"নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখি জল..." নজরুল সংগীতে নৃত্য পরিবেশন করছিল একটি ছোট্ট মেয়ে। গানের প্রথম ছত্রটি কানে যেতেই কিংশুক ক্লাবঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসে। তার বড়ো প্রিয় গান এইটি। গানের কথাগুলি কিংশুকের রক্তে মিশে যাচ্ছিল। নিষ্পলকে সে দেখছিল সেই ছোট্ট মেয়েটির নৃত্য পরিবেশন ও মুখ ভঙ্গিমা।
গানটি শেষ হতেই কিংশুক পুনরায় ক্লাবঘরে ঢোকবার মূহূর্তে মুখোমুখি হল মনোরমার। মনোরমা সেই নৃত্য পরিবেশনের সময় কখন ক্লাবঘরটির ভিতরে এসে একাকী চেয়ারে বসেছিল। চোখে চোখ পরতেই কিংশুক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কী করবে সে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। কারণ সরস্বতী পুজো উপলক্ষে নয়নপুর সার্বজনীন ক্লাবের উদ্যোগে যে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে গতকাল ক্যুইজ প্রতিযোগিতায় মনোরমা ও কিংশুকের সম্মিলিতভাবে প্রশ্নকর্তা ও পরিচালকের স্থান নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিংশুক সেই প্রতিযোগিতার সময় নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল।পাড়াতেই অনুষ্ঠিত ক্লাবের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় মনোরমা ও কিংশুক দুজনেই অন্যান্য সদস্যদের মতো সক্রিয় থাকে। দুজনে আবার বাল্যকালের বন্ধু ও সহপাঠী ছিল। ছোট থেকেই মনোরমাকে ভালো লাগত কিংশুকের। কিন্তু কখনো অন্তরের প্রেম সে ব্যক্ত করতে পারেনি পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলার কথা ভেবে। ফেসবুকে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে মনোরমা কিছুটা আন্দাজ করে কিংশুকের অন্তরের কথা। কিন্তু তখন অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। মনোরমা ও তার প্রেমিক শোভনের বিবাহ ঠিক হয়ে গেছে। এই কথার জানার পর মনোরমা কিংশুককে আনফ্রেণ্ড করে। আর সেই থেকে কিংশুকের মনে মনোরমার প্রতি গভীর অভিমান জমা হয়। তাই সে নিজেকে মনোরমার থেকে দূরে রাখবার জন্য ক্যুইজ প্রতিযোগিতা থেকে গা আড়াল দেয়। এর জন্য ক্লাবের কয়েকজন সদস্যও মনক্ষুণ্ণ হয়।
অপ্রস্তুত কিংশুক যখন ক্লাবঘরের দরজা থেকে পুনরায় বাইরে পা রাখে, মনোরমা ডাকে"শোন!"
এই ডাকটির জন্য কিংশুক বিগত প্রায় একবছর ধরে অপেক্ষা করছিল। কারণ মনোরমা কলকাতায় থাকে। আর কিংশুক থাকে গ্রামে। তাদের মধ্যে দেখা হয়নি ফেসবুকের দুজনে আনফ্রেণ্ড হওয়ার পর। তাই এই মূহূর্তের ডাক তার সব অভিমানকে ধুলিসাত্ করে দিল। কিংশুক তত্ক্ষণাত্ ঘুরে তাকায়,"কী?"
"ভেতরে আয় না!"
কিংশুক ভিতরে যেতে প্রথমে সংকোচ বোধ করছিল। কারণ দুজনকে ক্লাবঘরে বসে গল্প করতে দেখলে পাড়ার বা গ্রামের লোকে কী বলবে! মনোরমার তো বিবাহ ঠিক হয়ে গেছে। আবার ইচ্ছাও হচ্ছিল দুজনে একসঙ্গে একাকী বসে গল্প করতে। শেষ পর্যন্ত মনোরমার ইচ্ছায় সায় দিয়ে কিংশুক মনোরমার পাশে একটি চেয়ারে বসল।
"ক্যুইজের দিন কোথায় ছিলিস?" মনোরমার প্রশ্নে কিংশুক মাথা নীচু করে নিল। প্রশ্নটা স্বাভাবিক হলেও উত্তরের জন্য কিংশুক প্রস্তুত থাকেনি।
"না...মানে...,একটু কাজ ছিল!" কিংশুকের সংকোচপূর্ণ উত্তরে মনোরমা বুঝতে পারে কিংশুকের এই উত্তর কেবল অজুহাত। মিথ্যা। সে তাই প্রসঙ্গ পাল্টায়,"এখন কী করছিস? আর সব খবর?" এইভাবে নানা প্রসঙ্গে তাদের মধ্যে কথা হয়। কথায় কথায় মনোরমার বিবাহের কথা তোলে কিংশুক। কবে বিবাহ? বিবাহের পর মনোরমা কোথায় থাকবে? কারণ শোভন তো ডাক্তার। কর্মসূত্রে স্থান বদল করতে হয় মাঝে মাঝে। বুকের মধ্যে পাথর চাপিয়ে কিংশুক একের পর এক কথা বলে যাচ্ছিল। মনোরমাও খুশি হচ্ছিল। কিংশুক মনোরমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল সেই খুশির বিচ্ছুরণ। এটাই তো কিংশুক চেয়েছিল- মনোরমা জীবনে খুশিপূর্ণ সুখী হোক। তবু তার মনকে একটা নীরব ও সক্রিয় হাহাকার কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। পরের বছর এমনদিনে সিঁদুরে রাঙা মনোরমা কি তার পাশে বসে এভাবে গল্প করতে পারবে? সেই ভবিষ্যতের পরিণতি কী হবে তা ভাবতে ভাবতে সেই মূহূর্তটাকে আরও দীর্ঘায়িত করতে চাইছিল। জীবনের স্মরণীয় কিছু মূহূর্ত থাকে যাকে ছাড়তে ইচ্ছা করে না। মনে হয় মূহূর্তগুলি অনন্তই থাক।
পরের দিন অনুষ্ঠানের সময় কিংশুক মনোরমার দেখা পায় না। সারাক্ষণ অস্থিরতার মধ্যে কাটে। অনুষ্ঠানের শেষে সরস্বতীকে বিসর্জন দেওয়া হয়। ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে সরস্বতীকে জলে ফেলা হয়। মৃদু আলোয় অন্ধকারের মধ্যে আবছা সেই দৃশ্য বুকের ভিতর টনটন করে ওঠে। এই বছরের মতো সরস্বতী পুজোর আনন্দের সমাপ্তি। তবু এই সমাপ্তির পরেই আগামী বছরের জন্য মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কিংশুকের মন আরও ভারাক্রান্ত হয়। সে ভাবে আগামী বছর মনোরমাকে এভাবে পাশে পাওয়া, গল্প করা আর সম্ভব হবে না।
রাত্রে বাড়ি ফিরে ঘরের আলোটা নিভিয়ে যেই বালিশে মাথা রাখে, তখনই ফোনের রিং বেজে ওঠে। মোবাইল স্ক্রীনে 'মনময়ূরী' নামটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটিকে ক্ষীণ আলোতে ভরিয়ে তোলে। এই মনময়ূরী মনোরমার একটি ভালোবাসার নাম।
".....আমি কোনো বন্ধুকে বলছি না। তোকেই বললাম। তোকে আসতেই হবে। আসবি তো? না তোর বাড়িতে যেতে হবে?" ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে মনোরমার কণ্ঠস্বর।
বিবাহের নিমন্ত্রণে কিংশুক দ্বিধাগ্রস্ত হয়। বিবাহের দিন সে কি মনোরমা সামন গিয়ে দাঁড়াতে পারবে? বিয়ের দু'দিন আগে নিমন্ত্রণ কেন?-এইসব ভাবনায় কী উত্তর দেবে ভুলে যায়। আবারও মনোরমার কণ্ঠস্বর,"কি রে! কী হল?"
"নারে, যাব। অবশ্যই যাব। তোকে আর বাড়ি আসতে হবে না!" এই আমন্ত্রণ কিংশুক গ্রহণ করে। তারপর নানা কথা হয়। সেদিন অনুষ্ঠানে না থাকার কারণও জানায়।
ফোন রেখে দিলে আবার শিরায় শিরায় অন্ধকার সচল হয়ে ওঠে। বিবাহের আমন্ত্রণ কীভাবে রক্ষা করবে সে? যাকে একাকী অন্তরে একান্ত আপনের মতো ভালোবেসে গেছে, নানা সুখের কল্পনায় রঙীন ছবি এঁকেছে মনভূমিতে; তার শুভ পরিণয়ের মূহূর্তে তার চোখে চোখ রাখব কীভাবে? একদিন তো কিংশুক ভেবেছিল মনোরমা যদি কোনোদিন তার না হয়, তাহলে সে স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানাবে। তবে কি তাই করা উচিত?পরমূহূর্তেই ভাবে এতে তো মনোরমাকেই আঘাত দেওয়া হবে। মনোরমার সুখটা কেন সে মানতে পারছে না? নিজেকেই প্রশ্ন করে কিংশুক। তারা তো বন্ধুত্বের সম্পর্কে সারাজীবন যুক্ত থাকতেই পারে। আর সেই সম্পর্ককে দৃঢ় রাখতে গেলে মনোরমার বিবাহের দিন তাকে উপস্থিত থাকতে হবে। কারণ আমন্ত্রণের সময় মনোরমার কণ্ঠস্বরে একটা অস্পষ্ট আকুলতা কিংশুককে ছুঁয়ে যায়।
পরের দিন সকালে চোখ খুলে দেখে তখনও ঘর অন্ধকার। জানলার পাল্লার ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো ক্ষীণভাবে প্রবেশ করেছে। রাত্রিতে মনোরমার কণ্ঠস্বর আবারও কিংশুকের কানে বেজে ওঠে। মনোরমার বিবাহে যেতে গেলে কী উপহার দেবে? একটা গোলাপ। না। মনোরমার বাড়ির লোক কী ভাববে! স্বরচিত কোনো লেখা? না। তাতেও তো প্রেমের প্রকাশ হতে পারে। কিন্তু এই অব্যক্ত প্রেমকে তো কখনোই ব্যক্ত করতে চায়নি। সে জানে ফাটা দেয়ালে ফুলশয্যা বহুরূপী মাত্র। তবে কী দেবে? শেষে খুব সহজ একটা সমাধান কিংশুক খুঁজে পায়। তার হাতের আঁকা 'মনময়ূরী' সিরিজের ছবি সে দেবে। এই ছবিগুলি মনোরমার জন্যই এঁকেছিল; মনোরমাকে দেখাবে বলে।কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন চলে আসে ছবি আঁকার দক্ষতা এবং ছবির ক্ষুদ্র পরিমাপ নিয়ে। শেষে উপহারটিকে ভালোবাসার স্বাক্ষর হিসাবে, দুটি ছবি বেছে নেয় এবং তার সঙ্গে আরও একটি ভাবনা এঁকে দেবে বলে ঠিক করে। প্রেমের মানুষটি অন্যের হয়ে যাওয়ার মূহূর্তে এই ভালোবাসার স্বাক্ষরই কিংশুকের শ্রেয় বলে মনে হয়।
কিংশুক রঙ-তুলি নিয়ে বসে পরে। কালো ক্যানভাসে নানান রঙকে সজ্জিত করতে করতে মনে পড়ে শৈশব ও কৈশোরের কথা। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় মনোরমার সঙ্গে মেলামেশা, একসঙ্গে খেলা করা, ছুটির দিনে দীঘির জলে একসঙ্গে ঝাঁপাইঝোড়া মূহূর্ত। আর বিকালে বৌবসন্তী, লুকোচুরি খেলার সেই আনন্দঘন বেলা আজ আর নেই।তবু সেই মধুর স্মৃতি মনকে অস্থির করে তোলে। কিংশুক যখন পঞ্চম শ্রেনিতে পড়ে, তখন থেকেই মনোরমাকে ভালো লাগতে শুরু করে। মনোরমা যখন সাইকেল চাপা শেখে, তখন মনোরমার একটু বেঁকে সাইকেল চালানোর দৃশ্য আজও ভুলতে পারে না। প্রাইভেটে পড়বার সময় কিংশুক প্রায় মনোরমার দিকে তাকিয়ে থাকত। অষ্টম শ্রেনিতে একবার দাশরথি মাস্টারমশাইয়ের প্রাইভেটে মনোরমার সঙ্গে কিংশুকের প্রায় দেড়-দু মিনিট চোখের মিলন কিংশুকের স্মৃতিতে এখনও অমলিন। আজ সেই পুরানো মূহূর্তগুলি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একফোঁটা অশ্রু কালো ক্যানভাসে ঝরে পড়ে। কিংশুক সচেতন হয়। দূর্বল হলে তো চলবে না। তাহলে বিবাহের দিন মনোরমার সামনে দাঁড়াবে কীভাবে? কিংশুক তুলিতে করে সেই অশ্রুতে রঙ মিশিয়ে কালো ক্যানভাসকে রঙীন করে তোলে।
তবু বারবার পুরানো সময় ফিরে আসে। মাধ্যমিকের পর মনোরমা শহরে একটি স্কুলে ভর্ত্তি হয় এবং সেখানেই থাকতে শুরু করে। কিংশুকও সেই শহরের অন্য একটি স্কুলে ভর্ত্তি হয়। মনোরমার দেখা পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে শহর ঘুরেও মনোরমাকে চাক্ষুষ দেখা হয়ে ওঠেনি।ধীরে ধীরে কিংশুক নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজের মনকে ঠুলি দিয়ে জোড় করে বাঁধবার চেষ্টা করে। জীবনের সব চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার বাস্তবতা যে মেলে না। আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও ভবিষ্যত্ চিন্তা করে মনোরমার প্রতি তার ভালোবাসাকে অবদমিত করতে শুরু করে।
আঁকতে আঁকতে রাত দুটো বেজে যায়। সকালে সানাইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙে কিংশুকের। পরিণয়ের সানাই ব্যথাতুর কিংশুকের কাছে বিসর্জনের সানাইয়ের মতো লাগে। আজ মনোরমার বিবাহ। নানা ভাবনা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দিবাভাগ পড়ে আসে। পশ্চিমাকাশে সূর্যের কিংশুক বর্ণের ছটায় সারা আকাশ কিংশুক বর্ণ ধারণ করে। বিদায় মূহূর্তে দিগন্তের এই রঙের রাগিনীতে কিংশুকের চোখও রেঙে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শেষের কবিতা'র এই ছত্রগুলি যেন জীবনের সঙ্গে মিলে যায়:
"তব অন্তর্ধানপটে হেরি তব রূপ চিরন্তন।
অন্তরে অলক্ষ্যলোকে তোমার অন্তিম আগমন।
লভিয়াছি চিরস্পর্শমণি;
আমার শূন্যতা তুমি পূর্ণ করি গেছ আপনি।
জীবন আঁধার হল, সেই ক্ষণে পাইনু সন্ধান
সন্ধ্যার দেউলদীপ চিত্তের মন্দিরে তব দান।
বিচ্ছেদের হোমবহ্নি হতে
পূজামূর্তি ধরি প্রেম দেখা দিল দুঃখের আলোতে।"
কিংশুক ঘরে ঢুকে বইয়ের তাক থেকে অনেকদিন আগে কেনা 'শেষের কবিতা' বইটি বের করে। তিনটি ছবির সঙ্গে বইটিও রঙীন কাগজ দিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর সেই উপহারগুলিকে নিয়ে ধীরে ধীরে আলো ঝলমলে, সানাইয়ের উত্সস্থলের দিকে এগিয়ে যায়।
মনোরমা বেশ সুন্দর সেজেছে। বিবাহের সাজে অপরূপা লাগছে। মনোরমার বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে কী করবে কিংশুক ভেবে পেল না। চোখে চোখ পরতেই মনোরমা কিংশুককে ডাকল। উপহারটি মনোরমার হাতে তুলে দেওয়ার সময় বলল,"বেশ সুন্দর লাগছে তোকে, এই কনের সাজে!" বিনিময়ে মনোরমা মৃদু হাসল।উপহারটিকে গুরুত্ব না দিয়ে মনোরমার কিংশুকের সঙ্গে ছবি তুলতে চাইল। ছবি তোলার সময় কিংশুক নিজেকে খুব ছোটো মনে করছিল। মনোরমা যদি তার মনের সব কথা জানত তাহলে কি এইভাবে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত? তাছাড়া নিজের পোষাকটাও খুবই নিম্নমানের মনে হয় কিংশুকের। জুতোটাও তো ছেঁড়া। মাঝে মাঝে নিজের পোষাকের দিকে, আবারও সেই আলোয় সজ্জিত সিংহাসনে বসে থাকা মনোরমার দিকে তাকিয়ে নিজের সঙ্গে তার পার্থক্যটা দেখে নিচ্ছিল।
ভারক্রান্ত মনে কৃত্রিম হাসি একটা সাজিয়ে রেখে মনোরমার সামনে একটি চেয়ারে সে বসল। নানা আমন্ত্রিত অতিথির আনাগোনা ও তাদের সঙ্গে মনোরমার হাসিমুখে বাক্যালাপ দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেল। তবে মনোরমা এবং তার এক দাদা ছাড়া মনোরমার বাড়ির কেউই কিংশুককে গুরুত্ব দিল না। একটা কথা পর্যন্ত নয়। কিংশুক বুঝতে পারল তার অবস্থান। মনোরমাকে পাওয়া হয়নি এই পার্থক্যের কারণেই। সানাইয়ের শব্দ ও খুশির কোলাহলের মাঝে কিংশুক একপাশে স্থির দৃষ্টিতে মনোরমাকে দেখে যাচ্ছিল।
উলুধ্বনিতে কিংশুকের চমক ফিরল। বর এসে গেছে। প্রায় সকলে বর দেখতে চলে গেল। মনোরমা একা হয়ে গেল কৃত্রিম ফুলে সজ্জিত সিংহাসনে। মনোরমার চোখে চোখ পরতেই কিংশুকের মনে পড়ে গেল সেই অষ্টম শ্রেনির কথা। চোখ ছলছল করে উঠল। তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। মনোরমা জিজ্ঞাসা করল,"কিরে, খেয়েছিস?"
"হ্যাঁ!" বলে কিংশুক উঠে গেল মনোরমার দিকে। মিথ্যা বলা ছাড়া তার উপায় ছিল না। খাবার যে আজ তার মুখে রুচবে না -এই কথা মনোরমাকে তো বলা যায় না।
"আমি আসি রে!" কিংশুকের কথায় মনোরমা বলল,"আমার বরটাকে দেখে যা।"
"দেখেছি! খুব সুখী হবি তুই!" বলেই কিংশুক চলে আসে। এর চেয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আর যে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারত না। জীবনের বহু মূল্যবান জিনিসটা যে অপরের হয়ে যাচ্ছে এই জন্মের মতো!
এতদিন যার ভাবনায় মন ছন্দে বেজে উঠত, স্মৃতির ছত্রে ছত্রে ভালোবাসার কবিতারা আসত- আজ সেই কবিতারা থমকে গেছে। বিদায় মূহূর্তগুলিকে সক্রিয় করে এখন কেবল একটাই কবিতা বেজে উঠছে-"হে বন্ধু বিদায়!"
"খেয়েছিস?" মনোরমার দাদার ডাকে থামতে হয়। "হ্যাঁ, খেয়েছি!" প্রায় কণ্ঠরুদ্ধ কিংশুক অপ্রস্তুত হয়ে হনহন করে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। আলো পেরিয়ে রাস্তা ক্রমশ অন্ধকার হয়। তবু এই অন্ধকারে চলার মধ্যে কিংশুক তৃপ্তি বোধ করে। কারণে এবারে তার চোখে জল আর কেউ দেখতে পাবে না। এটাই তার যে ভালোবাসার গোপন গর্ব। ভালোবাসা যেন নদীর মতো উত্সস্থল থেকে এখন মোহনাতে মিশে গেছে সাগরের আহ্বানে। সেখানে হয়তো নদীর রূপটা লুপ্ত। কিন্তু অসীমতা তো থাকবে। নদীর বিসর্জনের ক্রন্দন সমুদ্রের গর্জন হবে সেখানে- সে ছাড়া সেই গর্জনের ভাষা কেউ কখনো বুঝবে না।
হাঁটতে হাঁটতে মনোরমার ছবি কিংশুকের মনে ভেসে ওঠে। পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে আলোগুলি চোখে জলসাটে লাগছে। উলুধ্বনি ও সানাই ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে...
রুমাল নিয়ে চোখ মুছে নেয় কিংশুক। তবু প্লাবন রুধিবে কে? তুবড়ি বাজির ফুলঝুরি আলো ক্ষণিকে অন্ধকারকে রঙীন আলোয় আলোকিত করে আবার নিভে যাচ্ছে। চিত্তাকর্ষক সেই মূহূর্তের দৃশ্য ভোলবার নয়। তবু কখনো সেটা স্থায়ী হয় না। স্থায়ী হয় বারুদের গন্ধ, অন্ধকারকে আপ্লুত করে।
সুচিন্তিত মতামত দিন