাষার বিবর্তন সূচিত হয় শব্দের চলমানতায়। শাশ্বতীর কবিতায় প্রতিটা শব্দকে এককভাবে বাঙময় হয়ে উঠতে দেখি। একজন সৃষ্টিসচেতন কবির মনন প্রকাশের যে লক্ষণগুলো শক্তিশালী হলে কবিতার বুনট হয়ে ওঠে ঘন তা দক্ষতার সাথে আয়ত্ত করেছে কবি। ঈপ্সিত শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভাষা হয়ে উঠেছে ইঙ্গিতময়। প্রয়োজনের সাথে রচিত হয়েছে আয়োজনের সেতু। দৃশ্য থেকে দৃশ্যাতীতে বদল আবার যেন চির চেনা সত্যকেই বহন করে চলেছে।
“ স্পর্শ করো, স্পর্শ করো, এখানে অস্থায়ী সকলেই ...”
যেখানে দুহাত পাতলেই নেচে ওঠে রসাতলি জল। সত্যিই সেখানে অস্থায়ী সকলেই। ভাব অস্থায়ী, আড়ি অস্থায়ী, মিলন অস্থায়ী, বিষাদ অস্থায়ী, ব্যাপ্তি অস্থায়ী, তুষ্টি অস্থায়ী, ক্ষণিক অস্থায়ী, দীর্ঘ অস্থায়ী, নারী অস্থায়ী, পুরুষ অস্থায়ী, স্থিতি অস্থায়ী, গতি অস্থায়ী, শান্তি অস্থায়ী, প্রেম অস্থায়ী , সংসার অস্থায়ী, রঙ্গমঞ্চ অস্থায়ী, কুশীলব অস্থায়ী। তবুও কেন মানুষের এতো চাঞ্চল্য? কেন এত খুঁজে ফেরা? কি সেই শক্তি যার ইচ্ছেতে জন্ম নেয় তাগিদ স্পর্শ পাওয়ার, স্পর্শ দেওয়ার?অথচ যেখানে যাবতীয় পাপপুণ্য, সঙ্গ, ঘৃণা, প্রেম, বিস্মৃতি মাত্রই ভ্রম। ভ্রমের সূত্র ধরে চলতে চলতে আসলে মানুষ পৌঁছে যেতে চায় কোন এক অপার জগতে। আর এই যাওয়া আসার পথের ধারে ফুটে থাকে কত অজানা রহস্যময় ফুল। সে ফুল না জানি কত আদরের। সকালবেলার আশীর্বাদী রোদের মতো। বিশ্বের সমস্ত ইতিহাস জানে কে চায় এই আলতো রোদটুকু কুড়িয়েবাড়িয়ে নিয়ে বড় যত্নে রেখে দিতে কালের সিন্দুকে। মহাকাল তাকেও কুড়িয়ে নিয়ে বসিয়ে দেন কালপুরুষের বুকে। রূপকথার ডালা খুলে উঁকি দেয় প্রথম শৈশবের সাত ভাই চম্পার গরীব দুখিনী গল্পমালার শুকসারি। হাজার বাতির ঝাড়লণ্ঠনের টুকরো টুকরো আলোয় ঝলমল করে ওঠে কুঁচবরণীয়া কন্যার বুকের তুষের আগুন—তার আমৃত্যু জাগরিত তেরো জন্ম।
এই তেরো জন্ম আসলে তেরো লক্ষ জন্ম হয়ে যায় অন্ধকারের। শরীরের রন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে হায়েনার লোভী কালো হাত। অনন্ত বিষাদ তাই ছড়িয়ে যায় কবিতার মর্মে মর্মে। শাশ্বতীর কবিতায় এই বিষাদ এক সর্বাত্মক ক্ষুধা নিয়ে ছড়িয়ে আছে। যেন অনন্তকালীন নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে গিলে নিতে চাইছে চেনাজানা মুহূর্তের রূপান্তরী ইতিহাস। আর এই সর্বগ্রাসী বিষাদ থেকেই সংগোপনে রাখা কবিহৃদয়ের ছায়াটুকুও প্রকাশ হয়ে পড়ে। এত যে মনখারাপ কুয়াশায় ঢেকে রাখে গা সে কুয়াশাও তখন মায়াবী রহস্য।
“ মৃত্যুর কাছে এসে সব শিল্প থেমে যায়
যন্ত্রণায় ঋদ্ধ হয় কবিদের কলমের বিষ ...”
