শবরী রায় - মায়াজম

Breaking

১৬ জুন, ২০১৮

শবরী রায়

            ধিমাল : একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া
                                                     
"ধিমালরা একবার ঠিক করল যে তারা আকাশ থেকে চাঁদ পেড়ে আনবে। তখন তারা মই বানাতে শুরু করল। মইয়ের উপরের দিকে ওঠা ধিমালরা নীচের অন্য ধিমালদের মইটাকে আরো উঁচু করতে বলল। নীচে থাকা ধিমালরা ভেবে বসল যে তারা তাদের মইটাকে ভেঙে ফেলতে বলছে। তারা তখন মইটাকে ভেঙে ফেলল। আর তাদের আকাশের চাঁদ পাড়া হল না। "
ধিমাল লোককথা
লোককথা থেকে জনজীবনের প্রাচীনতা আর কৃষ্টির গন্ধ পাওয়া যায়। কারা এই ধিমাল?  উত্তরবঙ্গে জন্ম আর কৈশোর অতিক্রম করেও ধিমালদের নাম কখনো শুনিনি। রাজবংশী, কোচ, মেচদের পার্থক্য নিয়ে মাথাও ঘামাইনি। সাদাচোখে সবই যেন এক। আর ইতিহাস?  ওসব তো বইয়ের পাতায় থাকে। যারা পড়ে তারাই একটু আধটু জানে। ভারতবর্ষের কোণে কোণে কত জাতি উপজাতি একে অন্যের সঙ্গে ভাববিলীন হয়ে গেছে তার হিসেব আর কে রাখে? উত্তরবঙ্গ সবসময় যেন দৃষ্টির বাইরেই আছে, আর এ তো সামান্য তরাই। মহানন্দা থেকে মেচি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা আঠারো মাইল লম্বা, ষোলমাইল চওড়া তরাইয়ের জঙ্গল প্রাচীনকাল থেকে পূর্ব মোরঙ্গ নামে পরিচিত হয়ে এসেছে। নেপাল, সিকিম, কোচবিহার রাজত্বের মূলস্রোত থেকে দূরের প্রান্তিক অঞ্চল হিসেবেই গণ্য। বছরে ৩০০০ মিলিলিটার বৃষ্টিপাত সমৃদ্ধ আর্দ্র, স্যাঁতসেঁতে গুরুত্বহীন জায়গার খবর ইতিহাস তেমন রাখেনি। তরাইয়ের বনাঞ্চলের হাতি,বাঘ,সাপ,ভাল্লুক, কীটপতঙ্গ ছাড়াও কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, ব্ল্যাকওয়াটার ফিভার এক তীব্র মানসিক অনীহার সৃষ্টি করেছিল একসময়। অথচ এইসব প্রতিকূলতাকে প্রতিবেশী করে বেঁচে থাকার অপরিসীম প্রয়াস যাদের ছিল সেই সাবেক বাসিন্দারা কোচ, মেচ, ধিমাল, থারু, লিম্বুদের সহাবস্থান ব্রিটিশদের সবসময় আশ্চর্য করেছে। কোম্পানি আমল থেকে ভিন্ন নথিপত্রে উঠে এসেছে এদের নাম।
               
      ১৮৪৯ সালে বি. এইচ. হজসন সাহেবের তথ্য অনুযায়ী কনকাই নদী পর্যন্ত ধিমালদের জনসংখ্যা পনেরো হাজার। ১৮৭২ সালে ভারতীয় তরাইয়ের সরকারি জনগণনা অনুযায়ী ৮৭৩ জন। ১৯৩১ সালে ৩৭৫ জন। ১৯৪৭ সালে ড্যাশ সাহেব দার্জিলিং গেজেটিয়ার্সে লিখছেন  "  The 1941 census seems to have lost trace of the Dhimal ". 
               কিন্তু ধিমাল সঙ্ঘের হিসেবে ১৯৮০ সালে ধিমালদের সংখ্যা ৫৫২ জন। ১৯৯৪ সালে ধিমাল অস্তিত্ব রক্ষা সমিতির হিসেব অনুযায়ী ৮০৪ জন, এবং ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসের সূত্র অনুযায়ী ৯৮৯ জন। এই সর্বশেষ সূত্র প্রসেনজিত মল্লিক ও গর্জন মল্লিকের। যারা প্রকৃত অর্থে নিজেদের ধিমাল বলে স্বীকার করেন এবং ধিমাল পরিচিতির অস্তিত্ব বয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে। 
    সর্বত্র আগ্রাসন এখন। বড় সংস্কৃতির পেটে সেঁধিয়ে যায় ছোট ছোট স্থানিক সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষগুলোর সত্তা।  সামান্য মনে হলেও এরা বাঁচিয়ে রাখতে চায় এদের স্বাতন্ত্র্য।


  " মোঙ্গল কো শাখা কেলাই ধিমাল জাতি,
  রাই, লিম্বু, কোচে, মেচে তাইকো সানাইতি। "

নদী-পাহাড়ের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে ভালোবাসে ওরা। মাছশিকারি। মেচি, চেঙ্গা, মানঝানদী থেকে পুটী, পয়া,মাগুর ধরতে ধরতে বড় হয়। তরাইয়ের খরস্রোতা নদীতে বাঁশের চোঙাকৃতি কোঁচা হাতে মাছ ধরতে ব্যস্ত মানুষের বর্ণনা দিয়েছেন হুকার সাহেব। মহানন্দা, বালাসন, চেঙ্গা, মাগুরমারি, লালকা, লচকা,টেপু, বাতারিয়া, তিস্তা নদীতে সহজলভ্য মাছ স্বাভাবিক ভাবেই ধিমালদের প্রধান খাদ্য বিবেচিত হত। মাছধরার প্রাচীন অভ্যাস ধিমালদের জিনের অন্তর্গত। তবে ধিমালরা বড় জালের ব্যবহার করে না কারণ পাহাড়ি নদীর খরস্রোত। মাছপ্রীতির কারণেই এরা নদীর কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। ধিমালদের খাদ্যাভ্যাসের হদিশ দিয়ে হজসন সাহেব লিখেছেন যে ধিমালরা সমস্ত ধরণের মাছ, ভূঁই ও জলকাছিম, বেঁজি, বুনো বেড়াল, শজারু, খরগোশ, বড় বড় গুঁইসাপ, বন-শূয়োর, হরিণ, গণ্ডার, বুনো মোষ শিকার করতো। বাছবিচারহীন মাংসপ্রীতি ভ্রাম্যমাণ ধিমালদের পশুশিকারের স্মৃতি মাত্র দেড়শ বছর আগের তরাইয়ের ইতিহাসেও রয়েছে। গল্পকথায় উঠে আসে যে,ধিমালরা গোরু, কুকুর, বিড়াল, বাঁদর, হাতি, ভল্লুক ও বাঘ বাদ দিয়ে সমস্ত পোষ্য ও বুনো জন্তুর মাংস খেত।  
           "  দার্জিলিং এর ইতিহাস " গ্রন্থে হরিমোহন সান্যাল লিখেছেন "ইহাদিগের ভোগ্য,ভোজ্যও নিতান্ত সামান্য। দুগ্ধ, ঘৃত অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু দধি ব্যবহার করে। গো, কুক্কুর, বিড়াল, হস্তী, ভল্লুক, ব্যাঘ্র, বানর, অশ্ব ব্যতীত সকল প্রকার মাংসই উদরস্থ করে। "
             ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে রিজলে সাহেবের লেখায় আছে সমস্তধরণের মাছ ছাড়া ধিমালদের খাদ্যতালিকায় ছিল শূয়োর আর গুঁইসাপ। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী এখনো ধিমালদের প্রিয় খাদ্য গুঁইসাপের মাংস। মাছ ছাড়া কাঁকড়া, গেঁড়ি-গুগলি, শামুকও খায় ধিমালরা। শাকসবজি তেমন পছন্দ করেনা, এখনো প্রচলন কম। সেদ্ধ ও পুড়িয়ে খাওয়াতেই স্বচ্ছন্দ। এখনো তেল, মশলার ব্যবহার না থাকার মতই। ঘিয়ের ব্যবহার নেই। 
           প্রধান খাদ্য ভাত। বরনি ধান বুনতো ধিমালেরা। বরনি ধানের আঠালো চাল দিয়ে তৈরি গেন্দ্রক পিঠে তাদের নবান্ন  উৎসবের খাদ্য। ভাউতি পাতা আর আতপচাল দিয়ে তৈরি গোরামদ তাদের প্রিয় পানীয়। ভাত-জাত মদ। মাছের যেমন জল ধিমালদের 
ধিমালদের কাছে গোরা তেমনই। বরনি ধান, গেন্দ্রক পিঠে, গোরা মদ, মেইনচি বেরাং (মেচি বুড়ি), দুধিয়া ওয়ারাং ( দুধিয়া বুড়ো), শবদেহ সমাধি, গারাম পূজা,  মাছ শিকার এই সব নিয়েই নদী পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাস করা ধিমাল জাতি। দুধিয়া পাহাড় থেকে সাদা, কালো, লাল,হলুদ মাটি এনে লালচে ঘরের দেয়ালে ধিমাল মেয়েরা ঘরের দেয়ালে আঁকে হাতি, হরিণ, ময়ূর, মুরগি, ফুল ও বন্দুক আঁকে বাড়ির মেয়েরা। ওই দুধিয়া পাহাড়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে বিষুয়ার দিন তীরধনুক আর কুকুর নিয়ে ধিমাল পুরুষরা গুঁইসাপ শিকার করতে যায়।
                    অন্যান্য ইন্দো - মঙ্গোলয়েডদের মতই ধিমালদের গায়ের রঙ হলুদাভ, চোখ ছোট, মণির রঙ কালো, মুখ চৌকো, নাক চ্যাপটা, গাল চর্বিযুক্ত, পুরু ঠোঁট, গাত্ররোম কম,কেশ কালো, মধ্যম উচ্চতাসম্পন্ন। ধিমালরা অহিংস, নম্র,ভদ্রজাতি বলেই পরিচিত। প্রকৃতির রোষ আর দয়ায় জীবনশৈলী তৈরি করতে হয় যাদের, তাদের জীবনযুদ্ধে স্থানিক পরিবেশের ছাপ পড়বেই, এই ছাপ কালোত্তীর্ণ হয়ে রয়ে যায়, এবং এখনো বর্তমান। 
                      ধিমাল পুরুষদের স্বভাবের কথা বলতে গিয়ে হজসন সাহেব বলেছিলেন -- ' The Dhimals are good husbands, good father and not bad sons ' সেই পরম্পরা এখনও বর্তমান। তাদের জীবন চর্যার নিখুঁত বর্ণনায় হজসন লিখেছিলেন, -- "The character of the Dhimals is full of amiable qualities......  They are intelligent, docile, free from all hard or obstructive prejudices, honest and truthful in deed and word, steady and industrious in their own way of life..."
