মহামায়া
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নেশা...”
পুরনো টেপরেকর্ডারে ক্যাসেটগুলো চালিয়ে দেখছিল রুচিরা। বাবার গলায় রেকর্ডিং। বাড়ি নির্জন থাকলেই বাবা মাথায় এসব পাগলামি ঘুরত। বাবা নেই চৌদ্দ বছরেরও কিছু বেশি সময়। এতগুলো দিন যাওয়ার পর কি প্রিয় মানুষেরা ম্লান হয়ে আসে? বাবা মানেই জীবনানন্দের কবিতা, জর্জ বিশ্বাসের গান, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ অথবা সৌমিত্র না উত্তম তাই নিয়ে তুমুল ঝড়। বাড়ি এলেই রুচিরা ডাউন মেমরী লেনে হেঁটে বেড়ায়। পরম মূহুর্ত।
মনে আছে, বাবা তোমায় মাঝমধ্যে ‘মহামায়া’ বলে ডাকত আর তুমি রেগে যেতে। ওরম কেন বলতো গো?
নন্দিতা বাদামী পিওর সিল্কে কাঁথা স্টিচে নকশা তুলছেন। রুচিরার পছন্দের রঙ। মেয়েকে তাঁর সেরা হাতের কাজের একটা শাড়ি উপহার দেবেন, অনেকদিনের শখ। চোখ না তুলেই মুখের হাসির ঝলক চশমার ফাঁক পর্যন্ত ঠাহর করা যায়।
বল?
রুচিরার আবদারমাখা প্রশ্ন।
তমসা
নন্দিতার হাসি যেন মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
তমসা কি?
কি না, কে। তোর বাবার প্রথম প্রেমিকা। লোকটা পাগলের মত ভালবাসতে জানত। তমসা তার মূল্য দিতে পারেনি। বনলতা সেন, রবি ঠাকুরের গান, সুপ্রিয়া দেবী সব জায়গাতেই তমসাকে খুঁজে বেড়াত তোর বাবা। আমি এলাম, তুই এলি, তবু আমার জীবন থেকে তমসা গেল না।
রুচিরা লক্ষ্য করছিল মা নক্সী কাঁথার মাঠ ধরে পেছনে হাঁটছে। রুচিরা কি থামিয়ে দেবে? অসহায় লাগছিল।
তারপর?
প্রতিমাসের মাইনে এলে তিনশো টাকা গীতার ফাঁকে গুঁজে রাখতাম। অনেক শাড়িও কিনেছি ঐ টাকা জমিয়ে। যখন দেখতাম লোকটা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে উন্মাদের মত করছে, শখানেক টাকা হাতে ধরিয়ে বলতাম যাও খেয়ে এসো। সস্তার মদ। স্বস্তি পেতাম। তমসা হারিয়ে যেত। তারপর কদিন খুব হুল্লোড়ে থাকত। আমি গীতা নিয়ে ঠাকুর ঘরে বসলেই বলত, “তুমি মহামায়া”
সরু সূচের ডগা আঙুলে ফুটলে যেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয় তেমন করেই নন্দিতার কথাগুল বিঁধছে রুচিরার বুকে।
লিভারের অসুখটা ধরা পড়তেই থেমে গেলাম। সঙ্গী করে নিলাম তমসাকে। বিনা নোটিশে সব যুদ্ধ শেষ
রুচিরা ক্যাসেট সেট করে প্লে বাটনে চাপ দিল
“বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি”
-সমাপ্ত-
সুচিন্তিত মতামত দিন