পুজো মানেই ছুটির গন্ধ , নতুন জামাকাপড় পড়ার গন্ধ ৷ স্কুলবেলায় পুজোর আগেই অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা সমাপ্ত হয়ে যায় ৷ফলে বইখাতার সাথে সখ্যতা বিশেষ থাকে না তখন ৷যেহেতু নতুন জামাকাপড় ,জুতো কেনার প্রতি কোনদিনই তেমন আকর্ষণ ছিল না ৷
ছোটবেলায় সাজতে খুব ভালোবাসতাম ।মাথায় নানা রঙের ক্লিপ ,টিপ , চুরি , নেলপালিশ পড়তে খুব ভালোবাসতাম ৷সারা বছর ধরে এগুলো পড়ার কোন সময় সুযোগ হত না ৷পুজোর সময় হলে মনের আশ মিটিয়ে নেলপালিশ পড়তাম ৷প্রতিদিন এক রঙের নেলপালিশ পড়তাম ৷
পুজা এলেই বাড়িতে আসত পুজো বার্ষিকীর বিভিন্ন সংখ্যা ৷ মাকে দেখতাম পয়সা জমিয়ে জমিয়ে এগুলো কিনতে ৷ পুজো শুরু হত হিসাবমত মহালয়া থেকেই ৷মহালয়ার পর পর শুরু হত বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা ৷কিংবা মাও আমাকে হাত ধরে নিয়ে যেত আত্মীয় ,স্বজনের বাড়ি I মহালয়ার দিনটা আমার কাছে খুব স্মরণীয় ছোট থেকে ৷বিয়ের আগে পর্যন্ত মহালয়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র'র পাঠ শুনতাম বাবা ,মা'র পাশে শুয়ে ৷ বাবাকেও দেখতাম ওনার সাথে সাথে শ্লোক উচ্চারণ করতে l কী যে আবেশ জড়ানো থাকত সেসব দিনে I ভোর চারটে কলতলায় জলের আওয়াজ এদিকে রেডিও পাঠ ৷রেডিও'র মহালয়া শেষে শুরু হত টিভির মহালয়া ৷ আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি বাড়িতে টিভি আসে ৷সে বছর আমার কী আনন্দ ! টিভির মহালয়া দেখার সুযোগ হবে ৷ এতদিন বন্ধুদের মুখে শুনতাম মহালয়ার গল্প ৷
আমার আনন্দ করাব মাধ্যম ছোট থেকেই খুব বিশেষ ছিল না ৷অল্পেতেই সন্তুষ্ট ৷ মহালয়ার দিন বাবা সকালে তর্পণ যেতেন গঙ্গায় ৷একটু দূরে ছিল রতনবাবুর ঘাট ৷ বাবার মুখে তর্পণ করার নিয়ম কানুন শুনতাম আর বায়না করে বলতাম ," পরের বছর আমিও তোমার সাথে গঙ্গায় যাবো ৷ পুজোর খাওয়া দাওয়া শুরু হত তখন থেকেই ৷মহালয়ায় দিন বাড়িতে রান্না হত লুচি ,ছোলার ডাল ,বেগুনভাজা, আলুর দম , পেঁপের চাঁটনি ,মিষ্টি I আহা সেই গন্ধ যেন আজও লেগে আছে ৷
পাড়ার চণ্ডীমন্ডে তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় চরম ব্যস্ততা ৷বাইরে লাইটিংয়ের কাজ , রাস্তায় আলো দেওয়া ,ঠাকুরের কাঠামোতে মাটি দেওয়ার শেষ কাজ , চক্ষু দেওয়া সবই হত চোখের সামনে ৷আমাদের হুডোহুড়ি শুরু হয়ে যেত তখন থেকেই ৷ বাড়িতে তৈরী হত নারকেলের নাড়ু ,নিমকি ভাজা ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ সব কিছুর মধ্যে পুজো পুজো গন্ধ ৷ ষষ্ঠী মানেই নতুন জামাকাপড় পড়া ৷ সকালবেলায় গায়ে হলুদ মেয়ে স্নান করা ৷সপ্তমী থেকেই ঠাকুর দেখতে যাওয়া শুরু হয়ে যায় । একটু বড় হতেই অষ্টমীতে পুষ্পোঞ্জলি সময় শাড়ি পড়তাম মা'র ৷বাবা মাকে বলতেন ," মে আমাদের বড় হয়ে গেল l " মা শুধু তাকিয়ে থাকত I অষ্টমী ,নবমীতে বাড়িতে পিসি ,পিসতুতো দাদা , জাড়তুতো দিদি , দাদা সবাই আসত । মজার অন্ত নেই তখন I
