প্রতিক্রিয়া এবং পুণর্পাঠ
-----------------
-----------------
এভাবে বলার বিশেষ কারণ আছে। বিনয় এবং খানিক কুন্ঠার সাথে বলি, খুব বেশি পড়তে পারি না আমি। সেক্ষেত্রে বলা ভাল, যে লেখাগুলোর প্রতি আমি আকৃষ্ট হই সেগুলো নিজেরাই যেন আমাকে পড়িয়ে নেয়। ঐ সময় লেখাগুলো আমার থেকেও বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি নড়েচড়ে বসি। হাঁটুমুড়ে বসি। বইটির সামনে। বারংবার পড়েও শেষ হয় না পড়া।
টাইমলাইনে স্ক্রল করতে করতে একদিন হঠাৎ ভেসে উঠেছিল "প্রজাপতি শুয়ে পড়ছে পোকায় পোকায়/এসবই নবান্ন, রক্তচর্চা আমাদের/গেরিলা উৎসব",তারপর বেশ খানিকটা সময় লেগেছে বইগুলো জোগাড় করতে। সেগুলো পড়তে পড়তেই খবর পেলাম কবির ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্হটি আসছে বইমেলা ২০১৮তে। স্বভাবতই বইটা নেব মনস্হির করেই গেছিলাম, বইমেলায়।
অনেকক্ষণ কেটে গেল সূচিপত্র থেকে প্রথম কবিতাটির দিকে যেতে। মাঝের পৃষ্ঠায় তিনটি লাইন "মাটিসর্বস্ব ডাকি তোমাকে/ আকাশ পর্যন্ত সহ্য করে যাই/ এ নেশা আমার কাটিয়ে দিয়ো না ঠাকুর" আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। কবির শাশ্বত উচ্চারণ, এক অপরিসীম দৈর্ঘ্য প্রস্হে টেনে দিল আমার মত এক তুচ্ছ পাঠকের চিন্তাশক্তি।
বইয়ের ৫৬টি কবিতা আমি বেশ কয়েকবার পড়েলাম। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় কবির তাৎক্ষণিক চিন্তার প্রতিফলন প্রকাশ পায় কবিতায় এবং পাঠক সেই সূত্রটিকে ছুঁয়ে ফেলতে চান কবিতাটি পাঠ করে। কবিতা সেই সাঁকো, আমার না পৌঁছাতে পারা জায়গাগুলোয় পৌঁছতে পারার।সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই বইয়ের ৫০টি কবিতা আমাকে নিরাশ করেনি। নিপুণ দক্ষতায় কবি তুলে ধরেছেন সাম্প্রতিক সময়। সময়ের ঘাত প্রতিঘাত।
স্বল্পদৈর্ঘ্যের কবিতাগুলির প্রতিটিতেই রাখা আছে বাস্তব দৃশ্যপট। দোদুল্যমান সময়, আশা নিরাশা সবকিছুকে জাপটে নিয়ে যে বেঁচে থাকা বা যাপন, তার কথা। একই দেখা কিছুটা অন্য দৃশ্যকোণ থেকে দেখে কবি বলেছেন "এই জন্মের কাশফুল প্রস্তুত রাখি তবে/আড়াল হোক মায়া হোক ঘন...নিরুপায়/আর সন্ন্যাস থেকে ফিরে আসুক লবণ"। বইটির প্রথম কবিতার লাইন, কবিতাটির নাম লগ্ন। এক ভীষণ বেঁচে থাকার কথা কাব্যিক আঙ্গিকে লিখে রেখেছেন কবি "আড়াল হোক মায়া হোক ঘন...নিরুপায়"। জন্মনিরোধক নামে অপর একটি কবিতায় কবি বলেছেন "রাস্তা নেই কোথাও শাড়ির নীচে শিশু ঘুমোয়, খিদে বাজারে বাজারে ঘোরে বালকভোজন..." বাংলা কবিতায় এই স্বর, সময়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার এই আঙ্গিক একেবারেই কবির নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র।
'ফেরত' কবিতায় কবি সমুদ্র বেছে নিয়েছেন উপমায়, পাঠককে ছুড়ে দিয়েছেন একটি প্রশ্ন "তোমার সঙ্গে যে এসেছে,/সে দেখছে, তুমি আর ফেরত পাঠাচ্ছো না সমুদ্রকে,/তখন?" কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে একটা আলোড়ন হয়, কখনও আয়নার মত লাগে কবিতাগুলোকে। 'কিচিরমিচির' 'আবিষ্কার', 'ভ্রমণ নয়', 'একা সভ্যতা', ঝিঁঝি 'ধ্বনি','নরম' এরকম এক এক করে প্রায় সব কবিতার কাছেই বারবার ফিরে যেতে হয়।
তবে দু একটি একই শব্দ ঘুরেফিরে এসেছে বিভিন্ন কবিতায়, যদিওবা সেই কবিতাটির ক্ষেত্রে শব্দটি প্রাসঙ্গিক তবুও মনে হয়েছে একই অর্থের অন্য শব্দ প্রয়োগ বইটিতে আরও বৈচিত্র্য আনতে পারত। হয়ত বাংলা কবিতার প্রতি এক অসম্ভব খিদে থেকে কথাটা উঠে এল।
আশ্চর্য হতে হয় বইটির প্রচ্ছদেও। অসাধারণ প্রচ্ছদ কবি'র নিজের অঙ্কনকৃত। আপাতদৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর। অনুভব করতে গেলে পড়ে দেখতে পারেন।
কাব্যগ্রন্থ: চুপ
কবি: পলাশ দে
প্রকাশক: তবুও প্রয়াস
প্রচ্ছদ: পলাশ দে
সুচিন্তিত মতামত দিন