শ্রাবনীড় (শেষ অংশ)
তিন
'তুই না বলেছিলি অফিসের ব্যাগ হল ছেলেদের চলমান সংসার! কিন্তু জেনে রাখো, তোমাদের টিয়াস্যার প্রমাণ রেখে খুন করেন না।'
'ওহ, কাম অন শ্রাবণী! ভদ্র আর সোজা-সাপটা ছেলেটাকে একটা ঘটনা দিয়ে বিচার করতে যাওয়া খুব ভুল হচ্ছে ।'
হ্যাঁ, ইয়ে, সেটা অবশ্য একহাত জিভ কাটার মতোই ঘটনা ছিল। কল্যাণীর কেরিয়ার ট্রেনিং কলেজে ফিজিক্স পড়াতে এসেছেন যে নতুন টিচার, টিকালো নাক আর বাচ্চাদের মত গোলাপি ঠোঁটের জন্য দুদিনের মধ্যে টিয়াস্যার নামে মশহুর হয়ে গেলেন। স্যার পড়ান তো ভালোই, কিন্তু সাবজেক্টের বাইরে কথা বলতে গেলেই চুপ, সাতবার খোঁচালে হয়ত একটা বাক্য বেরিয়ে আসে যার শব্দসংখ্যা তিনের বেশি হতে আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি। তবে ক্লাসে স্যারের চোখদুটো কম্পাসের কাঁটার মত মধুরা আর সঙ্গীতার মাঝাখানে গিয়ে স্থির। কেউ একটা প্রশ্ন ক’রে হয়ত কম্পাসটা নাড়িয়ে দিল, আবার ঘুরেফিরে ----- !
টিয়াস্যার চেয়ারে বসে প’ড়ে রুমালে নাক মুছলেন। ফর্সা নাকও গোলাপি হয়ে গেল। তারপর উঠে ফিরে গেলেন ব্ল্যাকবোর্ডে। লেখার সময় বোঝা যাবে, কম্পাস বা প্রজাপতি চোখ ছেড়ে ভর করেছে টিয়াস্যারের আঙ্গুলেও। তিরতির করে কাঁপছে তারা।
পরদিন শ্রাবণী এসে গেলে ছেলেমেয়েদের মাস্টার প্ল্যান তৈরি। টিয়াস্যার ঢুকলেন, একটু শুকনো শুকনো ভাব। টেবিল থেকে ডাস্টার তুলে অভ্যেসমত ব্ল্যাকবোর্ড সাফ করতে গেছেন, সারা ক্লাস চেঁচিয়ে উঠল --- মুছবেন না, স্যার !
কিন্তু না, লাইন দুটো নয় তো, ডাস্টার যত্ন করে মুছছে মিথ্যা শব্দের পাশের ফাঁকা জায়গা। তারপর খুব ধরে ধরে লেখা হল 'নহে' । বিস্ময়ের চিহ্ন দিলেন পাশটায়। তারপর মুখ নিচু করে বসে থাকা শ্রাবণীর দিকে অপলক দৃষ্টি পাতলেন। সমস্ত ক্লাস প্রথমে এক মিনিট শোকপালনের মত চুপ। তারপর ঝোড়ো হাততালি আর চিৎকার উঠল। সঙ্গীতা বাঁ কনুই দিয়ে বন্ধুকে প্রাণপণ ঠেলছে ।
কিন্তু কাল রাতে যখন আবার আলো তার অচঞ্চল হাতের পাতা রেখেছে কাঁধে, শ্রাবণী আবিষ্কার করল সে মুখ ঘুরিয়ে উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পড়েছে। নিজের বিচ্ছিন্নতার শক্তিতে নিজেই ভয় পেয়ে অবশেষে কথাও বলে ফেলল:
------- আমি কৃষ্ণনগর যাচ্ছি।
অসুস্থ মা বা অর্থশূন্য বাবাকে চিন্তায় ফেলে লাভ কী? সে বরং আলোর মাসিকে গিয়ে বলবে, সেই ধাই-মার মেয়ে তার পাঁচ ফুটিয়া মোটাসোটা চেহারাটি নিয়ে কেন ছায়া ফেলছে তাদের দাম্পত্যে? কেন তার সঙ্গে আলোর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠানোর গোপন বোঝাপড়া? হ্যাঁ, সবাই জানুক! মিথ্যে ব’লে বিনা দোষে কারও সঙ্গে প্রতারণা করলে শাস্তি পেতে হয়।
