স্কুলবাস থেকে নামতেই মীনার নজর পড়ল ছেলের মুখের দিকে। ভালভাবে নজর করে দেখল সে। মুখটা কিছুটা ভাবলেশহীন। স্কুল ইউনিফর্ম যথারীতি ধুলো মাখামাখি। পায়ের স্কুল শ্যুতেও একরাশ ধুলো। ওটা পালিশ করতে মীনাকে হিমশিম খেতে হবে। সাদা ইউনিফর্ম এতো ময়লা করে যে ওয়াশিং মেশিনে দিলেও হাত দিয়ে ভাল করে সাবান ঘষে দিতে হয়।
ছেলের হাতটা ভালভাবে শক্ত করে ধরল মীনা। রাস্তায় যা ট্রাফিক – যা ছটফটে ছেলে। রাস্তা পেরিয়ে হাউসিং এর গেট দিয়ে ঢুকেই ছুট লাগাল বিট্টু। স্কুলব্যাগের বোঝাটা আগেই মায়ের কাঁধে পাচার করে দেয় সে। স্কুল ছুটির পর বিট্টু মুক্ত বিহঙ্গ। সাত ঘন্টা স্কুলের পর বাস থেকে নেমেই হাউসিংটার ভেতরে চারপাশের রাস্তা ধরে একটা চক্কর। তারপর স্লাইড, ঝুলা – তারপর মায়ের ডাকাডাকি – তারপর তিনতলার ফ্ল্যাটে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা। এ বিট্টুর রোজকার রুটিন।
আজ অবশ্য বিট্টু এতক্ষণ সময় লাগাল না ফ্ল্যাটে ঢুকতে।
একটু স্লাইড আর ঝুলা চেপেই দৌড় দিল সিঁড়ির দিকে। ক্লাস টু বিট্টুর। সাত বছরের ছটফটে ছেলের সঙ্গে কি প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই মা দৌড়ে পারে? হাঁফাতে থাকে মীনা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে ফ্ল্যাটের তালা খোলে। ব্যাগটা থপাস করে রাখে চেয়ারের ওপর।
বিট্টু আজ দেরি করল না। পায়ের শ্যু তাড়াতাড়ি খুলে বসল সোফায়। মুখটা কেমন শুকনো। চোখদুটো ছলছলে। মীনার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘মাম্মা, আমি আজ স্পোর্টসের হিটে সিলেক্ট হই নি’।
ইতিমধ্যে চোখদুটো জলে ভরে এসেছে ছেলেটার। চোখের কোল ছাপিয়ে তা বইতে শুরু করেছে গাল বেয়ে। ঠোঁটদুটো ফুলে উঠেছে তীব্র ব্যর্থতায়, বেদনায়, হতাশায়। ‘মাম্মা, আমি কত আশা করেছিলাম যে আমি সিলেক্ট হব। চিতার মত ছুটতে পারি আমি মাম্মা। কিন্ত ঐ ছেলেটা আমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল মা। আমি হেরে গেলাম’। হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে বিট্টু।
মীনা হতভম্ব হয়ে যায়। হ্যাঁ, আজ বিট্টুদের স্পোর্টসের হিট ছিল। ছেলেটা ভাল দৌড়য়, তাই হয়তো খুব আশা ছিল ও হারবে না। কিন্তু এইটুকু ছেলের মনে যে ব্যর্থতার এতখানি গ্লানি তা তো আঁচ করতে পারে নি মীনা। এইটুকু ছেলের মনে হেরে যাওয়ার এমন যন্ত্রণা?
ছেলেকে সান্ত্বনা দেবে কি, মীনার নিজেরই চোখ ফেটে জল এল। ছেলে তখনও বিলাপ করে চলেছে, ‘মাম্মা, অয়ন, পার্থ ওরা সবাই সিলেক্ট হল; আমি হতে পারলাম না...’।
মীনা বসল ছেলের পাশে। বিট্টুর মাথাটা টেনে নিল নিজের বুকে।
বলতে লাগল, ‘ওরে আমার ছোট্ট সোনা, জীবনে আরও কত স্পোর্টস আসবে। একটাতে সিলেক্ট হতে পারিস নি তো কি হয়েছে পরের বার হবি আর যদি না-ই বা সিলেক্ট হলি, তাতে কি হল? কিছুই না। এতো কাঁদে না সোনা। খেলায় হার জিত তো আছেই। আজ যে হারল কাল তো সে জিততেও পারে বাবু। ওঠ, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নে। খুব খিদে পেয়েছে তোর’।
একটু শান্ত হয় বিট্টু। মায়ের কোলে শুয়ে খোলা জানালা দিয়ে চোখে পড়ে দূরের নীল আকাশ। সেই আকাশে একঝাঁক পায়রার ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে বিট্টু বলে ওঠে, ‘পরের বার মাম্মা দেখো ঠিক সিলেক্ট হব। তখন আমিও হাসব আর তুমিও হাসবে ঐ আকাশটার মত! ঠিক না মাম্মা’?
মীনা তাকায় বিট্টুর দিকে, এক চোখে জল, এক চোখে হাসি।
সুচিন্তিত মতামত দিন