অরিণ দেব

মায়াজম
1

                             দেহ....বাদ!




 গর্ভ ফুঁড়ে বেরিয়েই মানুষ যাযাবর । দশমাসের ঘরটি ভেঙে যেই না বেরিয়ে পড়েছে , সেই থেকে যাযাবর । ঠিকানা নেই , ঘর নেই , শুধু ডেরা আছে । মানুষ হয়তো এতেই খুশী , মানুষ হয়তো এটাকেই জীবনের ধ্রুব মেনে নিয়েছে । গর্ভের বন্ধন শেষ হলেই মানুষ স্বাধীন , তার  ভাবনা স্বাধীন , চেতনা স্বাধীন ! এমন কি এই যে ব্যক্তিগত পেট , যে কিনা এতকাল অন্যের ওপরে ছিল নির্ভরশীল সে বেচারাও স্বাধীন ! তখন পেটকেই খুঁজে খেতে হয় , পাখির মতো কিংবা শকুনের মতো । যাযাবর মানুষের যেন কোনও অস্তিত্ব নেই , আছে অদৃশ্য একটা  বন্ধন । এই বন্ধন কিসের বন্ধন ? রক্তের না মনের না সময়ের বন্ধন ! গর্ভ থেকে বেরিয়েই এই যাযাবর মানুষেরা সত্যিই কি হারিয়ে যায় ? কোথায় হারিয়ে যায় ? আর গেলে কেনই বা যায় । জীববৈচিত্র্য , জন্মবৈচিত্র্য আদিম রহস্যের ঘেরাটোপে রয়েছে । আদি নেই , অন্ত নেই , শুধু চলন আছে । চলনটুকুই দেখতে পাওয়া যায় , বাকিটুকু থাকে উহ্য । যেহেতু মানুষ যাযাবর প্রজাতি ( সে মনের দিক থেকেই হোক বা বাহ্যিক দিক থেকেই হোক ) তাই তার চেতনায় স্থায়ী কোনও অস্তিত্ব নেই । সম্পর্ক আছে অথচ সম্পর্ক নেই । গর্ভ ফুঁড়ে বেরিয়েছে সে একা , আজীবন সে একা । তার বন্ধু নেই , শত্রু নেই , আছে শুধু সে নিজে ।যে মানুষটি একা নির্গত হয়েছে পৃথিবীতে , সে প্রথমত নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখবে কী ? যা-ই দেখুক না কেন তার মধ্যে জড়িয়ে থাকছে তার ব্যক্তিগত আমি , তার ব্যক্তিগত আমিত্বদর্শন । গর্ভদেবী ছাড়া জন্মের আগে পর্যন্ত তার কোনও বন্ধু ছিল না , গর্ভদেবী ছাড়া জন্মের আগে পর্যন্ত তার কোনও প্রেমিকাও ছিল না । এবং না ছিল গোলাপের খেত না ছিল শ্মশান । গর্ভ-ভেঙে বেরিয়ে আসা যাযাবর প্রথমে যেটুকু বুঝতে পারে সেটুকু হল খিদে ও দুধের জগত । গর্ভধারিণী তার খিদে মুখে ধরেছেন দুধের স্বর্গ । ছোট জিভে চুকচুক পান করতে করতে হেসে উঠছে যাযাবর , যা দেখে পৃথিবীর প্রথম ঈশ্বর-দর্শনের জন্ম হচ্ছে গর্ভধারিণীর চোখে ।  তাহলে যাযাবর জীবনের সামান্য যেটুকু বন্ধন আছে সেইটুকু রয়েছে মাতৃস্তন ও একটা ঈশ্বর সম্বন্ধীয় ভাবাবেগ । কিছুদিন পরে যাযাবর অবশ্য ভুলে যায় সেইসব ঐশ্বরিক দিনের কথা । পথেঘাটে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্তিতে কোথাও ঘুমিয়ে পড়লে মাঝেমধ্যে স্বপ্ন আসবে হয়তো তখন । স্বপ্নের মধ্যে গর্ভধারিণী ফলন্তস্তন নিয়ে খুঁজতে এসেছেন সন্তান । হারিয়ে যেতে যেতে , ফুরিয়ে যেতে যেতে যাযাবর যেন দেখতে পাচ্ছে , কিংবা দেখতে পাচ্ছে না দৃশ্য , বাস্তবে ।

মা ছাড়া বাকি সম্পর্কগুলো ঝুরোমাটি । আঙ্গুলের ফাঁক গলে সুযোগ পেলেই ঝরে যায় , ঝরে যায় । মা-ই একমাত্র নারীজাত শব্দ , বাদবাকি নারীজাত শব্দের রেশ । জেট প্লেনের ধোঁয়ার লেজটা জেট প্লেন নয় , তেমন নারীজাত শব্দগুলো মা  নয় । নারী শব্দের বিনিময়ে পুরুষেরা বিপরীত অস্তিত্ব খোঁজে । নারীশব্দ একটা আকরগ্রন্থ যেন , আর পুরুষেরা ব্যক্তিবিশেষ তার স্বাদ নিতে আসে । নারী বলতে বুঝি - পানের ডিবের সামনে বসেছে মা , খয়ের , চুন , সুপারি দিয়ে খিলি করে মুখে পুরছে , আমি সামনে বসে মায়ের মুখের পানস্বাদ নিজের মুখে আস্বাদন করছি । এই মা আমার কাছে দেবীকল্প । যাযাবর স্মৃতির মধ্যে হৃদবিষয়ক কিছু যদি থেকে থাকে তো সেটা হল মা । সেই মাকে আমি যাযাবর হৃদয়ে যত্রতত্র ঘুরতে দেখি , ঘুরতে দেখি জ্বরের সময় , স্কুলের ব্যাগ পৌঁছে দেওয়ার সময় , দেখি ঘুম না এলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় । যাযাবর প্রাণে সামান্য যে  ঘরের ঠিকানা কোথাও থেকে থাকে - সেই ঠিকানা মা ।যাযাবর পুরুষ ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক , ভীষণ স্বার্থপর , খুব লোভী । যদিও জন্ম হয়েছে তার মা- কেন্দ্রিক অক্ষে ,  তবুও সেই মা-কেন্দ্রিক অক্ষেই কিন্তু তার কামনা বাসনার জগত  ।
নারী একটি রূপকধর্মী গাছ । পুরুষ একটি রূপকধর্মী পাখি । গাছ পাখিকে চেনে না , তবু সুসময় কিংবা দুঃসময়ে গাছের শাখাপ্রশাখায় পাখি বসে শুনিয়ে যায় কীর্তন । গাছ গ্রহণে যত পারদর্শী হতে পারে পাখি ততবেশি সুযোগ পায় আশ্রয়ের । গাছের ডালে বসেই পাখি খাচ্ছে , সঙ্গম করছে , সন্তান উৎপাদন করতে করতে মরেও যাচ্ছে একদিন , অথচ গাছের মৃত্যু নেই । নারীকে আমি কোন চোখে দেখি তার চেয়েও বড় কথা হল নারী আমাকে কী চোখে দেখে ! দেখাটা উভয়কেন্দ্রিক সাম্য না হলে মনের চিত-চেতনায় অসাম্য বিরাজ করে । অসাম্য থেকে আসে একে-অপরের প্রতি অবিশ্বাস । অবিশ্বাস থেকে আসে ভোগ । ভোগের কেন্দ্রে এসে পুরুষ সম্পূর্ণ ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে অনেকসময় নারীর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে । বিপরীত মেরুতে অবস্থানের হেতু পুরুষের চেতনার বিস্তার যতটা না আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার কথা , সেটা না হয়ে দেহকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে । আর দেহ তে এসেই পুরুষ হয়ে ওঠে প্রকৃত যাযাবর । তখন না পারে মায়ের কাছে পৌঁছতে না পারে অন্যান্য নারী সম্পর্কগুলোর  কাছে পৌঁছতে । একটা আজগুবি রহস্যের মধ্যে পড়ে পুরুষ ডুবতেই থাকে ডুবতেই থাকে । ডোবাটা যেন তার ভবিতব্য । ডোবাটা যেন তার ইহকাল পরকার  । পুরুষের যৌনতার আগমনই হচ্ছে প্রকৃত অর্থে যাযাবর অবস্থান ।

কিন্তু , এটাও যেন শেষ কথা নয় । তাহলে প্রশ্ন এসে যাবে - সহধর্মিণীর অবস্থানটা কি যৌনতা কেন্দ্রিক ? বা বান্ধবী বা দিদি বোন মাসি পিসি ইত্যাদি ইত্যাদি ! এ আজব এক খুঁড়োরকল । পুরুষ মনেপ্রাণে এই যৌন অবস্থান থেকে পালাতে চায় বলেই আরও গভীর করে যৌন অবস্থানে আটকা পড়ে যায় । জন্মভেদেই সর্বশক্তিমান পুরুষের কোষে বিশেষ কিছু গুণ বা বিশেষত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন । শারীরিক বিশেষত্বগুলোই যে মানবিক স্তরে প্রসারিত হতে হতে পুরুষের সংক্রমণে পৌঁছে দেবে , এটা কে আর জানত । শারীরিক সক্ষমতা ( পুরুষ অন্তত সেটাই মনে করে ) মানুষকে দানব করে তুললে মানবিক গুণগুলো হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক । তাই অন্ধকারে পুরুষকে চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলে তার যৌনখিদে সর্বনাশ করে দিতে পারে যে কোনও সম্পর্ককে । নারীরা এসব ব্যাপারে অজ্ঞ নয় , কিন্তু অনুভূতির পর্যায়ে তারা যেহেতু নদী তাই ভাসতে হলে বৃষ্টিই কামনা করে সে ।পুরুষ প্রধানত যাযাবর , ঘর নেই , বাস নেই , একটা দেহ আছে ভোগের জন্য ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. রূপকধর্মী পাখির মৃত্যু আছে, রূপকধর্মী গাছের মৃত্যু নেই... সত্যি নেই।

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন