রঞ্জন ঘোষাল

মায়াজম
4
                                 তীর্থের কাক


তীর্থ কাক পুষেছিল। পোষা-ই একরকম। সকাল সন্ধে তীর্থর খোঁজ করতে আসত। তীর্থ দাড়ি কামাত যখন তখন সকালে একবার উদয় হত। জানালার কানাতে এসে বসত। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেশ দেখত ক্ষৌরকর্মটি, তারপর বলত, ক্ক ! অর্থাৎ রুটি দাও। বাসি রুটি একটি ওর বরাদ্দ ছিল। টুকরো করে না দিলে বাবু আবার খেতেন না। রুটিটি উদরস্থ করে উনি বেরিয়ে যেতেন পাড়া চরতে। সন্ধের ঝোঁকে একবার এসে খোঁজ নিয়ে যেত তীর্থ ফিরল কিনা।

তীর্থ স্কুলে পড়ায়। সকালে সাড়ে দশটায় বেরোয়। আর ফেরে বিকেল পাঁচটায়। ঘরে একটা কোচিং বসায়, শুধু সন্ধে বেলা ছটা থেকে আট সাড়ে আট। পড়ায় উঁচু ক্লাসের অঙ্ক আর পদার্থবিজ্ঞান।

পার্থর সীনিয়র সহকর্মী অম্বুজেশ মহালনবীশ এ পাড়া দিয়েই যাতায়াত করেন। স্কুটার আছে। উনি ইংরিজীর। দত্তপুকুর অঞ্চলে এ সাবজেক্টে ভালো ফল করতে হলে ঐ অম্বুজেশবাবু। রেল লাইনের ওপারে নিবাধইয়ে বাড়ি। পার্থকে একটা হাঁক মেরে যান। আছো নাকি?

পাখি-শৌখীন লোক। টিউশানির ঝামেলা না থাকলে অম্বুজেশবাবু এতদিনে নামকরা পক্ষীবিশারদ হয়ে যেতেন। হুমায়ুন আবদুলালি আর সালিম আলি সাহেবের সঙ্গে একাধিকবার বেরিয়েছিলেন দুষ্প্রাপ্য পাখির খোঁজে। একবার ওঁর সাউথ এশিয়ান বার্ডস-এর ওপর লেখা একটি প্রবন্ধ অর্নিথলজিকাল সোসায়েটি অভ এশিয়া-প্যাসিফিক-এর জার্নালে বেরিয়েছিল।

উনিই এসে একদিন বললেন, “তীর্থ, তোমার দাঁড়কাকটি কথা বলে বলছ? টকিং ক্রো? দুর্লভ, দুর্লভ”!

“কথা ঠিক বলে না। তবে একবার টিট্‌ঠো বলে ডেকে উঠেছিল, এ কথা ঠিক। তা ময়না, কাকাতুয়ারা তো কতো কথা-ই বলতে পারে। এই কাকটা আর এমন বেশি কী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে ফেলেছে”?

“তীর্থ, তোমার দন্ডবায়সটিকে একবার দেখতে হচ্ছে”।

“আসুন না। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে ঘুরে যান, যদি সময় করতে পারেন”।

তিন দিনের মাথায় অম্বুজেশবাবুর সঙ্গে কাকটির মোলাকাৎ হল। তীর্থকে উনি বাইরে থেকে যখন ডাকছিলেন, কে একজন তাঁরই প্রতিধ্বনি করে ডেকে উঠল, টিট্‌ঠো, টিট্‌ঠো বলে।

অম্ভুজেশ বললেন, অদ্ভুদ্‌ তো!

তীর্থ জিজ্ঞেস করল, কেন? অদ্ভুদ্‌ কেন?

অম্ভুজেশ বললেন, কাকের ভোকাল কর্ড নেই। আছে কিছু পেরিফেরাল মাস্‌ল তাই দিয়ে তোমার নামটা উচ্চারণ করে ফেলছে ! ব্যাপারটা পিকিউলিয়ার।

তীর্থ জিজ্ঞেস করল, কেন? টিয়া ময়নার ভোকাল কর্ড আছে নাকি?

না, তা নেই, কিন্তু ওদের ভোকাল ফোল্ড অনেকটা ফ্লেক্সিব্‌ল। আর একটা ইন্টারনাল মেমব্রেনও ওরা ব্যবহার করে। ডাকো তো তোমার কাকবাবাজীকে।

তীর্থ রুটির টুকরো দিয়ে ডাকতেই দাঁড়কাকটি এসে হাজির হল। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অম্বুজেশবাবুকে কয়েকবার নিরীক্ষণ করে নিয়ে রুটির দিকে মনোযোগ দিল।

অম্ভুজেশ বললেন, “বলো তো বাবু – ‘অম্বুজেশ’”

কাকেশ্রী পাত্তাই দিল না। পাঁচিলে বসে রুটি খেল তারিয়ে তারিয়ে। খানিকক্ষণ বাদে ফটাস্‌ করে বলল, গম্বুগেৎ।

এবার অম্বুজেশ আরও অবাক। ক বর্গীয় শব্দগুলো কন্ঠ্যবর্ণ। গাটারাল। গলার পেশীসঙ্কোচন করে করে ফেলা যায়। কিন্তু গম্বুগেৎ-এর ম এবং ব কাকটা উচ্চারণ করে ফেলল কী কৌশলে? দন্ত্যবর্ণের খণ্ড ৎটি-ও সমান আশ্চর্যের।

“বয়েস কত তোমার এই পক্ষীসমাজের অত্যাশ্চর্য নমুনাটির”?

কাক বলে উঠল, “থাড়ে ঙয়”।

অম্বুজেশবাবু আবার উত্তেজিত। দ্যাখো কান্ড, এ আবার আনুনাসিক বর্ণও উচ্চারণ করছে দেখছি। বলছে ‘থাড়ে ঙয়’, অবভিয়াসলি বলতে চাইছে ‘সাড়ে নয়’। ময়না বা কাকাতুয়ার মত ঙ-র প্রয়োগ। এমনকি টিয়া প্রজাতিও আনুনাসিকে তেমন দড়ো নয়। তোমার এই কর্ভাস তো রীতিমত অবাক করে দিল হে তীর্থ।

বলতে বলতেই থম্‌কে গেলেন অম্বুজেশ। তারপরেই লাফিয়ে উঠে তীর্থের ঘাড়খানা ক্যাঁক করে চেপে ধরলেন। “অ্যাঁ, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে ? নিজেকে প্রোফেসর শঙ্কু ভেবেছো? তোমার কাক শুধু কথা বলছে না, প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে? ও কী করে বুঝল, আমি ওর বয়েস জানতে চেয়েছি? আর আমাদের ক্যালেণ্ডার মাফিক নিজের বয়সটা ঠিক বললই বা কী করে? চালাকির জায়গা পাও না? ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হয়েছো? অ্যাঁ? আমি বয়েসে তোমার চেয়ে সাত বছরের বড়ো, সেটা খেয়াল রেখো”।

তীর্থ ভাঙে, কিন্তু মচ্‌কায় না। বেমালুম বলল, “নতুন শিখছি স্বরক্ষেপণ। কলকাতায় গিয়ে ম্যাজিশিয়ান প্রোফেসর আর্গস গোগিয়া পাশার কাছে। উইকএণ্ডে যাই”। তারপরে অপরাধীর লজ্জিত মুখ নিয়ে যোগ করল, “কাক সেজে দিব্যি আপনাকে অবাক করে দিচ্ছিলুম। কিন্তু, ভুল করে, প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই ... ছ্যা ছ্যা – বেসিকালি কাকের বাসার কোকিলছানা যে ! - ধরা পড়ে গেলুম” !
>>>>>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন