কোয়েল দও

মায়াজম
1
                                    ব্যাধি



য়নাটা আরও একটু নিজের মুখের কাছে তুলে ধরল বিদিশা । নাকের পাশের তিলটা, ঠোঁটের কোণ, চিবুকও যেন কিছুটা ওরই মত । ভালো করে দেখবে বলে আরও খানিকটা মেয়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল । হঠাৎ শরীরের কাছে কিছুর উপস্থিতি অনুভব করে নড়েচড়ে উঠল তিতির, তবু ঘুম ভাঙ্গল না । চারদিন যা ধকল গেছে ওর। এই প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী করল কলকাতায় , কদিন প্রায় নাওয়া খাওয়া নেই বললেই চলে । কত সব বিখ্যাত মানুষ জন এসেছিলেন , বিদিশাও একদিন বাড়ির সকলের সাথে গিয়েছিল প্রদর্শনী দেখতে । তিতিরের কথা বলার সময়ই ছিল না ওদের সাথে । কিছু প্রেসের লোক ঘিরে ছিল তখন ওকে । শনিবার খবরের কাগজেও বেরিয়েছে ওর প্রদর্শনীর সাফল্যের কথা । মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসত , কিন্তু সেটা নিয়ে যে এতদূর পৌঁছাবে তা কল্পনা করেনি ওরা কেউই । অথচ পড়াশুনার ব্যাপারে ওকে যত উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল , ছবি আঁকার বিষয়ে তো বিদিশা বা তিতিরের বাবা কেউই সেরকম কোন আগ্রহ দেখায়নি কোনদিনই । বিদিশা ঘুমন্ত মেয়েটার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার নিজের কাজে লেগে পড়ল । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তিতিরের চোখ, নাক, হাত পায়ের আঙ্গুল । অনেকক্ষণ এভাবে দেখে বিদিশা নিজেই হেসে উঠল আপনমনে । বড়দিভাই প্রদর্শনী দেখতে দেখতে হঠাৎই সেদিন জিজ্ঞেস করে বসলেন , ' মেয়েটা ছবি আঁকার হাত কোথা থেকে পেলরে বিদিশা ? তুইতো লক্ষীপূজোর আলপনাটাও ঠিক মত দিতে পারিস না । ' বিদিশা কোন উওর করেনি, উওর করে সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করতে ইচ্ছে হয়নি ওর । দুচোখ ভরে তিতিরকে দেখছিল শুধু । 
অনেকদিন পরে আয়না নিয়ে আবার ছেলে মানুষী করতে করতে পুরনো দিনের যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বিদিশার । সাতাশ বছর আগে যেদিন বিদিশা মেয়েকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল তিতিরের ঠাকুমা ওকে প্রথম দু’মাস কোলেই নিতেন না । একে তো মেয়ে তার উপর কালো , কুশ্রী । ও কিছুতেই এ বাড়ীর মেয়ে হতে পারে না । মেজদি ধানবাদ থেকে মেয়ে দেখতে এসে বলেছিলেন ' বাবা কি ভয়ানক কালো ! এ যেন ঠিক সুন্দরীর কোলে বাঁদরী ।" বড়দা তো তিতিরকে ছোট বেলায় 'কালি' বলেই ডাকতেন। এতেই শেষ নয় - ' এ মেয়ের নাক বোঁচা, গায়ের রং বার্নিশ করা , এর বিয়ে হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি ।' পাড়া প্রতিবেশীদের কেউ কেউ প্রায়শই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন - 'তোমাদের বাড়ির সকলে এত ফর্সা, সুন্দর, কিন্তু তিতিরটা এমন কালো হল কি করে বলত বিদিশা '? 
বিদিশা উওর করত না, এসব প্রশ্নের উত্তর সেদিন ওর জানাও ছিল না। শুধু নিত্য দিন নতুন নতুন বিশেষণে খন্ড বিখন্ড হত। বিদিশার দুপুর গুলো কাটত বন্ধ দরজার পিছনে কেঁদে বা কখনো আজকের মত আয়না নিয়ে পাগলামি করে । একটা নিষ্পাপ শিশুর রূপ নিয়ে নির্মম বিশ্লেষণ শুনে কখনও মৃদু স্বরে প্রতিবাদ করলেও তা হারিয়ে যেত নিজের আপন জনেদের ক্রমাগত পাশবিক মন্তব্যে ।
তিতির এখন ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সের অধ্যাপিকা । ওকে এখন আর কেউ কালো বলে না, বলে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ । ওর ব্যক্তিত্বের পাশে অনেক অপরূপ সুন্দরীরাও ম্লান হয়ে যায় । এ মেয়ের গায়ের রঙ কালো বলে বিয়ে নিয়ে ছোটবেলায় যেসব আত্মীয়েরা খুব চিন্তিত ছিলেন , তাদের অনেকেই এখন ওর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। এদের অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিদিশাকে বলেন ' তোমার কপালটা সত্যিই ভালো ।' 
শনিবারের খবরের কাগজে তিতিরের প্রদর্শনীর ছবি ও সমালোচনা পড়ে ছোট পিসি শ্বাশুড়ী আজ সকালে এসেছেন চন্দননগর থেকে তিতিরের সাথে দেখা করবেন বলে । বিদিশাকে দেখে উনি হাসতে হাসতে বললেন ' তোমার মেয়ে হয়ে আমাদের তিতিরটা এত গুণী হল কি করে বলত বৌমা? 'ব্যঙ্গাওক ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হল না বিদিশার । এই প্রথমবার বিদিশা আজ বিরাশি বছরের শ্বাশুড়ীর কাছে ঘর ভর্তি লোকের সামনে জানতে চাইল ' আপনার ঠিক কি যোগ্যতা আছে ওর ঠাকুমা হবার? আপনার উওরটা পেলে তবেই আপনাকে আমি জবাব দেব। ' কথাটা বলেই গলা বুজে এল, চোখটা জলে ভরে উঠল বিদিশার । তিতির আস্তে করে জায়গা থেকে উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল । বিদিশা অঝোরে কেঁদে ফেলল ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন