অঙ্কুরোদ্গম
প্রাণপণ ছুটছিল মহুয়া। পাশে তিতলি। বিয়েবাড়ির কলরব আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। ষোল বছরের তিতলির সাথে দৌড়ে মহুয়ার একটু হাঁপ ধরছিল ঠিকই, কিন্তু আজ হারতে বসে নি সে। আজ তাকে জিততেই হবে। দৌড়ে কাছের স্টেশনে পৌঁছে সে দেখলো কলকাতাগামী ট্রেন আসছে। টিকিট কাটার সময় তখন আর নেই। কি আর করা। বিনা টিকিটের যাত্রী হয়ে কলকাতার দিকে রওনা হল মা আর মেয়ে। কলকাতায় যে আছে তাদের মুক্তির চাবিকাঠি!
আজ তিতলির বিয়ে। মহুয়া তার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বার বার বুঝিয়ে ক্লান্ত হয়েছে, যে মাত্র ষোল বছরে একটি মেয়ের বিয়ে দেওয়া কখনোই উচিৎ নয়। নাবালিকা বিয়ে আইনতঃ অপরাধ তো বটেই, অমানবিকও। কিন্তু কে কার কথা শোনে! মহুয়ার স্বামী অখিলেশ তিতলির বাবা। তার বক্তব্য হল,"তোমারও তো এই বয়সেই বিয়ে হয়েছিল! তুমি কি খারাপটা আছো! তোমার মতো ভালো কজন আছে, গুণে দেখাও তো! আলমারী ভরা শাড়ী, গা ভরা গয়না। " কিন্তু মহুয়া বুঝিয়ে উঠতে পারে না যে একটি মেয়ে শুধু শাড়ী গয়নাতেই সুখী হয় না। তারও মানুষ হওয়ার স্বপ্ন থাকে। আর মহুয়ার শ্বশুর, শাশুড়ীর কথায়, "এ হল বৌমার আদিখ্যেতা। নিজে ভালো আছে, তাই ও চায় না ওর মেয়ে ভালো থাকুক।" শুনে হাসি পায় মহুয়ার।
ছেলেবেলায় মহুয়া খুব ভালো ছিল পড়াশুনোয়। তার সাথে গান, কবিতা লেখা সবেতেই ছিল সে সমান দক্ষ। ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসটিচার বরুণাদি সবসময় বলতেন, "তোমরা মহুয়াকে দেখো। ওর পড়ার প্রতি অনুরাগ ওকে একদিন খুব বড় করবে, দেখো তোমরা।"
হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা দেওয়ার সময় মহুয়ার বাবা তিনদিনের জ্বরে দেহ রাখলেন। মহুয়ার মা পড়লেন অথৈ সাগরে। মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়ীতে আশ্রিতা মা চেয়েছিলেন মহুয়া পড়াশুনো করে অনেক বড় হোক। কিন্তু আশ্রিতার চাওয়ার কোন মূল্য থাকে না। মহুয়ার মামা আর দিদিমার আনা পাত্রের সাথে সেই ষোল বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় মহুয়ার। আর বন্ধ হয়ে যায় তার লেখাপড়া, শেষ হয়ে যায় তার সেই স্বপ্ন। এক বছর পর তার কোলে আসে তিতলি। তাকে মানুষ করে নিজের ক্ষোভ ভোলার এক অদ্ভুত শপথ নেয় মহুয়া।
কিন্তু না। আজ তার সাধের তিতলিরও স্বপ্ন বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র সে রুখবেই। দাঁতে দাঁত ঘষে সে। তিতলিকে বিয়ের আগে গা ধোয়াতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগে মেয়েকে নিয়ে বিয়েবাড়ী থেকে পালায় সে। তারপরে দৌড় আর দৌড়।
প্রাথমিক উত্তেজনাটা কাটলে মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়ে। সকাল থেকে শরবৎ ছাড়া কিছুই খাওয়া হয় নি মা মেয়ের। বিয়ের দিন তো এই দুজনকেই উপোষ করতে হয়! মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুকে জোর আনে মহুয়া।
সকালে ট্রেন পৌঁছোয় শিয়ালদহ স্টেশনে। টিকিট পরীক্ষক কেন জানি না, মা মেয়েকে দেখে টিকিট চান না। চাইলে মুশকিল হত মহুয়ার। তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে মাণিকতলাগামী একটা বাসে ওঠে মেয়েকে নিয়ে। বরুণাদির বাড়ী যে সে চেনে! আজ বরুণাদিই মহুয়ার একমাত্র ভরসা।
এতদিন বাদে হলেও বরুণাদি ঠিক চেনেন মহুয়াকে। বাড়ীর ভেতরে ডেকে আগে জলখাবার দিয়ে সুস্থ করেন মা মেয়েকে। তারপরে সব কথা শুনে মহুয়াকে বলেন,"তবে তুই এখন কি করতে চাস? পুলিশে অভিযোগ করলে তোর স্বামী, শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের তো গ্রেপ্তার করে নেবে। " মহুয়া হাতজোড় করে বলে, "না দিদি আমি তা চাই না। আমি শুধুই চাই তুমি আমার তিতলির দায়িত্ব নাও। আমার মতো ওর স্বপ্নগুলো যেন শেষ না হয়ে যায়, এটুকুই দেখো। এই নাও আমার সমস্ত গয়না, এই দিয়ে তুমি ওকে পড়িয়ো। আমি দেখতে চাই, ও খুব সফল হয়েছে। ব্যস এটুকুই। আমি আবার ওখানেই ফিরে যাবো। তাতে আমাকে যা লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়, করবো। কিন্তু তুমি তিতলিকে মানুষ করো। " তখন বরুণাদি বললেন, "কিন্তু ওরা যদি আমার বিরুদ্ধে পুলিশে খবর দেয়, ওদের মেয়ে অপহরণ করেছি বলে?" মহুয়া বলে, " জেলাশাসক তিতলিকে খুব ভালো চেনে দিদি, ও গতবার স্কুলের ফাংশনে গান গেয়েছিল তো! আমি ফেরার পথে জেলাশাসকের সাথে দেখা করে সব কথা লিখিত ভাবে জমা দেবো। তুমি চিন্তা করো না দিদি।" সব শুনে বরুণাদি বলেন," কিন্তু তারপরেও তুমি ওই বাড়ীতে থাকতে পারবে কি মহুয়া? " ম্লান হেসে মহুয়া বলে" আর কোথায় যাবো দিদি? বাঙালীর মেয়ে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছি একেবারেই কাঁধে চড়ে বেরোবো। শুধু দেখো আমার তিতলির ভাগ্য যেন আলাদা হয়।"
মেয়েকে ডেকে মাথায় হাত দিয়ে মহুয়া বলে, "মা তুমি মানুষ হয়ো। আমি ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আজ আমি ফিরছি বিজয়ী হয়ে। আমার যে স্বপ্নগুলোর শিকড় উপড়ে আমি গিয়েছিলাম সেখানে, আজ আবার সেই স্বপ্নদের অঙ্কুরোদগম হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। তুমি বিজয়ী হয়ো তিতলি। "
বরুণাদি আর তিতলি অশ্রুতে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার দিকে। যেন তারা পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছে। যতই সবুজ ধ্বংস করা হোক না কেন, আশার অঙ্কুরোদগম চলতেই থাকে। " ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।"
সুচিন্তিত মতামত দিন