কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুলে দেখতে তো অনেকটাই ছেলে ছেলে লাগে। কিন্তু ছেলে তো নয় শম্পা। দেহের সামনের গোল সোনার পাহাড় পিঙ্গল চূড়া সমেত ক্রমশ আরও গোলাকার আরও দুর্বিনীতভাবে বেড়ে উঠছে। খুব সতর্ক থাকতে হয়, ওড়না যেন সরে না যায়। পিরিয়ডের জ্বালাতন থাকেই। তার মধ্যে, কেউ যেন না দেখে - ব্যাপারটা খুবই মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সকালবেলা দোকানের শাটার খোলার সময় কোত্থেকে যেন ঠিক ভজা-কাকু মানে ভজহরি পাল এসে দাঁড়ায়। মুখে বলে, কী রে পাগলি ভালো আছিস তো ? আহা! যেন কতো স্নেহ ঝরে পড়ছে, কিন্তু নজর সেই নিচু হয়ে শাটার খোলার সময় ঝুঁকে পড়া বুকের দিকে। কেন যেন ওকে একেবারে পছন্দ করেনা শম্পা। কী করা যাবে। পাড়ার লোক। সময়ে অসময়ে অনেক সাহায্যও করে। এছাড়া তেমন কিছু ঝামেলা হয়নি কখনো। আবার এও ভাবে হয়তো ও নিজেই ভাবছে মনে মনে।আদতে মানুষটা সত্যিই তেমন কিছু নয়।
শম্পা জন্ম থেকেই শতদল ড্রাগস এর মালিক হিসেবে ওর বাবাকে দেখে এসেছে। কী সুন্দর ছিল বাবা। প্রায় রোববার করে চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, নিক্কোপার্ক কোথাও না কোথাও নিয়ে যেত চারজনকে। মানে শম্পার মা, বাবা, শম্পা আর ছোটোবোন রিম্পা এই চারজন মিলে। ছোট্ট রিম্পা আসার পর একটু হিংসে তো হয়েইছিল, একেশ্বরী শম্পার আদরের রাজকোষে যদি টান পড়ে ? কিন্তু রিম্পার সেরেল্যাকগন্ধী তুলতুলে মুখে “ দিইইদ্দি ” ডাক শুনে সব হিংসা কোথায় লুকিয়ে পড়লো কে জানে। গত দু’বছরে শম্পার বাবা শতদল কিডনির অসুখে ভুগছে। দোকানে আসতে পারে না। শম্পাকেই দোকান খুলতে হয় রোজ। লোহার শাটারের শক্ত হ্যান্ডেল টেনে টেনে হাতের চামড়াও কর্কশ রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। এইতো সেদিন ফলিক ট্যাবলেটস্ কিনতে এসেছিলো বনানী। ওর উচ্চমাধ্যমিকের বন্ধু। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাচ্চা হবে । এইসময় খেতে হয় ফলিক, আয়রন ট্যাবলেটস। খুব ভালো লাগছিলো শম্পার। বাবার মুখ ভাসতেই আবার কাজে মন দিলো।
একমনে ওষুধের লিস্ট দেখে টিক মারছিল কোন ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, কোনটা আনবে এইসব। টাকার জন্য কত দরকারি ওষুধ আনতে পারে না। অথচ কত চাহিদা। কী করা যাবে। ঠাকুর কেন এত কষ্ট দিচ্ছে ভেবে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কেউ এসে দাঁড়িয়ে আছে। শম্পা চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলো :
- কী লাগবে বলুন ?
- ম্যাডাম আমি সিপলা থেকে এসেছিলাম। আমাদের এই ইনহেলার ইনটেক করার একটা দারুন জিনিস আছে দেখুন। কোনও সাইড এফেক্ট নেই। বিক্রির উপরেও ভালো লাভ...
- এই জিনিসগুলো রাখার মতো আমার টাকা নেই বুঝলেন ? জ্বর বমি পেটখারাপ এরকম মামুলি ওষুধ ছাড়া আমার দোকানে দামী ওষুধ রাখার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। স্যরি। আপনি আসুন।
চোখ তুলে এবার রিপ্রেজেন্টেটিভের মুখটা দেখলো। কী সুন্দর দেখতে ছেলেটা । রিপ্রেজেন্টেটিভ কী বলবে ভেবে না পেয়ে পরে আসবো বলে চলে গেলো।
রাতে খাওয়ার সময় মাকে জিজ্ঞেস করলো :
- ডাক্তারকাকু আজ কী বলে গেলো মা ?
- আর কী বলবে? আরও কতগুলো টেস্ট লিখে দিয়ে গেছে। কী হবে রে ? আমার গয়নাগুলো দিয়ে তোকে আর রিম্পাকে বরের ঘরে পাঠাবো ভেবেছিলাম...
- আমি ছেলে হলে ভালো হতো। অন্তত এই কথাগুলো তোমাকে বলতে হতোনা।
খাওয়ার পর বাবার কাছে বসে অ্যাকোয়াটিকায় জল ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে স্নানের সময় রিম্পার ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলার কথা নিয়ে কত মজা, হাসাহাসি করলো বাপ-বেটি। রিম্পাও বাবার বিছানায় এসে কোলের মধ্যে ঢুকে আপত্তি জানাতে লাগলো । এখন সে বড়ো হয়ে গেছে । এসব বললে তার লজ্জা লাগে না বুঝি? রিম্পাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে বাবা বললো :
- দোকানের কী খবর রে ?
- তুমি এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামিয়োনা তো। আমি তো আছি ।
- ঠিক। তুই আমার একশো ছেলের বেশি।
- হুম, মা’কে একটু বলে দিয়ো তো , কেমন ফিঁচ ফিঁচ করে কাঁদে। মেয়েদের মতো হা হা হা...
- তুই যখন মা হবি বুঝবি মায়েরা কেন কাঁদে। বাবারা কাঁদে না...
- নাও , এবার তুমিও ?
বাবার মুখটা ধরে আদর করে, মাথার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।
নিজের আশপাশে যতদূর দেখা যায় সেই মাটিটুকু ছাড়া বাকি সঅঅঅব জল, জল আর জল। কোথায় এসেছে শম্পা? সামনে বিরাট নদী না সমুদ্র বোঝার উপায় নেই। মেঘলা আকাশে বিরাট বিরাট ঢেউগুলো গিয়ে যেন ধাক্কা মারছে। কেউ নেই কেনো? এখানে বাড়িঘরও তো দেখা যাচ্ছে না। হাজার চীৎকার করলে কেউ শোনার নেই। কেমন গা ছমছম করছে এবার । পাড়ের দিকে দৌড় শুরু করতেই শুনতে পেলো ডাকছে যেন কাকে। শম্পাকে? এখানে কে তার চেনা ? তাকিয়ে দেখলো সেই মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। সরু একটা নৌকোয় । সামনে পিছনে করে মাত্র দুটো সিট। রোয়িং ক্লাবের নৌকোগুলোর মতো। সামনের সিটে বসে দুহাতে দাঁড় বাইছে । পিছনের সিটটা খালি :
- ম্যাডাম শুনছেন...আমি সিপলা ছেড়ে দিয়েছি...সেলিং টার্গেট পূরণ করতে পারছিনা। আমি আর আপনি মিলে মামুলি ওষুধই বেচবো। ম্যাডাম...
একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেলো। চোখটা খুলেও আবার বন্ধ করে মনে মনে লজ্জা পেলো খুব। ধুর , স্বপ্নও এরকম হয় ! হাসিও পেলো। ঠিক করলো গড়িয়াহাট যাবে। দুটো ডিপ কালারের কুর্তি কিনবে যাতে ওড়না পরতে না হয়। দু’/ তিনমাস চললেই হবে । শাটার খোলার সময় খারাপ দেখতে লাগবে না।
ছোট্ট এবং সুন্দর । ভালোলাগা জানালাম ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ।
মুছুনঘুমের জানালা দিয়ে ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন গুলো অনন্ত পিপাসার্ত। তাতে পূরণের সত্য হয়তো থাকেনা, কিন্তু স্বপ্ন টা তো সত্য'ই...
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ।
মুছুনছোট , কিন্তু ভালো লেখা । এক দমে পড়ার মত , সাবলিল । পড়ার পর 'আমি আর আপনি মিলে মামুলি ওষুধই বেচবো। ম্যাডাম...' সংবেদনার রেশ রেখে যায় ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দাদা । আপনার প্রতিক্রিয়া পেয়ে ভাল লেগেছে
মুছুনবাহ ...রে ... অদ্ভুত ...
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ।
মুছুন