- ইন্দ্রনীল বক্সী

মায়াজম
2
চক্ষুদান

১.
আর কদিনই বা বাকি ! এদিকে মেঘলা দিন , শেষে ব্লোয়ারই ভরসা মনে হচ্ছে । ব্লোয়ার দিয়েই শুকিয়ে ফেলতে হবে প্রতিমা , নাহলে ফিনিসিং সামলানো যাবে না । বারোয়ারি তলার আটচালার নিচে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে ভবানী। এবছর নিয়ে ২৩বছরে পড়ল আনন্দপল্লীর এই বারোয়ারি , সেই প্রথম বছর থেকেই ভবানীই মৃৎশিল্পী এই প্রতিমার। সেই প্রথমবার সেই যে প্রতিমা গড়ল ভবানী তারপর থেকে আর তার বদল নেই ! কমিটি বদল হয় , পুরনোরা গিয়ে নতুন ছেলেপিলে আসে কিন্তু ভবানীর বদল হয়না । এলাকার মানুষের নাকি ভবানীর হাতের প্রতিমাই চাই ! ওই মায়াময় অথচ তীব্র চোখের প্রতিমার অদ্ভুত মুখ ভবানী ছাড়া আর কেউ ঠিক আনতেই পারবে না । মানুষের মনে বসে গেছে যে প্রতিমার মুখ । শুধু কি মা দুর্গা ! সরস্বতী , লক্ষ্মী , গণেশ , কার্তিক এমনকি সিংহটা পর্যন্ত ঘরের লোকের মতো হয়ে গেছে । একবার শুধু ভবানী অসুস্থ থাকায় অন্য শিল্পিকে দিয়ে প্রতিমা গড়ানো হয়েছিলো । সেও পাকা শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও এলাকার মানুষজন বলাবলি করেছিলো ঠিক যেন হয়নি মায়ের মুখের আদল ! পরেরবার আবার ভবানী ।
মফস্বলের এই আধা শহরে হাতে গোনা তিন চারটে পুজো । তাদের মধ্যেই কম্পিটিশন হয় প্রতিমা , মণ্ডপ , আলোকসজ্জা এবং সার্বিক পরিবেশ নিয়ে । একটা রঙ কোম্পানি প্রতিযোগিতার স্পন্সর। আনন্দপল্লী প্রতিমায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছে অন্তত ছবার।
কিন্তু এবারে আবহাওয়া বেশ দুশ্চিন্তায় রেখেছে ভবানীকে। ভালো রোদ না পেলে যে প্রতিমা শুকবেন সময় মতো ! রঙ চড়াবে কি করে ! তারপর আবার ডাকের সজ্জা এবারে। ভাবতে ভাবতে মোটা চশমার কাঁচের ভিতর দিয়ে দৃষ্টি গিয়ে আটকে যায় প্রতিমার বুকের বাঁদিকে , প্রতিমার বাঁ বুকের সুডৌল গড়নের পাশ ঘেঁসে যেন একটা হাল্কা চিড় নজরে আসছে ! আরও একটু ঝুঁকে আসে ভবানী , ভালো করে লক্ষ্য করতে দেখে , হ্যাঁ ঠিক তাই ! একটা চুলের মতো চিড় প্রতিমার বাঁ বুকের পাশ থেকে নেমে চলে গিয়েছে বাহুমূলের দিকে । সব্বোনাশ ! এখনই তেমন টান হয়নি তাতেই চিড় ! ভবানী ভেবে পায় না কি করে হলো ! মাটি ছানার সময় কিছু গড়বড় হয়েছে? নাকি মাটিতেই মিলাওয়াট !বলা যায় না মাটি আর সে মাটি কই । তাড়াতাড়ি একটু চিকন মাটি নিয়ে ভবানী প্রতিমার বাঁ বুকে হাত রাখে ।
এখন আর কিছু হয়না , কিন্তু আজ থেকে তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে শরীরে বিদ্যুৎ খেলতো যেন , সবে সবে হাত পাকাচ্ছে তখন কাকার সাথে ভবানী , বয়ঃসন্ধির ভবানীর সেই প্রথম নারীশরীর স্পর্শ ... হলেই বা মৃন্ময়ী! ভবানী একছুটে নদীপাড়ে চলে যেত ,একাই বসে থাকতো অনেকক্ষণ, মনে একমণ বোঝা নিয়ে উত্তেজনার পাশাপাশি একটা অপরাধবোধ ওকে ঘিরে ধরত। যখন শান্ত হয়ে ফিরে আসত তখন কাকা ভীষণ বকুনি দিত ।
এরপর যত বয়স হয়েছে , বিয়ে হয়েছে , হাতের স্পর্শে রক্তমাংসের নারীশরীর এসেছে , ভবানীর হাতের সূক্ষ্মতা যেন তরতরিয়ে বেড়েছে । ভবানীর হাত উজাড় করে দিয়েছে স্পর্শে , চেতনায় থেকে যাওয়া নারী শরীরে সমস্ত সূক্ষ্ম বাঁক তার প্রতিমা গড়তে ।
আপাততও ঢাকা দেওয়া গেছে চিড় । চড়া রোদ পেলে চলবে না , বাতাসেই শুকোক । এমনিতেই রোদ তো নেই ! ভবানী প্রতিমার উপরের ঢাকাটা টেনে দেয় কোমর পর্যন্ত। পেটে টান ধরেছে , এবার পেটে কিছু দানা পানি দেওয়া দরকার , ভবানী নেমে আসে উঁচু টুলটা থেকে।
২.
জানালাটা একটা ধাক্কায় খুলে দিতেই একটা ঠাণ্ডা জোলো বাতাস উর্মির চোখেমুখে এসে লাগল । জানাল দিয়ে দূরে সামনের মাঠের কোন বরাবর বারোয়ারী আটচালায় জ্বলছে বাল্বের আলো , হলদে আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মুখ থেকে অর্ধেক ঢাকা দেওয়া প্রতিমার কাঠামোটা , শুধু তার দুধারে পাঁচ পাঁচ দশটা অস্ত্রহীন মাটি রঙের হাত দেখা যায়। ঘুম চোখে কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকে উর্মি। মাঠ আর ওদের বাড়ির মাঝে একটা শুকনো সরু খালের পাড়ে ফুটে থাকা কাশ ফুলের সারি ঝরে গেছে কাল রাতের বৃষ্টিতে ।
কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে শরীরে বাতাস মাখল উর্মি । ওর ঘুমে মাখা বিধ্বস্ত শরীরে যেন একটু তরতাজা ভাব এলো। ঘরের বদ্ধ পরিবেশটাও কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একবার অবিন্যস্ত বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে পার্থ পাশ ফিরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।রাতে কিছুতেই জানালা খুলে শুতে দেয়না পার্থ । উর্মির আবার জানালা দরজা বন্ধ করে শুতে বড় অস্বস্তি হয়। বিছানার পাশে রাখা টেবিলের উপর মোবাইলটা তুলে একবার দেখে নেয় কটা বাজছে । এখন নেহাতই ভোর, পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ, এখনও ওদের ওঠার টাইম হতে ঘণ্টা খানেক দেরী । উর্মি একবার ঘরে দরজা খুলে বাথরুমে যায় , ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ে। পার্থ ঘুমের মধ্যেই চিত হতেই ওর একটা হাত সজোরে এসে উর্মির বুকে পড়ে। অস্ফুস্ট স্বরে উফ করে ওঠে উর্মি , আলতো করে পার্থর হাতটা সরিয়ে বিছানায় রেখে দেয় ।পার্থর এই এক দোষ , ঘুমলে একদম সাড় থাকে না ।