এই আর্তনাদ, কান্না, হত্যার উৎসব থেকে লিখিত হয় বেদনার অভিমান। রচিত হয় মহাকাব্যিক ধর্মের জয়। মৃত্যুর কাছে এসে শিল্পীকে থেমে যেতে হয় কিন্তু জাগতিক চেতনা বিলুপ্তির পরেই শুরু হয় ভিন্ন এক শিল্পের যাত্রা। রোপিত হয় এক অন্য সাধনার অনিবার্য বীজ। রক্তে-মাংসে-মজ্জায়-প্রাণে সজ্জিত হয়ে ওঠে শব্দপুঞ্জ, কবির ব্যক্তিগত উচ্চারণ। সেই চেতনার প্রকাশ প্রবাহিত হয় আবহমান স্বকীয়তায়। বিচ্ছেদের গাঢ়তর যন্ত্রণার মতো যে সন্দেহ কবিকে কুড়ে কুড়ে খায় তারও কানে মৃদুস্বরে পাঠ হয় –
“মৃত্যু কবিতার চেয়ে উপাদেয়”
আর কোন উপাদেয়তেই যে অধিকার নেই মানবীর। তাই বোধহয় শাশ্বতীর কলম গৃহবধূদের নিষেধ করে দেয় আগুন নিয়ে না খেলতে। পৃথিবীর কোনো উৎকৃষ্টে অধিকার নেই নারীর। সাম্য নারীর জন্য নয়। সেই কোন প্রাচীনকালে সামাজিক বিধানদাতা মনু নারীকে দিয়েছেন তার স্থান নির্বাচন করে। বিবাহই নারীর বৈদিক উপনয়ন, পতিগৃহবাস তারপক্ষে গুরুগৃহবাস, গৃহকর্মই হল তার কাছে সাঁজসকালের হোমযজ্ঞের সামিল।সে সমাজে নারীর স্থান শূদ্র সমন্তরীয় সুতরাং বেদ পাঠের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা কর্তব্য। সর্বোপরি শাস্ত্রজ্ঞানহীন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীন শূদ্রের মতোই নারীরও নেই ধন সঞ্চয়ের অধিকার। যে সমাজে লিঙ্গবৈষম্য বহু প্রাচীন সময় থেকেই বহমান তা যে তার শিকড় অনেক গভীরেই চারিয়ে দিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সমাজে কি মানবীর অধিকার থাকতে পারে স্বতন্র পরিচয় প্রতিষ্ঠার? আর তাই -
“সকালে উনুন আর সন্ধেয় তুলসীতলার প্রদীপ, এর মধ্যে সীমিত আর
স্তিমিত রাখতে হয় আগুনের সব উপযোগিতা, নইলে হাত পুড়তে পারে,
অসাবধানে শাড়ির আঁচলও হতে পারে দাউদাউ”
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের আয়নায় প্রতিফলিত নারীচরিত্রের বাইরে বেরোতে চাইলেই নারী অসতী। নারীর খেলার কোনো বয়স থাকতে নেই, বাসনা থাকতে নেই। খেলতে নেই স্বাধীন জল-মাটি-হাওয়া নিয়ে। বরং খেলার বয়স পার করে দিয়ে খেলনা হয়ে যেতে হয় আমোদপ্রিয় পৃথিবীর অপর এক জনসত্বার।নাহলেই সর্বনাশ।
“সেখানে মাংসের গন্ধ ...
মৃত্যু বুক ঠেলে উঠে আসে”
কোনো যন্ত্রণাই যেন চিৎকার হয়ে বেরিয়ে না আসে। নারীকে থাকতে হবে চুপ। তাই আগুনের অধিকার শুধু পুরুষের। যেভাবে মা দেখেছে জীবন, যেভাবে তার মা করে গেছেন জীবনের দাসীত্ব সেভাবেই বাঁচবে আজকের মেয়েরাও।প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ। আজ এই দু হাজার সতেরো সালে দাঁড়িয়েও যখন মাতৃত্ব গ্রহণে নারীর ইচ্ছে অনিচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে পুরুষ তাকে বিদ্রূপের তীক্ষ্ণ টার্গেটে বিদ্ধ করে তখন কি মনে হয়না মনুর উদ্ধত রক্তের উত্তরাধিকার আজো রয়ে গেছে এবং রয়েছে বেশ বহাল তবিয়তেই? এভাবে কি অপমানিত হয় না মাতৃত্ব?নারীত্ব? একই ভাবে পুরুষের এই বিচারবোধহীন বর্বরতায় কি পুরুষও বিচ্যুত হয় না মানুষের যথার্থ মান এবং হুঁশ থেকে? নারীপুরুষের মানবিক সহাবস্থান যেখানে সহজ হয়েছে সেখানেই ধরা দিয়েছে সৌন্দর্য। অথচ প্রতি মুহূর্তে ঘটছে এই ভাবনার ধর্ষণ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে। নারী শরীর মূল্যবান কিন্তু তার মন, তার মনন, তার চিন্তা-চেতনা-ক্ষত-রক্ত-সন্তাপ-দাহ সবই পিতৃতন্ত্রের পরম্পরায় অপ্রয়োজনীয়। ফলে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার পরিণামে নিজের সবকিছু মুখ বুজে খুইয়ে ফেলার বাধ্যতা একমাত্র নারীতেই বর্তায়। নারী শুধু নিজেকে বিলিয়ে দিতেই জন্মেছে যেন –
“নারীর বুকেতে ভয়, যোনিতেও ভয়
গলা টিপে বসে থাকে ভীত নিঃশ্বাসই
মিথ্যেই ক্যানভাসে আঁক কাটে মেয়ে
জলরং ধুয়ে গেলে মেয়ে বানভাসি”
নারী প্রথম থেকেই কবি। জমির বুকে ফসল ফলানোর উপায় যার চোখে প্রথম ধরা পড়ে, কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে যার মঙ্গলস্পর্শে প্রথম ঘুম ভাঙে সভ্যতার তাকে কবি ছাড়া আর কী বলা যায়? পুরুষ স্বাভাবিকভাবেই তাই ভয় পেয়েছে এই নারীকে। বন্দী করেছে সংসারের জটিল শৃঙ্খলে, হাজার রকম বেনিয়মে। যে নারী মাতৃভাবনায়, প্রেমিকার মতো পুরুষকে আপন সত্বায় মিশিয়ে নিতে চেয়েছে, পুরুষ তাকেই করেছে পদানত। বাইরে দেবীমূর্তি গড়ে ষোড়শপচারে যে নারীর পূজা করেছে অন্দরে সেই নারীকেই করেছে উলঙ্গ। তার শরীরে, মনে দেগে দিয়েছে ফতোয়ার কঠিন হিসেব। যে কোনো অবস্থায় পুরুষ হবে নারীর শ্রদ্ধেয়! পুরুষ নিয়েছে দাতার অধিকার, নারীকে করেছে ভিখারিনী। কিন্তু হাত পেতে আর যাই হোক সম্মান যাচনা করা চলে কি ?
“ আসলে তো ভিক্ষের অনুভবে
কোনো স্পষ্ট বর্ণমালা নেই, নেই বৃত্তিয় অনুভব...
শুধু ভিখারিরা জানে আঙুলে আগুন জ্বললে
তার থেকে শব্দ খসে পড়ে ...”
শৃঙ্খলিত নারী চিৎকার করে, মাথা কুটে মরে নিরেট দেওয়ালে, তবু একদিন প্রেমের স্বাধিকার চেতনার দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে ভেবে জ্বালিয়ে রাখে আশার অনির্বাণ শিখাটিকে। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় থেকে খুঁজে নেয় প্রেম।
“ এমন কঠিন রাত্রি
... গায়ে প্রেমিকের জ্বর
মোছাবো কি করে উপবাসী রাতের অক্ষর ...?”
নারী তো এমনই প্রেমময়ী। তাই বোধহয় তার অস্পষ্ট সকাল থেকে ছিঁড়ে পড়ে নীল খিদে। শব্দে শব্দে গেঁথে তোলে অব্যক্ত অনুরণন – সে শব্দ আসে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতই,
“ এক একটা শব্দ আসে যেন দৈববাণী
বৃষ্টির শরীরে মাখা সোঁদা গন্ধ যেন ...”
শব্দ যদি না বৃষ্টির মতো সহজ হয়ে ঝরে তাহলে তার সার্থকতা কোথায়? বৃষ্টির সহজতার মধ্যেই তো লুকিয়ে থাকে আগামী ফসলের আগমনী সংবাদ। শাশ্বতী এ দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে উত্তীর্ণ। ওর কবিতার বিশিষ্টতা এখানেই। কবির কথা কখন যে কবিকে ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পাঠকের তপ্ত হৃদয়ে বৃষ্টির শীতল আবেশ নিয়ে তা নির্ণয় করতে যাওয়া নিরর্থক। কখনো পেলব, কখনো মধুর শব্দকেই দেখেছি বিদ্যুৎঝলকের মতো ঝলসে উঠতে।
'সেই সব হরিণীরা"শাশ্বতীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অথচ পড়তে পড়তে কিছুতেই তা মনে হওয়ার উপায় নেই। অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে ভাষা ব্যবহারে কবিতাকে পাঠকের মননের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে ওর একটা স্বাভাবিক দক্ষতা আছে। ভাষা ব্যবহারের এই দক্ষতাই ওর কবিতার শরীর ছাপিয়ে মর্মের পরশ নিতে বাধ্য করে পাঠককে। ওর ব্যক্তিগত একক অনুভূতির গভীরে গিয়ে সংবেদনশীল পাঠক নিজেকে খুঁজে নিতে নিতে আবিষ্কার করে কবিতাকে নতুন করে নির্মাণের আনন্দ।
“ এসো বৃষ্টির কথা বলি...
যেখানে মেঘ জমেছে সেটা তোমার ছাদ হতে পারে,
হতে পারে আমার উঠোন ...”
বন্ধুর পথে কোনো বন্ধু থাক বা না থাক কবিতাকে একাই চলার মতো যথেষ্ট শক্তি দিয়েই সমর্থ করে তুলেছে শাশ্বতী। প্রায় সব কবিতাই অপূর্ব চিত্রময়। এই চিত্রময়তা কখনো এসেছে প্রথাগত রূপকল্পে কখনো আবার তাকে অস্বীকার করে। শব্দনৈপুণ্যে এর অন্তরলিন সুরটি অথচ অব্যাহত রয়েছে। ছন্দে শাশ্বতীর হাত যে প্রাণবন্ত এ বিষয়ে এ পর্যন্ত তার কবিতার পাঠকেরা আমার সঙ্গে একমত হবেন , আমি নিশ্চিত। এর পাশাপাশি গদ্যে লেখা কবিতাও পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত। কানায় কানায় ভরে উঠেছে কাব্যরসসমুদ্র। ওর যে লেখাটা একটা সময়ে রসিক পাঠকের কাছে ভীষণভাবে গ্রহণীয় হয়েছিল, সেটা আমারও অত্যন্ত প্রিয় রচনাও বটে, তার প্রাথমিক পাঠেই মনে হয়েছিল গদ্যের আঙ্গিকে এই হল সেই আদ্যন্ত কবিতা। নাই বা রইল পরিচিত ছন্দরীতি, নাই বা রইল চিরাচরিত কবিতার গঠনশৈলী। অসাধারণ একটা উপস্থাপন দেখেছি শুধুমাত্র ভাষাকে, শব্দকে সঠিকভাবে স্বাভাবিকতার স্পন্দনে রণিত করে কিভাবে। আশ্চর্যের বিষয় হল পুরোটাই গদ্যে লেখা অথচ কী গভীর তার কাব্যিক আবেদন। কবিতাকে শেষ পর্যন্ত কবিতাই হয়ে উঠতে হয় সে যে যতই ভিন্ন পথে হাঁটুন না কেন।এ এক অজানা রসায়ন। কবিতা নিয়ে যতই পরীক্ষা-নিরীক্ষা হোক না কেন কবি মাত্রই চান তাঁর কবিতা পাঠকের সামাজিক সমাদর পান। যাইহোক, যারা পড়েন নি তাদের কথা ভেবে আমার প্রিয় এই ম্যাজিক কিছুটা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না। আসুন একবার চোখ বুলাই...ডুবে যাই... ভেসে যাই রসসমুদ্রের অন্তঃস্থলে ---
“ আর কোন দিকে যাবোনা বলেই বারবার সমুদ্রের অভিমুখ বদলেছি আমি... ভালোবাসাকে ডেকেছি বিষণ্ণতার নামে। আর বিশ্বাস করেছি একদিন তুই ঠিক উঠে আসবি হিসহিসে বিষধরের মতো আমার ডুবন্ত অতীতের সমস্ত জল ভেঙে। তোর ছোবলে থাকবে রাঢ় বাতাসের লাল গন্ধ, - লেজের ঝাপটায় ফুটে ওঠা ছাতিমফুলের মতো কোনো এক বিষাক্ত তীব্রতা।
আমার স্নানহীন শরীর অনেক নদীকে শুষে নিয়েছে এ যাবৎ... তবু নদীদের মৃত্যুসংবাদ লিখতে নেই, --তাতে পাপ হয়। এরকমই এক পাপের হাত ধরে তোর চৌকাঠের খররোদ্দুর পেরিয়ে এসেছি...
আমি আর কোনো দিকে যাবোনা।
কোনোদিকে যাবোনা বলেই দুচোখে অন্ধকার গিলে বসে আছি,--বসে আছি আর একটা গোপন স্নান দৃশ্যের প্রতীক্ষায় ...”
[ স্নান বিষয়ক একটি চিঠি ]
আর কোনো পাপ করবোনা বলেই আমরাও বুকে জড়িয়ে নিয়েছি কবিতার পবিত্র ধুন, মীরার শ্যামপ্রেম বা সূফী সাধকের ঈশ্বর সাধনেচ্ছায় ধুলোর ভিতর মিশে যাওয়ার আবেদন। ব্যাক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকতার দিকে যাত্রারই আরেক নাম কবিতা। সচেতনভাবেই তার প্রয়োগ শাশ্বতীর কবিতায় পেয়েছি। রোমান্টিকতার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত ওর কবিতা অথচ ক্লাসিক রীতিকে অগ্রাহ্য করে নয়।রয়েছে প্রখর আত্মসচেতনতা আবার তা থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বমানবীর যন্ত্রণাবোধে তার উত্তরণ নেহাত সোজা কথা নয়। কত অবলীলায় শাশ্বতী তা করেছে। হয়ত একজন নারী বলেই ওর পক্ষে সম্ভব হয়েছে মরুভূমি ও বন্ধ্যাজমির প্রতীকে নারীকে রেখে আবেগের নিরুদ্ধ প্রগাঢ় সংহতি রচনা। শাশ্বতীর এই বইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় সৈয়দ হাসমত জালাল যা বলেছেন তার সঙ্গে আমিও একমত, --
“ বহুবিধ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে জীবনকে অতিক্রম করতে হলেও কবি বারবার ফিরে যেতে চান তাঁর শব্দের কাছে, অক্ষরের কাছে, কবিতার নিজস্ব আশ্রয়ে। সে অভিজ্ঞতা সবসময়েই সুখের নয়, সেখানে শাশ্বত প্রেম বলে কিছু নেই জেনেও কবিকে লেখার ভেতরে ফিরতে হয় ...”
তবু ভাবতে অবাক লাগে এই বিশাল জীবনের কতোটুকু অংশই বা কবি দেখেছে যে অনায়াসে বলতে পারে—
“ হরিণের মতো বেঁচে থাক প্রিয় শব্দগুলো
পৃথিবীর মেরুদণ্ডে গেঁথে গেছে আমার কলম...”
সত্যই অবলীলায় সৌন্দর্য সৃষ্টি করে কবিতায় প্রাণ দিতে পারে শাশ্বতী। আর তাই ‘সেই সব হরিণীরা’ ভাবের কষ্টিপাথরে গা ঘসে হয়ে ওঠে চিরন্তন মানবীর হৃদয় নিঙড়ানো ব্যথাকাব্য।
লিখেছেন-পিয়াল রায়
সুচিন্তিত মতামত দিন