বিশ্বাস করুন, এই নিয়ে তিন বোতল জল খেয়ে ফেললাম, নাড়ীও মাপার চেষ্টা করছি একবার। কিন্তু ব্যাটারি শেষ হয়ে হতচ্ছাড়া ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। খুব ভরসা করে আপনাদের কথাটা বলছি, পাঁচকান করার আগে একবার ভেবে দেখবেন মানে আপনি কোথায় আছেন আর তাতে আপনার জীবনে কি কি প্রভাব পড়তে পারে ,ভালো বলছি একবার ভেবে দেখবেন কিন্তু। নচ্ছার প্রতিবেশীগুলো আগে থেকে আমায় সাবধান করেনি আর আমিও প্রায় তিনমাস জ্যোতিষে বিশ্বাস খুয়িয়েছি,তাই কি আমার এমন হল? এখন আমার অবস্থাটা দেখুন ভয়ও করছে আবার লোভও হচ্ছে। ঠিক তিন দিন আগে এই বাসায় এসেছি আমি। বিছানা, আসবাব সব ঠিকঠিক জায়গায় বসাতে বসাতে সেগুন কাঠের পায়াটা দেওয়ালে ঠুকে যাবে এতে আর আশ্চর্য কি? কিন্তু তক্ষুনি বিকট আওয়াজ করে উত্তরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আর সিলিং থেকে একটা খোপ খুলে গিয়ে বিছানায় ধুলোবালিশুদ্ধু টপ করে পড়ল মহম্মদ পাকড়াশীর ডায়েরি- আদরের বশে উনি যার নাম দিয়েছিলেন ‘ গোলবাড়ির কষা মাংস’। মানুষকে শুধুই মাংস বলে উল্লেখ করে গেছেন ভদ্রলোক এবং জানতে পারলাম ভূগোল তাঁর প্রধান গবেষণার শিরদাঁড়া হলেও ইদানিং মনোবিজ্ঞানের ওপর ভূগোলের প্রভাবে মজেছিলেন মানুষটি। সে যাই হোক, কি কুক্ষণে যে আমি ওটা পড়তে গেছিলাম মশাই, দেখুন লিখতেও পারছি না, হাতের তালুর ঘামে কলম পিছলে যাচ্ছে।
প্রতি শনিবার বোটানিক্যাল গার্ডেনে বিভিন্ন বটগাছে ঢিল মেরে মেরে সেই ঢিলগুলোকে বাড়ি এনে নিয়মিত পরীক্ষা করে গেছেন মহম্মদ পাকড়াশী এবং কম্পাস নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন কলকাতার উত্তর ও দক্ষিণে, সেই ছোটবেলার উপহার পাওয়া কম্পাস - লোকাল তোতলা ম্যাজিশিয়ান মিঃ কার্তিক ঠাকুরের থেকে। গবেষণার অঙ্কের মাঝখানে মাঝখানে স্মৃতিচারণে হারিয়ে গেছেন ভদ্রলোক। তোতলা ম্যাজিশিয়ান বুড়ো হয়ে যাওয়ার পর পাগলের মতো এক কথা বলে যেত, “ খেলা নে” , “খেলা নে” কিন্তু বাচ্চা, বুড়ো, বাম, ডান কেউ ওকে খেলায় নিত না, বরং তোতলা ও ফোকলা মানুষটিকে “ ক্যালানে” বলে ভেংচি কাটত, সেই থেকেই ক্যালানে কার্তিক আর কি! “ গালাগালের উৎস সম্পর্কে” নামক ওনার পাদটীকায় এরকম আরও অনেক হ্যাঁটা/খিস্তির ইতিহাস জানা যাচ্ছে। আসল সমস্যায় আসি, মহম্মদ পাকড়াশী প্রচুর অঙ্ক কষে এবং কলকাতা সব জলাশয়ে ও গঙ্গার গভীরে ডুবসাঁতার মেরে একদিন খেয়াল করেন কম্পাসটা আর কাজ করছে না। এর অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উত্তেজনায় বহুবার হাত কেঁপে গেছে ভদ্রলোকের, অবশ্য ডায়েরির সঙ্গে আমার বিছানায় এসে পড়া ছিলিমটার এই বাঁকা হাতের লেখার পেছনে কোনও অবদান আছে আমি বিশ্বাস করি না।
পৃথিবী তুবড়ে যাচ্ছে মানে অনেকদিন ধরেই যাচ্ছিল, কেউ খেয়াল করেনি, প্রথম নজর করলেন মহম্মদ পাকড়াশী। সমস্ত জায়গায় ডুবসাঁতার দিয়ে তিনি দেখেছেন বাঙালিরা এতো জোরে জোরে আছাড় মেরে মেরে পুজোর পর প্রতিমা বিসর্জন করেছে সেই চাপ আর মা ধরিত্রী সামলাতে পারেননি। তিনি তুবড়ে গেছেন, উনি মনে করছেন চন্দননগরের জগধাত্রী প্রতিমাগুলো এসে পড়লেই খেলখতম। অর্থাৎ এই তুবড়ে যাওয়ার প্রভাবে এবার কলকাতায় আবহাওয়ার বিশেষ পরিবর্তন দেখা যাবে।কলকাতায় হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন কলকাতায় এবার শীত পড়বে না। যারা যারা “গেম অফ থ্রোন্স” নামক টিভি সিরিজ দেখে “উইন্টার ইজ কামিং” লেখা কুল ফেসবুক কভার রেখে শীতকে আদর আপ্যায়ন করবেন ভেবেছিলেন তারা আবহাওয়া দপ্তরের দিকে মহামিছিল করার ও ধর্নার পরিকল্পনা করুন কারণ এ বছর উইন্টার ইজ নট কামিং! ব্যাপারটা কিরকম? উত্তর কলকাতায় ডিসেম্বর-জানুয়ারি জুড়ে চলবে ভারী বর্ষণ কিন্তু চতুষ্কোণের বিস্তর সাফল্যের চক্কোরে দক্ষিন কলকাতায় দু মাস আগেই বসন্ত এসে যাবে। শিয়ালদহ আর কলেজ স্ট্রীটে ঠিক কি প্রভাব পড়বে সে নিয়ে মহম্মদ পাকড়াশী খুলে কিছু বলেননি তবে একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন দক্ষিণ থেকে সফর করে আসা ডাউন ট্রেনগুলো প্রচুর লু বয়ে আনবে আর যখন তখন শিশির পড়তে পারে ফলে হয়তো কবি জীবনানন্দ দাশের বইয়ের সেল বেড়ে যাবে। আপনার মতো আমার মনে প্রশ্ন এসেছিল যে আর কলকাতার বাইরে কি হবে? অভিমানী ভূবিজ্ঞানী এবিষয়ে বলছেন, “ এমনিও তো সব প্রগতি, হাঁচি, কাশি, ব্যবসা কলকাতাকে নিয়েই , তাই আমি বলবও না জেলায় জেলায় কি কি হবে, কলকাতা আর লন্ডন নিয়েই পড়ে থাক সবাই, পুরুলিয়াকে প্যারিস...” – এখানে অবশ্য পুরুলিয়াকে প্যারিসটা কেটে দেওয়া আছে, আমি আপনাদের বঞ্চিত করব না বলে বলে দিলাম। আমার আবার মামার বাড়ি পুরুলিয়ায় ,সস্তায় কিছু জমি কিনে নিতে বলব কিনা ভাবছি। বিখ্যাত মানুষের কেটে দেওয়া কথাও লেগে যায় মশাই।
মহম্মদ পাকড়াশী বলছেন কলকাতার দুভাগে দুরকম ঋতু চলার জন্য বেশ কয়েকটি আর্থসামাজিক ও মনোবিজ্ঞানসম্মত কাণ্ড দেখা যাবে। দক্ষিণ কলকাতায় আগেভাগে বসন্ত ঢুকে পড়ে ব্যবসায় ও জীবনযাত্রায় অনেক ভোল পালটে দেবে যেমন
১) অশীতিপর ও রুগ্ন বৃদ্ধরা এই শীতেই অক্কা পেতেন তারা পঞ্চভূতের মঞ্চে নাচবেন অন্তত আরও এক বছর। ঠাণ্ডা লাগা, হাঁচি, কাশির প্রকোপ কমে যাওয়ায় ওষুধের ব্যবসায় ক্ষতি হবে প্রচুর। বেশিরভাগ ওষুধের দোকান তাদের সর্দিকাশির ওষুধের স্টক সরিয়ে ফেলবে উত্তর কলকাতায় কারণ ভারী বর্ষণে ওখানে আবার এই জাতীয় শারীরিক সমস্যা বেড়ে যাবে। দক্ষিণ কলকাতার ওষুধের দোকানে শুধুমাত্র নিরোধ আর চিকেন পক্সের ওষুধ রাখা থাকবে। বসন্ত বড় রোম্যান্টিক!
২) চার মাসের লম্বা বসন্ত বাড়ি বাড়ি কোকিল পোষার হুজুগের জন্ম দেবে। ব্যাপারটা ট্যাটু, সেলফি এসব ইদানিং আদিখ্যেতার থেকে অনেক বেশী হিট করবে। তবে ঠগ পাখিবিক্রেতারা এই সুযোগে ছোট অবস্থায় অনেক কাককে কোকিল বলে চালিয়ে দেবে। কিছু পশুপ্রেমী নরমহৃদয় অবশ্য ভালবেসে কাকগুলোকেও বড় করবেন কিন্তু পাশাপাশি বাড়িতে কাক কোকিলের ফারাকের জন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব অনেক বেড়ে যাবে।
৩) দক্ষিণ কলকাতায় ডিসেম্বর থেকেই বাজার দোকানে “চৈত্রপ্রবাহ” নামক সেল শুরু হয়ে যাবে। ফলে ওষুধের ব্যবসা ছাড়া বাকি ব্যবসায় দারুণ সমৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের আবদার মেটাতে মেটাতে কিছুদিন পর নাজেহাল হয়ে যাবেন এবং ইন্সুরান্স বা লোনের ই ম আই জনিত নানা ঝামেলায় পড়বেন। দক্ষিণ কলকাতার চাকরিজীবীদের আর কোনও ব্যাঙ্ক ক্রেডিট কার্ড দিতে চাইবে না ফলে তারা বন্ধুবান্ধবদের থেকে কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে ধার করবেন এবং গোপনে সুদের ব্যবসা আবার মাথা চাড়া দেবে।
আরও যা যা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন মহম্মদবাবু টা মাথায় রাখলে স্পষ্ট বুঝতেই পারছি যে বসন্ত কিন্তু আড়ালে বেশ দুর্যোগই নিয়ে আসছে, এই সময়ে কসবায় বাড়িটা ভাড়া নিয়ে ফেললাম, হাওড়ার দিকে পালিয়ে যাওয়াটাই বোধহয় নিরাপদ হত। যাক এখন কি বা করার আছে , বরং ভাবছি কাল থেকে শিশু বা কিশোর কাক আর কাকের ডিম যা পাই ধরে, তুলে, বেঁধে আনব, অনেকটা সেলোটেপ লাগবে, ঠোঁটগুলো আচ্ছা করে বেঁধে না দিলে কা কা করে সারা পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে যাবে আমার বুদ্ধিটা।
উত্তর কলকাতার প্রতি ভদ্রলোক খুব একটা আশার কথা বলেননি ওনার ডায়েরিতে, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ছোটবেলা থেকে বারবার ছাতা হারিয়ে বাড়িতে লাঞ্ছনার শিকার করে ওঁর বর্ষাকাল নিয়ে এলারজি-ই ছিল। তবুও আপনারা যারা উত্তর কলকাতা থেকে আগ্রহী তাদের জন্য বলছি-
১) অধিক বর্ষণে সারাদিনই জল জমে থাকার ফলে বেশিরভাগ ইস্কুল রেনি ডে ঘোষণা করতে বাধ্য হবে এবং বাড়িতে বসে বসে বাচ্চারা বোর হয়ে নিজেদের মধ্যে কাগজের নৌকা প্রতিযোগিতা শুরু করবে। ক্রমশ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবগুলো থেকে পুরস্কার রেখে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে বং কানেক্সান ছবির “মাঝি রে” গানটি ব্যবহারিক জনপ্রিয়তা পাবে। সমস্যা হল নৌকা বানিয়ে ব্যাপকভাবে কাগজ নষ্ট করার জন্য পরিবেশবিদরা সাদা পোশাকে মাঝেমধ্যেই টহল দেবেন এবং নর্দমা জ্যাম করলেই আগামী বৃক্ষরোপণ উৎসবে আসামীদের দিয়ে মাটি খোঁড়াবেন ও গোবর চটকে সার বানানোর শাস্তি দেবেন।
২) ব্যবসায় মন্দা চলবে কারণ বেশিরভাগ লোকই বাড়ি থেকে বেরতে চাইবেন না এবং বাড়ি বসে বসে অলসভাবে হাই তুলতে তুলতে মুড়ি খাবেন এবং যেহেতু বিজ্ঞান বলছে একজনের হাই তোলা দেখলেই অন্য একজনের হাই তোলবার ইচ্ছে করে, পরিবারের অন্যরাও প্রচুর হাই তুলবেন, উত্তর কলকাতার মানুষের গড় কথায় শব্দের সংখ্যা কমতে শুরু করবে এবং এক একটি বাক্য শেষ করতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। মাঝেমধ্যেই হাইয়ের মধ্যে কথা হারিয়েও যাবে। পাড়ার আড্ডায় সবাই মিলে বসবেন বটে কিন্তু যে যার ছাতার তলায় গোটা পঞ্চাশেক হাই তুলেই বাড়ি চলে যাবেন তবে এক অন্যের আলজিভ নিয়ে রসিকতা করার একটা উদ্ভট ধারা চালু হবে এমনকি পুরুষদের ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকার জন্য মেয়েদের মুখ চাপা দিয়ে হাইতোলার ব্যাপারে বাড়ির বড়রা সাবধান করে দেবেন।
৩) উত্তর কলকাতায় খাদ্যের অভ্যাসে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন আসবেই। খিচুড়ি ও নানারকম ভাজা খাওয়ার প্রবণতা যথেষ্ট বেড়ে যাবে এবং জাঙ্ক ফুড কম খাওয়ার কারণে উত্তর কলকাতার ছেলেমেয়েদের দক্ষিণ কলকাতার ছেলেমেয়েদের থেকে কম ভুঁড়ি ও লোম গজাবে , ফলে ফেসবুক ও নানা ইন্টারনেট সাইটে দক্ষিণের মানুষরা প্রবল প্যাঁক খাবে। অবশ্য দক্ষিণের মানুষরা এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে সেইসব ছবি আপলোড করে উত্তরের মানুষদের ঈর্ষান্বিত করে মারবে।
এবার আপনারা বুঝলেন তো কি ঘোর দুর্দিন আসছে? এখন তবু আপনাদের কথাগুলো বলতে পেরে আমার অনেকটা হাল্কাই লাগছে, আর কাকের বুদ্ধিটাও এসে গেছে মাথায়, কিন্তু আপনি যদি মধ্য কলকাতার হন আপনি যে কি করবেন তা আমিও ঠিক বুঝতে পারছিনা। মহম্মদ পাকড়াশীর পলিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গি খুব গভীর তো তাই উনি শুধুই ডান আর বামের ওপর প্রভাবটাই জোর দিয়ে দেখেছেন, মধ্যপন্থা কি বুদ্ধ ওনাকে খুব একটা ভাবায়নি।
তবে আমি বলি কি হুট করে শীতের জামাকাপড়গুলো ফেলে দেবেন না মশাই। কে বলতে পারে মধ্য কলকাতা পৃথিবী তুবড়ে যাওয়ার জন্য হয়তো পুরো আলাস্কার মতো হয়ে গেল, আমি কি আর ভূগোলের অঙ্ক কষতে পারি। যাক কাল থেকেই কাক ধরার ফাঁদ পাততে হবে, ওটাই সোজা, এই বাজারে কোকিল কে খুঁজবে মশাই? তবে মহম্মদ পাকড়াশীর শেষ লেখাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ,উনি বলছেন-
“ আমার বাল্যবন্ধু ও বিখ্যাত রসায়নবিদ সমুদ্র গুপ্তর সঙ্গেই শুরু করছি আমার আগামী গবেষণা। নেশা, ট্রিপ, হ্যালুসিনেসানের ওপর এই কাজটা অনেকদিন ধরেই করার ইচ্ছে ছিল আমাদের । সমুদ্রর বাগানে সব গাছগুলো বেড়ে উঠেছে, ফুলও এসেছে, ওই ফুলগুলো তুলে নিয়ে সমুদ্র এখন পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মভেদী নেশাদ্রব্য তৈরির পথে আর আমি লক্ষ্য করব ওটা গ্রহণের পর মানুষের মনে তার প্রভাবের দিকটা। আশা করছি আর কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে এসে যাবে – সমুদ্র গুপ্তের ফুলগঞ্জিকা!”
সুচিন্তিত মতামত দিন