আত্মভাষার কবিতা ঃ কিরীটীভূষণ পাৎসা
তখন সাত কি আট বছরের, বাবামাকে ছেড়ে প্রথম বাইরে গেছি জ্যেঠুর সঙ্গে, ছাতনা, হাবুল-মাণিকদাদের বাড়ি । ওখানেই এক সন্ধ্যায় ঘরোয়া জলসায় শুনি প্রথমবার ।
“দদ্যাড়ে ফাগুন আল্য রে -
দক্ষণ্যা বাতাস্ সারাগায়ে কেরেকুতু দিয়ে গেল রে,
ওরে উচ্কায়্যে দিয়ে গেল রে- ওরে হুদ্কায়্যে দিয়ে গেল রে-
দেখি সিতানের জানালাটা খুলে,ধুলাতে পাতাতে টিক্ ডাং খেলে
বাগ্পারা মেঘ আকাশের কোলে সাদা ডেনা মেলে দিল রে ।”
কেউ একজন আবৃত্তি করেছিলেন এবং তাঁর পরিবেশনা ছিল যথেষ্টই হাস্যরসাত্মক, তবু এই পঙ্ক্তিগুলি ভুলতে পারি না । ‘“দদ্যাড়ে ফাগুন আল্য রে’ ... ‘ফাগুন আল্য রে দদ্যাড়ে’ ফিরে ফিরে আসে মনে, গেঁথে যায়; পরাবাস্তব হ্যাজাকের ঘিরে কয়েকজন, হারমনিয়াম-তবলা, গান-মস্করা-কথাবার্তা সরিয়ে শুধু এই র-ধ্বনির পৌনঃপুনিকতা, এই ভাষাঐশ্বর্য, এই ‘দক্ষণ্যা বাতাস্ সারাগায়ে কেরেকুতু দিয়ে গেল রে’... রয়ে যায় ।
কার লেখা ?
এই প্রশ্ন মনে আসেনি তখন ।
পরে মানবেন্দু রায়, তাঁর শৈশব ছাতনায় কাটিয়েছেন শুনে, এই প্রসঙ্গ তুলি ।
“তুমি শুনলে কোথায় ?”‘
আমি সবিস্তার বললে, উনি বললেন, “ কিরীটীভূষণ পাৎসা, আমার বন্ধুর বাবা । মনোহরপুরে থাকতেন । এই কবিতা কোথাও ছাপা হয়েছিল কিনা জানি না,তবে ছাতনা-কেঞ্জাকুড়ার মানুষদের মুখে মুখে ফিরত একসময়
“ দুর্জয় জাড়ে কপাটের আড়ে, সাড়ে সাত আনা হয়ে, -
বেজায় কষ্টে আষ্টে পিষ্টে বাতের বেদনায় লিয়ে
ছেঁড়া কাঁথা গায়ে চিৎ হয়ে পড়ে দুমড়্যে মুচড়্যে কুঁকড়্যে গঁঞ্জুড়্যে
খাট দড়ি ধরে টানাটানি করে আছি-বা প্রাণটা লিয়ে ।”
এখনো তুমি যদি ওই অঞ্চলে যাও শুনতে পাবে । একটা কবিতা, অনিন্দ্য, ছাপা হল-কি-হল-না সেটাও ব্যাপার নয়, এইভাবেই সাধারণ মানুষের কালেক্টিভ স্মৃতিতে টিকে যায়, কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে ।”
একেই কি লোকসাহিত্য বলে ?
কবিতাটির নাম, জানতে পারি, ‘ফাগুন’ । বাঁকুড়ায় লোকসংস্কৃতিতে উৎসাহী ব্যক্তিত্বদের আমি সুযোগ পেলেই এর কথা বলতাম ।
পার্থ আমার বন্ধু, স্কুলে পড়তাম একসাথে । ওর বাবা, অচিন্ত্যকুমার জানা, ‘রাঢ় একাভাডেমি’র কর্ণধার, আমার ছাত্রবয়স থেকেই স্নেহ করেন আমাকে । লোকজীবন, লোকভাষা নিয়ে যথেষ্ট লো কাজ আছে ওঁর । ওঁকেও বলি ।
১৯৯৫ সালে ‘রাঢ় একাভাডেমি’ কিরীটীভূষণ পাৎসার কবিতার বই ‘ফাগুন’ প্রকাশিত হয়, কবির প্রথম বই এবং এটিই একমাত্র । অচিন্ত্যবাবু লেখেন, “ফাগুন কবিতাটি যখন লেখা হয় তখন কবি একজন পূর্ণ যুবক । এটিই তাঁর প্রথম কাবিতা । সেই সময়ে কোনো পত্রিকাতে ছাপাও হয়েছিল, কিন্তু এখনও তার সন্ধান সন্ধান পাওয়া যায়নি । পাণ্ডুলিপিটিও হরিয়ে যায় । এখন কবি বৃদ্ধ তাঁকে ‘ফাগুন’ কবিতাটি লেখার জন্য অনুরোধ করা যায়, তিনি আবার নূতন করে ‘ফাগুন’ কবিতাটি লিখে আমাদের হাতে দেন, কিন্তু পুরানো কবিতার সঙ্গে এরকোনো মিল ছিল না । দীর্ঘদিন পর ছেঁরা-খোঁড়া অবস্থায় পুরানো কবিতাটির কিছু কিছু অংশ পাওয়া যায়, সেই অংশগুলি ঠিক ঠিক জায়গায় কবিতাটির মধ্যে সংযোজন করা হয়েছে ।”
বইটিতে ‘ফাগুন’সহ মোট আটটি কবিতা আছে । আছে কবির ভ্রাতুষ্পুত্র মলয় কুমার পাৎসা রচিত ‘কবি প্রসঙ্গ’ যা থেকে আমরা ব্যক্তি কিরীটীভূষণ সম্পর্কে জানতে পারি ।
এই বই প্রকাশ অনুষ্ঠান সম্পর্কে কবির প্রতিক্রিয়া ছিল, “ হ্যাঁ, আমি আনন্দিত আমার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে জেনে । তবে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কোনো ইচ্ছে আমার নেই ।”
আসেননি তিনি । আনুষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি, সম্মাননা পাননি আজীবন । অভিমান ? স্বাভিমান ?
পরবর্তীতে কেঞ্জাকুড়া অঞ্চলের লোকজনের সঙ্গে আমার পেশাগত যোগাযোগ গড়ে ওঠে । কবির কথা জানতে চেয়ে দেখেছি, সবাই যে কিরীটীভূষণ পাৎসার নাম জানেন এমন নয় ; কিন্তু ‘ফাগুন’ কবিতাটি প্রায় সকলেই শুনেছেন ; অনেকেই গড়গড় করে বলতে পারেন ।
“ ঐ ছুটেছে ফাগুন ইধারে-উধারে ফাগুন ছুটেছে চারধারে,
তার হুরহুরানিটা কমর কাঁকাল্যে, শিশিরনিটা বাঁশঝাড়ে ।
লেঞ্জারের দড়ি হিঁচুড়্যে ছিঞ্জুড়ে ফাগুন উঠেছে সিতানে,
ঊঠেছে ফাগুন আথানে-বিথানে ।”
( ফাগুন )
অথবা
“ বুক গুড়ুগুড়ু গলা গদগদ, ফিচা জাং সব করে লদপদ
শরীর উঠেছে জুয়ানে -
শিরশির করে কমর কাঁকাল, ঝিরি ঝিরি টানে নামছে পেঁকাল
আহারে মগরা মুয়ানে ।”
( ফাগুন )
কবির জন্ম ৯ই কার্ত্তিক, ১৩২৯ ; বাঁকুড়া জেলার মনোহরপুর গ্রামে । বাবার নাম পূর্ণচন্দ্র পাৎসা, মা নগেন্দ্রনন্দিনী । শৈশবেই পিতৃহারা, নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন স্কুলের পড়াশোনায় সমাপ্তি । তারপর জীবিকার সন্ধানে নানা জায়গায় । বাঁকুড়ায় গুরু-ট্রেনিং নিয়ে যোগ দেন আমাকুন্দা গ্রামের পাঠশালায়, পরে নিজের গ্রামে সত্যায়ন নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে, ধোবার গ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, লাপুড়্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং শেষে ঘাটতোড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন । ঘাটতোড় থেকেই অবসর ১৯৮৮তে । কবি ১৬ই জৈষ্ঠ্য ১৪০৩ ( ৩০ শে জুন ১৯৯৬ ) ইহলোক ছেড়ে যান ।
সাহিত্যে অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই । ব্যক্তিজীবনে প্রান্তিক, তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষজনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা; সেইসব মানুষদের মুখের ভাষা, তাঁদের জীবনবোধ, তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই, তাঁদের স্ফুর্তি – এই নিয়েই কিরীটীভূষনের কাব্যভূখণ্ড, যা সেইসময় পর্যন্ত বাংলা কবিতার মানচিত্রে একেবারেই অচেনা ।
“ এই সামাচ্ছি, এই বেরাচ্ছি, চাঁই পক্ পক্ ঘুরেই মরছি
থির কিছুতেই হতেই লারছি, চৈঁরে চৈঁরে হুপাল মারছি ।
হুদ্ হুদায়ে উঠেছে ভিতরে -
ঝট্কা উঠায়ে ভুড়ভুড়ি কাড়ে,
হুকুরবারও লয়, পুকুরবারও লয়, মাগের হাতের ম্যার্
বলতে লারার টেঁড়া চিপা যাঁকে গোক্লা ঘর আর ব্যার্ ”
( গোক্ল্যার ঘর-ব্যার্ )
এই লেখার অনুপ্রেরণা, এই লেখার সাহস তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বাসভুলি থেকে, প্রকৃতি ও জনজীবন থেকে ।
মনোহরপুর । বাঁকুড়া জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম, বাঁকুড়া ১ ডেভালাপমেন্ট ব্লক, কেঞ্জাকুড়া পঞ্চায়েতের অন্তর্গত জেলা শহর থেকে পশ্চিমে ২১ কিলোমিটার দূরে । এখন প্রায় ২০০ বাড়ি, প্রায় এক হাজার লোকের বাস । জীবিকা মূলত কৃষি, এছাড়া গ্রামের বেশ কিছু মানুষ কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন । ভূসম্পত্তির অনেকটাই ‘পাৎসা’ ( ব্রাহ্মণ ) পদবীর পরিবারগুলির; এছাড়াও তপশিলি জাতির মানুষদের বাস ।
একটু দূরেই দ্বারকেশ্বর নদ, প্রকৃতি রুক্ষ,এলাকার জমি দারুণ কিছু চাষ-উপযোগী নয় ।
গ্রামে রয়েছে সত্যায়তন আশ্রম, এই এলাকার ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে যার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ।
গ্রামটি থেকে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে ছাতনা ( একটি ব্লক হেডকোয়ার্টার), এক কালের সামন্তভূম রাজ্যের রাজধানী, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর রচয়িতা চণ্ডীদাস ছিলেন এই ছাতনারই অধিবাসী ।
বাংলাভাষর উপভাষাগুলির আলোচনার ক্ষেত্রে পণ্ডিতসমাজে ‘বাঁকড়ি’ কোনো আলাদা উপভাষা হিসেবে গৃহীত নয় । কিন্তু আমরা জানি মানুষের মুখের ভাষা ৮/১০ অন্তর বদলাতে থাকে । এই ছাতনা-মনোহরপুর-কেঞ্জাকুড়ার ভাষা বাঁকুড়া শহরের ভাষার থেকে ভিন্ন আবার আরও পশ্চিমের শালতোড়া-তিলুড়ি, রঘুনাথপুর-পঞ্চকোটের ভাষার থেকেও পৃথক ।
মনোহরপুরের লোকভাষাকে আমরা পশ্চিমবাঁকুড়ার ভাষা, সামন্তভূমের ভাষা বলতে পারি, যা বাঁকড়ি ভাষার মূল বিশিষ্টগুলি বহন করেও কিছু সূক্ষ্ণ নিজস্ব চরিত্র ধরে রেখেছে ।
এই ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পটভূমিকায় কিরীটীভূষণ পাৎসার লেখালেখি এবং তাঁর কবিতা এই অঞ্চলের এইসব চারিত্রিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধি ।
আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে এই লোকভাষায় কবিতা লেখার দুঃসাহসই আমাদের কাছে কবির জন্য সম্ভ্রম আদায় করে নেয়। কারণ, আজও আমরা দেখি এই ভাষায় কথাটুকু বলতে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় কুণ্ঠিত হয়, বাইরের লোকের সামনে এই ভাষা বলতে লজ্জা পায় । এবং এই ভাষা নিম্নবর্গের, অনভিজাতের এবং তাই হয়তো ‘অসম্মানের’ । তো, এই ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টির কথা কবির সমকালে ভাবাই যেত না।
কিন্তু ভেবেছিলেন কিরীটীভূষণ । লিখেছিলেন
“ফাগুন লাগেছে মনে, চিড়াকে উঠছে বনে
ই খেনে উখেনে এগনা উঠানে সরদলে
গুরু গুরু ছাঁচ কোলে কোলে
ফাগুন সিঁধাল ঢেঁকশালে ।
আনাচে-কানাচে ধসে ধাসে এই ঠেনে আর ঐ ঠেনে
বুকের পাঁজর হল ঝরঝরা ফাগুনা ইন্জেকসেনে ।”
( ফাগুন )
‘ফাগুন’ কবিতাটির দুইটি অংশ ঃ ‘ফাগুনের পূর্বাভাস বা শীতের বর্ণনা’ আর ‘ফাগুনের বর্ণনা’ । ‘ফাগুনের পূর্বাভাস বা শীতের বর্ণনা’ ৬টি স্তবকে, ‘ফাগুনের বর্ণনা’ ১৬টি স্তবকে বিভক্ত । স্তবকগুলি সংখ্যা দিয়ে ১,২,৩ . . . এইভাবে চিহ্নিত । বইটিতে ‘ফাগুন’ আর যে কবিতাগুলি আছে, যথাক্রমে ‘গোক্ল্যার ঘর- ব্যার্’, ‘সেই পলাশের তিনপাত’, ‘আপনজন’, ‘নেউতা’,‘জাড়েও ককিল ডাকে’, ‘ খেতার’, ও ‘আগমনী’ ।
কবিতাগুলি কবির আশেপাশের মানুষদের জীবনকেন্দ্রিক। এসেছে তথাকথিত নিম্ন-সম্প্রদায়ের
কথা ।
“বাউরী পাড়ায় উলুলা দিচ্ছে লুবার বিটির বিয়া
মাদলের বোল লহমে লহমে উঠছে ধুমুল্ দিয়া
ল হাঁড়ি মদ কুঁকড়া বরটা, বরের বাপ আর কত কাকা জেঠা
গলাগড়াতক্ হেঁড়া মদ মার্যে্ বেঁহুশ নেশার ঘোরে
ছাওলা তলায় স্যাত্ করে বর ছুপাচ্ছে মালা পরে।”
( ফাগুন )
আর এই সব প্রান্তজনের প্রতি কবির মমত্ব তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়
“ লেঠার ওপর লেঠা – দেবতার মার্
ট্যাঁড় বাইদ সোল তামাম ফুটকি ফুটা ।
ঘাঁট্যে চকুট্যে, গুঁতায়ে কাছাড়ে, কনরকম দিয়েছিলাম গাড়ে
কেউ-বা আফুটা কেউ-বা ফুটছে, ফুটতে ফুটতে তেথড়্যা মারছে
কড়ে কড়ে শুদু আগড়া –
পেট কলকলি অহোবিক্ল;ই তারই বাজছে লাগড়া
আশে পাশে ট্যাঁসো ধরেছে গাঁড়ুসে, পথ নাই পালাবার
ছাতুটুকু চাঁড়ে গোক্লা হেঁসুরে হেঁসুরে গোক্লা ঘর আর ব্যার ।
...
...
বাজারে লিচিন্ হল কেরাসিন, টুঁইয়ে উঠে গেছে চিনি
ভাতটি মার্যে ই আঁকাশিটা হাতে গ্যাছে স্যাজ বিটি ‘রিনি’।
তক-করে যদি বঁকটা মচ্যাড়ে, হিলাই হিচ্যাড়ে বাগাতেই পারে, -
রগ্যাড়ে আঁধার দদ্যাড়ে ইধার ছেব্কা মার্ছে চারধার
কি বেজে পড়্ল কি যে গজ্জড়্, এখন তক্ক ফেরোয়ার ।”
( গোক্ল্যার ঘর-ব্যার্ )
কবি চিনতেন নিজস্ব ভুবন, তাঁর ভদ্রাসন । তিনি পাঠককে ‘ নেউতা’ ( অর্থ ঃ আমন্ত্রণ ) দেন তাঁর বাসস্থানে আসার আর কবিতায় চিনিয়ে দেন নিজের ঘরটিকে ।
“ ছামুতে টুকচেন কুঁদরিলত পাছপিদ্যাড়ে গড়্যা
হেঁটাল ডাঙর, পাথর বহড়
ডেগে ডেগে ছুঁচলা কাঁকর
ডুংরী থানে পলাশ গড়া তাপলে জুরগুড়া ।
...
তিন শাল গাছ গেরাম থান পাশে হুচুক্ টাঁড়্
গাজন আল্যেই হুদ্ক্যে উঠে ঝলসে উঠে চাঁড়্
টিক দিগটায় দিন মজুর্যাম, লিক্ দিগ্টায় চাষা
কুলি মুড়ার আড়শুঙ্গাটা ঐটা আমার বাসা
...
লয় মুক্ দাদুড়ি, নেউতা করি দেখব কেমন ভালবাসার ফড়্যা
( আমার ) ঐ ত নিশান লাচ্ দুয়ারে কুঁদরি লত পাছ পিঁদাড়ে গরা
( নেউতা )
কবিকে তো চিনে নিয়ে হত তাঁর স্বজন, হ্যাঁ, চিনে নিয়েছিলেন কিরীটীভূষণ
“ গদার মায়ের, পায়ের ঘায়ের
ধান ভানুনির, গঙ্গাজলের,
বকুল ফুলের, সইয়ের মায়ের,
ফুলন দ্রাটার, বড় শালার
ষাঁড়ু ভায়ের ধম্মবিটির
জড়া ডুবের, মকর মায়ের
ছোট ভাইয়ের, চোখের বালির
মহাপসাদের ঠাকুরঝিয়ের
পিসির ।
মুড়ি ভাজুনির মিতিন বিটির
বেজ ধূলার, নয়ন তারার
দেখন হাসির, দদিকাদর
উল্কি মাসির ভাগিনা
হেন ধন ।
খুঁজে পাত্যে উমাক প্যালাম
তাকেই লিয়ে ঘ্র বাঁধলাক
পর-বিরানা কোথায় খুঁজি
থাকতে আপনজন ।
( আপনজন )
নিজের মাটি, নিজের মানুষের বিষয়ে এই সচেতনাই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল লোকভাষায়, অবহেলিত একটি ভাষায় যা তখনও অব্দি ভদ্রলোকের সাহিত্যে ব্রাত্যই ছিল ।
পরবর্তীতে ‘আঞ্চলিক ভাষার কবিতা’ আমাদের ভাষায় বিশিষ্টতা পায় । মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো বাংলা কবিতার মূলধারার কবিরা প্রান্তিক মানুষের মুখের ভাষাতেই মানুষের জীবন ও জীবন সংগ্রামের কথা কবিতায় নিয়ে আসেন । মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ মাড় ভাতের লড়াই’ ও অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘সাঁঝবিহান’ কাব্যগ্রন্থদুটি নানা মহলে সমাদৃত হই । লোকভাষায় কবিতা লিখতে আগ্রহী হন অনেকেই ।একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ‘আঞ্চলিক ভাষার কবিতা’ । ( যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি ‘আঞ্চলিক’ বিশেষণটির পক্ষে নই, এই কবিতাগুলিকে কবির নিজের ভাষায় রচিত ‘আপনভাষার কবিতা’, ‘আত্মভাষার কবিতা’, ‘আত্মার ভাষার কবিতা’ বলতেই বেশি পছন্দ করি । আলোচনার সুবিধার্থে এই ‘আঞ্চলিক ভাষার কবিতা’ এখানে ব্যবহৃত হল ) ।আবৃত্তিকারদের পরিবেশনে তা আপামর পাঠক/ শ্রোতার কাছে আবেদন রাখে । যদিও এই জনপ্রিয়তার সাথে সাথেই আসে উচ্চারণ ও উপস্থাপনায় বিকৃতি । কোনো কোনো কবি, যাঁদের সঙ্গে এই প্রান্তিক মানুষদের ভাষা ও সংস্কৃতির কোনো যোগাযোগই নেই, হাততালির লোভে এই ভাষার কবিতা লিখতে আসেন। এবং তা হয়ে ওঠে হাস্যকর, কখনও ভাঁড়ামির নামান্তর, হয়ে ওঠে শহুরে বাবুবিবিদের সস্তা মনোরঞ্জনের উপাদানমাত্র ।
কিন্তু তাঁরা কজন আর খোঁজ রাখেন কিরীটীভূষণ পাৎসার ?
হৃষিকেশ হালদার তাঁর ‘বাংলা আঞ্চলিক কবিতা’ বিষয়ে গবেষণায় এই কবি সম্পর্কে লিখেছেন, “রাঢবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষার কাব্যধারর আদিকবি কিরীটীভূষণ পাৎসা । সাম্প্রতিককালে বাংলা আঞ্চলিক কবিতায় যে একটি সম্বৃদ্ধ ভুবন তৈরি হয়েছে, তার সূত্রপাত কবি কিরীটীভূষণ পাৎসার কবিতা থেকে । বাঁকুড়ার কথ্যভাষাকে অবলম্বন করে কবিতার শরীর নির্মাণ করা যায় এবং তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা সম্ভব, এটা সহজাত কবিত্বশক্তি বলে প্রমাণ করেছেন কিরীটীভূষণ পাৎসা । “
২০১৭-তে ‘প্রান্তর’ প্রকাশন থেকে মানবেন্দু রায় ‘ফাগুন’-এর একটি সংস্করণ বের করেন । এটিই বর্তমানে কিরীটীভূষনের একমাত্র লভ্য বই ।
ভূমিকায় মানবেন্দু রায় লেখেন,” কিরীটীভূষণ কোন নামি ব্যক্তিত্ব ছিলেন না । সাধারণ গ্রামীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক । লোককবিতা লিখতেন, কিন্তু কবিখ্যাতির জন্য তাঁর কোনো দুর্মর আকাঙক্ষা ছিল না । ... আসলে লোকায়তিক চেতনাকে আত্মস্থ করে ব্রাত্য মানুষদের কথনভঙ্গির ভাষায় কবিতা লেখা অনেকের কাছে মান্যতা পায় না। বিশেষত সমাজের এলিট শ্রেণি এই জাতীয় সাহিত্যকে একটু দীনতার চক্ষে দেখতে অভ্যস্ত । কিন্তু কিরীটীভূষণ সেই সঙ্কীর্ণ বেড়াটাকে তাঁর লেখা দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে পেরেছিলেন ... কিরীটীভূষণের আটটি কবিতা যে এখন কালের কঠিন দাঁতকে এড়িয়ে বেঁচে আছে তার নেপথ্যে রয়েছে পাঠকের আনিকূল্য । বলতে দ্বিধা নেই কিরীটীভূষণের কবিতা বছরের পর বছর বেঁচে ছিল পাঠকের কণ্ঠে আর শ্রোতার আবেগঘন শ্রবনে ।এই পাওয়া একজন কবির সামান্য পাওয়া নয় । সেদিক দিয়ে দেখলে কিরীটীভূষণ আবহমান বাংলা কবিতার এক অমর উত্তরাধিকারী ।”
আঞ্চলিক কবিতার জনপ্রিয় ধারাটি হচ্ছে, কথকের দারিদ্র্য বর্ণনা এবং এটি করতে গিয়ে লোকভাষার এক ‘দরিদ্র’ চরিত্রই আমাদের সামনে তুলে ধরা হয় । “বাবু, তুমার ঘরে অ্যাতো কুছু, মুয়ের ঘরে লাই” মার্কা কবিতায় হাততালি পড়ে । এর বিপরীতে কিরীটীভূষণের ভাষা ঐশ্বর্যশালী, তিনি ভাষার ভেতরের যে লাবণ্য তাকে ধরতে পেরেছিলেন এবং তার কবিতা তাই ঝংকৃত, তাই শ্রুতি-আবেদনম্য । মূলত মাত্রাবৃত্তে, কখনও স্বরবৃত্তে লিখলেও ছন্দের চুলচেরা বিচার থেকে সরে এসে তিনি তাঁর আশেপাশের মানুষদের মুখের কথার যে স্পন্দন তাকেই অবলম্বন করেন তাঁর লেখার রীতিতে । র/ড় ধ্বনির পুনরাবৃত্তি, স্বরধ্বনির প্রয়োগ, একটু দ্রুত লয় – এই সব তাঁর স্বরটিকে স্বতন্ত্র করে ।
প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ, বাংলা সাহিত্যে তখনও অব্দি অব্যবহৃত, অচ্ছুৎ শব্দে তিনি কবিতা লিখেছেন । বলা যায় সেই শব্দগুলিকে তিনি স্থান দিয়েছেন সাহিত্যের পরিমণ্ডলে । শুধু শব্দ নয়, আঞ্চলিক বাগধারাও এসেছে তাঁর লেখায় ( যেমন ঃ শীতলার বাপ্ বেটা = প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও বাতাস ) । অভিধানের বাইরে থাকা ভাষাসম্পদ তাঁর কবিতায় রয়ে গেল ভবিষ্যতের কাছে গুপ্তধন হিসেবে ।
আর সিনট্যাক্সেও তিনি ধরেছেন ভাষার প্রাণকে । ( যেমন ঃ “হুকুরে ছুটছে যত মৌমাছি, কালা কানা খড়া নাই বাছাবাছি” – ফাগুন । ক্রিয়াপদকে বাক্যের মাঝে ও নঙর্থক ‘নাই’ বাক্যের শেষে না করে শেষ শব্দটির আগে ব্যবহার ) ।
তাঁর কবিতায় ক্রিয়াপদ প্রচুর; নামধাতু ,অজ্ঞাতমূল খাঁটি বাংলা ধাতু কত যে ছড়িয়ে আছে ! যাঁরা বলেন, “ বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদ কম” তাঁদের সামনে কিরীটীভূষণের কবিতা প্রতিবাদস্বরূপ । (“ঘাঁট্যে চকুট্যে, গুঁতায়ে কাছাড়ে, কনরকম দিয়েছিলাম গাড়ে” – ফাগুন )
তিনি অলঙ্কার-সচেতন । যমক, অনুপ্রাস প্রায় প্রতিটি পঙ্ক্তিতে, এই শব্দালঙ্কার শ্রুতিমাধুর্য আনে তাঁর লেখায় । এছাড়াও স্বাভাবিক শ্লেষ ো উৎপ্রেক্ষা আমরা পাই ।
এই অঞ্চলের মানুষের স্বভাব, তাঁদের আমোদগেঁড়ে, ফুর্তিবাজ, রসিক চরিত্রের ( ফাগুন ), পাশাপাশি অর্থনৈতিক অভাব (গোক্ল্যার ঘর-ব্যার্ , খেতার) ও দুঃখকষ্টের কথা তিনি লিখেছেন । কিন্তু এই দুঃখকষ্ট বড়ো হয়ে প্রাণের মাধুর্যকে ঢেকে দিতে পারে না । এই মানুষগুলি আমাদের চেনা, তাঁদের জীবন্ত করে রাখে কিরীটীভূষণের কলম ।
তিনি কবি । তাঁর লেখা যত না পাঠক পড়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রোতা শুনেছেন, মনে রেখেছেন । রামকৃষ্ণ চন্দ আমার বন্ধু, তাঁর বাড়ি কেঞ্জাকুড়ায় । ‘ফাগুন’ কবিতা শোনার স্মৃতি ও এর সম্পর্কে মুগ্ধতার কথা তিনি প্রায়ই বলেন । তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি কীভাবে কবিতা ‘টিকে’ যায়, কীভাবে সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে ।
মুদ্রিত হওয়ার, বই হওয়ার দায় থাকে না প্রকৃত কবিতার আর এখানেই লোকসাহিত্যের সার্থকতা, সার্থকতা কিরীটীভূষণ পাৎসার । ‘মান্য’, ‘প্রমিত’ বাংলা যেভাবে প্রসারিত হচ্ছে তার প্রভাব এড়িয়ে বাঁকড়ি ভাষা কতদিন নিজের স্বাতন্র্য বজায় রাখতে পারবে আমরা জানি না। এই ভাষা সাম্রাজ্যবাদের সময়ে বাংলা ভাষাও নিজেও তো আক্রান্ত । কিরীটীভূষণের কবিতা ধরে রইল এক অন্ত্যজ ভাষাপ্রয়োগকে, ভবিষ্যতের কাছে এই ভাষাটির অস্তিত্বের সাক্ষী হয়ে ।
আমার বাড়ির কাছের, প্রাণের কাছের কবিকে প্রণাম ।
অসাধারণ সুন্দরভাবে প্রায় সবদিক গুলিতেই আলোকপাত করেছেন, পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। এই প্রসঙ্গে উনার 'ক্ষেতার'কবিতাটির কথা মনে পড়ছে যেখানে কীভাবে তখনকার নিম্ন বর্গের চাষিদের অবস্থা অসম্মান আর অনটনে শেষ হতে বসেছিল তাও কবি দেখিয়েছেন আপন ভঙ্গিতে। আপনাকে এই লেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
উত্তরমুছুন