অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

      অস্পৃশ্যনামা





দ্বিতীয় পর্বঃ--




দলিতকথাটির অর্থ এমন বস্তু বা মানুষ যাদের কেটে ফেলা হয়েছে, ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে, টুকরো টুকরো করে পিষে ফেলা হয়েছে এবং ধ্বংস করা হয়েছে মারাঠি সমাজসংস্কারক বিপ্লবী মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে হিন্দু সমাজে নিপীড়িত অবর্ণ অস্পৃশ্য জাতিগুলির ক্ষেত্রে এই কথাটি ব্যবহার করেনসাধারণভাবেদলিতকথাটির অর্থ নিম্নবর্ণ বা দরিদ্র নয়, বরং এই শব্দটি দিয়েবোঝানো হচ্ছে এক অবদমিত অবস্থাসামাজিক রীতি তাদের যে অধঃপতিত করেছে দলিত বলতে সেটাই বোঝাচ্ছে ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয় যে যারা নিচু কাজ করে তারা পুনর্জন্মে খারাপ জন্ম পায় তারা কুকুর বা শুয়োর বা চণ্ডাল হিসাবে জন্মায়এই অস্পৃশ্য দলিত/শূদ্রদেরই মহাত্মা গান্ধি বললেনহরিজন তিনিহরিজননামে একটি সংবাদপত্র করতেন এবং হরিজনদের বিষয়ে লেখালেখি করতেন সে সময়েও শূদ্ররা শুধু অস্পৃশ্যই ছিলেন না, তাদের ছায়া পর্যন্ত পড়তে পারত না ব্রাহ্মণদের শরীরে ব্রাহ্মণরা যে পথে চলবেন সে পথে শূদ্রদের চলন গর্হিত অপরাধ ব্রাহ্মণদের সামনে শূদ্রদের ছাতা মাথায় বুক চিতিয়ে যাওয়াটা চরম ধৃষ্টতা শূদ্র, অর্থাৎ অস্পৃশ্যদের কোনো দেবতা নেই দেবতা নেই, দেউলও নেই এইসব অস্পৃশ্যদের কোনো মন্দিরে প্রবেশ করার অধিকার ছিল না অপবিত্র হয়ে যাবে দেব দেউল একই কুয়োয় জল ব্যবহারের অধিকার ছিল না শূদ্ররা যেখানে বসে সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর গৃহস্থ গঙ্গাজল গোবরজল ছিটাবে গান্ধিজি ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধীজী অস্পৃশ্য হরিজনদের হাতেঅন্নগ্রহণ আন্দোলন”-এর প্রথম সারির উদ্যোক্তা ছিলেন তা সত্ত্বেও বলা যায়, মহাত্মা গান্ধি শূদ্রদের জন্য তেমন কিছু করে উঠতে পারেননি তিনি সকলের কাছেবাপুজিহতে সক্ষম হলেও শেষপর্যন্ত শূদ্রদের বাপুজি হতে পারেননি অস্পৃশ্য শূদ্রদের নতুন নাম হরিজনদিলেন বটে, কিন্ত একবিন্দু মর্যাদা দিতে পারেননি নাম বদলালেই মর্যাদা বদলায় না হরিজন কেন ? এই হরি কি ঈশ্বর হরি ? তাই যদি হয় হরি তো সকলেরই ঈশ্বর; হরিজন তো সকলেই তাহলে কেন শূদ্ররাই কেবল যাদের হরিজন বলা হচ্ছে তাদেরকে কি হরি আলাদাভাবে জন্ম দিয়েছেন ? উচ্চবর্ণের হরি আর নিন্মবর্ণের হরি কি আলাদা ?
আসলে প্রকারান্তরে গান্ধিজি ব্রহ্মণ্যধর্মের সৃষ্ট বর্ণবৈষম্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন উনি উপলব্ধি করেছেন বর্ণপ্রথার প্রয়োজন আছে যদিও তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন না, কিন্তু দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ব্রাহ্মণরাই তাঁকে ঘিরে থাকতেন তদুপরি, তিনি কোনো শূদ্রের সঙ্গে আত্মীয়তা সম্পর্ক গড়েছেন বলে শুনিনি গান্ধিজি ভারতের ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যেতে পারেননি গান্ধিজি ব্রাহ্মণ্যধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, ব্রাহ্মণ্যধর্মে বিশ্বাস অটুট রেখে শূদ্রদের মঙ্গল করা সম্ভব নয় হয়ওনিগান্ধিজি যদি আন্তরিকভাবেই শূদ্রদের মর্যাদাই চাইতেন তাহলে এত সময় রাজনীতিতে ব্যয় না-করে ভারতের দলিত অর্থাৎ পিছড়ে বর্গদের অধিকার আদায়ের আদায়ের কাজে লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারতেনতিনি বদলে দিতে পারতেন ভারতের ইতিহাসের ধারাতৈরি হয়ে যেত নতুন এক ভারত, ভারতবর্ষমুছে যেত ব্রাহ্মণ-শূদের স্বতন্ত্র পরিচয়তিনি শূদ্রদেরহরিজনশিরোপা দিয়ে সকলকেই যদি হিন্দু হতে বলতেন, তাহলে সব ব্রাহ্মণ না-এলেও অনেকেই দলিত/শূদ্রদের পাশে এসে দাঁড়াতেন তাহলে আজকের দিনেও কোনো উচ্চবর্ণের সাহস হত না একটি দলিতকেও নগ্ন করে দিতে
দেবদাসী প্রথা দক্ষিণ ভারতে এখনো টিকে আছে এসব দেবদাসীরা অধিকাংশই হরিজন সম্প্রদায়ের থেকে আসা ব্রাহ্মণরা তাদের দিনের পর দিন ভোগ করলে জাত যায় না জাত যায় তাদের হাতের জল খেলে  দলিত হরিজনরা এখনো মূল স্রোতের সঙ্গে মিশতে পারেনি ফলে তারা কলোনিভিত্তিক জীবনযাপন করে যাচ্ছে ব্যাপক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দলিত-হরিজনরা যেন অস্পৃশ্যদলিত সম্প্রদায় জন্ম পেশাগত কারণে বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার মানুষরা আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষ করে পণ্ডিতদের কাছেদলিতনামে পরিচিতি পায়
এক ঈশ্বরের সৃষ্টি, এক ধর্মালম্বী, একই নিয়মে পিতা-মাতার মাধ্যমে পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে এত জাতিগত বৈষম্য কেন? নিশ্চয় এটা বিধির বিধান নয়, এটা সম্পুর্ণ মানুষের (ব্রাহ্মণের) তৈরি জাতিভেদের দলিল মাত্র, এতে কোনো সন্দেহ নেইএ ছাড়াও এক জাতি বা বর্ণের পুরুষের ঔরসে অন্য জাতি বা বর্ণের নারীর গর্ভে সন্তান জন্ম হলে শাস্ত্র বিধান মতে তাদেরকে অস্পৃশ্য, পতিত, জারজ, নীচু জাতি বা বর্ণ শঙ্কর বলা হত এবং এদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অমানবিক আচরণ করতযেমন ক্ষত্রিয়ের ঔরসে বৈশ্য নারীর গর্ভে বাগদির জন্ম, এরা অস্পৃশ্য বা পতিত জাতিশূদ্রের ঔরসে দ্বিজ (ব্রাহ্মণ) রমণীর গর্ভে চণ্ডালের জন্ম, এরা জারজ দোষে পতিত বা অস্পৃশ্যএইভাবে ছত্রিশ বর্ণ বা জাতির উৎপত্তি, এরূপ বহু ছোটো জাত বা অস্পৃশ্য জাতির উল্লেখ আছে (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড, ৫৯ পৃষ্ঠা)হিন্দুধর্মে পালনীয় অপস্তম্ব ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে, কেউ চণ্ডালকে স্পর্শ করলে তাকে জলে স্নান করতে হবে। কেউ চণ্ডালের সঙ্গে কথা বললে তারপর ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলতে হবে। চণ্ডালের উপরে চোখ পড়লে তারপর আকাশের সূর্য, চন্দ্র, তারার দিকে তাকিয়ে চোখ শুদ্ধ করে নিতে হবে। পরাশর স্মৃতিতে  বর্ণিত হয়েছে আরও কঠোরতা। বলছে, কোনো দ্বিজ অন্নগ্রহণের সময় কোনো কুকুর বা চণ্ডাল যদি তাঁকে স্পর্শ করে তাহলে সেই ফেলে দিতে হবে। চণ্ডালের ছোঁয়া কুয়ো থেকে কোনো ব্রাহ্মণ যদি জলপান করে তাহলে তাঁকে তিনদিন ধরে গোমূত্র মেশানো যব খেতে হবে। কারও ঘরে যদি চণ্ডাল প্রবেশ করে তবে গোবর মেশানো জল দিয়ে সমস্ত ঘর ধুয়ে ফেলতে হবে। মাটির হাঁড়িকুড়ি ফেলে দিতে হবে। বাড়ির পরিচারক সহ পরিবারের লোকেরা দিনে তিনবার করে গোমূত্র মিশ্রিত ঘোল খাবে। পরের তিনদিন গোমূত্র মিশ্রিত যবের জল খাবে। তারপরের তিনদিন গোমূত্র মিশ্রিত দুধ খাবে। তারপর এইসব মিশ্রণ একদিন করে খেতে হবে। এইভাবে বারো দিন ধরে শুদ্ধিকরণ চলবে।নারদের মতে – শ্বপাক, মেদ, চণ্ডাল ও মালারা ছিল মনুষ্য সমাজের বর্জ্য। তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডই ভালো, কেন-না অর্থদণ্ড করলে তাঁদের ছোঁয়া অর্থ নেওয়া যাবে না। তাদের অর্থও দূষিত (নারদস্মৃতি, পৃষ্ঠা ৪১)। কী তীব্র ঘৃণা, ভাবুন ! কোনো একটা ধর্মগ্রন্থ নয়, বরং যুগ যুগ ধরে কীভাবে হিন্দু সমাজ অস্পৃশ্যতার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল সেটা বোঝা গেল। আসলে এই হল সনাতন ধর্ম, যে চিরন্তন এইভাবে।
হিন্দু সমাজের এক সময়কার রাজা বল্লাল সেন সমাজের মহা সর্বনাশ করেছেন যতদিন এই পৃথিবী থাকবে ততদিন বল্লাল সেনের অনাচার অনাসৃষ্টি হিন্দু সমাজ ভূলবে না তিনি ছিলেন ধর্মে বৌদ্ধ এবং তাঁর গুরু ভট্ট-পাদ সিংহগিরি তাকে দীক্ষা দিয়ে শৈব মতে আনলেন বাংলার রাজা বল্লাল সেন বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে হলায়ুদ উমাপতি নামে দুই ব্রাহ্মণের সাহায্য চান হলায়ুদ বল্লালের মন্ত্রী উমাপতি তাঁর পঞ্চরত্নের অন্যতম ছিলেন এঁদের সাহায্যে বল্লাল সেন ছলে-বলে-কৌশলে বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য স্থাপন করেন ব্রাহ্মণের বশতা স্বীকার করার নাম ব্রাহ্মণ্যধর্ম ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে অনেক মানুষ হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেন বল্লাল সেন বৌদ্ধধর্ম উচ্ছেদ করেন এবং দ্বেষ, ঈর্ষা, স্বার্থপূর্ণ নৈতিকতাহীন ব্রাহ্মণধর্ম প্রচারে নিবেদিত হলেন যার ফলে বঙ্গে শত শত জাতি উপজাতির সৃষ্টি হল আত্মকলহ, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা, ঘৃণায় জাতি অসার বলহীন হয়ে পড়ল
যে সকল জনসাধারণ রাজার ব্রাহ্মণদের নিয়মনীতি মানল না তাঁদের পতিত ঘোষণা করা হল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দেওয়া ঘুষের মহিমায় শাস্ত্রের নামে জালিয়াতি করে প্রচার করলব্রাহ্মণ বাদে বাকি সকল মানুষই শূদ্র সকলেই হীন, নীচ,পতিত, অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য বর্ণ সঙ্কর
পরশুরাম সংহিতানামক একটি গ্রন্থে শূদ্রবিদ্বেষী ব্রাহ্মণেরা প্রচার করলেন, বারুজীবীর বীর্যে তেলি, কর্মকারের বীর্যে মালাকার, গোপের বীর্যে বারুজীবী, তেলির বীর্যে কর্মকার, মালাকারের বীর্যে পট্টিকার, পট্টিকারের দ্বারা কুম্ভকার, কুম্ভকারের দ্বারা কুবেরী এবং কুবেরীর দ্বারা নাপিতের জন্ম হয়েছে মনুসংহিতা এবং মহাভারতের মধ্য দিয়ে প্রচার করা হল ক্ষত্রিয়-স্বামী ব্রাহ্মণী-স্ত্রীতে মিলনের ফলে সূত জাতি জন্ম
বৈশ্য-স্বামী ক্ষত্রিয়-স্ত্রীতে মাগধ জাতির জন্ম
  বৈশ্য-স্বামী ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে বৈদেহ জাতির জন্ম (মনুসংহিতা : ১০/১১, মহাভারত : অনুশাসন ৪৮/১০) কিন্তু পৌরাণিক কাহিনিতে অন্য প্রকার দেখা যায় পিতা জমদগ্নি ব্রাহ্মণ, মাতা রেণুকা ক্ষত্রিয় কন্যা, পুত্র জন্মিলেন পরশুরাম তিনি সূত না-হয়ে ব্রাহ্মণ হলেন কেউ কেউ প্রচার করলেন শূদ্র পিতা ব্রাহ্মণী মাতাতে যে সন্তান হয় সেই সন্তান হয় চণ্ডালমগধের রাজা বিন্দুসার শূদ্র, বিবাহ করেন এক ব্রাহ্মণীকে -- পুত্র হলেন বিশ্বখ্যাত ক্ষত্রিয় রাজা অশোক অশোক পণ্ডিতদের তৈরি শ্লোকের প্রভাবে চণ্ডাল হননি বল্লাল সেন সকলের দ্বিজত্ব উঠিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণবাদের সকল হিন্দুদের শূদ্র নামে ঘোষিত করেন মাহিষ্যগণ ছিলেন বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় মহারাজ কার্তবীর্যার্জুন এদের পূর্বপুরুষ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এদের বহুকাল যুদ্ধ হয় বৌদ্ধযুগের একদল সন্ত, সাঁই বা সাধু বল্লাল সেনের অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে বিহারের পাহাড়ে আশ্রয় নেন এরাই পরে সাঁইতার বা সাঁওতাল নামে খ্যাত হন শঙ্খনির্মিত অলংকার বিক্রেতা শাঁখারী বা শঙ্খবনিক, কাঁশারী, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিকেরা ব্রাহ্মণ ছিলেন বল্লালসেন এদের পৈতা ছিড়ে ফেলে শূদ্র ঘোষণা করেন সূত্রধরেরা ছিলেন ব্রাহ্মণ এভাবে রাজা বল্লালসেনের অত্যাচারে তেওর, জালিক, রজক, দুলে, বেহারা, কেওরা প্রভৃতি অনেকেই বৈশ্য বংশে জন্মগ্রহন করেও বল্লালসেনের ফতোয়ায় সকলেই শূদ্র হতে বাধ্য হন বল্লালসেন যে সব ব্রাহ্মণ, বৈশ্য এবং ক্ষত্রিয়কে জোর করে শূদ্র করেন তাদের গৃহে পৌরহিত্য করতে অন্য ব্রাহ্মণদের নিষেধ করে দেনবল্লালসেনের অত্যাচারে হিংসা নীচতায় বঙ্গে হিন্দু সমাজ দিন দিন ধ্বংস হয়ে গেল হাজার হাজার ব্রাহ্মণের পৈতা জোর করে ছিড়ে তাঁদের শূদ্র ঘোষণা করলেন এবং অনেক পদলেহী শূদ্রকে তিনি ব্রাহ্মণ উপাধি দিলেন
আচার্য সুভাষ শাস্ত্রী বলেন, “ভ্রষ্ট চরিত্রের বল্লাল সেন এক বিবাহিতা ডোম কন্যাকে জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেন এবং তাঁর কৃত পাপ অর্থ সম্পদ দ্বারা হিন্দু সমাজের সমাজপতি পণ্ডিতগণকে নিমন্ত্রণ করলেন পার্বত্য ডোমজাতি বল্লালসেনের ছোয়ায় ব্রাহ্মণ জাতিতে পরিণত হল বল্লালসেনের চরিত্র ছিল নারীহরণ ব্যাভিচার দোষে কলুষিত যে সব ব্রাহ্মণগণ তাকে মান্য করলেন তিনি তাদের কুলীন উপাধি দিলেন