সাবধানী চোখে শুরু করেও আস্তে আস্তে আলোদ্যুতির দিনলিপির মধ্যে ডুবে যেতে লাগল শ্রাবণী। কথায় কাঁচা হতে পারে লোকটা, লেখাতে নয়! যে ভাষা তাকে কোনও দিন বলেনি আলো, অথচ শ্রাবণী আশা করেছে শুনবে, তেমনি বয়ানে ভরে আছে পাতার পর পাতা। কতদিন আগে সিকিমে ঝাউবন-ঘেরা পাহাড়ের মাথায় একটা গুম্ফার পাশে দুজনে গোটা বিকেল কাটিয়েছিল। আলো জানতে চেয়েছে, বুদ্ধমূর্তির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তুমি কী ভাবছিলে, শ্রাবণী? তারপর লিখছে, ওই বৃষ্টিভেজা পাহাড়ের পায়ের কাছে একটা ছোট্ট বাড়ি তৈরির কথা যার নাম সে রাখবে --- 'শ্রাবনীড়' ।
সবার আগে নিচের চিঠি-অংশে চোখ পড়েছে শ্রাবণীর, যেখানে শুধু 'শ্রীচরনেষু মা, আপনারা’-র বেশি লেখারফুসরত পায়নি । বাপরে, এ-যে দশ হাজার টাকার মানি অর্ডার! কোথায় পাঠাচ্ছে দ্যাখো তো? দইয়ের বাজার, কৃষ্ণনগর, জেলা: নদীয়া? শ্রাবণীর খুব চেনা ঠিকানা যে গো! নামটা কী লিখেছে দেখি ? শ্রী সুতনু বন্দ্যোপাধ্যায় ------ শ্রাবণী পরীক্ষার হলে ব’সে, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের লাইনে দাঁড়িয়ে, এমনকি ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের খাতাতেও এই নামটাই তো লিখেছে 'পিতার নাম' হিসেবে?
গান আর কান্নার দমকে কোথাও একটা মিল আছে, তাই না...!
শেষ পর্যন্ত পুরনো প্রস্তর যুগে বাস করা ভিনটেজ মডেল সঙ্গীতারই
জিত হল। 'তোর নিজের বরের
ব্যাগ খুলবি, কি তার ব্যাঙ্কের পাশবই দেখবি, এতে আবার লজ্জা পাবার কি আছে!
স্পেস দিবি পরীক্ষার খাতায় লেখার সময়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবার জায়গা ছাড়তে হয় নাকি?'
সে মধুরাকে কটাক্ষ করত। 'যারা স্পেস চায়,
তাদের লক্ষ্য সময় মত
ডিসপ্লেসড
হয়ে যাওয়া,
বুঝেছিস!'
গতকাল সন্ধ্যেবেলা আলোদ্যুতি
জীবনবীমা কোম্পানির সরখেলদার বাড়িতে গেলেই
গেটের ছিটকিনি লাগিয়ে শ্রাবণী আলোর কলেজের ব্যাগ নামিয়ে এনেছে। অতঃপর তার নানা রকম খোপ হাতড়ে কিছুই পাওয়া গেল না সন্দেহজনক। লেকচারারের মেয়ে সঙ্গীতার টিপস ছিল,
ব্যাগ খুঁজলে
পে-স্লিপ পাবিই। তাতে সব হিসেব মিলবে --- কত গ্রস মাইনে, কাটালো কত, কত ট্যাক্স দিচ্ছে, হাতে কত পায় ----। যত্তসব বাজে কথা! বইয়ের লিস্ট থেকে মুদি দোকানের ফর্দ
--- সব
ভুলভাল কাগজপত্র ব্যাগের ঠিক-ঠিক
জায়গায় তুলে রেখে সে মোবাইলের
রাইট মেসেইজ অপশানে গেল। একটু ঝাড় পাওনা হয়েছে সঙ্গীতার ।
'তুই না বলেছিলি অফিসের ব্যাগ হল ছেলেদের চলমান সংসার! কিন্তু জেনে রাখো, তোমাদের টিয়াস্যার প্রমাণ রেখে খুন করেন না।'
'ওহ, কাম অন শ্রাবণী! ভদ্র আর সোজা-সাপটা ছেলেটাকে একটা ঘটনা দিয়ে বিচার করতে যাওয়া খুব ভুল হচ্ছে ।'
'সোজা-সাপটা, না পাটি-সাপটা?'
'আচ্ছা! সব ভুলে গেলি এর মধ্যে?'
হ্যাঁ, ইয়ে, সেটা অবশ্য একহাত জিভ কাটার মতোই ঘটনা ছিল। কল্যাণীর কেরিয়ার ট্রেনিং কলেজে ফিজিক্স পড়াতে এসেছেন যে নতুন টিচার, টিকালো নাক আর বাচ্চাদের মত গোলাপি ঠোঁটের জন্য দুদিনের মধ্যে টিয়াস্যার নামে মশহুর হয়ে গেলেন। স্যার পড়ান তো ভালোই, কিন্তু সাবজেক্টের বাইরে কথা বলতে গেলেই চুপ, সাতবার খোঁচালে হয়ত একটা বাক্য বেরিয়ে আসে যার শব্দসংখ্যা তিনের বেশি হতে আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি। তবে ক্লাসে স্যারের চোখদুটো কম্পাসের কাঁটার মত মধুরা আর সঙ্গীতার মাঝাখানে গিয়ে স্থির। কেউ একটা প্রশ্ন ক’রে হয়ত কম্পাসটা নাড়িয়ে দিল, আবার ঘুরেফিরে ----- !
তো সেদিন শ্রাবণী নেই ক্লাসে। আজ সারাক্ষণ টিয়াস্যারের চোখ একবার ডানদিকে,
একবার বাঁ দিকে --- কিন্তু কোথাও ব্যথিয়ে যাওয়া ডানা মুড়ে বসতে পারছে না। তখন মধুরা চিমটি কাটল সঙ্গীতাকে,
মানে সাপোর্ট দিস।
--- স্যার আজ তো
শ্রাবণীর পাকাদেখা, তাই ছাড়া পায়নি বেচারা!
--- হ্যাঁ স্যার, পাত্র বহরমপুর হাসপাতালের ডাক্তার।
----- হ্যাঁ স্যার, এমাসেই বিয়ে, পঁচিশে চৈত্র।
টিয়াস্যার চেয়ারে বসে প’ড়ে রুমালে নাক মুছলেন। ফর্সা নাকও গোলাপি হয়ে গেল। তারপর উঠে ফিরে গেলেন ব্ল্যাকবোর্ডে। লেখার সময় বোঝা যাবে, কম্পাস বা প্রজাপতি চোখ ছেড়ে ভর করেছে টিয়াস্যারের আঙ্গুলেও। তিরতির করে কাঁপছে তারা।
পরদিন শ্রাবণী এসে গেলে ছেলেমেয়েদের মাস্টার প্ল্যান তৈরি। টিয়াস্যার ঢুকলেন, একটু শুকনো শুকনো ভাব। টেবিল থেকে ডাস্টার তুলে অভ্যেসমত ব্ল্যাকবোর্ড সাফ করতে গেছেন, সারা ক্লাস চেঁচিয়ে উঠল --- মুছবেন না, স্যার !
এবার একজন ছাত্র পেছন থেকে
-----
----- ওখানে একটা তথ্য জানানো হয়েছে। সে ব্যাপারে আপনার মতামত পেলে
ভাল হয়।
তিনি একটু অবাক হয়ে আবার ফিরলেন বোর্ডের দিকে। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে ঘোষণা
----
টিয়াস্যার শ্রাবণীকে ভালবাসিয়াছে।
সময় থমকে গেল মফস্বল বাংলার বসন্ত শেষের সেই দুপুরে। স্যার অনুরোধ
মেনে লাইনটার নিচেই লিখছেন কিছু:
---- কথাটি মিথ্যা
একটা সমবেত হতাশার শব্দ উঠে এল,
দুএকটা
কুলকুলির আওয়াজও ।
টেবিল থেকে ডাস্টার তুলে আবার ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে
চোখ ফেরালেন টিয়াস্যার । সে দর্শনপথে কম্পাস বা প্রজাপতি তার লক্ষ্য ছুঁয়ে যেতে ভুল করল না।
কিন্তু না, লাইন দুটো নয় তো, ডাস্টার যত্ন করে মুছছে মিথ্যা শব্দের পাশের ফাঁকা জায়গা। তারপর খুব ধরে ধরে লেখা হল 'নহে' । বিস্ময়ের চিহ্ন দিলেন পাশটায়। তারপর মুখ নিচু করে বসে থাকা শ্রাবণীর দিকে অপলক দৃষ্টি পাতলেন। সমস্ত ক্লাস প্রথমে এক মিনিট শোকপালনের মত চুপ। তারপর ঝোড়ো হাততালি আর চিৎকার উঠল। সঙ্গীতা বাঁ কনুই দিয়ে বন্ধুকে প্রাণপণ ঠেলছে ।
------ আরে বোকা, শুভদৃষ্টিটা বিয়ের দিন পর্যন্ত ফেলে রাখবি নাকি!
চার
অবিনাশকাকুর সাথে সাক্ষাত-পর
রাতে আলো চুমু খেতে এলে
সে ঠোঁটের নম্রতাকে কোথায় যেন লুকিয়ে শামুকের খোলের মত পেছল কাঠিন্য ছুঁড়ে দেয়। এই
রুক্ষতা,
আলো বোঝে,
একটু
চাপে ভাঙা যাবে, কিন্তু শামুকটা হয়ত বাঁচবে না। মুশকিল হল, গত ছমাসে তারা দুজনে দুজনের ঘাড়ে
বুকে মুখ গুঁজে শোয়ার অভ্যেস করে ফেলেছিল। কলকাতা যাতায়াতের রকেট বাসেও ঘুমের আচ্ছন্নতায় বারবার
সেই ভঙ্গি চলে আসে। কাজেই দুজনেরই দিশাহারা লাগল যে, এভাবে কীভাবে তারা নিদ্রাভিভূত হতে পারে । শেষে আলো একটা হাত রাখল শ্রাবণীর বাহুতে এবং দুজনেই
আলিঙ্গনের সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে সেই অভিব্যক্তি মেনে নিয়ে চোখ
বন্ধ করেছিল।
কিন্তু কাল রাতে যখন আবার আলো তার অচঞ্চল হাতের পাতা রেখেছে কাঁধে, শ্রাবণী আবিষ্কার করল সে মুখ ঘুরিয়ে উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পড়েছে। নিজের বিচ্ছিন্নতার শক্তিতে নিজেই ভয় পেয়ে অবশেষে কথাও বলে ফেলল:
------- আমি কৃষ্ণনগর যাচ্ছি।
------- আর পনেরো দিন পরেই
তো কলেজ ছুটি,
তখন নয়...
------- আমি আগেই যাচ্ছি।
অসুস্থ মা বা অর্থশূন্য বাবাকে চিন্তায় ফেলে লাভ কী? সে বরং আলোর মাসিকে গিয়ে বলবে, সেই ধাই-মার মেয়ে তার পাঁচ ফুটিয়া মোটাসোটা চেহারাটি নিয়ে কেন ছায়া ফেলছে তাদের দাম্পত্যে? কেন তার সঙ্গে আলোর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠানোর গোপন বোঝাপড়া? হ্যাঁ, সবাই জানুক! মিথ্যে ব’লে বিনা দোষে কারও সঙ্গে প্রতারণা করলে শাস্তি পেতে হয়।
কাজেই শ্রাবণীর দায়িত্ব শক্তিশালী
প্রমাণ জোগাড়ের। এখনও পর্যন্ত অবিনাশকাকুর বক্তব্য ছাড়া কিছুই তার পক্ষে নেই। আজ আলো অফিসে গেলে হাতের কাজ
সেরে জীবনের কঠিনতম
অভিযানে বেরোল শ্রাবণী,
অন্যের লেখা ডায়েরি
লুকিয়ে পড়া। সঙ্গীতার মতো সে পরস্পরের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে কোনও দিন বিশ্বাস করে না, কিন্তু সত্যি জানার এছাড়া উপায়ও তো নেই।
সাবধানী চোখে শুরু করেও আস্তে আস্তে আলোদ্যুতির দিনলিপির মধ্যে ডুবে যেতে লাগল শ্রাবণী। কথায় কাঁচা হতে পারে লোকটা, লেখাতে নয়! যে ভাষা তাকে কোনও দিন বলেনি আলো, অথচ শ্রাবণী আশা করেছে শুনবে, তেমনি বয়ানে ভরে আছে পাতার পর পাতা। কতদিন আগে সিকিমে ঝাউবন-ঘেরা পাহাড়ের মাথায় একটা গুম্ফার পাশে দুজনে গোটা বিকেল কাটিয়েছিল। আলো জানতে চেয়েছে, বুদ্ধমূর্তির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তুমি কী ভাবছিলে, শ্রাবণী? তারপর লিখছে, ওই বৃষ্টিভেজা পাহাড়ের পায়ের কাছে একটা ছোট্ট বাড়ি তৈরির কথা যার নাম সে রাখবে --- 'শ্রাবনীড়' ।
আহ, কী আশ্চর্য নাম, শ্রাবনীড়! ... কিন্তু আজ এসব কথার ওজন
পলকা,
পেপার ওয়েট চাপা না দিলে
জানলা দিয়ে সাদা একলা কাগজের মত
উড়ে পালাবে। ডায়েরি উলটিয়ে যত পেছনে যায় সে,
অক্ষরহীন মৌন ফুটে উঠছে বেশি,
আলোর স্বভাবের মতই
একটা দুটো
সোজা সাদা লাইনে এসে নেমেছে ভাবপ্রকাশ। আবার নিজে যেন সেটা বুঝতে পেরেই এক জায়গায় লিখেছে, 'টিয়াস্যার নামে আর কেউ ডাকে না। কিন্তু ফিরে পেলাম বাঁধা বুলি’। একটা পাতায়,
'মা-বাবা চলে গেলে তাদের আর ফেরানোর স্বপ্ন দেখো না’। শেষ মন্তব্যটা তিনদিন আগের,
'জানতাম, মিথ্যে বলার শাস্তি আমাকে পেতেই হবে।' চমকে উঠল শ্রাবণী! গতকাল রাতে আলোর দিকে
পেছন ফিরে শুয়ে এই
কথাই তো ভেবেছে!
আর দেখেছে,
রোদ-চিকচিকে পৃথুল এক নদীর মোহনায় সে
বসে একা, স্থির নৌকোতে। এখন দেখতে পেল,
আরেকটা নৌকোও দূরে ভাসছে, তার আরোহী এই
ঘরেরই আরেক বাসিন্দা।
আর গভীর মেঘ ঢেকে নিচ্ছে আকাশ। অথবা, হতে পারে তার মন থেকে
সমস্ত রাত্রি বেরিয়ে এসে চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল, ঘুর্ণায়মান মঞ্চের মত
এক অন্ধকার স্পেস থিয়েটার
তাকে তুলে ছড়িয়ে দিল কালো নক্ষত্রের জংগলে। একবার জোর করে
চোখ খুলতে চেষ্টা যে সে
করেনি তা নয়। তখন মনে হল, জানলার বাইরে জামরুল পাছের পাতায় পড়ে থাকা এই
মাঝদুপুর জ্যোৎস্নালোকিত। তলপেট থেকে বুক পর্যন্ত পেশি কুঁচকে উঠে
গলা দিয়ে বাঘের লাফের মত
হিক্কা বেরিয়ে আসছে । মোবাইলটা হাতড়ে পেয়ে কোনো রকমে স্পিড
ডায়ালের
নম্বরটায় চাপ দিতে পারল শ্রাবণী।
পাঁচ
বাইরের ঘরে আলোর কলেজের এক সহকর্মী ব’সে। তিনি গেছেন বারণ না শুনেই,
ডাক্তার ডাকতে। হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়ার
এই অসুখ
বড় হয়ে ওঠার
বয়েসে
শ্রাবণীকে দুচার বার
ভয় পাইয়ে
চুপ করে গেছিল। কৈশোরের গন্ধ নিয়ে সে ফিরল আবার । দুগ্লাস নুন-চিনির জল খেয়ে
নেওয়ায় এখন সে অনেকখানি সুস্থ । আশপাশের বাড়ি থেকে অন্তত
দশবারো জন,
প্রায় সবাই মহিলা, এসে নানা উপদেশ আর
মুখ-টেপা হাসি সমেত
আনন্দিত সন্দেহ প্রকাশ করে গেছেন। শ্রাবণী জানে তেমন কোন সুযোগ নেই, কিন্তু এই শারীরিক ধাক্কায়
মনের এতদিনের অসাড় ভাবটা
সরে গিয়ে সে যেন আলোর সামনাসামনি
দঁড়িয়ে
বোঝাপড়া করে নিতে তৈরি। আজ আলোর মাইনে
ও পোস্ট অফিস যাওয়ার দিন বলেই হয়ত
সকাল থেকে তার টেনশান তৈরি হচ্ছিল। হঠাৎ স্যালারির কথা মনে পড়তেই
ভাবতে চেষ্টা করল
পরিচর্যা চলাকালীন
আজও কি আলো তার
হাতে
দিয়েছে খামটা এবং সেও তুলেছে আলমারির লকারে?
অনেক বাইরের লোকের হুড়োহুড়ি চলছিল,
এবং এখন
তার মনেও
পড়ছে না
লোকটার অফিসের ব্যাগই বা কোথায়? বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারির পাল্লা খুলতে দেখা গেল
--- নাহ, যথাস্থানে । ব্যাগ নামিয়ে চেন টানতেই পাওয়া যাচ্ছে মাইনের খামও। কিন্তু বার করতে গিয়ে
খামের সঙ্গে
ব্যাগের ভেতরের
এক খোপ থেকে আঙ্গুলের টানে বেরিয়ে এল গোটা তিনেক এক হাজার টাকার নোট। মাথা
ঝুঁকিয়ে
ভাল করে দেখতেই
টের পেল
আরও কয়েকটা নোট গোঁজা রয়েছে খাপের মধ্যে, তার সঙ্গে জড়ানো মানি অর্ডার ফর্ম। সাবধানে ফর্মটা টেনে বের করল। ব্যাস,
এবার মোক্ষম প্রমাণ তার হাতে!
সবার আগে নিচের চিঠি-অংশে চোখ পড়েছে শ্রাবণীর, যেখানে শুধু 'শ্রীচরনেষু মা, আপনারা’-র বেশি লেখারফুসরত পায়নি । বাপরে, এ-যে দশ হাজার টাকার মানি অর্ডার! কোথায় পাঠাচ্ছে দ্যাখো তো? দইয়ের বাজার, কৃষ্ণনগর, জেলা: নদীয়া? শ্রাবণীর খুব চেনা ঠিকানা যে গো! নামটা কী লিখেছে দেখি ? শ্রী সুতনু বন্দ্যোপাধ্যায় ------ শ্রাবণী পরীক্ষার হলে ব’সে, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের লাইনে দাঁড়িয়ে, এমনকি ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের খাতাতেও এই নামটাই তো লিখেছে 'পিতার নাম' হিসেবে?
গান আর কান্নার দমকে কোথাও একটা মিল আছে, তাই না...!
হলুদ তারা-আকীর্ণ সন্ধ্যে নেমেছে বাইরে। পাঁচিল-কোণের শিউলি গাছটার নাম পালটে ঝাড়লন্ঠন রাখতে চাইছে জোনাকিরা। এবার 'শ্রাবনীড়'-এর মাথায় চাঁদ জ্বলে উঠবে।
সুচিন্তিত মতামত দিন