ঈশানী রায়চৌধুরী - মায়াজম

Breaking

৩১ মার্চ, ২০১৭

ঈশানী রায়চৌধুরী

কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়


তোমার ওই লাপিস লাজুলি চোখের তারায় সেদিন কীসের ছায়া পড়েছিল বল তো ? মিশাকে নিয়ে চিন্তায় ছিলে খুব ? মিশা আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নয়...তাই কি তুমি মাঝেমাঝেই খানিক অন্যমনস্ক হয়ে যাও ? আমার মনে আছে জানো, ও যখন খুব ছোট..ওকে সেই প্রথমবার দেখলাম.. কত জনকে যে গল্প করেছি ওর ! বলেছি, এত ফুটফুটে আর বুদ্ধিমতী মেয়ে আমি দেখিইনি কখনও | তারপর কী যে হল , ওর হাবভাব ছটফটানি সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেল | কখনও বা নিজের মনে হাত পা নেড়ে গুচ্ছের কথা বলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে , আবার কখনও একেবারে চুপ | তোমার মনে আছে, আমরা মাঝেমাঝেই এ নিয়ে আলোচনাও করেছি | আবার ভেবেছি, বাচ্চাই তো ... অমন কল্পনার ছায়া ছায়া জগতে আমরাও তো কতবার ছোটবেলায় ইচ্ছে করেই হারিয়ে যেতাম !
বুঝিনি | একেবারে বুঝিনি যে ওর কিছু সমস্যা আছে | যখন তুমি সব জেনে , নিশ্চিত হয়ে দৌড়ে এসেছিলে আমার কাছে , তখন তোমার দাম্পত্যের নৌকোটার খোলে অনেক অনেক জল | একটাই ছোট্ট ফুটো ; কিন্তু মেরামতের অযোগ্য | কিছুই করার উপায় ছিল না | কিন্তু তবু ... তোমরা স্বামী-স্ত্রী দু-জন মিলে জল সেঁচতে পারতে অন্তত ! তুমি অসহায়ের মতো আমাকে এসে বললে, মিশার বাবা তোমাদের মা-মেয়েকে এক জায়গায় থাকতে বলে নিজে নতুন চাকরির অজুহাতে দেশের বাইরে | তুমি বলেছিলে, মিশাকে নিয়ে তুমিও যাবে | বিদেশে এমন তো কত বাচ্চাই বড় হয় ! বরং ওখানে এইসব ছেলেমেয়েদের জন্য হাজার রকমের সুযোগসুবিধা | মিশার আত্মসুখী স্বার্থপর বাবা হাত নেড়ে স্রেফ নস্যাৎ করে দিয়েছিল তোমায় |
তুমি তাই একাই থাকো এখন | মিশাকে নিয়ে | সমুদ্রের ধারে ছবির মতো একটি বাড়িতে | মিশা এখন যুবতী এবং...একটু 'অন্যরকম' হলেও চোখে পড়ার মতো সুন্দরী | তবু তোমার ভয় করে না , কারণ তোমার পড়শিরা তোমাকে, তোমাদের আগলে রাখেন বড় বেশি যত্নে আর মমতায় | তাঁরা তোমাদের জন্য প্রয়োজনে পৃথিবী ওলটপালট করে দিতে পারেন | মিশা ওঁদের প্রাণ | মিশা নিরাপদ | আচ্ছা, মিশার বাবা ... ওই পলায়নী মনোবৃত্তির মানুষটিকে তুমি ক্ষমা করে দিয়েছ কি ?
তোমার ঘন নীল চোখে কেন ধূসর মেঘ ? আজ এত বছর পরেও ? আমি কিছুই ভুলিনি তো ! তোমার উজ্জ্বল ছাত্রীজীবন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের চত্বর পেরিয়ে সোজা পায়ে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ , বায়োকেমিস্ট্রিতে পি এইচ ডি, তোমার ঝকঝকে দৃষ্টি , সাজানো দাঁতের ঝিলিক হাসি , ফর্সা ছিপছিপে চেহারা, কোঁকড়া চুলের রাশ , তোমার বিয়ের মেরুন বেনারসী, আমাদের রাতজাগা অবাধ হুল্লোড় ....| মিশার বাবা ...| তুমি খুব গর্ব করে বলেছিলে, ও এক বিখ্যাত লেখিকার দৌহিত্র | আমরা শুনেই রোমাঞ্চিত !
কিছুই ভুলিনি, অথচ ভুলেও গেছি | ভুলে যাই | এখন এ শহরে এসে তোমার কথা সব সময়ে মনেও পড়ে না ... তবু.. কাল হঠাৎ তোমাদের পুরোনো বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে কেন যে তোমার ওই লাপিস লাজুলি চোখের কথা মনে এল ! ছোট্ট মিশার মুখ বুকের গভীরে এসে ধাক্কা মারল | ছোট্ট মেয়েটা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে তোমার শাসন নস্যাৎ করে দুষ্টুমি করতে করতে আধো আধো গলায় বলে উঠেছিল, "আমি এখন ছোট আছি, যা খুশি তাই করতে পারি |''
মিশাকে তুমি ভালো রেখো, আলোয় রেখো | ওর মন আসলে রামধনুর সাত রঙে সাতটি গুছিতে বাঁধা এক বিনুনির মতো | সে বিনুনি খুলে অকারণে চিরুনি চালিয়ে পরিপাটি করতে দিও না কাউকে | তাহলে যে ও আর 'মিশা' থাকবে না ! একেবারে অচেনা একজন হয়ে যাবে | ও আমাদের ওই পুতুলটি হয়েই থাকুক | ভুল হাতে ভুল চিরুনি দিয়ে ভুলভাল চুল আঁচড়ালে যদি জট পড়ে চুল ছিঁড়ে যায় ? ওর ব্যথা লাগে ? কষ্ট হয় ?
তার চেয়ে থাক না ! এইভাবেই | পাখি হয়ে, ফুল হয়ে, নদী হয়ে ...|

৩টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র