আগামী ৬ তারিখ এলে ওর আর পার্থর বিয়ের চারমাস হবে। দেখতে দেখতে চারমাস কেটে গেল ওর এই আনন্দপ্ললীতে , সংসার বলতে এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারেনি উর্মি , একটা ঘোরের মধ্যে চলছে এ কটা দিন । কলেজ শেষ করতেই দেখাশোনা শুরু করে দেয় ওর বাড়ির লোক । বেশ কিছু খোঁজ খবরের পর প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার পার্থকে ওদের বাড়ির পছন্দ হয়। সরকারি চাকরি,ছোটো পরিবার , ভদ্র, সৌম্য দেখতে পার্থকে উর্মিরও যে পছন্দ হয়নি তা নয় । শ্বশুর বাড়ি বলতে শ্বশুর,শাশুড়ি আর ওরা দুজন। শ্বশুর নির্বিরোধী নির্লিপ্ত মানুষ , রিটায়ার জেলা পরিষদের কর্মী। সারাদিন পেপার পড়েন , টিভি দেখেন আর সন্ধ্যায় সামান্য আড্ডা , এই এখন তাঁর রোজকার দিনলিপি । শাশুড়ি বেশ চটপটে এবং আধুনিক মনস্ক বলেই মনে হয়েছে উর্মির। শাশুড়ির আধুনিক মনস্কতা টের পায় উর্মি প্রথম যখন গায়েহলুদের তত্ত্বে আর পাঁচটা জিনিসের সাথে একটা সুন্দর হলুদ রঙের নাইটির ট্রে দেখে। একমাত্র ছেলের বউকে এখুনি রান্নাঘরে ও সংসারের অন্যান্য টুকিটাকিতে সেভাবে জড়াতে দেন না । বলেই দিয়েছেন “ আমি এখনও দিব্যি সচল আছি উর্মি , তোমাদের এই জীবন শুরু ,কাজ করার , দায়িত্ব নেওয়ার দিন বহু পড়ে রয়েছে তখন নাহয় নিও ” শ্বশুর বৌমা বলে ডাকলেও , শাশুড়ি উর্মির নাম ধরেই ডাকেন। ব্যাপারটা মন্দ লাগেনা উর্মিরও।নিজের ইচ্ছে মতো ও বাড়ির টুকটাক কাজে লাগে , কেউ ওকে নির্দেশ দেয় না । সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত পরিবেশ সহজই রয়েছে, উর্মিরও মন থেকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে স্বাভাবিক উদ্বেগ কমে আসছে।
পার্থও যথেষ্ট যাকে বলে কেয়ারিং হাসব্যেন্ড । উর্মির সামান্য শরীর খারাপ হলে তার উদ্বেগ দেখার মতো হয়। স্কুল আর সামান্য আড্ডা বাদ দিলে উর্মির জন্য যথেষ্ট সময় বরাদ্দ তার । এই চার মাসে আত্মীয় বন্ধুর বাড়ি নেমতন্ন্য বাদ দিলে বার তিনেক বাইরে রেস্টুরেন্টে খেয়েছে ওরা । গোটা চারেক সিনেমা দেখেছে । টুকটাক বাজারে যাওয়া প্রয়োজনে ,অপ্রয়োজনে সে তো লেগেই থাকে । সব মিলিয়ে উর্মির দাম্পত্য জীবনের শুরু খুব মন্দ হয়নি ।
পার্থ নড়ছে , উঠে বসে বিছানার উপর , একটা তন্দ্রা ভাবের মধ্যেও উর্মি টের পায় পার্থ উঠে বাথরুমে যায় । ফিরে এসে আবার বিছানায় শোয়ে , পার্থর দিকে পিছন ঘুরে শুয়ে থাকা উর্মিকে আচমকা সজোরে জাপটে ধরে ঘাড়ে মুখ ঘষতে থাকে । উর্মি সামান্য আপত্তি করলেও পার্থ ক্ষান্ত হয়না , উর্মির পরে থাকা রাত পোশাক একটানে তুলে দেয় । “ কি হচ্ছে কি ! না... ভালো লাগছে না পার্থ !” পার্থ ঘোরের মধ্যে উর্মির শরীর হাতড়াতে থাকে , কিছুটা জোর করে উর্মির দুই উরু প্রসারিত করে ধীরে ধীরে শরীরের দখল নেয় । আধোঘুমে অপ্রস্তুত উর্মি একবার শুধু যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে , পার্থ শীৎকার ভেবে দ্বিগুণ উৎসাহে ঝড় তোলে ।
এই একটা সময় উর্মির পার্থকে কেমন অচেনা অস্বস্তিকর লাগে, যখন দুজনার মধ্যে নগ্নতার উদযাপন হয় , খুব কাছ থেকে ,একেবারে শরীরে লেগে থাকা পার্থকে এক ভিন্ন মানুষ হিসেবে দেখতে পায় উর্মি , যার সঙ্গে হেঁটে চলে বেড়ানো , ওর সঙ্গে বাজারে যাওয়া, সিনেমায় যাওয়া বা দাদার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করা পার্থকে মেলাতে পারেনা ! বিয়ের পর প্রথম প্রথম উর্মি একটু সময় নিতে চাইলেও পার্থ কিন্তু সময় দেয়নি ।বউভাতের তিনদিনের মাথায় , এমনকি তখনও কিছু আত্মীয়স্বজন রয়ে গেছে এবাড়িতে , সেদিন রাতে উর্মিকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দখল নিয়েছিলো পার্থ । প্রথিত করেছিলো তার বিজয় ধ্বজা! উর্মির আড়ষ্টতা , অস্বস্তিকে কাটিয়ে ওঠবার সময় দেয়নি পার্থ । উর্মি দাঁতে দাঁত চিপে আত্মসমর্পণ করেছিলো শুধু । না: প্রথম রমণ উর্মির জন্য তেমন সুখানুভূতি আনেনি।
সেই প্রথম দিনের পর বেশীরভাগ দিন এমন হয়েছে, যে উর্মি না হয়েছে সেভাবে প্রস্তুত , না পার্থ সময় দিয়েছে , বেশীরভাগ সময়ই ওদের দেহজ প্রেম একতরফা তৃপ্তির স্খলনে আটকে থেকেছে , উর্মি একটিভ বা প্যাসিভ কোনো ভূমিকাই পালন করেনি, সুযোগও পায়নি , পার্থ আশ্চর্যভাবে ভ্রুক্ষেপহীন তার রমনসঙ্গীর সন্তুষ্টির ব্যাপারে । উর্মি শুধু একটা জৈব বস্তুর মতো পড়ে থেকে ব্যবহৃত হয়েছে । পার্থর নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ মেনে নিয়েও , শরীর ভর্তি লেহনের লালা নিয়ে ঘিনঘিনে অশুচি মনে অপ্রস্তুত যোনি ক্ষতের শ্রুশুষা করতে করতে উর্মির বাথরুমে প্রায়দিনই চোখ ফেটে জল এসেছে , মনেমনে চূড়ান্ত অপমানে ,যন্ত্রণায় নিজেকে বলেছে “ হি জাস্ট ফাকড মি ...জাস্ট ফাকড মি...!!”
এমনিতে বিয়ের আগে অভিজ্ঞ দিদি মাসিদের মন্ত্রণায় উর্মি বেশ খুশিই হয়েছিলো বরের এই ছোঁকছোঁকে স্বভাবের জন্য , কারণে অকারণে পার্থর ওর কাছে ঘেঁসে দাঁড়ানো , সুযোগ পেলেই ওর শরীরের নানা আনাচে কানাচে স্পর্শ করা নতুন বিয়ে হওয়া দম্পতির ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে। হয়ত একটু বেশীমাত্রায় কামুক বর জুটেছে ভেবে আপন মনে নির্জনে হেসেছে।
আজও প্রয়োজন মিটিয়ে পার্থ আবার নিজের জায়গায় ফিরে যায় , পাশ ফিরে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। উর্মি কিছুক্ষণ বিধ্বস্ত অবস্থায় শুয়ে থাকার পর উঠে বসে, জামাকাপড় ঠিক করে আবার একবার বাথরুমের দিকে যায় , বাইরে আলো ফুটে গেছে অনেক্ষন ।দূরে মাঠের কোনাকুনি বারোয়ারি আটচালার জ্বলে থাকা বাল্বের ম্রিয়মাণ আলো দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে আরো হারিয়ে যেতে থাকে ।
৩.
প্রতিমায় রঙ চাপানোর আগে ভবানী আর একবার ঝোলানো বাল্বটা টিনের শেড সমেত হাতে নিয়ে প্রতিমার পায়ের আঙুল থেকে শুরু করে গোটা শরীর খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, কোথাও কোনো চিড় রয়ে গেছে কিনা । চূড়ান্ত রেকি করে নেওয়া যাকে বলে , এরপর রঙ , তারপর ডাকের সাজ। ডাকের কাজের জন্য আবার আলাদা লোক আসবে ,তবে ভবানীকেও থাকতে হবে । ওর প্রতিমা পুরোপুরি কারও হাতে ছাড়বে না ভবানী । নেহাত ডাকের সাজের খুঁটিনাটি আছে অনেক তাই ! নাহলে এমনিতে ভবানীর প্রতিমায় কাপড় ভবানী নিজেই পরায় , কাউকে হাত লাগাতে দেয় না । ওর যে স্যাঙাত আছে ধলো , তাকেও না । প্রয়োজনে শুধু এক প্রান্ত ধরতে দেয় কাপড়ের । সেক্রেটারি সাহেব এবারে যে ছোকরা সে প্রায় রোজই দুবেলা আসে একবার করে । এসে কিছু বলে না , আগের সেক্রেটারিটার মতো অত বাচাল নয় ! চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ওর কাজ দেখে । ধলোকে দিয়ে চা আনায় , ওদের সবার জন্য । কিছু লাগবে কিনা জেনে আবার চলে যায় । কালে কালে কত দেখল ভবানী । ১৫০০ টাকা বায়নার প্রতিমা এখন ৪৫০০০ ছাড়িয়েছে । সাজসজ্জা আলাদা। কিন্তু মাটি যেন সে মাটি আর নেই ! আজকাল মাটি কেমন খরখরে , ছেনে ছেনে মিহি করতে বহু সময় লাগে । একটা কালচে ভাব রয়েছে , রঙে আর সজ্জায় ঢেকে যায় মাটির কালি । আর কি যুগ এলো ! আশ্বিনে বৃষ্টির ভয় !ঠাণ্ডা বাতাস বইবে কোথায় হাল্কা শীত ধরিয়ে তা না ! প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন একটু করে , তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষজন। আগে এই মাঠটার একদিকেই শুধু বাড়িঘর ছিলো, এখন চারদিকেই বাড়ি উঠে মাঠটাকে চেপে ধরেছে। নেহাত এলাকার লোকেরা বেশ বলিয়ে কইয়ে নাহলে এ মাঠটাও প্লট করে বেচে দিত কবে !
এক একজন মৃৎশিল্পীর এক এক রীতি । ভবানীর রঙ চড়ানোর রীতি হাত ও পায়ের আঙুল থেকে , সাদা রঙ বোলাতে থাকে ভবানী চওড়া তুলির মসৃণ টানে । এ এক প্রস্থ রঙ চাপিয়ে শুকিয়ে নিয়ে তারপর প্রতিমার যে যে অংশ উন্মুক্ত থাকবে সেই অংশ গুলোয় আসল রঙ চাপবে। যদিও ডাকের সাজে প্রতিমার শরীরে কিছু বিশেষ দেখা যাবে না , তবু ভবানী নিজের যতটা করার করে রাখবে। সত্যি বলতে কি ভবানীর নিজের এই ডাকের সাজ বিশেষ ভালো লাগে না, সবাই বলে বটে , মণ্ডপে আসা লোকজন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ওই সাদা অঙ্গ সজ্জার দিকে , কেন জানি প্রতিমার ওই শাড়ি গয়নার মানবী রূপই ভবানীর পছন্দ বেশী। ডাকের সাজে প্রতিমা যেন বড় বেশী ঠাকুর ঠাকুর লাগে , বড় বেশী মুগ্ধতা , বড় বেশী পবিত্র ! অবশ্য এসব আজব চিন্তা কাউকে বলেনা ভবানী। লোকে হাসবে শুনলে , নয় রেগে যাবে। বছরের পর বছর প্রতিমা গড়তে গড়তে ভবানীর কাছে এ শুধু যে ঠাকুরের প্রতিমা নয় , যাকে দর্শনার্থীরা ভক্তি ভরে প্রণাম করে ! ওর নিজের সৃষ্টি , তিল তিল করে গড়া নিখুঁত মানবী শরীর । পুজো মণ্ডপে যখন প্রতিমা প্রতিষ্ঠা হয় ফি বছর , ধুনোর ধোঁয়া , শাঁখ আর উলু ধ্বনিতে গড়া প্রতিমা যখন মা দুগগা হয়ে ওঠে , ভবানীর চোখ তখন চিক চিক করে এক অপার্থিব তৃপ্তির জলে , কেউ দেখতে পায় না ।
৪.
সকাল থেকে উর্মি খুব ব্যস্ত । বাপের বাড়ি থেকে পুজোর তত্ত্ব নিয়ে এসেছে দাদা , বিয়ের পর এই দ্বিতীয়বার দাদা এলো ওর শ্বশুর বাড়ি । জলখাবারের পর পার্থর সঙ্গে কোথায় বেরিয়েছে। উর্মির ব্যাস্ততার আর একটা কারণ হচ্ছে ওর নতুন সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি স্ক্রিনের স্মার্ট ফোন । আগেরটা মন্দ ছিলো এমন নয় , তবে এটা নতুন , আরও ভালো । সবচেয়ে বড় কথা এটা ওর বর এনে দিয়েছে, পুজোর গিফট। নতুন মোবাইলে এমনিতেই বেশ কটা গেম লোড করা আগে থেকেই । উর্মির আবার বেশ নেশা টেম্পল রানের।
দুপুরে দাদা খাবে ওদের বাড়ি ,এমনিতে রবিবার একটু ভালোমন্দ রান্না হয়েই থাকে । আজ দাদা আসায় একটু বেশীই আয়োজন। উর্মির শ্বশুর মশাই , দাদা আর পার্থ একসঙ্গে খেতে বসে খেলা থেকে রাজনীতি হয়ে সিনেমার আলোচনায় গড়িয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ হৈ হৈ করে কাটল । এক ফাঁকে দাদা ওকে একা পেয়ে জিজ্ঞেসও করে গেছে “ কিরে ! ভালো আছিস তো ? সত্যি করে বলবি , কিচ্ছু লুকাবিনা ...” কি বলবে উর্মি ! সত্যিই তো তেমন ভালো না থাকার কিছু ঘটেনি যা বলা যায়। নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে দাদাকে নিশ্চিন্ত করেছে। সন্ধ্যে নামার মুখে দাদা সবাইকে ওদের বাড়ি যাওয়ার জন্য বলে , উর্মিকে আর পার্থকে আবার সপ্তমীর দিন নিতে আসবে জানিয়ে রওনা হয়। এই প্রথম একমাথা ঝলমলে সিঁদুর নিয়ে বাপের বাড়ির পাড়ায় বর নিয়ে গরবিনীর মতো পা রাখবে , পাড়ায় দুর্গা মন্দিরে অষ্টমীর অঞ্জলি দেবে ভেবে উর্মির মনে একটা ভালো লাগা চারিয়ে যায় অজান্তেই।
সন্ধ্যে তখনও রাতে গড়ায়নি , শাশুড়ি সিরিয়ালে ব্যাস্ত । উর্মি ওর নতুন মোবাইলে। এমন সময় পিং শব্দে জানান দিয়ে একটা মেসেজ ঢুকলো হোয়াটস এপে উর্মির... পার্থ ... কি একটা ভিডিও পাঠিয়েছে ঝাপসা দেখাচ্ছে , ডাউনলোড হচ্ছে। ডাউনলোড হতেই , কিছু বোঝার আগে প্লে টিপতেই বিপত্তি !.. শীৎকারের শব্দ জেগে ওঠে মোবাইলে , উর্মি তাড়াতাড়ি মিউট করে দেয় স্পিকার । ভাগ্যিস টিভির সাউন্ড বেশ জোরেই ছিলো! ইসস... কি অসভ্য ! একদম যাচ্ছেতাই একটা পর্ণ ক্লিপ পাঠিয়েছে পার্থ ! উর্মি তবু বন্ধ করে না , কৌতূহলে পুরো সাড়ে চার মিনিটের ভিডিও দেখে যেতে থাকে। এমন নয় ও আগে এসব দেখেনি , সেই কলেজেই এসব দেখা হয়ে গেছে কবেই । বান্ধবীদের মোবাইলে রীতিমতো স্টক থাকত, ও কোনোদিন সাহস করেনি স্টক করার । শেয়ার করলে দেখত , দেখেই ডিলিট মারত। একটা নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজনা যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করত উর্মি । কিন্তু এটা বড্ড র ! উর্মির কান গরম হয়ে ওঠে , কপালে জমতে থাকে স্বেদ বিন্দু , একটা অস্বস্তি হচ্ছে শরীরে। কোথায় বসে যে পাঠালো... ইস বন্ধুদের আড্ডায় বসে নয় তো ! ভেবেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায় উর্মি ,সঙ্গে একটা চাপা আশঙ্কা বাসা বাঁধে শরীরে ।
পঞ্চমীর সকালে যেন একটু চনমনে ভাব এসেছে বাতাসে ।আশ্বিনের আমেজ না থাকলেও পুজোর আমেজ এখন মণ্ডপ ও তার আশে পাশে বিজ্ঞাপনের বড় কাট আউট ও ফ্লেক্সে টের পাওয়া যায়। ভবানীর কাজ শেষ প্রায় , এখন ডাকের কাজ চলছে । প্রতিমার মুখ টুকু শুধু ঢাকা একটা মোটা কাগজের বোর্ড দিয়ে ।
যতই নতুন জামা আসুক পুজোর আগে তুলে রাখা জামা কাপড় রোদে দেওয়ার রেওয়াজ মেনে উর্মি ওর বেনারসি , পার্থর পাঞ্জাবী , শ্বশুরের শাল , শাশুড়ির গরদ রোদে মেলতে থাকে । ঘন্টা খানেক রোদ খাইয়ে তুলে রাখবে । আজ উর্মির শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ করছে যেন । পার্থর স্কুল বন্ধ , সকাল থেকে আড্ডায় , আসবে সেই দুপুরে । কিছু পরে উর্মি জামাকাপড় গুলো রোদ থেকে তুলে ঘরে চলে যায় ।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর শরীর যেন আরও ভারী লাগছে উর্মির । এমনিতে দুপুরে ঘুমানোর তেমন অভ্যাস নেই , কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে একটু শুলে ভালোই হয় । একটা গ্যাসের ট্যাবলেট খাবে ! না প্যারাসেটামল ! মনে পড়ে যায় ডেট পিছবার জন্য ও ওষুধ খেয়েছে ,পুজোর কটা দিন যেন বিপদে পড়তে নাহয় , তার জন্য এসব হচ্ছে নাতো ! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে উর্মির চোখ লেগে যায় ।
বেলা ঢলে গেছে অনেকক্ষন । উর্মি ধড়মড় করে উঠে বসে বিছানায় । খুব জোর ঘুমিয়ে গেছিলো , পার্থ কখন এসেছে আবার বেরিয়েও গেছে টেরও পায়নি ! মাথাটা ভার ভার লাগছে । আনন্দপল্লীতে ধীরে সুস্থে পঞ্চমীর শারদ সন্ধ্যা নেমেছে । মণ্ডপের আলোক সজ্জায় গোটা এলাকা ঝলমল করছে ।
রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে চলে যায় উর্মির শ্বশুড় শাশুড়ি , আজও তার অন্যথা হলো না । উর্মি আর পার্থ খেয়ে উঠে নিজেদের ঘরে চলে আসে । টিভিতে কলকাতার পুজো পরিক্রমা চলছে । কি বিশাল বিশাল আর জাঁকের পুজো সব ! সোনার প্রতিমা , রুপোর মন্ডপ! ... এখন কিছুটা ভালো লাগছে শরীর উর্মির ।বিয়ের পর প্রথম পুজোর আমেজ ওকে ক্রমে জড়িয়ে ধরছে ।