জীবনে প্রথম প্রেমের প্রস্তাব আসে অষ্টমীর সকালে । তখন প্রেমের ঘটা এখনকার মত এত সহজলভ্য ছিল না ৷ দুরুদুরু বুকে একজন বলল ," , একটা কথা বলব কিছু মনে করবে না তো ! আমি তোমায় ভালোবাসি ৷" সেই কথাগুলো আজও মনের গভীরে যেন নাড়া দেয় I সেই আবেগী টানে কোথাও যেন ঝর্ণার মত ঝড়ে যায় অশ্বগন্ধা নদী হয়ে ৷ সেই সব দিন যার কোন মধ্যবর্তী নাম নেই ৷ গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যায় দিনের উপশম হয়ে যায় I মৌতাত লেগে থাকে চোখের সামিয়ানায় ৷ দিন যত বাড়ে সময়ের প্রসুতি বড় হয় ৷
সেই সব ভালোলাগা দিনগুলো চলে গেল বড় তাড়াতাড়ি ৷আজ সময় ভীষণ ভাবে বাড়তি লাগে I দুচোখে লেগে থাকা ঘুম আশ্রয় খোঁজে I এখন পুজোপ্রেম মানে বই পড়া ,বারান্দায় বসে সময়ের ইতিহাস গোনা I খাওয়া দাওয়া ,আড্ডা বড় কৃত্রিম হয়ে গেছে ৷ কোথাও যেন নেই টান I প্রয়োজন কমে যাচ্ছে জীবনের ৷ কিন্তু তাও পুজো এলে মনটা নেচে ওঠে ৷মনে পড়ে ছোটবেলাকার কথা ৷পটু কাকা মাটির তাল নিয়ে নড়াচড়া করত ঠাকুরের গায়ে প্রলেপ দেওয়ার জন্য ৷ মায়ের মুখ তৈরী করার সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম ৷ছোটবেলায় ভাবতাম আমার মাও বোধহয় এইভাবে আমার মুখ বানিয়েছে ৷ মাকে বলতাম একটু সুন্দর করে বানাতে পারোনি আমায় ! সবাই কত সুন্দর ,আমি কেন নয় মা ? মা বলতেন ," তোকে তো সুন্দর করেই বানিয়েছি ৷ কী যে বলিস ! " এখন পুজো এলে সেসব কথা খুব মনে পড়ে যায় ৷
পুজো মানেই ঢাকের আওয়াজ ৷" দুম দুমা দুম" বাজনা শুনলেই মনটা উদাস হয়ে যায় ৷ মনে হয় ছুট্টে চলে যাই কাশ ফুলের মাঠে ৷ সাদা সাদা শরতের ফুলগুলো দেখলে মনে হয় ," যে দিন গেছে তা সবটুকুইকী গেছে কিছুই বাকি নেই !" সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ দেখলে শরৎকাল রচনা লিখতে ইচ্ছা করে ৷ ছোট বেলায় কত বার লিখেছি সে রচনা ৷ সেই রচনায় কমা , দাঁড়ি থাকত না ৷ থাকত গন্ধ ৷ গল্প বলার গন্ধ I
কাশফুল আর শিশিরের ছোঁয়ায় মনে হয় এই তো সেদিনের মত সব আছে Iকিছুই তো
বদলায়নি ৷ কিন্ত সময়ের স্রোত বয়ে যায় অনেক ৷ বদলায় চরিত্র ,সংলাপ আর পুরাতন রীতি ৷
শহরতলীতে বাড়ি হওয়ার জন্য কাশফুল দেখার সুযোগ খুব কম পাওয়া যেত Iযখন মামার বাড়ি যেতাম দেখতাম রেললাইনের দুধারে কাশ ফুল ফুটে থাকতে দেখতাম ৷ পুকুরে পুকুরে পদ্মফুল ফুটে আছে দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠত ৷ মামার বাড়িতে আমাদের পুকুরের পাশে একটা ডোবা মত ছিল ৷তার পাশে ছিল গোয়ালঘর ৷
সেখানে কাশফুল ফুটে থাকত I শরৎ সেখানে এসে ধরা দিত দুহাত উজাড় করে ৷ দুমুঠো মেঘ ঢেলে দিত আবিরের থালায় I কোথাও কোন আতিথেয়তা নেই ৷ দুহাত ভর্তি করে আনন্দ ঢেলে দিয়েছে প্রকৃতির বুকে ৷
পুজো মানে ঘরে ফেরা
পুজো মানে গান
পুজো মানে দেদার আনন্দ
সকল দুঃখের অবসান
পুজো মানে হুটোপুটি
লুজ ,লিপস্টিকের টান
পুজো মানে নতুন প্রেম
বাঁচে থাকার উথান
সুচিন্তিত মতামত দিন