অর্ঘ্য দত্ত

মায়াজম
0
                                                           টিপ




তখন সকাল দশটা হবে। বসার ঘরের ডিভানে বসে মন দিয়ে পরীক্ষার খাতা দেখছিল শম্পা। হঠাৎ বেডরুম থেকে ভেসে আসা ছ’বছরের শায়রার তীব্র কান্নার আওয়াজ এবং সাথে সাথে শায়রার মা সালমার রাগত স্বর ওর মনোযোগে বিঘ্ন ঘঠায়। বিরক্ত হয় শম্পা।
-এত চেঁচামেচির মধ্যে খাতা দেখা যায়! হলোটা কী? ওকে বকছ কেন সালমা? বলতে বলতে শম্পা বেডরুমে এসে দেখে শায়রা অন্য দিনের মতোই ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজার জিনিস পত্র ঠোঁটে মুখে মাখার সাথে সাথে আজ আয়নায় লাগিয়ে রাখা একটা লাল টিপ নিজেই খুলে নিয়ে কপালে পরেছে। শায়রা কিছুতেই সেটা খুলবে না। আর সালমা ওর চুলের মুঠি ধরে পিঠে কিল মারতে মারতে বলছে, ‘তোরে কইতাছি না আমাগো লগে এ হারাম? কথা শোনোস না কেন হারামজাদি?’ শায়রা কেঁদে যাচ্ছে তারস্বরে কিন্তু তবু ডান হাতের আঙুল দিয়ে কপালে চেপে রেখেছে টিপটা।
-তুমি কী পাগল হয়ে গেলে? এ’টুকু মেয়ে! তাছাড়া কপালে একটা টিপ পরলেই তোমাদের পাপ হয়ে যাবে বুঝি? সালমার মুখ দেখে কথাটা ওর মনঃপূত হয় নি বুঝতে পেরে শম্পা আরও বলে, এ গুলো কী আমি ধর্মের জন্য পরি? এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক আছে? এই যে আমার রোদে এলার্জি বলে আমি সমস্ত মুখ ঢেকে রাস্তায় বেরোই তার মানে কি আমি তোমাদের ধর্মের নিয়ম পালন করছি? এটুকু মেয়েকে কেউ এ ভাবে মারে? যত্তোসব…, রাগে বিড়বিড় করতে করতে শম্পা শায়রার হাতে তুলে দেয় লাল টিপের একটা নতুন প্যাকেট। নতুন টিপের পাতা হাতে পেয়ে শায়রাও মুহূর্তে কান্না ভুলে যায়।
নিঃসন্তান, স্কুল শিক্ষিকা শম্পা ও তার স্বামী সুমিত থাকে মুম্বাইয়ের উত্তর পশ্চিম শহরতলি ভাসাইয়ে। শম্পা স্বাভাবিক সুন্দরী। সুমিতের শখে কেনা গুচ্ছের প্রসাধনী তাই ওর ড্রেসিং টেবিলে অবহেলায় পড়ে থাকে। শম্পার নিজের শখ শুধু কপালের টিপে। বিচিত্র রঙের, মাপের এবং নকশার। সুমিতও কাজের জন্য গুজরাত বা মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলেও সেখান থেকেই শম্পার জন্য সংগ্রহ করে আনে নানা রকম এথনিক্ টিপ।
সেদিনই মধ্যরাতে শম্পার ফ্ল্যাটে হঠাৎ করে বেজে ওঠে ডোর-বেল। সুমিত অফিসের কাজে দু’দিনের জন্য গেছে বরোদায়। ঘরের ডিম লাইটেও শম্পা দেখতে পায় দেওয়াল ঘড়িতে রাত বারোটা চল্লিশ। ওর ভয় লাগে। বসার ঘরে এসে আলো জ্বালিয়ে আই-হোলে চোখ রেখে দেখে আবাসনের দারোয়ানের সঙ্গে সালমা। অবাক হয়ে দরজা খুলতেই শায়রার হাত ধরে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে সালমা। শম্পা লক্ষ্য করে সালমার কপালে দু’ভুরুর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে লাল টিপ। ইশারায় দারোয়ানকে চলে যেতে বলে বিস্মিত শম্পা দরজা বন্ধ করতেই সালমা কেঁদে ভেঙে পড়ে ওর পায়ের ওপর -তুমি আল্লার দূত। তুমি ফেরেস্তা । আজ রাতটা আমাগো মা-বেটিরে তোমার এখানে থাকতি দাও বৌদি।
সালমার কাছ থেকে শম্পা জানতে পারে যে নীলেমোড়েতে রেললাইনের ধারে যেখানে মুর্শিদাবাদ বা পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গা থেকে এসে গরীব বাঙালি, যারা ওর মতোই লোকের বাড়ি বা দিন মজুরের কাজ করে,বস্তি বানিয়ে থাকে যেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ধরার জন্য আজ রাত বারোটা থেকে বিরাট পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে ওদের ঘরদোর ভাঙচুর করেছে। জোর করে সবাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। শুধু যাদেরকে হিন্দু বলে সনাক্ত করতে পেরেছে, তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। স্বামী পরিত্যক্তা সালমা বুদ্ধি করে কপালে টিপ পরে মেয়েকে কোলে নিয়ে ভিড়ে মিশে বেরিয়ে এসেছে ঘর ছেড়ে। মহারাষ্ট্র পুলিশ কপালের টিপ দেখে ওদের আর আটকায় নি। তাই বৌদির ওপর ওর এখন কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
শম্পা নিজেও এই কাকতালীয় ঘটনায় অবাক হয়ে যায়। বসার ঘরে মেজেতে ওদের শোয়ার ব্যবস্থা করে সালমাকে আশ্বস্ত করে- যে কদিন তোমাদের এই ঝামেলা না মিটছে তোমরা আমার কাছেই থেকো। কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসা ছ’বছরের শায়রার মুখেও এখনও এক অবুঝ আতঙ্ক যেন জড়িয়ে আছে। না শুয়ে, সালমাও শায়রাকে বুকের মধ্যে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকে।
- রাত করো না। এখানে তোমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, এখন শুয়ে পড়।
বলে বসার ঘরে আলো নিভিয়ে নিজের বেডরুমে এসেই শম্পার চোখ যায় ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখা নানান রকমের টিপের কৌটো ও পাতার দিকে। এক নিরুপায় ক্রোধ শম্পাকে অস্থির করে তোলে। হঠাৎ যেন ও বুঝতে পারে তার এই সব বাহারি টিপ শুধু নির্দোষ প্রসাধনী মাত্র নয়। মানুষে মানুষে ভেদ করার এক ভয়ঙ্কর অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে এই আপাত নিরীহ রঙ চঙে টিপের মধ্যে।
সারারাত নির্ঘুম ছটফট করে শম্পা। পরের দিন সকালে উঠেই এতদিন ধরে যত্ন করে সংগ্রহ করা ওর যাবতীয় টিপের পাতা, টিপের প্লাস্টিকের প্যাকেট,ছোট ছোট টিপের কৌটো সব পোঁটলা করে ফেলে দেয় সদর দরজার বাইরে রাখা বিন ব্যাগের মধ্যে। নিজেকে যেন হালকা লাগে শম্পার। আয়নায় নিজের টিপহীন ফর্সা কপালটাকে দেখে আজ যেন শম্পার ভোরবেলার মতোই উজ্জ্বল লাগে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)