তুষ্টি ভট্টাচার্য - মায়াজম

Breaking

১৬ জুন, ২০১৮

তুষ্টি ভট্টাচার্য


                            লোকদেবতা 




উৎসব বলতে আমরা বুঝি দোল, দুর্গোতসব, দীপাবলি, ঈদ, সবেবারাত বা ক্রিসমাস, এরকমই ধর্মীয় আবহে বেড়ে ওঠা অথচ ধর্মের বাইরে চলে যাওয়া মনের আনন্দ, মিলনের মেলায় নিজেকে আবিষ্কার। প্রচলিত উতসবের বাইরে আঞ্চলিক কত যে নাম না জানা উতসবের সূচনা হয়, অনেক সময়েই শহুরে আমরা তার খোঁজও রাখি না। গ্রামে গঞ্জে উপদেবতা, লোকদেবতার আবির্ভাব হয় বিভিন্ন রোগভোগ, খরা, বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন্দ্র করে অথবা সন্তানের মঙ্গল কামনায়এরকমই কিছু লোকদেবতার উল্লেখ করব আজ। তবে জানি, যেটুকু কুড়িয়ে পাওয়া, তার থেকে অনেক অনেক খোঁজ না পাওয়া দেবতা রয়ে গেলেন আমার জানার সীমানার বাইরে।    
    প্রথমেই বলি জয়নগর আর মজিলপুরের কথা। শিয়ালদহ-লক্ষ্মীকান্তপুর রেললাইনের পশ্চিমে জয়নগর শহর ও পূর্বে মজিলপুর শহর। কায়স্থ প্রধান জয়নগর হল প্রাচীন শহর, অন্যদিকে ব্রাহ্মণ প্রধান মজিলপুর হল অপেক্ষাকৃত নবীন শহর। জয়নগর নামটি এসেছে স্থানীয় দেবী জয়চণ্ডীর নাম থেকে। জনশ্রুতি আছে, এখানকার প্রথম বসতি কলকাতার বাগবাজারের মতিলালবংশের পূর্বপুরুষ গুণানন্দ মতিলাল সপ্তদশ শতকে বাণিজ্যের কারণে নদীপথে যেতে যেতে গঙ্গার কিছু দূরে এক বাদাম গাছের কাছে নোঙর করেন; রাতে গঙ্গার কিছু দূরে জনশূন্য স্থানে আশ্চর্য আলো দেখতে পান এবং দেবী জয়চণ্ডী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে মাটি খুঁড়ে প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। পরদিন গুণানন্দ মাটি খুঁড়ে একটি প্রস্তরখণ্ড পেয়ে তা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। আজও দেবী এখানে পূজিতা এবং প্রতি জৈষ্ঠ্যপূর্ণিমায় দেবীর প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে মেলা বসে। মতিলালবংশের পর এখানে কায়স্থ সেন এবং বড়িশার মিত্রবংশ বসতি করেন। মিত্রপরিবারের প্রতিষ্ঠিত রাধাবল্লভ মন্দির ও দোলমঞ্চ বর্তমান।
   মজিলপুর শহরের ধন্বন্তরি কালীবাড়ি একটি প্রাচীন শক্তিপীঠ। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে আদিগঙ্গার তীরবর্তী স্থানগুলি শক্তিসাধনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল; সপ্তদশ শতকে এক সিদ্ধতান্ত্রিক ভৈরবানন্দ আদিগঙ্গার তীরে এই ধন্বন্তরি দেবীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। মজিলপুর শহরের উল্লেখযোগ্য লোকদেবতা হলেন পণ্ডিতপাড়া ও কয়েলপাড়ার পঞ্চানন ঠাকুর। কয়েলপাড়ার পঞ্চানন গভীর পাঁশুটে রঙের ভয়ঙ্কর মূর্তি, পাশে গর্দভবাহনা শীতলা দেবীর ও বাবাঠাকুরের (দক্ষিণরায়) মূর্তি আছে। পণ্ডিতপাড়ার পঞ্চানন ও শীতলা সাধারণ ইটের ঘরে পাশাপাশি বিরাজিত; এদের সামনে বাবাঠাকুর, জরাসুর ও বসন্ত রায়ের ছোট ছোট মূর্তি বর্তমান। আগে মন্দিরটি চালাঘরের ছিল এবং মূর্তির বদলে ঘটে পূজা করা হত।
(তথ্যসূত্র- ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২৫১-২৫৪)

   এবারে পাঁচুঠাকুরের কথা বলি। পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ বা পাঁচু ঠাকুর  এক খ্যাতিমান লৌকিক দেবতা। লোকবিশ্বাসে ইনি শিবের এক অর্বাচীন রূপ; অন্যমতে, ইনি শিবের পুত্র। মূলত গ্রামরক্ষক, শিশুরক্ষক রূপে পঞ্চানন পূজিত হন; তবে সন্তানদাতা, শস্যদেবতা হিসাবেও বাঙালি হিন্দু সমাজে তাঁর পূজার প্রচলন আছে। মূলত রাঢ়-বঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া-হুগলী-কলকাতা, বর্ধমান, নদিয়া ও বাঁকুড়াতে এঁর পূজা হয়ে থাকেদক্ষিণ চব্বিশ পরগণার স্থানবিশেষে ইনি 'বাবাঠাকুর' নামেও পরিচিত। পঞ্চাননের গাত্রবর্ণ লাল এবং চোখমুখের ভঙ্গি রুদ্ররূপী; বেশ বড় গোলাকার ও রক্তাভ তিনটি চোখ ক্রোধোদ্দীপ্ত। প্রশস্ত ও কালো টিকালো নাক, দাড়ি নেই, গোঁফ কান অবধি বিস্তৃত। মাথায় পিঙ্গলবর্ণের জটা চূড়া করে বাঁধা এবং তার মধ্যে জটা কিছু বুকে পিঠে ছড়ানো। কানে ধুতরো  ফুল। উর্ধাঙ্গ অনাবৃত; নিম্নাঙ্গ বাঘছাল পরিহিত, আবার স্থানবিশেষে কাপড় পরানো থাকে। তবে গলায় ও হাতে বেশ বড় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষমালা থাকে। হাতে ত্রিশূল ও ডমরু; পায়ে খড়ম এবং মাথায় বা দেহের উপর সাপ বিদ্যমান। পাশে থাকে পঞ্চরংয়ের বা পাঁচমুখো গাঁজার কলকে। এঁর অনুচর হলেন লৌকিক দেবতা জরাসুর ও ধনুষ্টংকার নামক দুজন অপদেবতা। এঁর সঙ্গে থাকে মামদো ভূত, ঘোড়া, বাঘ প্রভৃতি। গ্রামদেবতা রূপে মন্দিরমধ্যে কিংবা গাছতলায় শনি ও মঙ্গলবারে ইনি পূজিত হন; কোথাও মাটির মূর্তিতে, কোথাও শিলা বা ঘটের প্রতীকে। শিশুদের ধনুষ্টংকার এবং গর্ভস্থ শিশু রক্ষা করা বা নষ্ট ভ্রূণ থেকে প্রসূতিকে রক্ষা করা পঞ্চাননের কাজ। তাঁর উদ্দেশ্যে ছাগবলির প্রচলন আছে।
উল্লেখ্য, রাঢ়-বাংলার মুখ্য লোকদেবতা ধর্মঠাকুর ক্রমে ভাগীরথী প্রবাহের নিম্নধারার জনসংস্কৃতিতে পঞ্চানন রূপের ভিতর দিয়ে পরিপূর্ণ শীবমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন।[
মধ্যযুগীয় বেশকিছু মঙ্গলকাব্যের পুঁথিতে পঞ্চানন ঠাকুরের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। দ্বিজ দুর্গারাম রচিত পঞ্চাননমঙ্গল সংগীতাংশে আছে, "পঞ্চমুখে গান কর ত্রিলোচন।"
রূপরামের ধর্মমঙ্গলে আছে,    
"কামারহাটে পঞ্চানন্দ বন্দে জোড় হাতে।