           ধিমাল বিশ্বাস অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই আকারহীন প্রকৃতি পূজাই আদিকালে প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন বড়ো গাছ,পাথর,মাটি ইত্যাদি পূজা ধিমালদের বৈশিষ্ট্য ছিল একসময়। নবান্নের সময় 'নায়া উম চাকা' বা নতুন অন্নগ্রহণ মূলত পূর্বপুরুষকে নতুন ফসল উৎসর্গ করার বিধি হিসেবে পালিত। এছাড়া আষাঢ় মাসে ধানের শিষ উঠলে গাভি-পূজার প্রচলন ছিল। শারীরিক অসুস্থতার জন্য গৃহদেবতার 'পচিমা পাকা'-র পূজা করতো। গারাম পূজা প্রকৃতপক্ষে সমস্ত গ্রামের কল্যাণ বিধানে এক মিলনোৎসব। এই পূজার মূল উপকরণ শুয়োর, মুরগী ও গোরা। পূজোর পরে নাচ গান ও ভোজের উৎসব। এই গারাম পূজার আসরে উপযুক্ত যুবকরা পাত্রী খোঁজে, বয়স্করা একত্র হয়ে আসর জমায়। এই পূজাই পরবর্তীকালে বৈভব দেখানোর ব্যাপার হয়ে ওঠে। 
                 জন্ম মৃত্যু বিবাহের ক্ষেত্রে ধিমালদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য খুব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করবো। ছেলেমেয়েদের বিবাহপূর্ব মেলামেশায় বাধা ছিল না একসময়। রজঃস্বলা হবার পর বারো থেকে  ষোলো বছরের মেয়েরা বিবাহ উপযুক্ত ধরা হত। আঠারো কুড়িবছর ছেলেদের ক্ষেত্রে। অবশ্য মেয়ের সংখ্যা কম হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বরের বয়স কম হত। মনে করা হত পরিণত গৃহিণী সংসারের পক্ষে মঙ্গলজনক। নারী পুরুষের যৌনতা নিয়ে ছুতমার্গীতা ছিলনা। নারীর যৌনস্বাধীনতা তৎকালীন ধিমাল সমাজের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। বিয়ের আগে গর্ভবতী নারীকে পিতার নাম জানাতে হত সমাজকে। তারপর হয় সেই পুরুষকে বিবাহ করতে হত, নয়তো সন্তানের দায়িত্ব নিতে হত। ১৮৯১ সালে রিজলি লিখেছিলেন যে, ' Dhimals seem to regard marriage as a form of minor importance '. কিন্তু পরবর্তী একশো বছরে হিন্দু বিবাহ প্রতিষ্ঠান ধিমাল সমাজে ছাপ ফেলেছে।  জন্মের সময় দাইয়ের প্রচলন ছিলনা, প্রসূতি নিজেই শিশুর সঙ্গে নিজের নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করতো। অল্পকিছুদিনের অশৌচ শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতো। 
                হজসনের সময় দেখা যাচ্ছে ধিমালরা মৃতদেহ সমাধিস্থ করতো। সমাধির ওপর পাথরচাপা দিয়ে মৃতের জন্য খাদ্য আর মদ রেখে চলে আসতো স্বজন বন্ধুরা। পরিবার তিনদিনের অশৌচ পালন করতো। অশৌচকাল শেষে স্নান ক্ষৌরি করে, ধামি অর্থাৎ পুরোহিতের দেওয়া মন্ত্রপূত জল মাথায় ছিটিয়ে দেব-দেবী পচিমা আর তিমাং এর উদ্দেশ্যে মোরগ আর শূয়োর উৎসর্গ করে আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে ভোজ শুরু করতো। সেইসময় শ্রাদ্ধাদির খরচ ছিল চার থেকে আট টাকা জানিয়েছেন হজসন। যদিও এখন পচিমা আর তিমাং দেব দেবীর বিষয়ে আর কিছু জানা যায় না। আদি অ্যামিনিস্ট সমাধিপ্রথা বেঁচে থাকলেও  এর মধ্যে ছাপ ফেলে গেছে হিন্দু শ্রাদ্ধ আচার। বর্তমানে তেরো দিনে আচার সম্পন্ন হয়। আদি উপজাতি বিশ্বাসের সঙ্গে ধীরেধীরে মিলিত হয়েছে হিন্দু পরম্পরা। 
                 ধিমাল জনজীবনে নাচ ও গান পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে আসছে। এই নৃত্য গীতচর্চা মূলত শ্রুতি নির্ভর। এইসব গানে ছাপ ফেলে আছে যুগান্তরের বিশ্বাস আর জীবনশৈলী। ধিমালদের আদিম বিশ্বাসে ঢুকে আছে দুই বাদ্যযন্ত্র।  নাগরা আর নাগরী। যা দেবতার মত পবিত্র। আর একটি পবিত্র বাদ্যযন্ত্র ঢাক বা ঢাকে। ধিমাল নাচ- গানের আসরে মূলত ঢাক,উরনি ( ছড় সহ একতারা), চোঙা, মেরদং, সেরেঞ্জা,বাঁশি ব্যবহার হয়। বর্তমানে হারমোনিয়ামের ব্যবহারও চালু হয়েছে। সেরেঞ্জা বা সারিঞ্জা হল রাজবংশী অনুপ্রাণিত সারিন্দা। তারযন্ত্র এটি। এছাড়া মৃচুংগা, বাঁশের ফাঁকের মধ্যে একটি পাতা ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বাজানোর যন্ত্র। 
এছাড়া তুনজাই যন্ত্রটি কাঠের ফ্রেমের মধ্যে আড়াআড়ি সরু কাঠি দিয়ে তৈরি। হাত দিয়ে আঘাত করে বাজানো হয় তুনজাই।
             ধিমালদের চিত্রকলা বিশেষ আলোচনা দাবী করে। প্রতিবেশী কোনো জনগোষ্ঠী এমন কলাকুশলতা দেখাতে পারেনি যা ধিমালদের মধ্যে বর্তমান। তাদের বর্ণময় চিত্রকলা অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। নিকটতম আবহ থেকে তারা সংগ্রহ করে চিত্রকলার বিষয়। জঙ্গলের হাতির হানাকে মনে রেখে দেয়ালে হাতি, বনের ময়ূর, পশুপাখি, টবসহ লতাপাতা, যন্ত্র-সরঞ্জাম,মাছশিকার  ইত্যাদির অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে দেয়ালচিত্রে। দরজাকে মাঝখানে রেখে ফ্রেমে আঁকা হয় লতাপাতা, পাখি, মাছের জ্যামিতিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি। ছবি আঁকে দেয়ালে, জানলার ফ্রেমে, কুলুঙ্গিতে। ব্যবহৃত হয় প্রাকৃতিক রঙ। সাদা, খয়েরী, কালো, নীল মেটে রঙ। ঘরের রঙ সবসময় লালচে।
                   হাতে ও গলায় উল্কি আঁকতেও দেখা যায় ধিমাল মেয়েদের। অলংকার সাধারণত রূপোর এবং মিশ্র ধাতুর। কেবলমাত্র কানের দুলেই সোনা পরে ধিমাল রমণী। ব্যবহৃত অন্যান্য গয়নার মধ্যে, টাকা মালা, চন্দ্রহার, সূর্যহার, হাতের ঝুড়ি খারু, পায়ের ঠেঙ খারু, বাজুতে পরার বাঁশপাতারি কনকন ( কাঁকন), নাকের ফুল পোচিং, মাথার সিঁথি সিদমন ইত্যাদি। 
                  ধিমালদের সুমহান ঐতিহ্য বয়নশিল্প। নিজেদের বস্ত্রের চাহিদা মেটাতে তাঁতে বোনা কাপড় তৈরির দক্ষতার বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। পশমের ব্যবহার তারা জানতো না। ধিমাল ভাষায় রেশমকে পোশম বলে। ধিমাল পুরুষদের আদি পরিচ্ছদ চৈতে-ধারি বা কালো, মোটা কাপড়ের হাঁটু পর্যন্ত গামছা। ধিমাল রমণীর আদি পোশাক বুক থেকে হাঁটু অবধি ঢাকা কাপড়, 'দাকা-বোনা'(কালো কাপড় )। দাকা-বোনাকে জায়গামত রাখার জন্য কোমর বন্ধনী 'ধারি'। দাকা-বোনা, কালো কাপড়ের মধ্যে লাল ডুরে থাকে,আর কোমর বন্ধনীর রঙ হয় শাদা। বিয়ের সময় ছাড়া এমন পোশাক এখন আর তেমন ব্যবহার হয় না। ধিমালদের কাপড় তৈরি করার তাঁত এবং পাটের ফেসো থেকে মোটা চটের মতো ধোকরা তৈরি করার তাঁত সম্পূর্ণ আলাদা।
               বয়নশিল্প ছাড়া অন্য কোনো লোকশিল্প তেমন দেখা যায় না। বাঁশের কাজ জানলেও মৎস্য প্রিয় ধিমালরা মাছধরার সরঞ্জাম বাঁশের কোচা, হ্যাংগা, ঢোকসা, চাঁচ  ইত্যাদি নৈপুণ্যের সঙ্গেই বানিয়েছে কেবল।