পার্থ মোবাইলে কি করে চলেছে অনেকক্ষণ। সামান্য কিছু কথাবার্তা , পরশু দাদা কখন আসবে, কি কি জামা কাপড় নিতে হবে এসব কেজো কথা হওয়ার পর পার্থ সেই যে মোবাইলে মুখ গুঁজেছে আর তোলেনি।
না: রাত হলো বেশ । উর্মি টিভি বন্ধ করে বাথরুমে ঘুরে আসে , সঙ্গে রাতের পোশাকও পালটে নেয় , এটা রোজের অভ্যাস ওর । পার্থ এরই ফাঁকে জানালা কখন যে বন্ধ করেছে কে জানে! উর্মি কিছু বলে না আর এনিয়ে , পার্থর দিকে চোখ যেতে দেখে পার্থ ওর দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । উর্মি এ কদিনে এ চোখের ভাষা চিনে নিয়েছে ।
বিছানায় শুতেই পার্থ কাছে সরে আসে , উর্মির সারা শরীরে হাত বোলাতে থাকে রাত পোশাকের উপর দিয়ে । উর্মির আজ সত্যিই ভালো লাগছে না এসব একদম , শরীর মোটেও সাড়া দিচ্ছে না । পার্থ হঠাৎ ওর মোবাইলটা নিয়ে উর্মির চোখের সামনে মেলে ধরে । একটা ভিডিও চলছে , ভল্যুম কমানো থাকলেও ভিডিওর দুই কুশীলবের যৌন কাতর বার্তালাপ শোনা যায় । ভিডিওর মেয়েটা এবার নিজেই হাঁটু-মুড়ে পিছন ফেরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ সঙ্গীর দিকে ...
পার্থ উর্মির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে হিসহিস করে বলে ওঠে “ দেখো ... রেয়ার এন্ট্রি ... দারুণ না!” আচমকা খামচে ধরে উর্মিকে , এক ঝটকায় উপুড় করে দেয় ... কি করতে চাইছে পার্থ ! কয়েক মুহূর্ত লাগে বুঝে উঠতে উর্মির । সর্বশক্তি দিয়ে পার্থকে ঠেলে সরিয়ে দেয় উর্মি ওর শরীরের উপর থেকে , উঠে বসে বিছানার উপর ... “ না ... বললাম তো! ... আমার ভালো লাগছে না একদম শুনছোনা কেন !” পার্থ হতচকিত হয়ে উঠে বসে , আবার হাতটা ধরে উর্মির চেপে ... আবার এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয় উর্মি ওর হাত ... “ না” হাতের পাঁচ আঙুল মেলে ধরে পার্থর দিকে , পার্থ কেমন চমকে ওঠে উর্মির কণ্ঠস্বরে! ওর তীব্র চাহনিতে ! একটা প্রত্যাখ্যাত কাম-জর্জর পৌরুষের আগুন এক বারের জন্য জ্বলেই মিলিয়ে যায় পার্থর চোখে ।
ভবানী তার তুলির শেষ আঁচড় কাটে আটচালার নির্জনে ।বাল্বের হলদে আলোয় নিপুণ দক্ষতায় প্রতিমার আয়ত চোখে দেয় প্রান্তিক টান , ভবানীর গড়া প্রতিমা ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে উজ্জ্বল , তীব্র ও পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ...নিস্পলক , ভবানী ওর ঝাপসা হয়ে যাওয়া ভারি চশমাটা খুলে মুছে নেয়। রাত পোহালেই...কাল মহাষষ্ঠী ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন