অর্ঘ্য দত্ত

মায়াজম
0
                      টিকটিকি 



চোখ খুলতেই রণিতার মনে হল যেন ওর মুখের পরে একটা টিকিটিকির স্থির বাদামী মুখ ঝুলে আছে। আবছা। চোখের ভারী পাতা বন্ধ হয়ে আসার আগে দু চোখের মণি চওড়া করে আবার তাকালো ঝুঁকে পড়া মুখটার দিকে। এবার মনে হল ডোনার মুখ। বাষ্প-জমা কোনো কাচের মধ্যে দিয়ে যেন দেখছে। অস্পষ্ট। ঘোরের মধ্যে চোখ বুজেই বাঁ হাতটা উঁচু করে মুখটা ছুঁতে গিয়ে হাতে লাগল একটা চশমার কাচ। ফ্রেম টপকে আঙুল সামনের গালের ত্বক স্পর্শ করতেই বুঝতে পারলো, ডোনা নয়। ডোনা চশমা পরে না। অথবা যেহেতু কোনো বোঝাবুঝির মতো অবস্থায় নেই, অনভ্যস্ত স্পর্শই হয়তো ওর অবশ মাথাকে বলে দিল এই অচেনা ত্বক এগারো বছরের ডোনার নয়। রণিতা আবার চোখ খুলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে ঝুঁকে থাকা মুখটাকে। সামনে জমে থাকা বাষ্প মুছে গিয়ে ধীরে ধীরে দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে এলে বুঝতে পারে ডোনা নয়, উদ্বিগ্ন মুখটা ওর মা নলীনির।
-- এখন কেমন লাগছে রণি? নলীনি ওর কপালে হাত রাখে। নলীনির পেছনে এসে দাঁড়ায় সুব্রত। রণিতার চোখের মণি অন্য কাউকে খুঁজছে বুঝতে পেরে সুব্রত বলে,
-- এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল। আমি এয়ারপোর্ট থেকে মাকে নিয়ে ফিরে এসে ডেকে দিয়েছি। তোমার রাজকন্যে এখন বাথরুমে গেছে। রণিতার মনে হয় যেন অনেক দূর থেকে একটা চেনা স্বর কিছু বলছে। 
রণিতার চোখ আবার বুজে আসে। স্যালাইন লাগানো ডান হাতটাও টনটন করতে থাকে ব্যথায়। তলপেটও যেন ভার হয়ে আছে।
প্রায় এগারো বছরের ব্যবধানে তেত্রিশ বছরের রণিতার দ্বিতীয় সন্তান হয়েছে। ছেলে। প্রথম সন্তান মেয়ে, বছর এগারোর ডোনা। এই বয়সে আশ্চর্যজনক ভাবে নরমাল ডেলিভারি হলেও কিছু পোস্ট ডেলিভারি জটিলতা দেখা দিয়েছিল দিন তিনেক আগে। সুব্রতও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সেই খবর পেয়েই নলীনি আজ ভোরের ফ্লাইটে কলকাতা থেকে সোজা উত্তর মুম্বাইয়ের মালাডে ডঃ কুদালকারের এই নার্সিংহোমে। নলীনি অবশ্য ডেলিভারির আগেই চলে আসতে চেয়েছিল, তখন রণিতাই আগ্রহ দেখায়নি। বলেছিল, কোনো দরকার নেই। নামী ডাক্তার, ভালো নার্সিংহোম, কোনো সমস্যা হবে না। ভাইএর নতুন চাকরি, সকালে কে ওকে রান্না করে দেবে! 
গত পাঁচদিন ধরে এই নার্সিংহোমের ডিলাক্স রুমেই রণিতার গোটা সংসার। বেচারা ডোনাও সেই যে মায়ের সঙ্গে এসেছিল, সেই থেকে টানা পাঁচদিন এই নার্সিংহোমেই। রণিতা মেয়েকে ছেড়ে থাকতে চায়নি। গতকাল সকালে সুব্রতর কাছে সব শুনে নলীনি একরকম জোর করেই চলে এসেছে। ছেলে মানস অনলাইনে আজ সকালের টিকিট কেটে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে গেছে। দশবছরের বড় দিদিকে মার মতোই ভালোবাসে মানস। নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে, নাহলে নিজেও ঠিক চলে আসতো।
দুজন গুজরাটি প্রতিবেশী ভিজিটিং আওয়ার্সে রণিতাকে দেখে যাওয়ার পরে সন্ধ্যাবেলায় নলীনি ডোনার চুল সরিয়ে ঘাড়ে আঙুল দিয়ে ঘষে ময়লা তুলতে তুলতে সুব্রতকে বলে, আজ আমি এখানে রণির কাছে থাকছি, তুমি ডোনাকে নিয়ে ফ্ল্যাটে যাও। কতদিন তোমরা ঠিকমত ঘুমোতে পারোনি। ডোনাটার গায়েও বোধহয় সাবান পড়েনি অনেকদিন। এখানকার এইটুকু বাথরুমে স্নান করা যায়!
মা আমাকে যেতে দেবে নাকি! আমি না থাকলে মার ঘুমই হয় না, মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে চোখ তুলে বলে ডোনা। তারপর লাজুক হেসে বলে, মা পাশে না থাকলে আমারও ঘুম হয় না।
রণিতা, এ বেলায় অনেকটা সুস্থ, বলে-- না,না, ও এখানেই থাক। কী অসুবিধা হচ্ছে ওর, ভালোই তো আছে!
কাপড়ে পেঁচানো রণিতা-সুব্রতর তিনদিনের ছেলেকে কোলে করে নিয়ে এসে ওদের দেখিয়ে সিস্টার জানিয়ে গেল ডঃ কুদালকার রাউন্ডে আসছেন। সুব্রত বলে, ডাক্তারবাবু আসছেন, চলো আমরা সবাই এখন একটু বাইরে গিয়ে বসি।
'ডাক্তার দেখে গেছেন, আর চিন্তার কিছু নেই। দিন তিনেক বাদে তোমার দিদি ছেলেকে নিয়ে বাড়ি যেতে পারবে,' সুব্রত ফোনে মানসকে খবরটা দেয়। 
নলীনি বেডের পাশে চেয়ারে বসে রণিতার বাঁ হাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, আজ আমি থাকি তোর কাছে, ওরা বাপ-বেটি বরং ফ্ল্যাটে গিয়ে বিশ্রাম নিক। ওদের ওপর দিয়েও যা ধকল গেল ক'দিন।
রণিতা নিজের হাতটা দিয়ে মা'র হাতটা চেপে ধরে বলে, না মা, তাহলে তুমিই না হয় ডোনাকে নিয়ে যাও, সুব্রত বরং এখানেই থাকুক।
আহা, সুব্রতর কথাটা একটু ভাববি না! লাগাতার পাঁচ-ছদিন ছেলেটা ভালো করে ঘুমায়নি। ডাক্তার তো বললোই আর চিন্তার কিছু নেই, তুই অযথা ভয় পাচ্ছিস কেন? রাতে আর এমারজেন্সি কোনো দরকার পড়বে না, তাছাড়া আমি তো তোর কাছে থাকছিই। নলীনি রণিতার মুঠি থেকে নিজের হাতটা টেনে নিয়ে ওর মাথায় বোলাতে থাকে। 
রণিতা চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কিন্তু নিচু স্বরে বলে, না। হয় তুমি নিজে যাবে ডোনার সঙ্গে নাহলে ও এখানে আমার পাশেই থাকবে। তারপর নলীনির ব্যথিত, বিস্মিত চোখ থেকে চোখ সরিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে, ভাই যেদিন হয়েছিল, সেদিন তুমিও আমাকে বাপির সঙ্গে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলে, মনে নেই?
রণিতার কপালে বুলোতে থাকা নলীনির হাতটা মৃতের হাতের মতো ভারী ও শীতল হয়ে ওঠে যেন। রণিতা ওর ক্লান্ত, স্থির চোখদুটো রাখে চশমার আড়ালে থাকা মায়ের ঘোলাটে চোখে। মা-মেয়ের দৃষ্টির মধ্যে তেইশ বছরের পুরোনো একটা নড়বড়ে সেতু যেন হঠাৎ কুয়াশা ফুঁড়ে আবার প্রকাশ হয়ে পড়ে। যে সেতুর ওপর ওরা কেউ এতদিন ভুলেও পা রাখেনি। কিছুটা স্থাণু সময়ের পর রণিতা টের পায় কপালে রাখা নিশ্চল আঙুলগুলো আবার সচল হয়ে উঠছে, শীতল আঙুলগুলো আবার মমতায় উষ্ণ হয়ে উঠছে। নলীনি বুঝতে পারে সেদিনের দশ বছরের বালিকা রণিতা ওর নিজের বুকের ভেতরে যে অন্ধকার ঘরটা দরজা বন্ধ করে রেখেছিল গত তেইশ বছরে সেখানে এতটুকু আলো ঢোকেনি। রণিতাই ঢুকতে দেয়নি। অথচ, নলীনিও জানে না সে ঘরে ঠিক কী আছে! 
'আমি আর বাপির পাশে শোবো না, ব্যাস্।'- এটুকুই শুধু বলেছিল রণি। আর শোয়ওনি কোনোদিন।
-- কি গো, মেয়ে আর তোমার পাশে শোবে না বলছে কেন? তোমার শোয়ার যা ছিরি! ঘাড়ে-টারে পা তুলে দিয়েছিলে না কি? সংকোচ কাটিয়ে নলীনি মলয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল।
-- তাই হবে হয় তো! মলয় বলেছিল স্বাভাবিক হেসে। সেদিনের পরে আর কোনোদিন এ নিয়ে কোনো কথাও হয়নি। তারপর অকালে মলয় চলে যাওয়াতে ছেলে মেয়ে বড় করার ব্যস্ততায় এসব নিয়ে আর ভাবারও সময় পায়নি নলীনি।
নলীনি দেখে উল্টোদিকের বেডটাতে সুব্রত ল্যাপটপে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছে এবং ডোনা ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে একটা বই পড়ছে।
-- চলো দিদিভাই, আজ তোমাকে নিয়ে আমিই নাহয় তোমাদের ফ্ল্যাটে যাই। বাবা বরং মায়ের কাছে থাকুক, নলীনি স্টুল থেকে উঠে ডোনার জিনিসপত্র ব্যাগে গোছাতে গোছাতে বলে। রণিতা দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে পাথরের মতো। ঠিক তেইশ বছর আগে এক রাতে ওর বুকের ওপর দিয়ে একটা টিকিটিকির হেটে যাওয়ার স্বপ্নে হটাৎ ঘুম ভেঙে ওর সদ্য বড় হতে থাকা বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা বাপির হাতের নিচে যেমন সারারাত পাথর হয়ে পড়েছিল।
Attachments area

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)