ছেলেদের জন্য কত মেয়ে ওষুধ যায় খেতে।"

'তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব' নামক মধ্যযুগীয় কাব্যাংশে আছে,
"পঞ্চানন দেব প্রায় অশ্বত্থ তলায়।


মধ্যমাঠে সরোবর তীর দেখা যায়।।"


(তথ্যসূত্র - বাংলার লৌকিক ধর্মসংগীত, তৃপ্তি ব্রহ্ম, পৃষ্ঠা: ২৪৭-২৪৮)
  সুন্দরবন সংগঠক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক রফিকুল ইসলাম খোকনের লেখা থেকে এখানকার বাসিন্দাদের প্রাত্যহিক জীবনের সুস্পষ্ট ছবিটি পাওয়া যায়। সমুদ্র, নদী-খাল আর বাদাবন দিয়ে পরিবেষ্টিত সুন্দরবন অঞ্চলের কৃষিজীবী, বনজীবী এবং জলজীবী মানুষরা প্রতিনিয়ত ঝড়-বন্যা, মারি-মড়ক এবং শ্বাপদ-শঙ্কুল প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে। প্রাকৃতিক সম্পদই এখানকার মানুষের জীবনধারণের একমাত্র রসদ। তাই এখানকার শ্রমজীবী মানুষরা প্রকৃতিকে জয় করতে,  প্রকৃতির দান গ্রহণ করার পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে,  জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেবদেবী, পীর গাজীদের ওপর নির্ভর করে, এরাই ওদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার,  হিংস্র কুমির-কামট,  বিষাক্ত সরীসৃপ এবং ভয়াল জঙ্গলের সব ভয়কে উপেক্ষা করার সাহস জোগায়।

  বনবিবি অরণ্যের দেবী রূপে পূজিতা। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী কোথাও তিনি মুরগির রূপ ধারণ করেন, কোথাও বাঘের। বনবিবি অন্য কোনো দেব-দেবীর মতো উগ্র বা প্রতিহিংসাপরায়ণ নন। বরং সুশ্রী, লাবণ্যময়ী ভক্তবৎসলা দেবী। বনের সমস্ত সৃষ্টিতে রয়েছে তার মমতা। তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। তেমনি ভালোবাসেন প্রকৃতিকে। বনবিবির মাহাত্ম্যের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে আছে সুন্দরবন অঞ্চলের কৃষিজীবী, ক্ষেতমজুর, বাওয়ালী,  মৌওয়ালী,  কাঠুরে,  জেলে,  আদিবাসী মুন্ডা, শিকারী প্রভৃতি গরিব মানুষ। জঙ্গলে যাওয়ার আগে বনবিবির পুজো করা অবশ্য কর্ত্তব্য এদের কাছে।
গাজীপীর

গাজী-কালু চম্পাবতীর পুঁথির কাহিনী যাই থাকুক না কেন হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত সুন্দরবনের সবাই তাকে স্মরণ করে। যে কেউ সুন্দরবনে ঢুকবার আগে হাতজোড় করে বনবিবির পাশাপাশি গাজীর নামে দোহাই দিয়ে ঢোকে। সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়গুলোতে সাদা বর্ণের মুখে দাড়িসহ কোথাও জামা-পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ মূর্তি, কোথাও লুঙ্গি পরা ঘাড়ে গামছাসহ মূর্তি পূজিত হয়। এই পূজার নিরামিষ নৈবেদ্য হলো বাতাসা,  পাটালি,  আতপচালের শিরণি ইত্যাদি। গ্রামের সাধারণ লোকেরা জঙ্গলে প্রবেশ ছাড়াও গৃহপালিত পশুপাখির কামনা করেও গাজী সাহেবকে স্মরণ করে থাকে।

বিপদসঙ্কুল সুন্দরবনের আর এক লৌকিক দেবতা হলেন দক্ষিণ রায়। তিনি সাধারণভাবে বাঘের দেবতা হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ রায়ের মতো সুন্দর সুপুরুষ আকৃতির লৌকিক দেবতা সত্যিই বিরল।
বনদেবী নারায়ণী
কৃষিজীবী ও বনজীবী মানুষের মধ্যে এক উচ্চ আসন পেতে বসে আছেন এই দেবী। ইনিও বাঘের দেবতা বলে পরিচিত। তবে কিছুটা বাড়তি মাতৃত্বের অধিকারিণী। বিভিন্ন বাড়ির আশপাশের বনবাদড় অথবা ঝোপঝাড় সংলগ্ন স্থানে বনদেবী নারায়ণীর থান রয়েছে। বেশিরভাগ থান হলো মাটির দেয়াল খড় অথবা টালির ছাউনি দেয়া ঘর। তালপাতার ছাউনি দেয়া ছোট্ট কুঁজিঘরের থান চোখে পড়েছে। সুন্দরবনের আরণ্যক সভ্যতার অন্যতম সাক্ষী হয়ে মা নারায়ণী মধ্যযুগ থেকে বিরাজ করছেন।

   এখানেওপাঁচু ঠাকুরের প্রভাব আছে, সঙ্গে আছে তার স্ত্রী পেঁচি। পাঁচু ঠাকুর শিশুসন্তান রক্ষক দেবতা। শিশুসন্তান হারাবার ভয় বাবা ও মাকে চিরদিন কাতর করে রাখে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো না থাকায় সুন্দরবন অঞ্চলে কয়েক দশক আগে পর্যন্ত শিশু মৃত্যুর হার ছিল ভয়ানক। লৌকিক দেবতা পাঁচু ঠাকুরের জনপ্রিয়তা হয়েছে সন্তান হারাবার ভয় থেকে। গৃহস্থের বাসস্থান থেকে কিছু দূরে পুকুর অথবা খালের পাড়ে তালগাছ, বটগাছ তলায় উন্মুক্ত স্থানে পাঁচু ঠাকুরের উপাসনা ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত হয়। কোথাও গ্রামের বাইরে মাটির ছোট্ট ঘরে পাঁচু ঠাকুর,  স্ত্রী দেবতা পাঁচি ঠাকুরানী পূজিত হন। অনেক মা আছেন, যারা শারীরিক কারণে বারবার মৃত সন্তান প্রসব করেন। এই মায়েরা পাঁচু ঠাকুরের থানে পূজা দেন। সন্তান রক্ষা হলো পাঁচু ঠাকুরের থানে মাটির মূর্তি বা ছলন প্রতিষ্ঠা করে পূজা দেন।

   সুন্দরবনের মূর্তিমান যমদূত কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাবার বিশ্বাসে জল ও বনজীবী মানুষের কুমির দেবতা কালু রায়ের পূজা করে। দক্ষিণ রায়ের মতো এর মূর্তি একেবারে মানবীয়। পোশাক পৌরাণিক যুদ্ধ-দেবতার মতো। দুই হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র ঝোলানো, পীঠে তীর ধনুক। আরণ্যক দেবতার প্রাচীন পূজা পদ্ধতি মেনে কালু রায়ের পূজায় বনঝাউ ফুলের নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হয়।
  আরণ্যক লোকদেবতা আটেশ্বর। আটেশ্বরের মূর্তি পূজার প্রচলন ব্যাপক। বেশির ভাগ থানে মূর্তিপূজা হয় নিয়মিত। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, বনরক্ষক আটেশ্বর জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের মানুষ ও গৃহপালিত পশুদের রক্ষা করেন।
   জ্বররোগ নাশক রূপে পূজিত বিচিত্র দেবতা জ্বরাসুর। অনুররূপী এই জ্বরের দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য লোকসমাজ এর পূজা করেন। এই দেবতার দেহাবয়ব বিচিত্র ধরনের। গায়ের রঙ ঘন নীল। তিনটি মাথা, নয়টি চোখ, ছয়টি হাত ও তিনটি পা নিয়ে জ্বরাসুর অসংখ্য থানে শীতলা, মনসা, দক্ষিণ রায়,  আটেশ্বর,   প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে পূজা পান।
   সুন্দরবন অঞ্চলে মনসা পূজা হয় অতি সাধারণ থান ও মন্দিরে। অনেকে পারিবারিক গৃহদেবীরূপে মনসার প্রতীক ঘট অথবা মূর্তি প্রতিষ্ঠা পুরুষানুক্রমে করে আসছেন। সম্পন্ন কৃষিজীবী পরিবারে প্রতিবছর ভাদ্র মাসে মনসার ভাসান, পদ্মপুরাণ ও মনসামঙ্গল কাব্য পাঠের ব্যবস্থা থাকে। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে বার্ষিক পূজা করা হয়। বার্ষিক মনসা পূজাকে চলতি কথায় বলা হয় রান্নাপূজা।

   কৃষিজীবী, জলজীবী ও বনজীবী লোকসমাজে জঙ্গলজননী বিশালাক্ষীর প্রভাব অসীম। এক সময় সুন্দরবনের জঙ্গলমহল যত প্রসারিত হয়েছে; বিশালাক্ষী পূজার ক্ষেত্র ততই বিস্তৃত হয়েছে। কৃষক, জেলে, মৌয়ালি-বাওয়ালি প্রভৃতি পেশার মানুষের নয়নের মণি ইনি।

   ভাঙ্গড় পীর মধ্যযুগের বলিষ্ঠ ইসলাম প্রচারক। তার মাহাত্ম্য কথা প্রচারিত হয়েছে তৎকালীন নিম্নবঙ্গ জুড়ে। মুন্সী মোহাম্মদ খাতের, মোহাম্মদ মুন্সী ও মুন্সী বয়নন্দীন রচিত বনবিবির জহুরানামা পুঁথিতে পীর ভাঙ্গড় শার পরিচয় পাই। আল্লাহ রসুলের আজ্ঞায় বনবিবি ও শা জাঙ্গলী ভাটির দেশে এসে প্রথমেই ভাঙ্গড় পীরের আস্তানায় গিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন।
   বিবি মা! এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে ভক্তি, ভালোবাসা ও নির্ভরতা। জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কোনো রূপভেদ এখানে নেই লোকধর্মে বিবি মা খুব সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর ভাবে স্থান পেয়েছেন। বিবি মা নামটি আবেগপ্রসূত এবং মাতৃত্ববোধক। কিন্তু বিবিমা একক ব্যক্তিত্ব নন। বিবি মাদের মধ্যে ওলাবিবিমা সর্বজ্যেষ্ঠ। সাত বিবিদের মধ্যে তিনি অধিক সমাদৃত। অন্য ছয়জন তাঁর প্রিয়তমা ভগ্নী। ওলা উঠা রোগের অধিষ্ঠাত্রী বিবি হিসেবে তিনি সর্বজন পরিচিত। অন্য ছয়জন বোনদের নাম হলো ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবি। মতান্তরে আর একজন আছেন, তার নাম মড়িবিবি। এদের মধ্যে ঝোলাবিবি বলে মানুষের বিশ্বাস। মাটির স্তূপের প্রতীকে এবং মাটির প্রতিমা মূর্তিতে সর্বত্র এরা পূজিত হন। বালি-সিমেন্টে জমিয়েও এদের স্তূপ বানানো হয় কোথাও কোথাও। তবে ছোট-বড় মাঝারি মাটির মূর্তিতে পূজা-হাজত দেয়া হয় প্রায় সর্বত্র।
   মানিক পীর গোরক্ষক দেবতারূপে চাষী হিন্দু গৃহস্থ পরিবারে পুজ্য। এর ব্যক্তি-পরিচয় অন্যান্য পীর-গাজী-বিবিদের মতো রহস্যাবৃত। ভক্তজনের বিশ্বাস, ইনি ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো হেকিমী চিকিৎসক ও সাধক। গৃহপালিত পশুপক্ষীর রোগ নিরাময়কারী ছিলেন বলে এক সময় শ্রদ্ধাভক্তির প্রাবল্যে লৌকিক দেবতায় উন্নীত হয়েছেন।
   সুন্দরবনের জেলেদের সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা হলেন মাকাল ঠাকুরতার মূর্তি মানবাকৃতি নয়, বরং ছোট একটি বা একসঙ্গে দুটি স্তূপের মতো। এই স্তূপটি মাটির তৈরি ওল্টানো গ্লাস বা কতকটা টোপরের মতো দেখতে। মাকাল ঠাকুরের পূজার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। সুন্দরবনের জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে নদী বা খালের পাড়ে পূজা করে থাকে। পূজার জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে মাটি দিয়ে বেদি তৈরি করে তাতে মূর্তি বসানো হয়। বেদির চারপাশে তীরকাঠি পুঁতে বেড়া দেয়া হয়। সিঁদুর মাখানো ফুল, বেল পাতা ও তুলসিপাতার সঙ্গে নৈবেদ্য হিসেবে আতপচাল, পাকা কলা, বাচ্চাদের চকলেট ইত্যাদি দিয়ে মাকাল ঠাকুরের পূজা হয়।
  পৌষ বাংলা বর্ষপঞ্জির নবম মাস। এই সংক্রান্তিতে সূর্য ধনু রাশি থেকে মকরে সঞ্চারিত হয়, তাই এর নাম 'মকর সংক্রান্তি'একে 'উত্তরায়ণ সংক্রান্তি'-ও বলে, কারণ এই দিন থেকে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে। এই সংক্রান্তির ব্রহ্মমুহূর্তে যমুনা নদীতে মকর-স্নান করলে আয়ুবৃদ্ধি হবে -- এই বিশ্বাসে মাতা যশোমতী বালক কৃষ্ণকে স্নান করাতে নিয়ে যান। পরে এদিনেই যমুনায় স্নান সেরে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতি রাধিকার সঙ্গে 'মকর-পাতায়', এ হল আত্মার সঙ্গে আত্মার দৃঢ় বন্ধন স্থাপন। পৌষ সংক্রান্তিতে আমরা পিঠে পুলি উৎসব করি, মেলাও বসে কোথাও কোথাও। আর ঘুড়ি ওড়ানো হয় কিছু কিছু অঞ্চলে। এর বাইরে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌষ পার্বনের পালুনীর নিয়ম এক একে জায়গায় একেক রকম।



   বাংলার অনেক স্থানে একসময় কুমারী মেয়েরা এইদিন থেকে কনকনে ঠান্ডার ভোরে একমাস ব্যাপী মকরস্নান-ব্রত শুরু করতো। আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা-তামসিকতার রিপুগুলিকে জয় করার এ ছিল এক সংগ্রামী মনোবৃত্তি। ছড়া গেয়ে পাঁচ ডুব দেওয়ার নিয়ম ছিল: "এক ডুবিতে আই-ঢাই।/দুই ডুবিতে তারা পাই।।/তিন ডুবিতে মকরের স্নান।/চার ডুবিতে সূর্যের স্নান।/পাঁচ ডুবিতে গঙ্গাস্নান।।"

   উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে বাস্তুপূজার প্রচলন আছে। শঙ্খপাল, বঙ্কপাল, ক্ষেত্রপাল, নাগপালের ধ্যান করে বাস্তুর ধ্যান ও মানসোপচারে পূজা করা হয় এইদিন। বাস্তুর প্রণাম মন্ত্র হল, "ওঁ বাস্তুরাজ নমস্তুভ্যং পরমস্থানদায়ক। সর্বভূতজিতস্ত্বঞ্চ বাস্তুরাজ নমোহস্তু তে।" এরপর পাদ্যাদি দিয়ে গ্রাম্যদেবতার পূজা করা হয় এবং পায়স-বলি দান করা হয়।

   পৌষ সংক্রান্তি দিনে গ্রাম-বাংলার অনেক স্থানে উঠোনে মড়াই-এর পাশে 'উঠোন লক্ষ্মী'র পুজো হয়। তিনিই কোথাও 'পৌষলক্ষ্মী'এদিন বাড়ির উঠোন গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে, শুচি-স্নিগ্ধ করে তোলা হয়। ধানকাটা পর্বে যে 'পৌষ তোলা'র চার-পাঁচ গুচ্ছ ধানগাছ সাদরে গৃহস্থ বাড়িতে আনা হয়েছিল, তাই গাদা থেকে নামিয়ে মাথায় বহন করে নামানো হয় উঠোনে। গোটা উঠোন জুড়েই আলপনার নান্দনিকতা। আঁকা হয় লক্ষ্মীর নানান গয়না; চাষের সমস্ত উপকরণ--গরু, লাঙল, জোয়াল, মই; আর লক্ষ্মীর পা--পৌষ গাদা থেকে পুজোস্থল পর্যন্ত, পুজোস্থল থেকে গৃহের সিংহাসন পর্যন্ত। এই চরণ চিহ্নে পা ফেলেই যেন লক্ষ্মী ঘরে আসবেন। বাংলার কোনো কোনো স্থানে একে বার (বাহির) লক্ষ্মীপুজোও বলে। পুজো শেষ হলেই ঠাকুর তোলা যায় না। রাতে লক্ষ্মীপেঁচা বা শেয়ালের (দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে শেয়াল লক্ষ্মীর বাহন বলে কথিত) ডাক শুনে উঠোন থেকে লক্ষ্মীকে ঘরে তোলা হয়। গভীর রাতে লক্ষ্মী তুলে উঠোন নিকিয়ে ঘুমতো যান গৃহকর্ত্রী।



  পৌষ সংক্রান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি লোকাচার হল 'আওনি-বাউনি' বা 'আউরি-বাউরি'এটি আগের দিন পালিত হয়। তবে দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে এর নাম 'চাঁউনি-বাউনি' বা 'চাউড়ি-বাউরি' যা পৌষপার্বণের দু'দিন আগে 'মচ্ছিমূলো' খেয়ে পালিত হয়। 'গণদেবতা' উপন্যাসে এর বর্ণনা এইরকম, "....আউরি-বাউরি দিয়া সব বাঁধিতে হইবে, মুঠ লক্ষ্মীর ধানের খড়ের দড়িতে সমস্ত সামগ্রীতে বন্ধন দিতে হইবে, -- আজিকার ধন থাক, কালিকার ধন আসুক, পুরানে নূতনে সঞ্চয় বাড়ুক। লক্ষ্মীর প্রসাদে পুরাতন অন্নে নূতন বস্ত্রে জীবন কাটিয়া যাক নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায়। অচলা হইয়া থাক্ মা, অচলা হইয়া থাক্।" সোনার পৌষ যে চলে যায়, তাকে বাঁধতে হবে! তাই শিসসহ ধানগাছ পুজো করে ঘরের খুঁটি, গোলা, গোয়াল ঘর, সিন্দুক ঢেঁকিশালে তা বাঁধা হয়। আর শস্য-সম্পদের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করা হয়। তারই অঙ্গ হিসাবে বাংলার মেয়েরা ছড়া কেটে পৌষ বন্দনা করেন, "পৌষ পৌষ -- সোনার পৌষ/এস পৌষ যেয়ো না/জন্ম জন্ম ছেড়োনা।/না যেয়ো ছাড়িয়ে পৌষ--/না যেয়ো ছাড়িয়ে,/পৌষ পৌষ -- সোনার পৌষ।"

   পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে রাঢ় তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় 'টুসু জাগরণ' হয়। টুসু উৎসবের শুরু অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে। পৌষ সংক্রান্তির ভোরে সূর্যোদয়ের আগে টুসু বিসর্জন দেওয়া হয়। কারণ সূর্যের সঙ্গে টুসুর ভাসুর-বুয়াসি বা ভাদ্র-বউ সম্পর্ক। যেহেতু চৌডল ব্যবহার করলে সূর্যদেব দর্শিত হন না, তাই সুদৃশ্য চৌডলে টুসু ভাসান যায়।

  তুষ-তুষলীর ব্রতিনীরা এই দিন মাস-কালীন ব্রতের শেষে জমিয়ে রাখা তুষ-গোবরের গুলি মাটির হাঁড়িতে রেখে আগুন ধরায়। তারপর তা ভাসিয়ে দেয় নদী বা পুকুরের জলে। একাধিক ব্রতিনীর ভাসানো অগ্নিশিখা বহনকারী হাঁড়ি বায়ুচালিত হয়ে ঘাট-ঘাটলার কিনারে কিনারে চরে বেড়ায়।

   বাংলার কোনো কোনো স্থানে এদিন 'ধর্মের পিঠে' উৎযাপিত হয়। এই লোকানুষ্ঠানটি ধর্ম বা সূর্য পূজার অঙ্গ। বাড়ির উঠোন সকালে গোবর জলে নিকিয়ে নতুন কলকে নিয়ে পিটুলির ৫টি গোলাকার ছাপ দেওয়া হয়। ছাপ পড়ে গোয়ালে, গবাদিপশুর দেহে, গোলায়, ঢেঁকিশালে এবং ঘরের মধ্যে। গৃহস্থের সামগ্রিক কল্যাণ কামনাই এই লোকানুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য।

   দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় এদিন বৎসরান্তের কৃষিকাজ সমাপনান্তে খামার খুঁটিকে কেন্দ্র করে উৎসবের আয়োজন হয়। একে 'মেহি পূজা' বলে, কারণ 'মেহি'-র অর্থ খুঁটি। এই খুঁটি ঝাড়াই-মাড়াই সহ নানান কাজের সাক্ষী, গরু বাঁধার স্থান। তাই মেহি পূজা বা খামার পূজা হল  এক কৃতজ্ঞতার অনুষ্ঠান, ধন্যবাদাত্মক চিন্তন। খুঁটিকে কেন্দ্র করে আঁকা হয় নানান কৃষি উপকরণের আলপনা, পরিষ্কার করে সাজানো হয় সেইসব উপকরণ। কৃষক-পুরুষ শেয়ালের ডাক শুনে পুজোয় বসেন। পুজো শেষে নতুন ধানে ভরা মান মরাইতে তুলে সে বৎসরের মত কৃষিকার্যের সমাপ্তি হয়।

   মেদিনীপুরে এইদিন লৌকিকদেবী  বড়াম; মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলীতে সিনিদেবী এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বারা ঠাকুরের যুগ্মমূর্তি, নারায়ণী ও দক্ষিণ রায়ের বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মেদিনীপুর, পিংলা, ময়না, সবং অঞ্চলের মাহিষ্য কৃষক সম্প্রদায় এদিন বিকেলে 'বণিপুজো'র আয়োজন করে। গৃহের পুরুষ বা নারীরাই এর উদ্যোক্তা এবং পূজক। এর তিনটি পর্যায় -- মই খুঁটি প্রতিষ্ঠা, খেত মাড়ান এবং 'সাঁথ ধরা'এটি মেহি পূজার মতই এক লোকাচার। খেত মাড়ান পর্বে চাষের জমিতে রক্ষিত একগুচ্ছ ধান গাছের ('ঝুঁটি') গোড়ায় 'লবাৎ' (নতুন ধানের চাল বেটে প্রস্তুত মিষ্টান্ন) ও ফলমূল নৈবেদ্য রেখে সরষে ও সাদা কল্কে ফুল ('শুক্ল যাদু'-র প্রতীক) দিয়ে পুজো করতে হয়। এরপর সেই ঝুঁটি ছিঁড়ে তা মইখুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয়। আগামী বছর ভালো ধান হবার এ এক লৌকিক প্রার্থনা। 'সাঁথ ধরা' হল বন্য প্রাণির ডাক শুনে সেই পূজিত 'ঝুটিসযত্নে ধানের গোলায় তুলে রাখার অনুষ্ঠান। লোকবিশ্বাস, শেয়ালের সাঁথ ধরা সবচাইতে সৌভাগ্যের বিষয়।

   রাঢ় অঞ্চলের অনেক জায়গায় পৌষ সংক্রান্তির পরদিন তপশিলী সম্প্রদায়ের মানুষ কর্তৃক 'আক্ষেন' বা 'আখ্যান দিন' পালিত হয়। একে 'এখ্যান যাত্রা'-ও বলে। এদিন লোকদেবতা ও অপদেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়। পূজার শেষে আয়োজিত হয় নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান।

   অনেক জায়গায় আবার এইদিন গ্রামের বালকেরা 'কুলাইর মাগন' বা 'কুলের মাগন' বা 'পৌষ মাগন' পালন করে। তারা আমন ধান উঠে যাবার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে চাল, ডাল, সবজি মাগন করে আনে তা এইদিন নিজেরাই মাঠে রান্না করে কুলাই ঠাকুরকে নিবেদন করে এবং একত্রে ভোজন করে।



(তথ্যপঞ্জি:

১. স্বামী নির্মলানন্দ (১৪১০) বারো মাসে তেরো পার্বণ (৬ষ্ঠ সংস্করণ)ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, কলকাতা।
২. চিন্তাহরণ চক্রবর্তী (২০১৪) হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান ( তৃতীয় মুদ্রণ), প্যাপিরাস, কলকাতা।)


   ইতু পূজা বাংলার আর একটি লোকউৎসব। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইহলোকে শস্যবৃদ্ধি কামনায় এবং পরলোকে মোক্ষ লাভের ইচ্ছায় ইতু বা ইঁয়তি পূজা করা হয়। কার্তিক সংক্রান্তিতে ইতু পূজার শুরু এবং অগ্রহায়ণ মাসের শেষে এই পূজার সমাপ্তি ঘটে।আচার্য সুকুমার সেন ইতু পুজোর ইতিহাসকে অন্য আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, ইতু হলেন প্রাচীন ইন্দ্রপূজার দৃষ্টান্ত। ঋকবেদীয় সূক্তগুলোর নাম ইন্দ্রস্তূপ, সেখান থেকে ইন্দথথু>ইতু। তাঁর মতে, মেয়েরা ইন্দ্রের মতো বর পাওয়ার বাসনায় ইন্দ্রদ্বাদশীর দিন ইতু পূজা করে। তবে বাংলার মেয়েরা ইতুকে শস্যের দেবী হিসেবেই পূজা করে থাকে।একটি সুন্দর মাটির খোলাতে মাটি ভরে তার মধ্যে মান, কচু, কলমীলতা, হলুদ, আখ, শুষনি, সোনা ও রুপোর টোপর, জামাই-নাড়ু, শিবের জটা, কাজললতা রেখে ফুলের মালা, ধূপ-দ্বীপ-সিঁদুর প্রভৃতি পুজোর উপকরণ ও ফল-মিষ্টান্ন ও নবান্ন সহযোগে ইতু পূজা করা হয়।
এই পূজার সময় বলা হয় -
‘ইয়তি ইঁয়তি নারায়ণ,

তুমি ইঁয়তি ব্রাহ্মণ।

তোমার শিরে ঢালি জল,

অন্তিম কালে দিও ফল।‘
  ভাদু উৎসব  পশ্চিমবঙ্গ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বর্ধমান, জেলা ছাড়াও ঝাড়খন্ডের রাঁচি ও হাজারিবাগ অঞ্চলের লৌকিক উৎসব। ভাদু উৎসব নিয়ে মানভূম অঞ্চলে বেশ কিছু লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। পঞ্চকোট রাজপরিবারের নীলমণি সিংদেওর তৃতীয়া কন্যা ভদ্রাবতী বিবাহ স্থির হওয়ার পর তাঁর ভাবী স্বামীর অকালমৃত্যু হলে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন, এই কাহিনী মানভূম অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচারিত। বিয়ে করতে আসার সময় ভদ্রাবতীর হবু স্বামী ও তাঁর বরযাত্রী ডাকাতদলের হাতে খুন হলে ভদ্রাবতী চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন
  পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা গ্রামের কোন বাড়ীর কুলুঙ্গী বা প্রকোষ্ঠ পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন। একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে তাঁরা সমবেত কন্ঠে ভাদু গীত গেয়ে থাকেন। ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদুর মূর্তি ঘরে নিয়ে আসা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রকে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়ে থাকে। এই রাত্রে রঙিন কাপড় বা কাগজের ঘর তৈরী করে এই মূর্তি স্থাপন করে তার সামনে মিষ্টান্ন সাজিয়ে রাখা হয়। এরপর রাত নয়টা বা দশটা থেকে ভাদু গীত গাওয়া হয়। কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা গ্রামের প্রতিটি মঞ্চে গেলে তাঁদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ও তাঁরা এই সব মঞ্চে ভাদু গীত পরিবেশন করে থাকেন। ভাদ্র সংক্রান্তির সকালে দলবদ্ধভাবে মহিলারা ভাদু মূর্তির বিসর্জন করা হয়। পূর্বে ভাদুর কোন মূর্ত রূপ ছিল না। একটি পাত্রে ফুল রেখে বা গোবরের ওপর ধান ছড়িয়ে ভাদুর রূপ কল্পনা করে উৎসব পালন করা হত। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রকমের মূর্তির প্রচলন হয়েছে। মূর্তিগুলি সাধারণত হংস বা ময়ূর বাহিনী বা পদ্মের ওপর উপবিষ্টা মূর্তির গায়ের রঙ হলুদ, মাথায় মুকুট, হাতে পদ্মফুক, গলায় পদ্মের মালা ও হাতের তলায় আলপনা থাকে। কখনো মূর্তির কোলে কৃষ্ণ বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি থাকে।



  পুরুলিয়ার ডাক্তারবাবু বিশ্বজিৎ দাসের লেখায় গোগা ঠাকুরের উল্লেখ পাই। কাটোয়ার পানুহাট চরবিকিহাট চরপানুহাট দাঁইহাট একটা বড় এড়িয়া নিয়ে পূর্ববাংলার খেটেখাওয়া মানুষজনের বাস।কেউ শব্জি বিক্রি করেন।কারু আছে ছোটখাটো ব্যবাসা। কেউবা ক্ষেতে কাজ করেন। কিন্তু চৈত্রমাস এলেই মানুষগুলো যেন ফিরে পায় নিজের দেশ। নিজের সংস্কৃতি। ভাগীরথীর তীর  হয়ে ওঠে পদ্মাপাড়ের গাঁ-গঞ্জ।  পরনে লাল কাপড়। গায়ে লালাজামা। গলায় নতুন গামছা। আর মাথায় সিঁদূর চর্চিত নাঙলের মতো নীলঠাকুর। কিশোরী সখী সেজেছে। ঝম ঝম করে বেজে উঠেছে বাজনা। ফুলোট ক্লারিওনিয়েট। সঙ্গে ঢাকের বাদ্যি। রাঢ় বাংলায় তখন মরার মাথা নিয়ে কালকেপাতাদের শব সাধনা।  ঢাকের উদ্দাম বাজনা। ওরা তখন শোলকগানের রিয়ারসেলে মত্ত। এদের পুরুত ঠাকুর হলেন বালা। বামুন-টামুনের বালাই নেই। তিনি একটু পুজো আচ্চা করেই নির্দেশ দিলেন। অমনি শুরু হয়ে গেল নাচ গান। শোলকগান বা অষ্টক গান। গোল হয়ে সখীদের বিচিত্র স্টাইলে নাচ। শিব নটরাজ। গান বাজনায় তিনি ভোলানাথ। তাই তাঁকে গানবাজনার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে হয়।
  গোগা ঠাকুর নামে একধরনের কাঁচামাটির পুতুল পাওয়া যায় পুরুলিয়াতে। ইনি মাড়োয়ারী ও রাজপুত সম্প্রদায়ের মধ্যে এক অত্যন্ত জনপ্রিয় লোকদেবতা। গাড়িখানার কুম্ভকার পল্লীর মাত্র দু ঘর কুম্ভকার পরিবার  এই গোগা ঠাকুরের পুতুল তৈরী করেন। এই কুম্ভকার পরিবার জাতিতে অবাঙালী বিহারী। গোগা ঠাকুরের পুতুলটি কাঁচা মাটির হাতে টেপা অত্যন্ত সরল গঠনশৈলীর ছোট্ট পুতুল। গোগাজী রাজবেশে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার উপরে বসে আছেন। ক্ষেত্রবিশেষে হাতে ছত্র অথবা বল্লম, মাথায় পাগড়ি অথবা শিরস্ত্রাণ। এই পুতুলগুলি কখনোই পোড়া মাটির হয় না। অদ্ভুত এবং আকর্ষণীয় এই পুতুলগুলিকে রঙ করাও হয় না।
  কিংবদন্তি অনুযায়ী গোগাজী ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দীতে তিনি দাদরেওয়া নামক একটি ছোট রাজ্যের শাসক ছিলেন। বর্তমানে যা রাজস্থানের অন্তর্গত। পিতা ছিলেন রাজা জেওয়ার, মাতা রানী বাছাল। রানীমা সন্তান কামনায় গুরু গোরক্ষনাথের শরণাপন্ন হলে, গোরক্ষনাথ তাকে দুটি মন্ত্রপূত গুগগুল ফল দেন। যা খেয়ে রানি সন্তান লাভ করেন। মন্ত্রপূত গুগগুলের কারণে জন্ম হয় বলে সন্তানের নাম  রাখা হয় গোগোগাজী, যিনি তান্ডুল নগরীর রাজা সিন্ধা সিং এর কন্যা শ্রীয়াল রোজকে বিবাহ করেন। গোগাজীর খুড়তুতো ভাই অর্জন ও সর্জনের শ্রীয়াল দেবীর উপর কুনজর ছিল। জানতে পেরে ক্রুদ্ধ গোগাজী তাদের হত্যা করেন। গোগাজী গুরু গোরক্ষনাথের একজন উল্লেখযোগ্য শিষ্য ছিলেন। ইনি রাজপুত, পাঞ্জাবী, হরিয়ানা জেলার মানুষের কাছে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন লৌকিক দেবতা বা পীর রূপে পূজিত। মূলতঃ সর্পসংকুল এলাকাগুলিতে সর্পপদেবতা হিসেবে গোগাজীর প্রভাব লক্ষণীয়। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের উত্তর পশ্চিম জেলাগুলিতে গোগাজীর পুজা করা হয়। পুরুলিয়াতে বসবাসকারী অবাঙালীরা এঁর পুজো করেন।
   রাখী পুর্নিমার পাঁচ দিন বাদে, ভাদ্র মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিকে গোগা পঞ্চমী বলা হয়। ওই দিন গোগাঠাকুরের পুতু্লের  সামনে বিশেষ সুরে গান গেয়ে মিষ্টি রুটি আর চুর্মা  উতসর্গ করা হয়। ঘরে সাপের আলপনা এঁকে  পুজা করা হয়। এইভাবেই গোগা ঠাকুরকে সন্তুষ্ট করা হয় যাতে তিনি পরিবারের সকলকে সর্পপদংশনের হাত থেকে রক্ষা করেন। গোগাজী বা গোগা ঠাকুর বাঙালীদের সর্পদেবী মনসার মত লৌকিক সর্পপদেবতা হিসেবে পুজিত হয়ে চলেছেন রাজপুত ও মাড়োয়ারীদের মধ্যে।
                                
   স্বপন ঠাকুর সম্পাদিত কৌলাল পত্রিকার নবারুণ মল্লিকের লেখায় উল্লেখ পাই এঁটু ঠাকুরের কথা। এই দেবতার নৈবেদ্য হল পুরোহিতের এঁটু বা উচ্ছিষ্ট খাবার তাতেই দেবতা সন্তুষ্ট এমনি এক বিচিত্র অভিনব রাঢ়ের লোকদেবতা এঁটুঠাকুর পূজিত হচ্ছেন সেই আদ্দিকাল থেকে ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া বীরভূমজেলার লাগোয়া সীমান্তগ্রাম আম্বা থানা কুন্ডোহিত বীরভূমের বাবুইঝোড় থেকে দূরত্ব মেরেকেটে পাঁচ কিম্বা ছয় কিমি নিকটবর্তী রেলস্টেশন বীরভূমের পাঁচড়া

  এঁটুঠাকুরের নিত্যসেবা হয় পুরুতমশাই লাল কাপড় পরেন মাথায় লাল কাপড়ের ফেটি কোমরে গামছা জড়িয়ে ভক্তি ভরে পুজোয় বসেন সকালে কপালে জুতসই একটা সিঁদুরের ফোঁটা হাতে লোহার চিমটে পুরুতের গলায় থাকে আলুর চপের মালা! দেশি মদের পাউচ এর নাম তুফান পিঁয়াজসহ দু একটা গোটা ফলের চেন মন্ত্র-আপাত অর্থহীন প্রাচীন ঝাড়খন্ডী ভাষায় সুরেলা এক তাল ধ্বনিপুঞ্জ সঙ্গে তাল সহযোগে চিমটে্র ধাতব সঙ্গত এক একটা করে চপ ছিঁড়ে, মন্ত্র "মাখিয়ে" তাতে কামড় মেরে খানিকটা পুরুত খেয়ে নেন বাকিটা দেবতাকে করেন উৎসর্গ আর থাকে পবিত্র তুফান বেশ কিছুটা কোঁৎ করে গিলে নিয়ে বাকিটা এঁটুঠাকুরের মাথায় তখন জোরে জোরে বেজে ওঠে চিমটে এঁটুঠাকুর সিগারেট টানতেও ভালোবাসেন বোঁ করে দুটো টান মেরে বাকিটা এঁটুঠাকুরের জন্য পুরতমশাই দিয়ে দেন পেসাদ পাওয়ার জন্য অনেকেই মুখিয়ে থাকে
  ভাদ্রসংক্রান্তিতে কুলদেবী মনসাপুজো  জাঁকজমক করে পুজো হয় কবিগান যাত্রা আর ডিজে মাইকের হুঙ্কারে মুখোরিত হয়ে ওঠে আম্বা পরের দিন অর্থাৎ পয়লা আশ্বিন এঁটুঠাকুরের বাৎসরিক পুজো  তখন চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড! প্রচুর মোরগ বলি হয় আর সেদিন থাকে স্পেশাল নৈবেদ্য মনসাপুজোর দিনে যে দশাসই  পাঁঠা বলি দেওয়া হয়েছিল দেবীর থানে, তার অন্ডকোষ দুটো কেটে নিয়ে বিশেষ ভোগের আয়োজন শুরু হয় বেশ করে তেল-ঝাল মাখিয়ে ভেজে পুরু্তঠাকুর মদ দিয়ে খানিকটা চেখে  দেখেন, পরে ভাগ পান দেবতা। 
   শেষ করব খাস কলকাতার চীনা কালীঠাকুরের কথা বলে।  সারা কলকাতা বিশুদ্ধ চীনা খাবার খেতে ট্যাংড়ায় হামলে পড়ি আমরা, অথচ চায়না টাউনের অতি বিখ্যাত চীনা কালী মন্দিরের কথা আমরা অনেকেই জানি না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এর চেয়ে আর বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে? প্রায় ৬০ বছর আগে এখানকার এক স্থানীয় বুদ্ধিস্ট চীনা অভিবাসীর হাতে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। জন তাঁর তৃতীয় প্রজন্মের এক আমেরিকা প্রবাসী নাতি, ধর্মে বুদ্ধিস্ট। সেই জন আমেরিকায় বসে প্রায়ই রাতে তাঁদের পারিবারিক কালী মন্দির ও কালী মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। শেষে মায়ের টানে, এমন অবস্থা হয় জনের যে ধুত্তরি বলে আমেরিকার পাটই চুকিয়ে দিয়ে,  ট্যাংড়ায় ফিরে আসে, কেবল এই মন্দিরটিকে নিয়ে থাকবে বলে। এখানেই শেষ নয়, নিজেও মায়ের টানে ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু হয়ে যান, কাজেই জন বর্তমানে চীনা হিন্দু।
  ওঁর এই মন্দিরটিকে নতুন করে বানাতে স্থানীয় চীনারা, বাঙালিরা সবাই হাত লাগান। যদিও একজন  বাঙালী ব্রাহ্মণ পুরোহিত আছেন, কিন্তু উনি নিজে এবং স্থানীয় চীনারাই প্রতিদিন মন্দির ধোয়া মোছা, ফুল মালা দিয়ে মূর্তি সাজানো, ধূপ দীপ জ্বালানো, আরতি করা এসব করেন। দু হাতে দুটি জ্বলন্ত চীনা ধূপকাঠি নিয়ে চীনা ভক্তরা মা কালীর সামনে তিনবার মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করেন। প্রতিদিনের ঠাকুরের প্রসাদ দেওয়া হয় ফল, মিষ্টি, বিস্কুট এখানে যেসব মায়ের  চীনা ভক্তরা আছেন, তাঁরা অনেকেই দুবেলা মন্দিরে এসে প্রণাম করে যান, তাঁরাও কিন্তু হিন্দুদের মতন কেউ বিফ খান না। কালী পুজোর দিন এখানে এলে দেখবেন বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহানকাকে বলে। সমগ্র বৌদ্ধ, খ্রিস্টান চীনারা ভক্তিভরে মায়ের মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন। সেদিন প্রসাদ পাবেন ফল মিষ্টির সঙ্গে নিরামিষ ন্যুডলস বা চাউমিন।
*     
  আরও অনেক খোঁজ বাকি রেখে ঠিক এই পর্যন্ত লিখে থেমে যেতে হল আমাকে। লোক দেবতা - এই বিষয় নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে, তবুও কত অজানা রয়ে গেছে আমাদের। বর্তমানে ধর্ম নিয়ে এত হানাহানি দেখার পর একটা কথাই মনে জাগে, এই প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রামীণ মানুষগুলোর কাছ থেকে আমাদের সর্ব ধর্মের সমন্বয় কীভাবে হাতেকলমে করে দেখাতে হয়, শেখা দরকার। প্রাণের টান, এখনও যদি কোথাও আছে, তা এই আঞ্চলিক অনুষ্ঠানগুলির মধ্যেই আছে। কোন লোক দেখানো আড়ম্বরে পার্বনের মূল সুরটি নষ্ট হতে দেয়নি এরা।




লেখক পরিচিতি-তুষ্টি ভট্টাচার্য, কবিতা ও গদ্য দুইই লিখে থাকেন। এ পর্যন্ত দুটি কবিতার বই। পাঠক প্রকাশনী থেকে ‘ভিজে যাওয়া গাছ’ ও সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী থেকে ‘ব্ল্যাক ফরেস্ট




৩টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র