গৌতম সেন

মায়াজম
0
          নক্ষত্রলোক ও ভ্রাম্যমান আমি (কল্পকাহিনী)




        এক রাউন্ড ঘুম হল। সময় রাত্রি মধ্যযাম। হাতে বেশ খানিক নিস্তব্ধ অবসর। একটা মহাজাগতিক বোধ বলা যেতে পারে। চারদিক এমন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার, নিজের ঘর না শ্রীহরিকোটা তখন এ চিন্তা অমূলক। ভাবনাকে রকেটের ঢাকনা মুড়ে উৎক্ষেপণ করলাম মহাশূন্যে।
লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের ভিড়, তারা যুগপ্রাচীন এক উপনিবেশের স্থায়ী অধিবাসী। আমি এই অসময়ে লক্ষ্যহীন ক্লান্তপ্রাণ উদ্ভ্রান্ত এক রকেটযান উড়ে এসে জুড়ে বসলাম বনেদি গ্যালাক্সির এই যৌথ পরিবারে। তারারা সব বিস্মিত, উদ্বিগ্ন আমায় দেখে। আমার আর বিশেষ কিছু করার ছিল না তখন। কক্ষপথে অধিষ্ঠিত, নিদ্রাভঙ্গ উদ্বেল তরঙ্গ হয়ে পাক খেতে থাকা এক বিচিত্র অনাবাসী অন্য গ্রহের জীব। এ ছাড়া আমি তখন অন্য কিছুই নই।
এত বিস্ময়, এত অজানা বিষয়ের সমাহার – কি ভীষণ ব্যস্ত তারা, আমার ই মত অতন্দ্র। আমি উত্তেজিত তারাদের মাঝে, তারা ও অবাক। এই যুগ্ম বিমূঢ়তা কেটে গেল ক্ষণিক অবসরে। আমি কি তবে কোনও দিকভ্রষ্ট উন্মাদ ছুটে চলেছি, না কি কোনও অভীষ্ট সন্ধানে আমার এই ছুটে চলা। মাথায় এত কথার ঘুরপাক, তবু সবই যেন এক মাপা ছক মেনে হয়ে চলেছে। এ কি উদ্ভ্রান্ত ভ্রমণ আমার!
হঠাৎ অকল্পনীয় এক ঘটনা। এই অচেনা মহাশূন্যে বিগত পরমাত্মীয় এক শব্দহীন অনুভূতি যেন ঘিরে ফেলল আমায়। পার্থিব বোধ তখন অকর্মণ্য, নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় সাব্যস্ত হয়েছে। কেমন এক অভিজ্ঞ, সুশিক্ষিত নভশ্চর বলে মনে হতে লাগল নিজেকে। সেই অনুভূতি যা আমাকে ঘিরে রেখেছিল – সে যেন আমার পরম বন্ধু, পথ প্রদর্শক, সহমর্মী সহযাত্রী। কখনও সে আমার বিদেহী প্রেম-পরমাস্পদ পরলোকগতা স্ত্রী, কখনও বা শ্রদ্ধাস্পদ আশীষদাতৃ জনক-জননী। যে বা যারাই হোক, তাঁরা আমার সুবর্ণ অতীত।
ভীষণ এক ব্যস্ততা। সামনে পিছনে, ডাইনে-বাঁয়ে। এরা কারা? ত্বরিতগতিতে ইতস্তত: ছোটাছুটিতে মত্ত। বুঝলাম আমি গ্যালাক্সিতে এসে মহা ঘূর্ণনের সামিল হয়েছি। উচ্চারিত শব্দগুলো নীরব খোলসে মোড়া, তবু উপলব্ধিতে এক আশ্চর্য অনুভূতি। এ কক্ষপথে অচেনা অদেখা মহাজাগতিক চিত্রাবলী একে একে অবচেতন মন থেকে টেনে টেনে বার করে আনছে চেনা চেনা মাইলফলক – নীলাচলে সফেন সমুদ্র, নীলগিরি পাহাড়ের গাঢ় ছায়াময় ঘন সবুজ চায়ের বাগান। বিন্দু বিন্দু গতিময় আলোকচ্ছটা আমার তখন দৃষ্টিময়। কত ছোট্ট পরিসরে বিস্তৃত গড়ের মাঠ, কখনও রাজভবন, কখনও যানজট – সবই আছে দৃশ্যপটে। কেমন যেন অলৌকিক, মায়াবী রূপান্তরিত রোজকার ফেলে আসা পৃথিবী।
ভুলে যাচ্ছি সব, যা দেখছি গুলিয়ে যাচ্ছে। এত দ্রুত অপস্রিয়মাণ দৃশ্যাবলী। আমার পথপ্রদর্শকেরা সব কেবলই অনুভূতি। পার্থিব, কলেবর বিশিষ্ট, দৃশ্যমান নয় তারা। কণ্ঠস্বরবিহীন, স্পর্শের অস্তিত্ব রহিত তাঁরা, তবু একমাত্র চেনা চেনা গন্ধ খুঁজে পেয়েছি যেন সামান্য, অতি সামান্য হলেও তাঁদের মাঝে। আমি চাইছি পৃথিবীর গল্প শোনাই তাদের। জন্মের গল্প, মৃত্যুর গল্প – মিথ্যাচার, অপসংস্কৃতির কথা, ধর্ষণ, নির্যাতনের চালচিত্র সব নির্বাক বর্ণনা নিমেষে শেষ হল। নিজের কাছে নিজেকে বড়ই অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হতে লাগল। কিছুই নতুন বলে মনে হল না এঁদের, এঁরা আক্ষরিক অর্থে সবাই অন্তর্যামী। এদের চোখে এ কেবল যুগপ্রবাহ মাত্র। কেমন এক নিরুদ্বেগ, উদাসীনভাব। অথচ আমি নতুন হতে আরও নতুন, বিস্ময় হতে আরও গভীর বিস্ময়ের সম্মুখীন। দেখলাম ব্ল্যাক ম্যাটার, দেখলাম ব্ল্যাক হোল। আর এদের ঘিরে শত সহস্র আলোকবিন্দুর মত্ত নাচন। গতি ছাড়া গত্যন্তর নেই এ এমন এক জগত।
এ গতিময় ছায়াপথ কোনও বিভ্রমের নয়। আমার এই অসময়ের সাময়িক কল্পভ্রমণও কোনও পরাবাস্তব নয়। আমার পৃথিবী, আমার বিশ্বাসের মতই কঠিন বাস্তব। নিত্য, ঘটমান, অনন্ত এক চক্র। সৃষ্টি–ধ্বংস, জন্ম-মৃত্যু অবিরাম ঘটে চলেছে। বিস্ময় যতই ঘনীভূত হোক, টের পাচ্ছি গভীর, আরও গভীর এক বিশ্বাসের ভিত মজবুত হতে চলেছে আমার ভিতর। বিশাল এক আপেক্ষিকতার মাঝে আমি, একই অভিমুখে গ্যালাক্সির অধিবাসীবৃন্দ আর আমার ভাবনা ছুটেই চলেছে। আমি ক্রমেই চরম গতিপ্রাপ্ত এক বিন্দুতে পরিণত হচ্ছি। কোনও উৎকণ্ঠা নেই, ভয়-ভীত কোথায় উধাও। আশ্চর্য জগত যেন এক – শুধু কবিগুরুর গানের কলি আমার এই অনন্ত ভ্রমণের মূল সুর হয়ে বাজতে লাগল, ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি...’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)