               ধিমাল জাতির স্বাতন্ত্রের সবচাইতে বড় প্রমাণ হল ধিমাল ভাষা। শতাব্দীর পর শতাব্দী তরাইয়ের ওপর মানবস্রোত জীবন, সংস্কৃতি, ধর্মের ওপর প্রভাব ফেললেও তাদের ভাষাকে তারা চোখের মণি করে রেখেছে। যদিও লিপি না থাকার কারণে বিবর্তনের ঢলকেও রোখা যায়নি। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে হিমালয়ের তিব্বতি-বর্মি ভাষাগুলির 'প্রোনোমিলাইজড' শাখার পূর্বভাগের মধ্যে (ধিমাল, লেপচা, রাই, থামি, লিম্বু, ইয়াখা, খাম্বু ইত্যাদি) হিমালয়ের পাদদেশের অস্ট্রিক-ভাষী আদি বাসিন্দাদের ব্যাকরণের ছাপ পড়েছে। 
               ধিমালদের তিনটি ঋতু।  গ্রীষ্ম -- শাকা দিনা, বর্ষা -- ওয়াই দিনা এবং শীত -- চুং দিনা। ধিমাল ভাষায় সূর্যোদয় -- রিমা।
             ভাষার পার্থক্য ধিমালদের আলাদা রেখেছে। টোটোদের নিজেদের লোক বললেও এই দুই ভাষার যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
 ধিমালদের লোককথাগুলি যদি প্রাচীন অতিবৃদ্ধ ঠাকুরদার ঠাকুরদা হয়, তবে ধিমালদের লিখিত ইতিহাস নবীন যুবক। মেজর ব্রায়ান এইচ হজসনই ১৮৪৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর লেখা প্রবন্ধে ধিমালদের উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, " The Dhimals, whose numbers do not now exceed 15,000 souls, are at present confined to that portion of the sal forest lying between the Konki and the Dhorla, mixed with the Bodo, but in separate villages and without inter marriages ". যদিও তিনি মেচ ও ধিমালদের এক জাতের বলে চিহ্নিত করেন, তিনি বলেন ধিমালরা বোড়ো-কাছাড়ি গোষ্ঠীর এক শাখা। যেভাবেই হোক ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাদের নাম সেই প্রথম লেখা হল। নির্দিষ্ট ভাষা আর জীবনকথাবিশিষ্ট  ক্ষুদ্র জনজাতিকে বহিরাগতরা কেউ লক্ষ্য করেনি। কোচ, মেচ,কাছারি জাতির অন্তর্ভুক্ত ভেবে হলেও তাদের নাম উঠে এল এইসব জাতিচর্চার পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে।   
 " Hodgson describes the Bodo and Dhimal tribes as of the same race, and there appears no reason for separating them in a work of this nature, as their customs, religion, & etc appear nearly identical. " ১৮৭২ সালে Descriptive Ethnology of Bengal  বইটিতে ডালটন সাহেব উদ্ধৃত করলেন হজসনকে। 
                   কে এই ধিমাল এই প্রশ্ন বর্তমানের অবশিষ্ট ধিমাল জাতির মধ্যেও রয়ে গেছে। তবে তাদের লোকচরিত্র, তাদের বৈশিষ্ট্য, তাদের পৃথক ভাষা ব্যবহার তাদের চেতন মনন এবং সংস্কৃতির মধ্যে স্পষ্ট। ইতিহাস চর্চা, গবেষণার পথের জটিলতায় না গিয়ে হারিয়ে যাওয়া জনজাতির একটা রূপরেখা খোঁজার চেষ্টা করছিলাম বইটা পড়তে পড়তে। আমাদের চোখের সামনেই থাকে সব, অথচ আমরা দেখতে পাই না। হয়তো আমাদের তেমন দেখার চোখও থাকে না। উত্তরবঙ্গে জন্ম, লেখাপড়ার প্রথম অংশ হওয়া সত্ত্বেও স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই, আমি ধিমালদের নাম ও জানতাম না। লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র,  তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা প্রকাশিত এই বইটি  আমাকে আগ্রহী করে তোলে। শ্রীশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরের পাহাড়ি, তরাই এলাকার ধিমাল আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে, ক্ষেত্রসমীক্ষা করে গবেষণাধর্মী এই বইটি লেখেন। 
               ১৬০ পৃষ্ঠার এই বইটির আলোচনা লিখবো এমন আমার ক্ষমতা বা জ্ঞান কোনোটাই নেই। যজ্ঞবাড়ির পায়েসের দুধ কাঠের হাতা দিয়ে নেড়ে, দু হাতা তুলে দিলাম, আমারই মত আগ্রহী পাঠকের জন্য, যারা এখনো অবাক হতে ভোলেনি, বড় কাজ করতে না পারলেও অন্যকে কোনো কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে দেখলে যুগপৎ বিস্ময় আর শ্রদ্ধা জাগে, আর অনুপ্রেরণা ও। আদিবাসী ও অন্তেবাসী নিয়ে যারা গবেষণা করেন,  করবেন ভাবছেন, কিংবা উপন্যাস বা গল্প লিখবেন ভাবছেন তারাও একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন। বইটিতে ধিমাল ভাষায় লেখা প্রবাদ, দুটো ছেলেভুলানো গল্প ( fables), বেশ কিছু ধাঁদা, এবং তার অনুবাদ রয়েছে, রয়েছে চিত্রকলা, গহনা, ঘরবাড়ির ছবি। বাস্তবিক ধিমালদের সংলাপ, তাদের হারিয়ে যাওয়া, ফিরে জমিয়ে রাখা সংস্কৃতির টানাপোড়েন। বইটি গবেষণামূলক হলেও রস কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। কখনো কবিতার মত মনে হয়েছে, কখনো গল্পের মত কখনো তথ্য ও তত্ত্বের স্মার্ট টানটান ভাব।
      পরিশেষে বইটির লেখক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গভীর অনুভব লেখকের নিজের ভাষায় উদ্ধৃত করলাম।

   " দিন চলে যায় মণিরামে, হাতিঘিষায়, বুড়াগঞ্জে অচেনা নদীর তীরে। কয়েক হাজার বছরের অবিচ্ছিন্ন ইতিহাসের রীত-রেওয়াজ, ভাষা-সংস্কৃতি,গান-গল্প, মদ-ধান, আলপনা- শিকার, গারামপূজা- গেন্দ্রক পিঠে, কন্যাপণ- মৃতদেহ সমাধি, মাছধরা - লিপিহীনতা এইসব মেটেরিয়ালি তুচ্ছ জীবন প্রকরণ সম্বল করে একবিংশ শতকের উজ্জ্বল কার্নিভালের দিকে তাকিয়ে আশায় আশায় দিন চলে যায় আর পাঁচটা আম হিন্দুস্থানির মতোই সহজ সরল অতিথি বৎসল মলিন মানুষ গুলির।....
           ধিমালরা জীবনের মূলস্রোত থেকে প্রাণবন্ত সফরির মতো আশা করে শুধু একটু নিজের জল, একটু নিজের স্পেস, একটু নিজের মতো করে বংশপরম্পরায় বেঁচে থাকা। তারা জানে শক্তির দেবতা ঢেনা কাংগাল তাদের ছেড়ে গেছে চিরতরে, তারা জানে নৃত্যগীতের দেবতাও দুনিয়ার সব জাতিকে ভালো ভালো নাচ-গান দেওয়ার পর ধিমালদের জন্য আর অপেক্ষা করেননি -- তাই তাদের সব নৃত্য কলা গাছের পাতা নড়ার মত গতানুগতিক, অনুচ্ছ্বল, তারা জানে বৃহত্তর সংস্কৃতি বড় মাছের মতো করে আস্তে আস্তে গিলে ফেলছে তাদের, তারা জানে যে প্রাকৃতিক - সামাজিক - সাংস্কৃতিক আলো-হাওয়া কম হয়ে আসছে দ্রুত, এখন তাদের দরকার সংরক্ষণের অক্সিজেন। তারা জানে যে এভাবেই ফিরে আসা যায়।
        অনাগত সুদিনের প্রতীক্ষায় থাকে ধিমালরা -----......"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র