ইন্দিরা দাশ - মায়াজম

Breaking

৩১ মার্চ, ২০১৭

ইন্দিরা দাশ

                                 তর্পণ






মেজাজ ভালো নয় রোহিণীর। কিংশুক ট্যুরে ব্যাঙ্গালোরে। শাশুড়ি-মা’কে বাড়িতে একা রেখে রোহিণীর অফিস করাটা একেবারেই অসম্ভব। উনি স্ট্রোক থেকে সেরে সদ্য বাড়ি ফিরেছেন হাসপাতাল থেকে। একটু যত্নআত্তি করার, চোখে-চোখে রাখার প্রয়োজন। ছেলে বাড়িতে না থাকলে দায়িত্বটা বউমা রোহিণীর ওপরেই পড়ে। যদিও পাশের ফ্ল্যাটের জোয়ারদাররা দরকারে রোহিণীর মোবাইলে চট করে খবর দেন। মা লাঠি নিয়ে একাই চলাফেরা করতে পারেন, তবু কানে কম শোনেন, চোখে কম দেখেন। আয়া একজন রাখতেই হবে। বয়স্ক মানুষটার কাছাকাছি থাকা, সময়মত ওষুধটুকু খাওয়ানো ছাড়া আয়ার কোনও কাজ নেই। তার জন্য দৈনিক তিনশো টাকা খরচায় কিংশুক বিরক্ত, “এক প্রায়-নিরক্ষর মহিলা এতগুলো টাকা শুধু বসে থেকে নিয়ে চলে যাবে!” 

কিংশুকই ঠিক করল যে আয়াকে রোববারগুলো আসতে মানা করে দেওয়া হবে। মাসে চারটে দিনের পয়সা বাঁচবে তাহলে। মা’ও পক্ষপাতি ছিলেন না আয়া রাখার ব্যাপারে। “আমার হয়েছেটা কি, বৌমা? স্ট্রোক-টোক কিছুনা, বয়স হলে ওরকম হয়। তাই বলে ঐ মেয়েটাকে সারাদিন বসিয়ে রাখতে হবে! তিনটে’র পর পিপ্‌লু এসে যায়। পাঁচটায় তিন্নী’র মা এসে বাসন মাজবে। ছ’টার মধ্যে তুমিই বাড়ি পৌঁছে যাও”। 

অথচ এই সময়সীমাটুকুর মধ্যেও বিপদ আসতে পারে। মাসকয়েক আগে এক শুক্রবার যখন বাড়ি থেকে ফোনে পিপলু ভিতু গলায় বোঝালো যে ঠাম্মা বাথরুমে মেঝেতে পড়ে রয়েছে, ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না, তখন কিংশুকের ফোন ছিল সাইলেন্ট। কিংশুক‘কে মেসেজ ছেড়ে, বড়বাবুকে জানিয়ে রোহিণী দৌড়ল বাড়িতে। জোয়ারদার-দম্পতি লোকাল ডাক্তারকে কল করেছেন। তিনটে সেলাই লাগানো পর রক্ত পড়া বন্ধ হলেও হাসপাতালে ভর্তি করতেই হোল। সে যাত্রা সি-টি স্ক্যান, চিকিৎসার গুণে মোহিনীবালা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেও, পিপ্‌লু’র ভীতি কাটতে অনেকদিন সময় লেগেছিল। ওনাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর আর একা রাখা হবেনা, এই সিদ্ধান্তটা রোহিণীই নিলো। 

দুদিন পরে আয়া-নার্সিংব্যুরো’র ফোনটি এল। ‘মিসেস বসু, আপনার জন্য একটি ক্যান্ডিডেট পেয়েছি। মেয়েটি নতুন, কিন্তু পরিচ্ছন্ন, ভদ্র। ভাঙ্গা হিন্দী, ইংরিজীতে কাজ চালিয়ে নিতে পারবে”। আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে রোহিণীর কথাগুলো শুনে। জানা গেলো কোন দক্ষিনী তনয়া কাজ খুঁজতে এই কলকাতায় এসে নার্সিংব্যুরোতে নাম লিখিয়েছেন। মোহিনীবালা শুনে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। ‘বল কি বৌমা, যদি চায়ে তেঁতুল-গোলা জল মিশিয়ে এনে খাওয়ায়? হে ভগবান!’ 

মঙ্গলবার শুভাগমন হোল বাসন্তী’র। কালো রঙ্গেরও একটা ঔজ্জ্বল্য আছে। রোগা-পাতলা মেয়ের চোখ দুটো দীঘল, কিন্তু দোয়েল পাখির মত ছটফটে, একটু যেন আশঙ্কিত। রোহিণীর ভালো লাগলো মেয়েটাকে। সরু সোনালি-পাড় লাগানো পরিষ্কার সাদা শাড়ি আর বিনুনীতে ছোট্ট বেলফুলের মালায় একটা পবিত্র ভাব। 

দিনকয়েক গেলে বাসন্তীর ওপর বিরক্তিটা একটু কমেছে শাশুড়ি-মা’র। মোহিনীবালাকে যত্নে রাখে সে। অবসরে বাড়ির ছোটখাটো কাজও করে। মেয়েটা’র আর্থিক অবস্থা খারাপ তাই ভিন্ন শহরে কাজে জুটেছে । রোহিণী একদিন শুনেছে তার বাড়ির কথা। কেরালায় ছোট্ট শহরে ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডে চাকরী করত স্বামী। এক অ্যাক্সিডেন্টে মাথায় গভীর চোট পাওয়ার পর জ্ঞান ফিরলেও দুপায়ে আর বল রইলনা, দুহাতের শক্তিও নিঃশেষ প্রায়। বিছানায় শুয়ে শুধু ছেলেমেয়ে তিনটের পড়াশোনা দেখিয়ে দিতে পারে সে। বাসন্তীর দাদা সাহায্য করলেও কিছুদিন পর আর বৌদি তার নিজের সংসারখরচ থেকে অর্থ অপচয় হতে দেয়নি। 

ক্লাস টেন-পাশ বাসন্তী বহু চেষ্টাতেও স্বামীর চাকরীর জায়গায় কাজ পায়নি। সোনাদানা বন্ধক রেখে, বড় মেয়েটার ভরসায় সংসার ফেলে সে এসেছে কলকাতায় দূর-সম্পর্কের দিদির বাড়িতে। প্রাইভেট নার্সিংহোমে দিদি নার্সের কাজ করে। বাড়িতে দুটি ছোট ছেলে, তাই রাতের ডিউটি নেয়না সুমালী। পরিবর্তে ছুটিছাটা ছাড়াই টানা-সপ্তাহ কাজ করে। জামাইবাবু বসার ঘরটিতে ‘কেরালা স্টোরস’ খুলেছে, নারকেল চিপ্‌স, সাম্বারের পাউডারের বিক্রিবাটা মন্দ হয়না। 
বিপদে পড়ে হাজির হয়েছে বাসন্তী, ফেলতে পারেনি সুমালী, তবে বলেছে ছুটি নিয়ে বোনের বাড়িতে বসে থাকা তার ঘোর অপছন্দ। এই কারণেই হয়ত রোববারের ছুটির কথায় ম্লান হোল বাসন্তী! অথচ বাড়ির বাবুর, শ্বশ্রুমাতার হুকুম রোহিণী চাইলেও বদলাতে পারেনা! 

সোম থেকে শুক্র, মন্দ কাটেনি। শনিবার বিকেলে পরদিনের ছুটির কথাটা বাসন্তীকে একবার মনে করিয়ে দিলো রোহিণী। মাথাটা নীচু করে কি যেন বলতে গিয়েও বলল না মেয়েটা । 
সোমবার সকালে আধঘন্টা দেরী করে এলো বাসন্তী। পরনে ফিটফাট সাদা শাড়ি, কিন্তু চোখের নীচে একটা কাটা দাগ, কপালে ছোট কালশিটে। কারণ জিজ্ঞেস করতে সদুত্তর দিলনা। লক্ষ করল রোহিণী, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে মেয়েটা! 

সপ্তাহ শুরু হলেই তার নিজস্ব গতিবেগে দৌড় শুরু করে। সপ্তাহান্তে কিংশুক গাড়ি-ভাড়া করেছে শনি-রবিবার সবাইকে নিয়ে চন্দননগরে তার কাকার বাড়ি বেড়াতে যাবে। কিটব্যাগে অল্প জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়েছে রোহিণী। মা’র ওষুধগুলো এনে হাজির করেছে বাসন্তী। আমতা-আমতা করে একবার বলল তাদের সঙ্গে চন্দননগর যাওয়ার কথা, রাস্তায় মোহিনীবালাকে দেখাশোনা করা দরকার। কিন্তু কিংশুককে রাজী করানো অসম্ভব, “ওবাড়িতে অতিরিক্ত মানুষটার খাওয়া-শোয়া ঝামেলা দাঁড়াবে।” 
সেই রোববার পেরোলে সোমবারে সাদা-শাড়ি এসে পৌঁছল না। ফোন এলো নার্সিং-ব্যুরো’র মিস্টার দাশগুপ্ত’র, জানালেন, দিন-দুয়েকের মধ্যে নতুন বাঙ্গালী আয়ার ব্যবস্থা করছেন। সকলের অজান্তে, রবিবার সন্ধ্যেয় হঠাৎই প্রতিবেশীর কাছে বলে বাসন্তী কেরল ফেরত গিয়েছে, শুধু রোহিণীর জন্য মুখবন্ধ খামে রেখে গেছে একটি চিঠি। 

অফিসফেরতা নার্সিংব্যুরো পৌঁছে বাইরের ঘরটাতে বসেই চিঠিটা খুলে ফেলল রোহিণী। ভাঙ্গাচোরা ইংরিজীতে বাসন্তী লিখেছে এক লজ্জাকর যন্ত্রণার কাহিনী। তার জামাইবাবুর শুরুর থেকেই তার শরীরটার ওপর কু-নজর পড়েছিল। দিদির অবর্তমানে, ছোট বাচ্চাদুটোকে অন্য ঘরে বন্ধ রেখে, সে বাসন্তীর ওপর হামলা চালাত। নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করত বাসন্তী। বদনামের ভয় দেখাত লোকটা। বাসন্তীর চোখে অসুস্থ স্বামী আর ছেলেমেয়েগুলোর নিরুপায় মুখ ভাসত। প্রতি রবিবার পাশবিক নির্যাতন চলত তার ওপর। রবিবারের সমস্ত দিন রাস্তায় বেরিয়ে অজানা শহরে কোথায় সময় কাটাবে বাসন্তী? রোহিণী-কিংশুকের সুখের সংসারে সপ্তাহান্তের বিশ্রাম আর আনন্দের মাঝখানে তার জায়গা হয়না। গত রোববারও জুলুমবাজিতে বাধা দেওয়াতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছিল তার। হাঁটাচলার অসুবিধেটা দেখেও তার চূড়ান্ত অসন্মানের পরিস্থিতিটা আন্দাজ করতে পারেনি রোহিণী। এই রবিবারও বিয়ারে বুঁদ, সমস্ত দিন বাসন্তীর শরীরে থাবা বসিয়েছে লোকটা। দিদিকে জানালে বাসন্তীর নিজের ওপরেই দোষটা পড়বে, তাই সন্ধ্যের পর ব্যাগ গুছিয়ে, জমানো সামান্য টাকা সম্বল করে, একে-তাকে জিজ্ঞেস করে স্টেশনে রওনা দিয়েছে বাসন্তী। রোহিণীর সংসারে যে সন্মান পেয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে সে। 

ক’দিন ছুটি নিলো রোহিণী। তৃতীয় দিন দরজায় বেল টিপল নার্সিং-ব্যুরোর কার্ড হাতে ফ্যাকাসে মেয়েটা, ‘আমি মিনতি, দিদি’। শাশুড়ি-মায়ের কাজকর্মটুকু বোঝালো রোহিণী। মোহিনীবালা বাঙ্গালী-মেয়েকে মেনে নিলেন তাড়াতাড়ি। 

তবু শুক্রবার সকালে যখন কাজে এলো মিনতি তার মুখখানা কাঁচুমাচু, হাঁটুর কাছে উঁকি দিচ্ছে কোঁকড়াচুলো মাথা। ছোট মেয়েটার পরনে আধময়লা স্কুলের পোশাক। ‘বৌদি, গত মাসে কাজ ছিলনা, ইস্কুলের মাইনে দিতে পারিনি। সেখান থেকে কুসুমকে বের করে দিলো আজ। বাড়িওয়ালা বুড়োটা ইস্কুল না থাকলেই, ওকে নিজের ঘরে ডেকে হাত-পা টেপায়, বুকে হাত দেয়। পাশের বুটিকের বৌদি বিকেলে একটু বসতে দিত, আজকাল সেটাও বন্ধ। 

রোহিণীর এবার সময় নষ্ট করলনা। বাচ্চাটাকে ঘরে এনে দুটো বিস্কুট তার হাতে দিয়ে, আলমারি থেকে নিয়ে এলো বাসন্তীর মাইনেটা। ‘আপাতত এটা স্কুলে জমা দিয়ে আবার নাম লিখিয়ে আসবে মিনতি। স্কুল থেকে এ বাড়িতে চলে আসবে কুসুম। দুটো ভাত খাবে। সাড়ে-ছ’টায় তুমি যখন বাড়ি যাবে, তখনই ও ফিরবে, তার আগে নয়’। 

বিকেলের বারান্দা থেকে আজ টবের বেলফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। আপন মহিমায় ফুটে উঠেছে সৌন্দর্যরাশি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র