মানস চক্রবর্তী

মায়াজম
0
                              নামহীন







         সে মেয়ের পেটের মধ্যে মহাশূণ্য । পেটের মধ্যে শূণ্য মানে বোঝো ... কী অস্বস্তি...ডান দিকে হাত দিলে ফাঁকা ভাব বাঁদিকে চলে যায় ,আর বাঁয়ে চাপলে ডাইনে । মজা রে মজা । দুহাতে একসঙ্গে চাপলে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে সে শূণ্যতা একদম মধ্যি খানে... ।অসহ্য...শূন্যতা নিয়ে থাকা যায়...শরীরের অন্তর্গত এমন অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া নিয়ে কে কতক্ষণ সহজ থাকতে পারে । বালিশে পেট চেপে ও উপুর হয় । আর তাতে শূণ্যতা ভয়ংকর হয়ে ওঠে । দম বন্ধ হয়ে আসে । শূণ্যতার শক্তির কাছে ও হার মানে...চলতে থাকে ...মৃত্যুর তপস্যা ।
ওর বর পাহাড়ী সহর থেকে ছুটে আসে । এ ডাক্তার ,সে ডাক্তার । কোথাও তেমন পরামর্শও মেলেনা । এমন কি মনের ডাক্তারও দেখানো হয় তাকে ।
এসব ভুলে থাকতে সে নিজেই সারা দিনে অনেক রকম কাজ তৈরী করে...পুতুল বানায়...পিচ-বোর্ড দিয়ে ঘর...সেকেলে পাঁচ পয়সা দিয়ে জাহাজ...এমনি কত কী ।
কিন্তু এত কিছু করেও সে কিছুতেই পেট-ফাঁকার ব্যাপারটা টপকাতে পারছিলোনা । এমন ক্ষেত্রে যা হয়...অন্য মেয়েদের মত...বাথরুমে আয়নায় নিজেকে বারবার সে বলেছে...ওমন উতলা হয়না সোনা...দ্যাখো...এখানে যখন পুঁচকীটা বাসা বাঁধবে...তখন আর ফাঁকা থাকবেনা একটুও । কিন্তু মগজের বিচক্ষণতা তার আয়নার মধ্যে প্রতিচ্ছবিকে ভেংচি কেটেছে...মরনদশা...এই ফাঁকা বাচ্ছা ভরাতে পারে ?
দীর্ঘযন্ত্রণা নিয়ে সে একদিন চীলেকোঠার ঘর পরিস্কারে হাত লাগায় । বইয়ের পাহাড়থেকে সে পায় বিচিত্র এক ছবির বই । তার ভাসুরের যৌবনের আঁকা রঙীন ছবি । ল্যাণ্ডস্কেপ । এবং সে মগ্ন হয়ে ওখানে বসেই ছবি দেখতে থাকে...ঘন্টার পর ঘন্টা . ।অনেক পরে যখন নীচে নামে ততক্ষণে পেটের অস্বস্তিটা বেমালুম
হাপিস ।এটা তার নিজের আবিস্কার ।তাই সে কিছুটা রক্ষণশীল হয়।টাইমস এর রবিবারের ভ্রমণের
পাতা খুলে পরদিন বসে । লণ্ডনের রাস্তার ছবি দেখতে দেখতে ওই লালবাস কখন ভবানীপুরে পৌঁছে যায় । সে বাসে জানলার পাশে বসে থাকে।।ওড়নাটা পতাকার মত উড়ছে...এমনসময়ঝিরঝিরে বৃষ্টি...কালীঘাটে নেমে পড়ল...।ঝুপ করে লোডশেডিং ।
নাঃ সে ঊঠে পড়ে ।বরকে ফোন করে...আমি ঠিক আছি এখন...পেটে আর সেই ফাঁকা যন্ত্রণাটা নেই ...ইত্যাদি...।
তার পেটের মধ্যের শূণ্যতা ছবিতে ছবিতে ভরে যায় ।
এভাবে নিজের রোগ থেকে নিজেকে উদ্ধার করে সে ।
তার ভাসুর এর মধ্যে দেশে ফেরেন । উনি টরেন্টোয় থাকতেন...মস্ত নামকরা শিল্পী । তিনি ফিরতেই বাড়ী সেজে উঠলো...তাঁর ঘরের দেয়াল আক্ষরিক অর্থে একজিবিশনের গ্যালারি হয়ে গেল। ও নিজেই সেসব ছবি টাঙালো । কিন্তু সে রাত থেকে ওর কষ্ট আবার শুরু হোল । সারা রাত হরেক ছবি দেখেও আর কষ্ট কমল না । এখন পেটের শূণ্যতা নেই...দেয়ালের শূণ্যতা...। ভাসুরের কাছে আবদার করল...পেন্টিং চাই, না হোলে তার দেয়ালের শূণ্যতা তাকে গিলে খেয়ে নেবে যে !
ভাসুর ছবি দিলেন ...তবে শর্তও চাপালেন । কেউ কিনতে চাইলে দিতে হবে । তখন না বলা চলবে না । রাজী হয়ে গেল সেই মেয়ে । আর মজার ব্যাপার একসপ্তাহের মধ্যে জোড়ামোমবাতির অগ্নিময় যৌনমিলনের ছবিটা এক রসিক দম্পতি কিনে নিল । আবার একখণ্ড শূণ্যতায় দেয়ালের কষ্ট তাকে পেড়ে ফেলল । হাতের কাছে একটু তুলো ছিল...কাজললতার কালী তেলে গুলে সাদা কাগজে ট্যারা বাঁকা একটা ছবি এঁকে সে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে নিশ্চিন্ত ।
আবার এক বিপর্যয় এল । চারুকলা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারী তার আঁকা ছবিটা কিনে নিল । সে আবার কালো আর আলতার রঙ মিশিয়ে পোড়ো বাড়ী আঁকল...দেয়ালে টাঙ্গাতে না টাঙ্গাতে তা বিক্রী হয়ে গেল ।
একের পর এক সে ছবি টাঙায় আর তা দু'-এক দিনের মধ্যে বিক্রী হয়ে যায়...।
কিন্তু দেয়াল খালি না রাখার ইচ্ছে তাকে জেদী ...আরও জেদী করে তুলল । খানিক আগেও তাকে দেখে এলাম উপুড় হয়ে সে ছবি আঁকছে...।সব ইচ্ছে উজাড় করে ...। রঙ নেই আর...রক্তই সম্বল...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)