……..ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় শূদ্রের মুণ্ডপাত করে নিজের পাপাচার ক্ষমতাকে হিন্দু সমাজের মধ্যে স্থায়ী আসন দেওয়ার জন্য তাঁর পোষা পুরোহিতদের ব্যবহার করেন এবং হিন্দু সমাজের মধ্যে বর্তমান বিভেদ-বৈষম্য, ছুৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা, জাতভাগ, হিংসা, ঘৃণা এবং বর্তমান সময়ে ধর্মের নামে সকল প্রকার পাপাচারের জন্মদাতা তিনি তাই হিন্দু সমাজ বর্তমানে প্রায় পঙ্গু
কে এই রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ? একে রামে রক্ষে নেই তায় সুগ্রীব দোসর ! রাজা বল্লালসেনের কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন মানবসমাজকে চিতায় তুলে দিলেন এবং এরপর রঘুনন্দন সেই মানবসমাজের চিতায় অগ্নিসংযোগ করে ভস্ম করার দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন নবদ্বীপে ভগ্ন-কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরে রঘুনন্দন ভট্টাচার্য জন্ম গ্রহণ করেন সমাজরক্ষার ধুয়ো তুলে তিনি একটিঅষ্টাবিংশতিত্ত্ব স্মৃতিরচনা করে ফেললেন ব্রাহ্মণদের প্রধান্য বিস্তার করার জন্য তিনি ঘোষণা করলেন -- “যুগে জঘন্যে দ্বিজাতি ব্রাহ্মণ শূদ্র এবহি অর্থাৎ- কলিযুগে মাত্র দুটি জাতি আছে একটি ব্রাহ্মণ অপরটি শূদ্ররঘুনন্দন ক্ষুরধার ফতোয়া দিয়ে হিন্দু সমাজের ক্ষত্রিয় বৈশ্য সমাজকে বিলুপ্ত করলেন তার লেখনিতে বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাখ, পাল, সাহা, কুন্ডু, নাপিত সহ সকল শ্রেণির হিন্দুমানুষ বল্লালসেনের গড়া জাত বিভাগে সবাই শূদ্র শ্রেণিতে ঘোষিত হল রঘুনন্দন ব্রাহ্মণসমাজ যাতে সহজে শূদ্রদের শোষণ করতে পারে তার লেখনীর মাধ্যমে নানাবিধ ব্যবস্থা করে দিলেন ব্রাহ্মণ সমাজ রঘুনন্দনের নববিধান মুঠোয় পেয়ে শূদ্র জাতিকে শোষণের জন্য তৎপর হয়ে উঠল  শ্রাদ্ধ, বিবাহ, পঞ্চামৃত, সাধভক্ষণ, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, পুকুরখনন, গৃহপ্রবেশ, বিদেশযাত্রা, পুজো-পার্বন, তিথি, নক্ষত্রদোষ প্রভৃতি কাজে ব্রাহ্মণের খাজনা বা তোলা চাই শূদ্রের কাছ থেকে মৃত যজমান শ্মশানে চলেছে, সেখানেও ব্রাহ্মণের খাজনা আদায় যজমান মৃত মাতা-পিতার বা পুত্র-কন্যার শোকে পাগল, ব্রাহ্মণ চোদ্দো পুরুষের পিণ্ডদানের ফর্দ করে শোকাতুর যজমানের শোকের অবসরে যজমানকে লুণ্ঠন শোষণ করে, রাস্তার ভিখারিতে পরিণত করে কেন-না ভিক্ষা করে হলেও ব্রাহ্মণদের আবদার পূরণ করতে হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে মৃতদের স্বর্গে বসবাসের জন্য কত রকমের ব্যবস্থা, কত রকমের ফন্দিফিকির তার বদলে মোটা অঙ্কের দক্ষিণা, যতটুকু তিল ততটুকু স্বর্ণ, জমি, সবৎস গাভী, ষোড়শ দান, পাত পেড়ে ভোজ সারা ইত্যাদি প্রাপ্তি শোষণের করতে করতে লোভ এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে ব্যক্তির পরমাত্মীয়র মৃত্যু হওয়ার কারণে পেট ভরতি করে চব্যচোষ্য ভোজ করার মতো অমানবিক নিষ্ঠুর প্রথা চালু করা বিয়ের আনন্দে ভোজ খাওয়া যেতেই পারে, সন্তান প্রথম ভাত খাচ্ছে সেই আনন্দেও ভোজ চলতেই পারেতাই বলে কারোর প্রাণপ্রিয় আত্মীয়ের মৃত্যু হলে সেই আনন্দে ভোজ খাওয়া যায়? মৃত্যু কি আনন্দের বিষয় ! কারোর আত্মীয়-বিয়োগ হলে কি সেই আনন্দে মিষ্টিমুখ করা যায় ! মৃতদেহ সৎকার(দাহ বা কবর)করার আর কোনো কাজ থাকে না তারপর যাঁর শোক সেই- বহন করে, আর কেউ নয় বেদ তো তাই- বলে শ্রাদ্ধ মানে শ্রদ্ধা জানানো, মস্তক মুণ্ডন করে গণ্ডায়পিণ্ডায় গেলানো নয় আমরা যাঁরা শ্রাদ্ধের ভোজ খেতে যাই, তাঁরা কোন্ আনন্দে সেজেগুজে মৃতব্যক্তির বাড়ি গিয়ে মুখে অন্ন তুলি ! নিজেকে অসভ্য, বর্বর বলে মনে হয় না! না, মনে হয় নামনে হয় না বলে আমরা শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে ত্রুটি খুঁজি, রান্নার ভালো-মন্দের চর্চা করি, আপ্যায়নের বিচার করি
শূদ্রেরা মনে করেন ব্রাহ্মণরাই ব্রাহ্মণ-পুরোহিতরাই মানুষকে স্বর্গে পাঠানোর ঠিকা পেয়েছেন মনে করেন ব্রাহ্মণের হাতেই মৃতব্যক্তির স্বর্গ নরক ব্রাহ্মণের দাবি মেটালে স্বর্গ, না-মেটালে অবশ্যই নরকে ঠাঁই শূদ্রের মাথায় ব্রাহ্মণের পা না-চড়ালে স্বর্গ কোথায় ! ব্রাহ্মণের কাছে মাথা নত করলেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়, সব পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় রঘুনন্দন এবার তার ভেদনীতি আরও বিস্তার করলেন বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাখ থেকে ডোম, মেথর পর্যন্ত, সকলকেই তিনি ব্রাহ্মণের দাস, শূদ্র বা গোলাম বলে ঘোষণা করলেনতারপর তিনি শূদ্রদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিকে সৎ বা অসৎ শূদ্র বলে ঘোষণা করলেন রঘুনন্দনের প্রদত্ত উপাধি আবার কোনো কোনো শূদ্র খুব গর্বভরে গ্রহণ করেলেনভাবতে থাকলেন আমি অন্য শূদ্রদের থেকে একটু ভালো, কারণ আমি কুলীন শূদ্র ব্রাহ্মণদের পদাঘাত নীরবে হজম করে শত শত শূদ্রগোষ্ঠী বা গোলামগোষ্ঠী অন্য শূদ্র বা গোলামদের উপর অত্যাচার শুরু করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করল না তারা ভুলে গেলেন যে – ‘আমরা সকলেই শূদ্রশ্রেণি তথাকথিত ব্রাহ্মণদের চোখে ভুলে গেল বিয়ে, শ্রাদ্ধ, পুজো-পার্বন ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে শূদ্রদের বসার আসন ব্রাহ্মণদের আসন থেকে সর্বদা আলাদা রাখা হয় অবমাননার এখানেই শেষ নয় যেমন -- শূদ্রের সামনে দেবতাকে ভোগ দেওয়া যাবে না শূদ্রের সৎকারে  কোনো ব্রাহ্মণ অংশগ্রহণ করতে পারবে না, অন্যথায় ব্রাহ্মণের ব্রহ্মত্ব নষ্ট হবে ব্রাহ্মণদের হুঁকোয় শূদ্র শ্রেণির মানুষ তামাক পান করতে পারবে না স্বামী বিবেকানন্দের বাড়িতে বৈঠকখানায় বাবার বিভিন্ন জাতের জন্য আলাদা আলাদা হুঁকো সাজানো থাকত পাছে জাত যায়, সেই কারণে কেউ কারোর হুঁকোয় মুখ দিতে পারত না বিবেকানন্দ স্বয়ং সবকটি হুঁকোয় মুখ দিয়ে টেনে দেখেছিলেন কীভাবে জাত যায় শ্মশানে শূদ্রের চিতা ভস্মের কাছাকাছি ব্রাহ্মণদের শবদাহ নৈব নৈব শূদ্রের বেদে গায়ত্রী মন্ত্রে অধিকার নেই ; শূদ্র ওম স্বধা বা স্বাহা প্রভৃতি বেদমন্ত্র উচ্চারণ করবে না ব্রাহ্মণ শূদ্রের বাড়ির কোনো দেবতাকে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে পারবে না, কারণ শূদ্রের বাড়ির দেবদেবীও শূদ্রকোনো পুরোহিত  শালগ্রাম শিলা নিয়ে কোনো শূদ্রের বাড়ি যাবে না, গেলে সেই বিগ্রহকে প্রায়শ্চিত্ত করে ঘরে তুলতে হবে শূদ্রের খাবার গ্রহণ করলে পাপ হয় শূদ্রের বাড়ির পুজোর ভোগ শূদ্রান্ন, তাই কোনো অজুহাতেই এই খাবার গ্রহণ করা যাবে না কোনো শূদ্র প্রতিমা বা ঠাকুরের মূর্তিকে স্পর্শ করবে না, অন্যথায়  মূর্তিরূপ দেবতার অশুদ্ধ হয়ে যাবে, জাতিপাত হবে আহা রঘুনন্দন বাবা, আপনি কত মহান !!! আপনার সেই অসন্মানের ধ্বজা আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি পরম আনুগত্যতায়
উচ্চ বর্ণবাদ-বিরোধী অনেক আন্দোলন ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে হয়েছে বাংলাতেও কম হয়নি কয়েকটি আমি আগেই উল্লেখ করেছিসেইসব আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চায় অনালোচিত থেকে গেছে অনেক আন্দোলনতাই বলে আন্দোলন থেমে থাকেনিএমনই এক আন্দোলনের নাম মতুয়া আন্দোলন, পতিত আন্দোলন মতুয়া আন্দোলনের স্রষ্টা হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরহরিচাঁদ ঠাকুর গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজের পতিত নিচুতলার মানুষদের জন্যই ধর্মীয় মতাদর্শগত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিণত হয়জাতি বর্ণ বিভক্ত হিন্দু সমাজ, অস্পৃশ্যতা এবং কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে নিবেদিত হয় মতুয়া ধর্ম আন্দোলনসমাজের এই জাতপাতভিত্তিক বিপর্যয়ের জন্য হরিচাঁদ ব্রাহ্মণ্যধর্মকেই দায়ী করেন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মই প্রধান নিয়ামক শক্তি তাই বর্ণবিভক্ত সমাজ ব্রাহ্মণ্যধর্মকেই তিনি বেছে নেন আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবেএর আগে তথাকথিত নিচুজাতের কোনো নিজস্ব কোনো ধর্ম ছিল না হরিচাঁদই এইসব অন্ত্যজ অনুন্নত শ্রেণির মানুষদের জন্য নিজস্ব মতুয়া ধর্ম প্রচলন করেনধর্ম-কর্মে যাঁরা মাতোয়ারা তাঁরাই মতুয়াহরিচাঁদহাতে কাম মুখে নামএই বাণীর মাধ্যমে বলেননমঃশূদ্ররা কারও চেয়ে হীন বা নিচ নয় কারও কাছে দীক্ষা নিয়ো না বা তীর্থস্থানে যেয়ো নাঈশ্বর সাধনার জন্য ব্রাহ্মণদের প্রয়োজন নেইবাংলার নিম্নবর্ণের নমঃশূদ্র, কাপালি, পৌণ্ড্র, নোয়ালা, মালো মুচিদের মধ্যে মতুয়া আন্দোলন জনপ্রিয়তা লাভ করে অবশ্য এর প্রধান ভিত্তি হল নমঃশূদ্ররা সংখ্যার দিক থেকে নমঃশূদ্ররা ছিল পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বড়ো জনগোষ্ঠী হরিচাঁদের বার্তা কৃষিজীবী মৎস্য আহরণকারী নমঃশূদ্রদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল
না, এই অসন্মানের ধ্বজা : ভীমরাও রামজি আম্বেদকর বয়ে নিতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন, সোচ্চারেইবাবাসাহেব ভারতীয় ব্যবহারশাস্ত্রজ্ঞ (জ্যুরিস্ট), রাজনৈতিক নেতা, বৌদ্ধ আন্দোলনকারী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, বাগ্মী, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবী বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী এবং ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন, কিন্তু ইনি গরীবমহরপরিবারে (তখন অস্পৃশ্য জাতি হিসাবে গণ্য হত) জন্মগ্রহণ করেন আম্বেদকর সারাটা জীবন সামাজিক বৈষম্যতার, ‘চতুর্বর্ণ পদ্ধতিহিন্দু সমাজের চারটি বর্ণ এবং ভারতবর্ষের অস্পৃশ্য প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন অস্পৃশ্য আম্বেদকরও জাতিবৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন অন্যান্য অস্পশ্যদের সঙ্গে আম্বেদকরও বিদ্যালয়ে যেতেন, কিন্তু তাদের আলাদা করে বসতে দেওয়া হত ক্লাসঘরে এবং শিক্ষকগণ দ্বারা অমনযোগী অসহায়ক ছিলেন তাদের শিক্ষাকক্ষের ভিতরে বসার অনুমতি ছিল না, এমনকি তাদের যদি তৃষ্ণা পেত উচ্চশ্রেণির কোনো একজন উঁচু থেকে সেই জল ঢেলে পান করাত, কারণ নিন্মশ্রেণিদের জলস্পর্শ করার কোনো অনুমতি ছিল নাপরবর্তী সময়ে আম্বেদকরের প্রসিদ্ধি এবং অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় সমর্থনের কারণে, তাঁকে ১৯৩২ সালে লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে (Second Round Table Conference) আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলমহাত্মা গান্ধি অস্পৃশ্যদের জন্য গঠিত পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করেন, যদিও তিনি অন্য সকল সংখ্যালঘুদের যেমন মুসলমানদের শিখদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী (Separate Electorate) বিনাদ্বিধায় মেনে নেন এই বলে যে, তিনি অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের গঠনকৃত নির্বাচকমণ্ডলী হিন্দু সমাজকে ভবিষ্যতে বিভক্ত এবং উচ্চশ্রেণির ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে ১৯৩২ সালে যখন ব্রিটিশরা আম্বেদকরের সঙ্গে একমত হন এবং পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীদের ঘোষণা করেন, তখন মহাত্মা গান্ধি পুনের এরোদা কেন্দ্রীয় কারাগারে (Yerwada central jail) শুধুমাত্র অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতি উপবাস শুরু করেন গান্ধির এই উপবাস (fast) ভারতজুড়ে বেসামরিকদের মাঝে প্রবল বিক্ষোভের উদ্দীপনা জোগায় এবং ধর্মীয় গোঁড়াবাদী নেতারা (Orthodox Politicians), কংগ্রেস নেতারা কর্মীদের মধ্যে মদনমোহন মালব্য পালঙ্কর বালো তাঁর সমর্থকরা আম্বেদকরের সহিত এরাভাদে (Yeravada) যৌথ বৈঠক করেন গান্ধিবাদীদের প্রবল চাপের মুখে (Massive coercion) এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিশোধ (Communal reprisal) অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কে নির্মূলীকরণের আশংকায় আম্বেদকর পৃথক নির্বাচকমন্ডলী বাতিল করতে সম্মত হন এই চুক্তির পরে গান্ধি উপবাস পরিত্যাগ করেন, ইতিহাসে এটি পুনে চুক্তি নামে পরিচিত চুক্তির ফলশ্রুতিতে, আম্বেদকর পৃথক নির্বাচকমন্ডলী গঠনের দাবি ছেড়ে দেন যা আম্বেদকর গান্ধির সঙ্গে বৈঠকের আগে ব্রিটিশ সাম্প্রদায়িক কর্তৃক শর্ত সাপেক্ষে মঞ্জুর করে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন অস্পৃশ্যদের জন্য সংরক্ষিত হয় এই চুক্তিতে যাকে বলা হয় অস্পৃশ্য সম্প্রদায় (Depressed Class)
বাবা সাহেবের প্রথম স্ত্রী রামাবাই দীর্ঘ অসুস্থতার পরে মৃত্যুবরণ করেন অসুস্থ অবস্থায় তাঁর স্ত্রী রামাবাইয়ের পান্দরপুর তীর্থে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন কিন্তু আম্বেদকর তাঁকে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, তিনি তাঁকে বরং একটি নতুন পান্দরপুর বানিয়ে দিবেন হিন্দু পান্দরপুরের পরিবর্তে - যেটা কি না তাদের অস্পৃশ্য বলে গণ্য করে ১৩ অক্টোবর নাসিকের কাছে ঈওলার বৈঠকে বক্তব্যে আম্বেদকর তাঁর ভিন্ন ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার অভিপ্রায় ঘোষণা করেন এবং তাঁর অনুগতদেরও হিন্দুধর্ম ত্যাগে প্রণোদিত করেননিউইয়র্কে লিখিত গবেষণালব্ধ উপাত্তের ভিত্তিতে একই বছর তিনি তাঁর বই দ্য এননিহিলেশন অব কাস্ট প্রকাশ করেন ব্যাপক জনপ্রিয় সাফল্যে অর্জনের পর, আম্বেদকর গোঁড়াবাদী ধর্মীয় নেতাদের এবং নিন্ম সাধারণের জন্য অস্পৃশ্য, বর্ণপ্রথার তীব্র সমালোচনা করেনকংগ্রেস গান্ধি অস্পৃশ্যদের প্রতি যা করেছিল, আম্বেদকর কপটতার সহিত তীব্রভাবে গান্ধী কংগ্রেসকে আক্রমণ করেন তাঁর কাজের মধ্যেকারা শূদ্র ছিল ?”তে (Who were Shudras?) বর্ণনা করতে চেষ্টা করেন শূদ্র বর্ণ গঠিত হয় অর্থাৎ পুরোহিত তন্ত্রের হিন্দু বর্ণ প্রথার (Hierarchy of Hindu Caste System) নিন্মবর্ণ গঠনের উপর আলোকপাত করেন তিনি এও উল্লেখ করেন শূদ্র কীভাবে অস্পৃশ্য থেকে আলাদা তিনি সারা ভারতের সিডিউল কাস্টেস ফেডারেশনে তাঁর রাজনৈতিক দল বদলে তদারকি করেন, যদিও তা ১৯৪৬ সালে ভারতের সংবিধান পরিষদের নির্বাচনে ভালো করেনি পরিশিষ্ট লিখতে গিয়ে ১৯৪৮ সালে আম্বেদকর হিন্দুবাদকে কর্কশ ভাষায় সমালোচনা করেন তাঁরদ্য আনটাচেবলস : থিসিস অন দ্য অরিজিনস অব আনটাচেবলিটি”-তে এভাবে – “The Hindu Civilisation.... is a diabolical contrivance to suppress and enslave humanity. Its proper name would be infamy. What else can be said of a civilisation which has produced a mass of people.... who are treated as an entity beyond human intercourse and whose mere touch is enough to cause pollution?”  অর্থাৎ হিন্দু সভ্যতা.... হচ্ছে মানবতাকে দমন এবং পরাভূত করতে একটি পৈশাচিক কৌশল এর প্রকৃত নাম হবে সামাজিক কুখ্যাতি কাকে সভ্যতা বলে ডাকা যায়, যার একগাদা মানুষ...., যাদের সত্ত্বা মানব সম্পর্কের নীচে গণ্য হয় শুধু যাদের ছোঁয়া দূষণের জন্য যথেষ্ট ?”
এত কিছু করেও কি বাবা সাহেব সমাজকে বদলাতে পেরেছে ? না, পারেনি সমাজ যেখানে ছিল সেখানেই আছে কারণ বাবা সাহেবের বার্তা দেশের সর্বত্র পৌঁছায়নি কারণ সদিচ্ছার অভাব জাতপাতকে সামনে রেখে ভারতীয় রাজনীতিকদের নোংরা রাজনীতি
ভারতে প্রথম জনগণনা হয় ১৮৭২ সালে সেখানে নমঃশূদ্রদের কোনো উল্লেখ ছিল না তখন তাদের বলা হতচণ্ডালবাচোঙঅবশ্য ১৯১১ সালের জনগণনায় অবমাননাকরচণ্ডালনামের অবলুপ্তি ঘটে জনগণনায়চণ্ডালনামের অপসারণ ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু অস্পৃশ্যতা আজও ঘোচেনি চণ্ডাল একটি বল-বীর্য সমন্বিত অর্থ দ্যোতক শব্দ চণ্ডের সঙ্গে জাতিসূচক আলপ্রত্যয় যুক্ত হলে চণ্ডাল হয় এমনিভাবে লাঙ্গল, জোঙ্গাল, জঙ্গল, ডাঙ্গাল, বহাল, খেড়ওয়াল, সাঁওতাল, বঙ্গাল প্রভৃতি আদি অস্ট্রাল শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলেই চণ্ডালশব্দের গুণগত এবং অর্থগত অভিব্যক্তিটি যথার্থ প্রতিভাত হয়ে উঠবে ঋকের অনেকগুলি শ্লোকের রচয়িতা বিশ্বামিত্র ছিলেন চণ্ডাল গুহক চণ্ডাল, রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি অনন্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ জাতক কাহিনিতে বোধিসত্ত্বকে সততার প্রতীক হিসেবে চণ্ডালবলে আখ্যায়িত করা হয়েছে বহুবার কার্যসিদ্ধির জন্য সুদাস, মনু, অগ্নী, বরুণ প্রভৃতি দাস বা অসুর নেতাদেরও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত বৈদিক সাহিত্যে অর্থাৎ রক্ষস (পরবর্তীকালে রাক্ষস বলা হয়েছে), অসুর, নাগ, চণ্ডাল শব্দগুলি কোনোভাবেই ঋণাত্মক নয় -- বরং গুণবাচক এবং ধ্বনাত্মক  অন্যদিকে নমঃশূদ্রশব্দটি একেবারেই অর্বাচীন ব্রিটিশ আমলের আরোপিত হীনাত্মক শব্দ
১৯১১ সালের সেন্সাসে বাঙলার জাতিগুলির মধ্যে নাম পরিবর্তনের একটা হিড়িক তৈরি করা হয়েছিল ছোটজাতগুলিকে হিন্দুভুক্ত করার জন্য বাংলার তৎকালীন দিকগজ পণ্ডিতদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতোজাতির উন্নয়ননামক গালভরা নামকরণের আড়ালে তারা বিজ্ঞাপন জারি করেছিলেন প্রায় চল্লিশজন নামকরা মহাপণ্ডিত এই বিজ্ঞাপনে সই করে লিখেছিলেন – “The caste called Namasudra is Brahmin by origin beging descended from the great Brahmin, Kashypa and not ‘Chandal’” শুধু চণ্ডাল নয়, এই হিড়িকে সামিল হয়েছিল বাংলা, বিহার আসামের তথাকথিত ছোটোজাতেরা আবেদনপত্রের ওজন ছিল দেড় মন চণ্ডালেরা চেয়েছিল নমঃ ব্রাহ্মণ নাম, কোচরা চেয়েছিল ক্ষত্রিয়, বৈদ্যরা চেয়েছিল ব্রাহ্মণ, কাপালিরা চেয়েছিল বৈশ্যকাপালি, বাগদিরা চেয়েছিল ব্যগ্রক্ষত্রিয়, হাঁড়িরা চেয়েছিল ক্ষত্রিয়, সুবর্ণ বণিকেরা চেয়েছিল বৈশ্য আর পোদরা চেয়েছিল পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় বিহারের ভূমিহারেরা হল ব্রাহ্মণ কায়স্থরা প্রথমে শূদ্র পরে ক্ষত্রিয় দুসাদেরা দাবি করেছিল ক্ষত্রিয়ত্বের এর আসল কারণ ছিল আইন সভায় সংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব করা বিংশ শতকের শেষ দশকে আগা খাঁ ভাইয়েরা যখন সঠিকভাবে লোক গণনার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছিলেন এবং বারবার প্রমাণ দাখিল করছিলেন যে, হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল, সাঁওতালরা কেউই হিন্দু নয়যাই হোকজাতির উন্নয়ন' নামে তৎকালীন ছোটোজাতগুলির মধ্যে হিন্দুকরণের হিড়িক পড়ে যায় ব্রাহ্মণের আইনসভায় যাওয়ার প্রতিনিধি সংখ্যা বাড়ে কিন্তু জাতিগুলি সিডিউল্ড তালিকা ভুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণের স্থায়ী দাসে পরিণত হয়ে যায় ১৯১১ সালের সেনসাসে স্বাধীন বোধি চিত্তসম্পন্ন একটি প্রাগ বৈদিক জাতি শূদ্রত্বে উন্নীত হয়
নমো বা নম নামের বিসর্গীকরণ () হয়েছে নমঃশূদ্র নাম হওয়ার পরে সেনসাসে নমোরা চণ্ডাল থেকে নমঃশূদ্র হয়েছে ১৯১১ সালে নমো নেতারানমোনামটি উদ্ধার করতে অনেক সংগ্রাম চালিয়েছেন কিন্তু সর্বপ্রথম দলবদ্ধভাবে আন্দোলন হয় ১৮৭২ সালে প্রথম লোকগণনাতে বাংলায় নমোরা চণ্ডাল নামে চিহ্নিত হয়েছেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আগমনের পর, শুধুমাত্রনিন্দাসূচকবাক্য হিসাবেই কারণ সম্পদ সৃষ্টিকারী এই সুবিশাল জনগোষ্ঠীর তথাকথিত কোনো ধর্ম ছিল না নমো নেতারানমোনামটি উদ্ধার করতে অনেক সংগ্রাম চালিয়েছেন কিন্তু সর্বপ্রথম দলবদ্ধভাবে আন্দোলন হয় ১৮৭২ সালে প্রথম লোকগণনাতে
তথাকথিতধর্মছিল না, তাই কোনো তথাকথিত ধর্ম মানার দায়ও এই গোষ্ঠীর ছিল না তাই ব্রাহ্মণরাই তো বটেই, এমনকি বৌদ্ধরাও নিজ ধর্মে টানতে অসমর্থ হয়ে এই জাতিকেচণ্ডালনামে ভূষিত করেছিলেন ! অথচ চণ্ডাল একটি আর্যভাষী জনগোষ্ঠী, যারা উত্তর-পশ্চিম ভারতের লোক এবং ব্রাহ্মণ্যসমাজ কর্তৃক নিন্দিত বাংলায় ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণ বা অন্যান্যরা যে নমো নরগোষ্ঠীর লোক সে-কথা নৃ্তাত্ত্বিক পরিমিতিতেও পাওয়া গেছেরোমিলা থাপার বলেছেন, ভারতীয়রা যে হিন্দুতাঁরা জানতেই পারতেন না, যদি গ্রিকরা সমুদ্রপথে পূর্বদিক থেকে আক্রমন করতেন তখন তাদের সিন্ধুনদী অতিক্রম করতে হত না, আর গ্রিক উচ্চারণেসিন্ধুনদীহিন্দুহত না ভারতীয়রা হিন্দুহওয়ার পরে সবচেয়ে বড়ো হিন্দু সেজেছেন ব্রাহ্মণরা (আমার অন্য একটি প্রবন্ধে জনৈক ব্রাহ্মণ-পাঠক সরাসরিই বলেছিলেনব্রাহ্মণরাই সনাতন ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে’) -- অবশ্যই নিজেদের স্বার্থে এবং গ্ণসমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যেই যে লক্ষ্যে তারা ১০০ ভাগ সফল, একথা বলাই বাহুল্য ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সৃষ্টির জন্য বল্লালসেন যখন বাংলায় বৌদ্ধদের কচুকাটা করে জাতপাত সৃষ্টি করেন, তখনও নমোরা তার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি রাষ্ট্রশক্তির বহির্ভূত হয়েও এই জাতি ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার প্রতিরোধ সংগ্রাম করেছিলেন পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে সেইসব আর্য-অনার্যদের যুদ্ধ বা সংগ্রামের কাহিনিই স্বর্ণাক্ষরে বর্ণিত আছেবলা হয়, আমীষভোজী এই নমোগোষ্ঠী জৈবিক জীবনযাপনে যেমন বৌদ্ধ হতে পারেন না, তেমন মানবিক কারণে ব্রাহ্মণ হওয়াও সম্ভব নয় তাহলে কীভাবে নমোদের নামের সঙ্গে শূদ্র যোগ করে তাদেরকে হিন্দু করা হল ? ‘আত্মসমর্পণ না-করাএই নমোগোষ্ঠীকেচণ্ডালনামে নথিভূক্ত করে রেখেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদীরা
বড়োলাট ওয়াভেল সকাশে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় হিন্দু অস্পৃশ্যদের কংগ্রেসী নেতা বাবু জগজীবন রাম আবেদন জানানইংরেজদের উচিত আরও দশ বছর ভারতে তাদের দখল কায়েম রাখাকারণ ইংরেজদের অবর্তমানে বর্ণহিন্দুরা নীচুজাতের মানুষদের উপর নিপীড়ন আর অত্যাচার আরও বাড়িয়ে দেবে (ক্ষমতা হস্তান্তর দেশবিভাগলাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পৃষ্ঠা )বাবু জগজীবন রামের এই বয়ান থেকে আন্দাজ করা যায়, মহাত্মা গান্ধির হরিজনদের দুর্গতি ছিল কতটা অসহনীয় সেই কারণেই বাবু জগজীবনের কাছে কংগ্রেসী শাসনের অপেক্ষা পরাধীনতা তথা ইংরেজদেরন্যায় বিচারঅধিকতর গ্রহণীয় ছিলঅস্পৃশ্য সমাজের নেতা আম্বেদকর গান্ধি প্রদত্তহরিজনঅভিধাকে অভিহিত করেছিলেনরাজনৈতিক অনুকম্পাবলে আজও অস্পশ্যতা আইনত দণ্ডনীয় হওয়া সত্ত্বেওগণতান্ত্রিকসেকুলারভারতে নির্বাচনের মরশুমে দেখা যায়রাজনৈতিক অনুকম্পা’- মহোৎসবস্বাধীনোত্তরসেকুলারভারতে মন্দির অপবিত্র করার অছিলায়হরিজনবধ তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাপ্রকৃত ধর্মহীন বা সেকুলার মতাদর্শ আমাদের সমাজ প্রগতির শর্ত সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির বিলোপসাধন করবেন না কারণ এই ব্যবস্থাই তাঁদের পুষ্টিসাধন করেগান্ধিজি বললেন – “অস্পৃশ্যতা বিলুপ্ত হবেই, কারণ হিন্দুধর্ম বাঁচবে, আর যদি অস্পৃশ্যতা দূর না-হয় তাহলে হিন্দুধর্ম অবলুপ্ত হবেবাবা সাহেবও একই সুরে বলেছিলেন – “হিন্দুসমাজ যদি জাতব্যবস্থা মুক্ত না-হয়, তবে তারা নিজেদের রক্ষা করার শক্তি অর্জন করতে পারবে নাডঃ আম্বেদকর আরও বলেছেন – “আজ প্রয়োজন সমস্ত নির্যাতিত বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের একত্রিত হয়ে ভারতের মাটি থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল উৎপাটন করে ফেলা অন্যথায় তারা মানুষের অধিকার নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না" একুশ শতকের ভারতে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সমাজজীবনে আজও কিন্তু অস্পৃশ্যতার প্রতাপ খর্ব করা যায়নি হিন্দুধর্মের অচলায়তন পূর্ববৎ স্থানুই রয়ে গেছে
১৯৫০ সালে সংবিধানে বিবৃত ১৭ নম্বর ধারা বলে সারা ভারতে অস্পৃশ্যতার বিলোপসাধন করা হয় কিন্তু হিন্দুত্বের জগদ্দল পাথরে কোনো আঁচড় পড়ল না তাতে ১৯৯২ সালের ১৬ আগস্ট, চুনি কোটালকে মনে পড়ছে ?  পশ্চিম মেদিনীপুরের দলিত আদিবাসী লোধা সবর সমাজের মেয়ে চুনি তিনিই সবরদের প্রথম গ্রাজুয়েট নিজ সমাজকে অশিক্ষার অন্ধকার থেকে টেনে বের করে আনার ব্রত নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি জাতপাতের প্রবর্তক সমাজপতিরা ইউনিভার্সিটিতে তাকে এই সমাজপতিদের কঠিন বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়  একজন শিক্ষিতা সমাজ সচেতনার প্রতি শুধু আদিবাসী হওয়ার কারণে দেশের সমাজপতিদের এই বৈষম্যমূলক আচরণ, অসহযোগিতা তিনি মেনে নিতে পরেননি ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার প্রতি ধিক্কারে, ক্ষোধে, দুঃখে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন  স্বাধীনতা দিবসের পরের দিনে চুনি কোটাল জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেল এদেশের দলিত আদিবাসী মূলনিবাসীদের বর্ণবৈষম্যের নিপীড়ন থেকে আজও মুক্তি দেয়নি ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ব্রাহ্মণ্যবাদের বলি হলেন অন্ত্যজ চুনি কোটাল যাদের জন্য যাদের প্ররোচনায় চুনি কোটাল আত্মহত্যা করলেন তাদের কোনো শাস্তি হয়েছে বলে আমি শুনিনি
ভারতীয় সংবিধানে জাতিভেদ কেন্দ্রিক অস্পৃশ্যতাকে নিষিদ্ধ করেছে, বলা হয়েছে --  Untouchability is abolished and its practice in any form is forbidden…… ‘untouchability’ shall be an offence punishable in accordance with law”. (The Constitution of India, Part III, Fundamental Rights) এই সংবিধান মোতাবেক ভারতের সমস্ত অঞ্চলের পুণ্যতীর্থ, দেবমন্দির, উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকল জাতের মানুষের কাছে সমানভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে অস্পৃশ্য দলিত শ্রেণির মানুষ ভারতের বিভিন্ন পুণ্যতীর্থে, দেবমন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে, শহর-নগরের পুষ্করিণী বা কূপের জল পান করতে পারবে, উচ্চবর্ণ মানুষের সঙ্গে একই বিদ্যালয়ে পাশাপাশি বসে শিক্ষালাভ করতে পারবে, একই কর্মক্ষেত্রে মিলিত ভাবে কাজ করতে পারবে, একই ভোজনালয়ে পাশাপাশি বসে পানাহার করতে পারবে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ভারত সরকার নিন্মবর্গের মানুষদের উচ্চবর্গে উন্নীত করার জন্য বিভিন্ন প্রকার উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা করেছে দলিত তপশীলদের (Schedule Caste) জন্য শিক্ষা জীবিকার ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রচলন করে তাদের শিক্ষাগত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটানোর প্রয়াসও রয়েছে
কতটা বদলেছে সমাজ ? কতটা বদলেছি আমরা ? সময়ের সংকটে কয়েকজন যুক্তিমনষ্ক মানুষদের কিছুটা বদলালেও এখনও দলিত শ্রেণির মানুষেরা তিমিরেই পড়ে আছেএখনও জাতির ক্ষেত্রে স্বজাতি বিবাহ শাস্ত্রসম্মত, উঁচু জাতির সঙ্গে নীচু জাতির বিবাহ গ্রহণ হয় নাআজও ব্রাহ্মণ-পুত্রসন্তান যদি কোনো শূদ্র-কন্যার বিবাহ হয় তাহলে তাকে শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে জাতিচ্যুত নাহলেও পরিবারচ্যুত হতে হয়খবরের কাগজেপাত্রপাত্রী চাইবিজ্ঞাপনে লক্ষ করুন কেমন জাতবিচারের ধূম ! চূড়ান্ত বজ্জাতি বজ্জাতি কি অশাস্ত্রীয় নয় ? কী বলছে শাস্ত্র ? একবার ফিরে দেখা যাক – “অথ ব্রাহ্মণস্য বর্ণানুক্রমেণ চতস্রো ভার্য্যা ভবন্তি ।।।। তিস্রঃ ক্ষত্রিয়স্য ।।।। দ্বে বৈশ্যস্য ।।।। এক শূদ্রস্য ।।।। -- অর্থাৎ ব্রাহ্মণ স্ববর্ণ ব্যতীত অন্য তিন বর্ণের কন্যাকে বিয়ে করতে পারবে ক্ষত্রিয়, বৈশ্যা শূদ্রাদের বিয়ে করতে পারবে; বৈশ্যেরও শূদ্রা বিবাহে কোনো আপত্তি নেই, শুধুমাত্র শূদ্ররাই শূদ্রা ভিন্ন অন্য কারোকেও বিয়ে করতে পারবে না তার মানে উচ্চবর্ণের বিয়েতে কোনো বাছবিচার নেই, তাদের বিয়ে সকল বর্ণের সঙ্গে হতে পারে তাহলে পাত্রপাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের এত জাতপাতের বিচার কেন আজও জারি আছে এটা কি হিন্দুদের শাস্ত্রের অবমাননা নয় ? অপরদিকে শূদ্রের পাত্ররা শূদ্র ব্যতীত অন্য কোনো উচ্চবর্ণের পাত্রীকে বিয়ে করতে পারবে না কারণ বিবাহ সূত্রে সেইসব উচ্চবর্ণের পাত্রীরা শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হবে ব্যবস্থা আজও মেনে চলা হয় আমাদের সমাজে সে কারণে নিন্মবর্ণ উচ্চবর্ণে উন্নীত হতে পারল না মনু বলেছেনযে স্বপত্নী শূদ্রাতে ব্রাহ্মণ ঔরসে জাতা কন্যা যদি অন্য ব্রাহ্মণ বিবাহ করে এবং তার কন্যাকে যদি অপর ব্রাহ্মণ বিবাহ করে এবং এমনভাবে ব্রাহ্মণ সংসর্গ যদি ধারাবাহিক সাতপুরুষ পর্যন্ত হয়, তবে ওই বর্ণ ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয় এবং এমনভাবে যেমন শূদ্র ব্রাহ্মণ হয়, তেমনই ব্রাহ্মণও শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়ভুলে গেলেন ব্রাহ্মণেরা, পিছিয়ে গেলেন শূদ্রেরাকোন্ এক অনৈতিক উদ্দেশ্যে ক্রমে ক্রমে শূদ্রের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ রহিত হয়ে গেল বললেন – “ব্রাহ্মণী ক্ষত্রিয়া বৈশ্যা ব্রাহ্মণস্য প্রকীর্ত্তিতাঃ।।/ক্ষত্রিয়া চৈব বৈশ্যা ক্ষত্রিয়স্য বিধীয়তে/বৈশ্যৈব ভার্য্যা বৈশ্যস্য শূদ্রা শূদ্রস্য কীর্ত্তিতাঃ।।শূদ্র সমাজশরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লতাদের আর বর্ণান্তর প্রাপ্তির সুযোগ থাকল না
মাঝেমাঝেই দেশনেতাদের মুখে শোনা যায়, শূদ্রদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্রমোন্নত করাই আমাদের সমাজের লক্ষ্য সেই আদর্শ তো ছিলই, সব ভুলে গেলেন কেন ? কিরকম সেই শিক্ষা ? “ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বিশস্ত্রয়োবর্ণা দ্বিজাতয়ঃ/শ্রুতিস্মৃতি পুরাণোক্ত ধর্ম্মযোগ্যাস্তুনেতরে।।/শূদ্রোবর্ণশ্চতুর্থোপি বর্ণত্বাদ্ধর্ম্মমর্হতি/বেদমন্ত্রস্বধা-স্বাহা বষট্কারাদিভিবিনা।।” – ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এই তিন জাতি দ্বিজশব্দবাচ্য এরাই শ্রুতি স্মৃতি পুরাণোক্ত ধর্মের অধিকারী অন্য জাতি নয় শূদ্রজাতি চতুর্থবর্ণ বলে ধর্মে অধিকারী, কিন্তু বেদমন্ত্র স্বাহা, স্বধা বষটকারাদি শব্দের উচ্চারণের অধিকারী নয়শুধু ধর্ম বিষয়েই নয়, লৌকিক বিষয়েও শূদ্রকে কোনো উপদেশ দিতে মনু নিষেধ করেছেন এই বলে – “ শূদ্রায় মতিং দদ্যাৎশাস্ত্রকারগণ খুবই ন্যায় বিচারক বলেন, ধর্মবেত্তাগণ তো সেটাই বলেন ! কেমন সেই ন্যায় বিচার ? চার বর্ণের একই অপরাধের শাস্তি চার প্রকারের ব্রাহ্মণগণের সত্য দ্বারা শপথ করলেই হত, ক্ষত্রিয় অশ্ব বা আয়ুধ দ্বারা এবং বৈশ্য গো, বীজ বা কাঞ্চন দ্বারা শপথ করত, কিন্তু এত অল্পে ছাড়া যায় না তাই শূদ্রের জন্য ফতোয়া – “অগ্নিং বা হারয়েদেনমপ্সু চৈসং নিমজ্জয়েৎ/পুত্রদারস্য বাপ্যেনং শিরাসিং স্পর্শয়েৎ পৃথক।।/সমিদ্ধো দহত্যগ্নিরাপো নোন্মজ্জয়ন্তি / চার্ত্তিমৃচ্ছতি ক্ষিপ্রং জ্ঞেয়ঃ শপথে শুচি।।অর্থাৎশূদ্রকে অগ্নিপরীক্ষা, জলপরীক্ষা কিংবা স্ত্রীপুত্রাদির মাথা ছোঁবে বা স্পর্শ করে পরীক্ষা করবে অগ্নি যাকে দগ্ধ না করে, জল যাকে না ভাসায় এবং স্ত্রীপুত্রাদির মাথা ছুঁলে শীঘ্রই কোনো যন্ত্রণা ভোগ না করেশপথ সম্বন্ধে সেই ব্যক্তিকে শুচি বলে জানবেশূদ্রের কী অবর্ণনীয় অবস্থা ! এখন এই ব্যবস্থার প্রচলন নেই ঠিকই, একদা এহেন ব্যবস্থা লাগু ছিল এটা ভাবলেই তো শিউরে উঠতে নয় মহামতি শাস্ত্রকারগণ এখানেই ক্ষান্ত হননি নির্দয় অপরাধপ্রবণ শাস্ত্রকারগণ শূদ্রদের আগুনে পুড়িয়ে আর জলে ডুবিয়ে মেরেও শান্তি পাননি তাঁরা টুঁ শব্দ করলেই শূদ্রদের হাত-পা কেটে নেওয়ার হুকুম দেওয়া হত, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কর্কশবাক্যে কথা বললে জিভ কেটে নেওয়ার আদেশ হত, ‘বামনা’ ‘বিটকেলবলে পালালে শূদ্রকে লোহার ডাণ্ডা ছুঁড়ে মারার কথা বলা হয়েছেশূদ্র যদি দর্পিতভাবে ব্রাক্ষণকে ধর্মোপদেশ করে, তবে রাজার সেই শূদ্রের মুখে কানে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হবে, শূদ্র যে অঙ্গ ব্যবহার করে শ্রেষ্ঠ জাতি ব্রাহ্মণকে মারবে রাজা তার সেই অঙ্গটাই কেটে ফেলে দেবেশূদ্র যদি উচ্চবর্ণের সঙ্গে একাসনে বসে তবে রাজা তার কটিদেশে গরম লোহার শালাকা দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, অথবা না-মরে যায় এমনভাবে তার পাছা দুটির মাংস কেটে দেওয়া হবে, শূদ্র যদি অহংকার করে ব্রহ্মণের গায়ে থুতু দেয় তাহলে রাজা তার ঠোঁট দুটো কেটে দেওয়া হবে, ব্রাহ্মণের গায়ে প্রস্রাব করে দিলে লিঙ্গ সমূলে কেটে দিতে হবে, ব্রাহ্মণের সামনে বাতকর্ম বা বায়ু নিঃসরণ করলে পায়ুপথ বা গুহ্যদেশ কেটে নেওয়া হবে শূদ্র যদি দ্বিজগণের ধন হরণ করে তবে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে, শূদ্র যদি বেদ শ্রবণ করে তাহলে রাজা সিসা ঢেলে তার কান বন্ধ করে দেওয়া হবে, বেদমন্ত্র উচ্চারণ করলে জিভ কেটে দেওয়া হবেব্রাহ্মণগণ শূদ্রদের শুধু  হাতে মেরেই তুষ্ট হতে পারেননি, ভাতে মারার ব্যবস্থাও করে রেখেছেনশক্তেনাপি হি শূদ্রেন কার্য্যে ধনসঞ্চয়ঃ/শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে।।”(মনুসংহিতা, দশম অধ্যায়, শ্লোক ১২৯, )
বর্ণ পিরামিডের উপরের স্তরে অবস্থানকারীরা শুদ্ধ বলে বিবেচিত এবং তাদের অসংখ্য পদবি আছে পিরামিডের নিচের অধিবাসীরা হলেন অচ্ছুৎ, তাদের কোনো পদবি নেই, কিন্তু অসংখ্য কর্তব্য আছে এই শুদ্ধ এবং অচ্ছুতের বিন্যাস উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পেশা এবং বর্ণভেদভিত্তিক বিশাল ব্যবস্থার অধীনে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ব্যবস্থা মানুষের উপকারী কার্যক্ষমতাকে হত্যা করে, পঙ্গু করে এবং ছিন্নভিন্ন করে দেয় নিম্নবর্ণের মানুষদের জোর করে একঘরে করে রাখা হত যে রাস্তা দিয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অস্পৃশ্যরা হাঁটতে পারতেন না গণকুপের জল পান করতে পারতেন না, হিন্দুমন্দিরে প্রবেশ করতে পারতেন না তাঁরা, উচ্চবর্ণের স্কুলে তাদের প্রবেশাধিকার ছিল না, নিন্মবর্ণের মানুষরা ঊর্ধ্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত করতে পারত না আম্বেদকর যে মাহার বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সেটি সহ কিছু নির্দিষ্ট বর্ণের লোকেদের তাদের কোমরে ঝাঁটা বেঁধে রাখতে হত, যাতে হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের ছাপ মুছে ফেলতে পারে আর-এক নিন্মশ্রেণিকে গলায় পিকদানি ঝুলিয়ে রাখতে হত তাদের মুখের দুষিত লালা সংগ্রহ করার জন্য উচ্চবর্ণের হিন্দুপুরুষের অবিসংবাদিত অধিকার ছিল অস্পৃশ্য নারীদের দেহের উপর রামায়ণ, মহাভারত সহ প্রাচীন সাহিত্যে এরকম প্রচুর ধর্ষণের কাহিনি পাই ভারতের অনেক অঞ্চলেই এখনও এসব ব্যবস্থা অনেকাংশে রয়ে গেছে বর্তমান জন্মের অবাধ্যতায় শাস্তির মেয়াদ বেড়ে যাবে অর্থাৎ পরবর্তী পুনর্জন্মে আর-একবার অস্পৃশ্য অথবা একজন শূদ্র হিসাবে জন্মাতে হবে তাই বিধিনিষেধ মানাটাই সর্বোত্তম

ক্রমশঃ- 

৪টি মন্তব্য:

  1. অসাধারন একটি নিবন্ধ পড়লাম । কপি করে রাখলাম (ব্লগ ও লেখকের নাম সহ ।) । চেনা জানা সবাইকে পড়াব বলে । লেখককে এমন সাহসী লেখার জন্য কুর্নিশ জানাই । এই লেখাটার বহুল প্রচার কাম্য ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ সমীরবাবু। অনুপ্রেরণা পেলাম। সঙ্গে থাকুন বন্ধু। ভালো লাগবে। আগের পর্বের লিংকটা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

      মুছুন
  2. অস্পৃশ্যনামা দ্বিতীয় পর্ব তো পড়লাম । প্রথম পর্বটার লিঙ্কও এখানেই দেওয়া হোক ।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র