শবরী রায়

মায়াজম
1
                          সম্পাদকীয়
সংখ্যা প্রকাশে দেরি হয়ে গেল, সেই দায় নিলাম। শিরোনামটি যে এখনো এত সংবেদনশীল বুঝতে সত্যিই আমাদের দেরি হল। আমরা সেই সমাজেই বাস করি এখনো যেখানে বাকশক্তিতেও পরানো রয়েছে পরাধীনতার শেকল। মুখ খুললেই তুমি দুর্মুখ। " মাতৃশক্তির জয় হোক" সোনালী যখন এই শিরোনাম বেছে আমাকে ওর সঙ্গে ডাক দিয়েছিল, তেমন তলিয়ে ভাবিনি আমি। লেখা আহ্বান করার পর ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছি দুজনেই।


মাতৃত্ব যেন কামনাবাসনারহিত এক দুর্মূল্য অলঙ্কার। যাকে গোপন বাক্সবন্দী করে রাখাই ধর্ম। মৃন্ময়ী কিংবা চিন্ময়ী যেকোনো রূপেই মাকে আমরা দু-ধাপ ওপরের বেদীতে বসিয়ে রেখেছি। মা শব্দটি যেন ঠিক পার্থিব নয়। হয় অলৌকিক দেবী মূর্তি কল্পনা, নয়তো ত্যাগের পরাকাষ্ঠা। খরখরে হাত, মিয়োনো সিঁদুর দাগ, ন্যাতানো কাপড়ে হলদেটে ছোপ, তেলচিটে চুল,পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে শীর্ণ শরীর। গল্পে, উপন্যাসে কবিতায় ছলোছলো চোখে এই মায়েদের গুণগান।' মাতৃত্ব' নারীর এই একটি ভূমিকার ওপর কেবল নিজের প্রয়োজনে সমাজ তার যত স্তাবকতা যত স্তুতি প্রাণ ঢেলে উজাড় করে দিয়েছে।

মাতৃত্বেই নারীর পূর্ণতা, এই বোধ নারীর চেতনায় প্রবেশ করানো হয়েছিল প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাতেই। দেবত্বের মহিমা আরোপ করে মানবিক দিকটি দেওয়া হয়েছে মলিন করে। মন, মেধা, ব্যক্তিত্ব, সম্পদ তার থাকবেনা। থাকবে কেবল মমতাময়, দায়িত্বপূর্ণ নিরলস মাতৃত্ব। " ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যর্মহতি " বাক্যবন্ধ এখনো যেন মাথায় এসে আঘাত করতে চায়। অথচ আমাদের দু প্রজন্ম আগেই মায়েরা মাতৃত্ব ছাড়াও বাইরে বেরিয়েছেন পেশাগত কারণে। শৃঙ্খল ভেঙেছে কিছুটা হলেও, আর স্বাভাবিকভাবেই আরোপিত শৃঙ্খলা ও। সেই কোন আমলে জন স্টুয়ার্ড মিল বলে গিয়েছিলেন "কোন ক্রীতদাসই ততদূর পর্যন্ত এবং সম্পূর্ণভাবে ক্রীতদাস নয়, যেমনটা স্ত্রী "। আর মা?

মা শুধু মা। মা আর কখনো প্রেমিকা হবেনা। নারীত্ব মাতৃত্বে পূর্ণ হয়, পুরুষ পিতৃত্বে সার্থক একথা কখনো শুনিনি কিন্তু। বেদ-পুরাণে আশীর্বচন উচ্চারিত হয়েছে সে যেন "অশূন্যপস্থা" হয়। যাতে তার কোল কখনো খালি না হয়, ক্রমাগত ভরে উঠতে থাকে বিরতিহীন। এর পেছনের কারণ না উচ্চারণ করলেও চলে, তাইনা? মাতৃত্বেই অহং মুক্তি ঘটে। নাকি অহং তৃপ্তি?

মাতৃত্বের চালিকাশক্তি ঠিক কী?

মাতৃত্ব নারীর একটি অবস্থা মাত্র, এক অতিরিক্ত গৌরব। যা চাপিয়ে দেওয়া। জৈবিক কারণবশত সে তা অর্জন করে, তার শরীর দিয়ে। মাতৃত্ব আছে যৌনতা নেই। এতো অসম্ভব কল্পনা। প্রেমহীন মিলনে উৎপন্ন মাতৃত্ব সাধারণ জীবজগতের মত জৈবস্তরে কিম্বা হিসেবনিরপেক্ষ বৈষয়িক স্তরেই দাঁড়িয়ে থাকবে একথা ভাবতে শিউরে উঠি। শক্তি যদি একদিন ক্ষমতার রূপ নেয়? দূরস্বপ্নে দেখি যৌনতাবিহীন মাতৃত্ব গ্রহণ করছে নারী। বিজ্ঞানসম্মতভাবে সুযোগ্য শুক্রাণু বেছে নিয়ে ক্রয় করছে সে উন্নততর বোধসম্পন্ন মানুষের জন্ম দেওয়ার আশায়। প্রেমহীন যুক্তিবাদ সমাজকে বদলে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। এ স্বপ্ন নয়, একটি দুস্বপ্নের কথা বললাম।

অনেক শক্তি ও সহনশীলতার মত মাতৃত্বও নারীর আর একটি শক্তি। শক্তি ও ক্ষমতার পার্থক্য বোঝার দিন এসেছে। দেবী সরস্বতী ও রাধা মাতৃত্বে উত্তীর্ণ নয় তাই তারা প্রেমের যোগ্য। মা কী কখনো প্রেমিকা হতে পারে? প্রেম তো মানবিক। মা দু-ধাপ ওপরের দেবী। মা কী তবে মিথ? মাতৃত্বের পুজো কী তাহলে মিথ্যে দেবীপুজো?

সংখ্যাটি সাজানোর জন্য সোনালীর নিরলস প্রয়াস আমাকে মুগ্ধ করেছে। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে গড়ে উঠলো আর একটি সুন্দর সম্পর্ক। লেখকদের বক্তব্য পাঠক পড়ুন। মতামত দিন। এগিয়ে নিয়ে চলুন মায়াজমকে। চরৈবেতি।



                                                                               শবরী রায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন