ছায়াছবি
“আজ আবার আলো ডাকছে আমাকে, আমাদের…”
সকাল থেকে সমবেত স্বরে গাইছে রীতা, সাগরিকা, দিব্যা, রেহানারা। গত কয়েকদিন ধরেই চলছে রিহার্সাল। সৌমিদি তাঁর হারমোনিয়ামের হাঁপর টেনে সুর বের করছেন আর তাঁর সাথে গলা মেলাচ্ছে ‘শ্রীময়ী’ হোমের মেয়েরা। সময় একদমই নেই । পয়লা বৈশাখের দিন বাংলা-হিন্দী চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা শ্রীরূপা গুপ্তর আগমন ঘটছে এই হোমে। হোমের মেয়েদের প্রাপ্তিযোগ ঘটবে। তারই আয়োজন। বছরে এক দুবার এমন মূহুর্ত এসেই যায়। কেউ না কেউ চলে আসেন হোমের বাসিন্দাদের সাথে দেখা করতে । উৎসবের মহড়া চলে। সৌমিদির ডাক পড়ে ওঁর পেল্লাই হারমোনিয়ামসহ। কেউ নাচ, কেউ গান , ঘরদোর পরিষ্কার যেন ঋতু তার চাকায় যেমনভাবেই ঘুরুক না কেন নিয়ম ভেঙে শরত এসে লেপ্টে বসে ‘শ্রীময়ী’র অন্দরে। সারকথাটা সবাই জানে ওরা। খিচাক খিচাক ছবি উঠবে, খবরের কাগজে বেরবে , অনেক প্রতিশ্রুতি, তারপর সব গায়েব।
- ওই পেঁচি , আয়নায় অত কি দেকচিস র্যা? সিরূপা তোকে লায়িকা বানাবে?
উমার ধ্যাতানিতে চমকে উঠল রেহানা। বহরমপুর এক্কেবারে ছেড়ে দেওয়ার সময় লোটার ভেতর এই আয়নাটা নিয়ে এসেছিল। আম্মি রোজ গোসলের পর এটাতে মুখ দেখত। রেহানাও রোজ দেখে। আসলে আম্মিকে দেখতে পায়। উমার রসিকতায় বাকি মেয়েদের অট্টহাসি ‘শ্রীময়ী’ হোমের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে পড়ছে।
- সালির সখ কত। আবার পুরনো নাটক !
দিব্যাও জুড়ল কিছু শ্লেষ। এবার রেহানাও হেসে ফেলল। সত্যিই তো! আর কত রঙ্গমঞ্চ জুটবে কপালে কে জানে।
২)
‘লোমানি’র সুবাস সারা শরীরে ডলছে শ্রীরূপা। গন্ধটা দেবাংশুর খুব পছন্দের। অবশ্য দেবাংশুই প্রথম গিফট করেছিল শ্রীরূপাকে পারফিউমটা। দিনটা আজও মনে আছে। হাতে কয়েকটা সিরিয়ালের সাইড রোল ছাড়া কিছুই নেই তখন। ভাগ্যিস কো-অ্যাক্টর দ্বীপদার জন্মদিনের পার্টিতে দেখা হয়ে গেল দেবাংশু বোসের সাথে। দুঁদে পরিচালক। শ্রীরূপাকে টার্গেট করলেন আর জিতেও গেলেন। ‘আমি সেই মেয়ের’ মুখ্য নায়িকা শ্রীরূপা গুপ্ত আজ নাম, অর্থ , প্রতিপত্তির মালিক। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সবেতেই ‘আমি সেই মেয়ে’র জয়জয়কার। স্ক্রিপ্ট শুনতে গিয়ে লোমানি গায়ে ঘষতে ঘষতে শ্রীরূপার শরীরের এক ইঞ্চিও ছাড়েনি দেবাংশু। এখন অনেক ছবির কাজ, তাও পারিশ্রমিকে ফাঁকি দেয় না শ্রীরূপা।
দেবাংশুই হোমের ঠিকানাটা টেক্সট করেছিল। যেভাবে অর্থ বাড়ছে কিছু দান না করলে ট্যাক্সের জালে জড়াতে হচ্ছে। পয়লা বৈশাখই শুভারম্ভ। মিডিয়াকেও খবর দেওয়ায় আছে। জুটের একটা শাড়ি বেছে নিল শ্রীরূপা। বার বার আয়নায় মেপে নিচ্ছে শরীরের সমস্ত ভাঁজ। ঠিক যেন আয়না নয় দেবাংশুর চোখ মাপছে শ্রীকে।
‘শ্রীময়ী’র সামনে হন্ডাসিটি থামতেই হৈ-চৈ শুরু। ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি চারিদিকে। শ্রীরূপা যেন স্বর্গের দেবী। সবাই ছুঁয়ে দেখতে চায়। অহঙ্কার গাঢ় হয় শ্রীরূপার নাকের পাঁটায়।
৩)
রেহানার ভয় লাগছিল। আগে কাউকে এতটা বলেনি। কিন্তু এই লোকটা সকাল থেকে প্রত্যেকটা মেয়েকে ডেকে তাদের অতীত জানতে চাইছে, ছবিও তুলছে। অস্বস্তি নিয়ে বলতে আরম্ভ করল,
- আমার তখন তের হবে। চাচাজান অনেকবার আমার গায়ে হাত দিবার ট্রাই নিয়েছে। আব্বুজান জানলেও কখনো চাচাকে মানা করেননি। আম্মি শুধু একবার বটি নিয়ে গেছিলেন। দু’বছরের মধ্যে আম্মি তিনদিনের জ্বরে চলে গেলেন। চাচাজান রোজ এসে আমার শরীর লুটে খেত। একদিন রাতে শুনলাম আব্বুর সাথে তিরিশ হাজার টাকায় রফা হচ্ছে, আমায় চাচা নাকি দুবাই পাঠাবে। ভোররাতে গোসল করার নামে লোটাতে কিছু জিনিস নিয়ে পালালাম। রফিক, অনেকবার বলেছিল আমায় নাকি ও ভালবাসে, গ্রামেরই ছেলে। দেখা হল মসজিদ মোড়ে। শুনল, বলল, কলকাতায় যা শহরের বাসে, আমি দুদিনে আসছি। অপেক্ষা করিস। যেখানে বাস নামাল, পাঁচদিন বসেছিলাম, কেউ এল না, জ্ঞান ছিল না। পুলিশ দিদি নিয়ে আসে এখানে।
থম মেরেছিল লোকটা। রেহানার পিঠে হাত দিয়ে বলেছিল,
- একটা ছবি করব, তোমার গল্পটা নিয়ে। টাকা পাবে তুমি। তোমার গল্প সবাইকে বলব। কাগজের অফিসের লোক আসবে, তোমায় সবাই চিনবে।
তারপর মাঝে মাঝেই আসত লোকটা। বারবার একা ঘরে জিগ্যেস করত, চাচাজান কিভাবে রেহানাকে খেয়েছে। লোকটাও খেত। তবে চাচাজানের মত না। ভাল লাগত রেহানার। রেহানা অপেক্ষা করত , কবে আবার আসবে লোকটা।
না, তেমন কেউ আসেনি। অন্য একটা লোক এসে কিছু সিনেমার টিকিট দিয়ে গেছিল হোমের মেয়েদের জন্য। ‘আমি সেই মেয়ে’ , ওরা সবাই গেছিল। রেহানা সবাইকে গর্ব করে বলেছিল এটা ওর গল্প। এবার টাকা আসবে, কাগজের অফিসের লোক আসবে, নাম হবে। সবাই হিংসে করত। তবু কেউ এল না। ওরা নাটক ভাবে।
৪)
কেউ ফুল, কেউ কাগজের পাখা, কেউ রুমাল যে যেমন পারছে উপহারে ভরিয়ে দিচ্ছে শ্রীরূপাকে। একটা কাগজের মোড়ক এল। শ্রীরূপা খুলে ফেলল। মামুলি একটা আয়না। তাও অভিনয়ের হাসি মেখে তাকাল
- বাহ
- এটায় রোজ মুখ দেখবেন, আপনি নয়, আমিই সেই মেয়ে। ঐ লোকটা আমার জামাটা খুলে আপনাকে পরিয়ে দিয়েছে।
রেহানা খুব হাসছে। দেবাংশু বলেছিল, কোন এক হোমের মেয়ের আত্মকথা, যদিও স্টোরি টাইটেলে দেবাংশু বোসের নামটাই গেছে। শ্রীরূপা একবার তাকাল আয়নার দিকে, এত ঝাপসা? সত্যি নিজেকে দেখা যাছে না। শুধু ঐ মেয়েটার বিদ্রূপমাখা হাসি।
আয়নাতে বিন্দু বিন্দু লোমানি সুবাসের ঘাম ঝরে পড়ছে।
-সমাপ্ত-
দুর্দান্ত লেখা। খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন