কলকাতার পুজো – পুজোর কলকাতা
বেশ কিছুকাল আগের কথা, আমার ছেলেটা খুব ছোট ছিল তখন। পুজোয় বেড়াবার বায়না করত, ওকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতাম। বড় বড় প্যান্ডালগুলো দেখার চেয়ে পথে পথে নানা দৃশ্য দেখতে ভাল লাগত আমার ছেলেবেলা থেকেই। ওকেও সেই নেশা ধরাবার তালে ছিলাম। উল্টোপাল্টা রাস্তায় চলে যাব, যতদূর পায়ের ক্ষমতা, মানে দুজনেরই। পথে ঠাকুর পড়লে দেখে নেব। সে যেমনই হোক।
তা একবার, ল্যান্সডাউন রোড ধরে পদ্মপুকুরের পাশ দিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে গেছি। তারপর চলতে চলতে কখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড পেরিয়ে ওদিকে চলে গেছি, তা খেয়ালও নেই। পথে পথে ঘুরছি, সব পাড়াতেই দুচারটে পুজো, চারদিকে রঙিন আলো, বেলুন, টুকটাক খাওয়া, ছেলে আমোদ পাচ্ছে সব কিছুতেই। হঠাৎ এক জায়গায় চোখটা আটকে গেল। কলকাতায় জন্ম, এতকাল দক্ষিন কলকাতার এই অঞ্চলে কত ঘোরাঘুরি করেছি, তবে ঠিক এই পাড়াটায় জীবনে প্রথম এলাম। একটা বারোয়ারি পুজো, এমন কিছু জাঁকজমকের নয়। তবে পুজো উদ্যোক্তাদের নামটা দেখেই কেমন যেন চমকে গেলাম, ‘বলরাম বসু ঘাট রোড সর্বজনীন’। চমকে যাওয়ার কারণ হলো, আমার মনে পড়ল, সম্ভবত এটাই কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন ‘বারোয়ারি’ পুজো।
সেকালে বারোয়ারি পুজোই বলা হতো। ‘বারো-ইয়ারি’ থেকে ‘বারোয়ারি’ এসেছে আমরা সবাই জেনে গেছি এতদিনে। আবার ‘সম্ভবত’ লিখতে হচ্ছে। শোনা যায় হুগলির গুপ্তিপাড়ায় প্রথম বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে পুজোর আয়োজন করেছিলেন। তাই থেকে বারো-ইয়ারি, সেখান থেকে বারোয়ারি। সেকালে ইয়ার-দোস্ত এই উর্দু শব্দবন্ধ বাংলায় বলা লেখা দুইই হতো। ‘ইয়ার কি হরকতেঁ’ এমন কিছু থেকে ‘ইয়ারকি’ এসেছে। তাই ‘বারো ইয়ারি’ নামের উৎস এমনই। কিন্তু আমার মতে ‘বারো’ ঠিক টুয়েল্ভ নয়, বারো মানে অনেক। ‘বারো ভূতে লুটে পুটে খাচ্ছে’ বা ‘বারোভাতারির আবার লাজ লজ্জা’, এমন কথা থেকে ইঙ্গিত পাই, ‘বারো’ মানে দ্বাদশ সংখ্যা নয়, বহু বা অনেক। তাই অনেকে মিলে পুজোর আয়োজন করাই ছিল বারোয়ারি। আর কলকাতার প্রথম বারোয়ারি সম্ভবত এই বলরাম বসু ঘাটের পুজোই।
কেন এই বারোয়ারি পুজো করার প্রয়োজন হয়েছিল? পরবর্তীকালে তো যতরকম দেবদেবী, এমনকি দেবত্ব আরোপ করা কিছু মানুষেরও দলবেঁধে পুজো করার চল হয়েছে কলকাতায়। এমন সব দেবদেবীর উত্থান হয়েছে, যাঁরা কোনওদিন বাংলায় তেমন মোয়া পেতেন না। কিন্তু হয়েছে। কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এই পুজোগুলো আসলে দেবদেবীর যতনা আরাধনা, তার চেয়ে উৎসব বেশি। সেকালের ‘রাজা’ উপাধি পাওয়া লোকজন আর কলকাতার ধনীসমাজ, ব্রিটিশ আনুকূল্যে বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে বসেছিলেন। এক একটি গৃহে এই পূজার আয়োজন করা হতো, সাহেবসুবোদের কোনও ছুতোয় আমন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যেই। মদ্যমাংসের ঢালাও আয়োজন, ‘নচ’গার্লসদের লাস্যভরা নৃত্য, এসব কোনও শাস্ত্রীয় আচার নয়। পুজোটা ছিল উপলক্ষ্য মাত্র।
শোনা যায়, বরেন্দ্রভূমে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম এই অকালবোধনের উদ্যোক্তা। মতান্তরে, নদিয়ার রাজা ভবানন্দ প্রথমে শুরু করেন আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা। তার আগে বসন্তকালে বাসন্তীপূজার রেওয়াজ ছিল। তবে ঐতিহাসিকরা এখন অনেক প্রাচীনকাল থেকেই আশ্বিনমাসে দুর্গাপূজার ইতিহাস সামনে আনছেন। আজ থেকে সাত আটশো বছর আগেই মাটির দুর্গা গড়ার নির্দেশের কথা শোনা যাচ্ছে। তবে একথা ঠিক, যে এই রাজাগজাদের বাড়িতে যে পূজার আয়োজন হতো, তাতে ধর্মানুষ্ঠানের চেয়েও হুল্লোড় ও আমোদের পাল্লা থাকত ভারি। এই ধরণের পুজোই শুরু হয় কংসনারায়ণ বা ভবানন্দের বাড়িতে, যা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে বাংলার প্রধান শহর কলকাতায়।
ম্লেচ্ছ সাহেবসুবোর সে আসরে আমন্ত্রণ থাকলেও স্থানীয় সাধারণ পুরবাসী বা গরিবদের ছিলনা প্রবেশাধিকার। তাই কিছুটা ক্ষোভের কারণেই শুরু হয় গুপ্তিপাড়ার প্রথম বারোয়ারি দূর্গাপূজা। আবারও বলি, ১২ জন ব্রাহ্মণ মিলে এ পুজোর আয়োজন করেছিলেন বলা হয়। তবে এতে আমার সন্দেহ আছে। অনেকে মিলে করেছিলেন বলেই প্রত্যয়। ‘অনেক’ শব্দকে ‘বারো’ লিখে ভাব প্রকাশের কথা আগে লিখেছি। সে ভাবেই বারো ইয়ারি শব্দবন্ধ এসেছে মনে হয়। বারো জন ব্রাহ্মণসন্তানকে নিজেদের ‘ইয়ার’ বলে ডাকাটাও কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়। যদিও, সঠিক ইতিহাসটা জানা নেই, শুধুই শ্রুতিনির্ভর। এছাড়াও যাঁরা পুজোর আয়োজন করলেন, নামটা তাঁদের দেওয়া নয় সম্ভবত। এই নামটা ডিরোগেটরি বা অসম্মানসূচক। যে সব মহিলাদের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থাকে এক বা একাধিক, তাঁদের তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ বা উপহাস করে বারো-ভাতারি বলা হয়। বারো অর্থে বহু, ‘ভাতার’ অর্থ স্বামী, তাই বহু মানুষের অঙ্কশায়িনী বলে যাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাঁকেই ‘বারোভাতারি’ বলে নিন্দেমন্দ করা হতো। এই সব নিন্দে, উভয়লিঙ্গের মানুষরাই করতেন প্রধাণত ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে। ‘বারো-ইয়ারি’ শব্দবন্ধেরও উৎপত্তিও একই ভাবে সমাজপতি ধনীলোকদের চক্ষশূল সাধারণ মানুষদের আয়োজিত পুজো। যেন পুজোর অধিকার দেবতারা একমাত্র তাঁদেরই দিয়েছেন। তাই ‘বারো-ভাতারি’র মতো ‘বারো-ইয়ারি’ও নিশ্চিতরূপে ডিরোগেটরি, বা অসম্মানসূচক উল্লেখ। আর অন্য উপহাস বা গালিটির মতো এখানেও ‘বারো’ শব্দের অর্থ নিশ্চিতরূপেই ‘বহু’।
কলকাতার প্রথম বারোয়ারি সংগঠনের দাবিদারদের মধ্যে বাগবাজার সার্বজনীন যদিও ছিল, তবু সেকালে বিখ্যাত আদিগঙ্গার তীরে, যেখানে একসময়ে সতীদাহ হয়েছিল, সেই বলরাম বসু ঘাটের পূজাটিই অবিসম্বাদিত ভাবে কলকাতার প্রথম বারোয়ারি বলে স্বীকৃত। এখানে নাকি পাঁচ ধরণের পূজারী আজও থাকেন। একজন তান্ত্রিক, একজন যাজ্ঞিক, আরও তিনজন আলাদা স্পর্ধায়। এই সতীস্থলে যজ্ঞ করাও নাকি কিছুটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। এখানেও এ পুজো কারও একক নয়, বরং সম্মিলিত পুরবাসীর উদ্যোগে হয়েছিল বলেই জানা যায়।
বাগবাজারের উদ্যোক্তারা এঁদের দেখাদেখিই পূজা শুরু করেন। তার পরবর্তীকালে পূজা আয়োজন করার উদ্দেশ্য বদলে যায়। স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাবে শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতি ও আরও কিছু বারোয়ারি পূজা।
এখানে উল্লেখ্য এই, যে কালে কালে এইরূপ অনেকের দ্বারা আয়োজিত পূজার উদ্দেশ্যের পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে যা ছিল বঞ্চিতদের সংগঠিত হওয়া, তা এসে বলরাম বসু ঘাটে হয় বড়লোকের নিছক আমোদ ও হুল্লোড়ের বাইরে এসে কঠোর ধার্মিক বাতাবরণের পূজা, তা আবার খানিক অন্য মুখে বইতে থাকে স্বদেশির আবহতে।
এই ভাবে কলকাতার ‘সার্বজনীন’ পূজা সংগঠিত হতে থাকে। আমাদের কৈশোর শেষে কিংবা যৌবনের শুরুতে শুনি ‘সার্বজনীন’ নয়, ওটা ‘সর্বজনীন’ হবে। খাতায় কলমে তা লেখা শুরু হলেও বিভিন্ন ক্লাব সমিতির কাপড়ে লেখা ব্যানারে তখনও ‘সার্বজনীন’ই চলছে। ইদানিং বৈয়াকরণরা মত দিচ্ছেন, দুটি বানানই ঠিক, অর্থ কিঞ্চিৎ ভিন্ন। তবে ‘বারোয়ারি’ শব্দটা মাত্র কয়েকটি এলাকার পূজা উদোক্তারা ব্যবহার করেন এখন। ‘বারোয়ারি’ শব্দটার কিছুতা সীমাবদ্ধতাও আছে। বারো জনেরই হোক, বা ‘বারো’ অর্থে অনেকই হোক, সর্বসাধারণের অংশগ্রহণটা কিন্তু ‘সর্বজনীন’ শব্দেই বেশি প্রকাশ পায়।
আমাদের শিশুকাল থেকে কলকাতার পুজোর অনেক বিবর্তন চোখে পড়েছে। পুজোয় আনন্দ করাটাও এখন নিজেদের ফ্ল্যাটে বা ঘরে বসে আত্মীয় বন্ধু জড়ো করে খাওয়াদাওয়া ও কিঞ্চিতাধিক মদ্যপানের (কারও কারও ক্ষেত্রে) মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আগে দেখা যেত, পাড়ার পুজা মন্ডপটিই, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া ছিল মিলনক্ষেত্র। পাড়ায় যাঁদের মধ্যে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হয়, তাঁরা ছাড়াও একমাত্র এই পুজোর কদিনই যাঁরা প্রবাসে থাকেন, বিলেতে, মার্কিন দেশে বা ভারতেরই অন্য শহরে, তাঁদের অনেককে পাওয়া যেত, অনেক বরিষ্ঠ এলাকাবাসি, নিয়মিত বাড়ির বাইরে না আসতে পারলেও, একদিন বেরোতেন। কম বয়সি কিশোর কিশোরীরাও কিছুটা নতুন প্রেমের উন্মেষ টের পেত সে সময়ে। সে সব বয়স বাড়লে বেশির ভাগই মিলিয়ে যেত অবশ্য। পাড়ার পুজো মন্ডপে্র আরতিতে ধুনুচি নাচতে চলে আসতেন অনেক। ঢাকির হাত থেকে ঢাক নিয়ে বাজাতেও দেখা যেত কাউকে কাউকে। পাড়ার প্রায় সব বয়সি মহিলারা চান করে তাঁতের পাটভাঙা শাড়ি পরে মন্ডপের একটা ঘেরা অংশে ফল কাটতে বসে যেতেন সাত সকালে। পূজার শেষে সেই ফলই হাতে হাতে প্রসাদ হিসেবে বিতরিত হতো।
কলকাতার দুর্গাপুজোর কয়েকটি বিশেষ আঙ্গিক ছিল ষাটের দশকের শেষ অবধিও। তা হলো, ত্রিপল দিয়ে চুড়ো করা মণ্ডপ বা প্যান্ডাল হতো। ওপর দিকটা যত পারা যায় ঢালু রাখা হতো। যদিও সেকালে দুর্গাপুজোয় বাজি পোড়ানোর কোনও চল ছিলনা, তবু জ্বলন্ত কিছু পড়লে যাতে গড়িয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে, এককালে কলকাতায় গোলপাতা (যা আদৌ ‘গোল’ নয়, অনেকটা নারকেলের পাতার মতো) দিয়ে ছাউনি করে মণ্ডপ হতো। একবার এই মণ্ডপে (তা পুজোর না গানের জলসার, তা নিশ্চয় করে বলতে পারিনা) আগুন লেগে নারী, শিশু সমেত বহু মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছিলেন। তারপর থেকে পাতা দিয়ে ছাওয়া প্যান্ডাল আইন করে বন্ধ করা হয়। তখন থেকেই ত্রিপল খাটিয়ে মণ্ডপ খাড়া করা শুরু। ওপরে ত্রিপল ও নিচে মণ্ডপের জন্য নির্ধারিত সাদা ও হলুদ কাপড় জুড়ে চাঁদোয়া হতো। এই প্রসঙ্গে, লম্বা লম্বা কাপড়ের ফালি জুড়ে মণ্ডপ বানানো হতো। বিয়েতে লাল এবং সাদা আর পুজোতে হলুদ/কমলা এবং সাদা কাপড়ের ফালি একের অন্তরে এক জুড়ে চাঁদোয়া, বাঁশের খুঁটির মোড়ক, এসব প্রস্তুত হতো। অন্য কোনও রঙের কাপড় ব্যবহার করা হতোনা।
পুজো মণ্ডপ কিছুটা জায়গা থাকলে, যা অধিকাংশ পাড়াতেই থাকত, বানানো হতো অডিটোরিয়াম বা প্রেক্ষাগৃহের আদলে। যেখানে স্টেজ বা মঞ্চ থাকার কথা, সেখানে মঞ্চই বাঁধা হতো। তার ওপরে প্রতিমা রাখা হতো। দুই পাশে দুটি ঘরের মতো করা হতো কাপড়ের পর্দা আর ঢেউ খেলানো টিনের দেওয়াল দিয়ে। এই ঘরদুটির একটি পুজোর সময়ে ব্যবহার হতো প্রসাদ বিতরণের জন্য, অন্যটিতে গ্রামাফোন রেকর্ডে পুজোর গান, যা প্রতিবছর রেকর্ড কোম্পানিরা বের করতেন, তা বাজানো হতো মণ্ডপের ওপরে রাখা অ্যামপ্লিফায়ার মারফত। মধ্যরাত্রে বা দ্বিপ্রহরে এলাকাবাসির শান্তি বিঘ্নিত করে বাজতনা সে গান অধিকাংশ ভদ্র পাড়ায়। আর যাও বা বাজত, তার শব্দমাত্রা থাকত এখনকার তুলনায় অনেক কম।
মণ্ডপের মাঝখানের আয়তাকার অংশটিতে চাঁদোয়ার অন্তরালে থাকা বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো বেশ কয়েকটি সিলিং ফ্যান। এছাড়াও মণ্ডপের কোণে থাকত দাঁড় করানো বড় পাখা। পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষরা, বাড়ির গৃহিনীরা, ওই চেয়ারে বসেই গল্পগাছা করতেন সকাল সন্ধে। ওটাই ছিল বাৎসরিক মিলনের জায়গা। দুটি সময়ে ওই সব চেয়ার তুলে দেওয়া হতো, এক, সকালে অঞ্জলির সময়ে, দুই সন্ধ্যায় আরতির সময়ে। এই আরতির সময়ে পাড়ার যুবক এবং পুরুষ সদস্যরা ধুনুচিনাচের নানারকম কৌশল দেখাতেন। যত না প্রতিমার প্রতি ভক্তিতে, তার চেয়ে বেশি এলাকার যুবতীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার নিমিত্ত। এপাড়ার নামজাদা ধুনুচিবাজ ওপাড়ায় যেতেন আমন্ত্রণে তাঁর কলা প্রদর্শন করতে, এমনও ব্যবস্থা ছিল।
কোনও কোনও পুজো প্যান্ডালে এক দিক বন্ধ করে, তিন দিন নাটক, যাত্রা, বা ছায়াছবি দেখানো হতো আরতি হয়ে যাবার পর। পুজোর বিসর্জন সাধারণত দশমির দিনই হয়ে যেত। অনন্তকাল ধরে মন্ডপে প্রতিমা রেখে দেওয়ার চল ছিলনা। বিজয়া দশমির কয়েকদিন পর ওই মণ্ডপই রূপান্তরিত হতো প্রেক্ষাগৃহে। চারদিকে পড়ে যেত টিনের বেড়া। ডেকরেটারদের ভাঁজকরা হলুদ কাঠের চেয়ার তো আগে থেকেই মজুদ ছিল, মাথার ওপরে পাখাও ছিল। প্রতিমা ভাসানের পর ওই স্টেজেই শতরঞ্জি-ফরাস পেতে আয়োজন করা হতো গানের জলসা বা বিচিত্রানুষ্ঠানের। দুইপাশে দুটি ঘর, যা প্রসাদ বিতরণ ও রেকর্ড বাজানোর কাজে লাগত পুজোর ক’দিন, সেদুটিই হয়ে যেত গ্রীনরুম আর শিল্পীদের বিশ্রামের জায়গা। কলকাতার প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কাকে কোন পাড়া নিয়ে যেতে পেরেছে, তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত। নাকের বদলে নরুণের মতো হেমন্ত বা মান্না কণ্ঠি গায়কদের বেশ চাহিদা ছিল সেই সব পাড়ায়, যাদের বড় শিল্পী আনার মতো আর্থিক সামর্থ ছিলনা। যাঁদের নিয়মিত গাইতে দেখা যেত, তাঁদের মধ্যে, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, পূর্ণদাস বাউল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা ছিলেন। যাঁদের ক্ষমতা থাকত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কেও আনতেন, মান্না দেকে অবশ্য পুজোর ফাংশানে তেমন শুনেছি বলে মনে পড়েনা। গানের পরে বা মধ্যে থাকত কৌতুকাভিনয়। তাতে জহর রায় বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেনই। অন্য কেউ কেউও থাকতেন। কৌতুক গীতি বা প্যারডির জন্যও খানিক সময় রাখা হতো। সে গান গাইতেন প্রধাণত মিন্টু দাশগুপ্ত। এর পরে সবশেষে অর্কেস্ট্রা পার্টির বাজনা। তাতে ভি বালসারা, ওয়াই এস মুলকি, খোকন মুখার্জি, এঁদের দেখা যেত। যাঁরা এঁদের আনতে পারতেন না, তাঁদের জন্য কম পয়সার অর্কেস্ট্রাও থাকত। এই দলে মুখ্য বাদক পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতেন, একজন থাকতেন হাওয়াইয়ান বা স্প্যানিশ গিটারে, ড্রামার থাকতেন একজন, বঙ্গো বাদক আর একজন, অন্যান্য পারকাশন নিয়েও বসতেন কেউ কেউ।
অবশ্যম্ভাবী ছিল এই পর্বের শেষে ইংরিজি সুর ‘কাম সেপ্টেম্বর’ বা ‘টেকিলা’ বাজানোর অনুরোধ। এই সময়ে পাড়ার কিশোর বা নব্য যুবকদের ঠেকিয়ে রাখা যেতনা, তারা একটা কোনায় গিয়ে ‘টুইস্ট’ নাচতে আরম্ভ করে দিত। বয়োজ্যেষ্ঠরা হয় উঠে যেতেন বা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতেন। এই ধরণের নাচনাচি, যদিও তা এখনকার নাচের তুলনায় একেবারেই ‘নিরামিষ’ পদবাচ্য, বড়দের সামনে নাচা অসভ্যতা মানা হতো। কিন্তু কী করা যাবে, ওই সুর যে টেনে নিয়ে যায়। তাই বড়রা মুখ ফিরিয়ে থাকতেন।
পুজোর আলোকসজ্জা ছিল খুবই মামুলি। যে পাড়ায় পুজো, তাদের কোনও এক উঁচু বাড়ি, যা সর্বোচ্চ ত্রিতলই থাকত অধিকাংশ জায়গায়, তার ছাদে ‘চক্র’ বসানো হতো। এই চক্র ছিল একটি গোলাকার বোর্ডের ওপর অনেকগুলি সাদা বাল্ব বসিয়ে, তাদের এক একটিকে নানা রঙের রঙিন কাগজে মুড়ে অলটারনেটর মারফত অটোমোশন চালু করে নানারকম নকশা করা। কখনও সে তারার মতো, কখনও কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে বৃত্ত ছড়িয়ে পড়ছে, এইটুকুই। প্যান্ডালের কিছুদূর পর্যন্ত কয়েকটি ডেকরেটারদের কাপড়ে মোড়া খুঁটিতে বাঁধা থাকত টিউবলাইট। সত্তরের দশকের শেষভাগে কলেজ স্কোয়্যারের পুজোতে চন্দননগর থেকে টুনিবালবের খেলা (যতদূর মনে পড়ে, একটি জাহাজ তৈরি করা হয়েছিল, আর কিছু ফ্লোরাল প্যাটার্ন) এনে দর্শনার্থীদের তাক লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সেকালে কিংবা একালে, যে কথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে, তা হলো ‘ঠাকুর দেখা’। একে অপরকে স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা, ‘ঠাকুর দেখতে যাবিনা?’ কোনও শিশুকে বড়দের জিজ্ঞাসা, আজ কটা ঠাকুর দেখলে? মূলত দুর্গাপ্রতিমা দর্শনই ছিল কলকাতা তথা বাংলার রীতি। মুখে মুখে এও শোনা যেত, খুব বৃষ্টি পড়ছে, বেরোনই হলোনা, অষ্টমী পড়ে গেল, এখনও ঠাকুরের মুখ দেখিনি। তার মানে প্রতিমাদর্শনই ছিল মূল চাহিদা। তাই সে কথা মাথায় রেখেই পঞ্চাশের দশক থেকেই প্রতিমায় বৈচিত্র আনা শুরু হয়। একচালার পুরো পরিবার ভেঙে তখন আলাদা আলাদা দেবদেবীদের স্থাপনা শুরু হয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে। অসাধারণ কিছু প্রতিমাশিল্পীর উত্থান হয় সেই সময়ে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কুশলী শিল্পী ছিলেন নিতাই পাল। এঁর পরে গোরাচাঁদ পাল, রমেশ পাল ও জিতেন পাল এর নাম করা যেতে পারে। রমেশ পালের বাজার দর ছিল সর্বাধিক। তিনি কলেজ স্কোয়্যার, ফায়ার ব্রিগেড, পার্ক সার্কাস-বেনিয়াপুকুর এবং যাদবপুর কৃষ্ণা গ্লাস এর প্রতিমা গড়তেন তখন। তারপরে এ পুজো ছেড়ে ও পুজোয় যান। বহু মণ্ডপ বদল হয় তাঁর। পরবর্তীকালে সমাজসেবী সঙ্ঘ, একডালিয়া এবারগ্রীনের প্রতিমাও করেন তবে আজীবন পার্ক সার্কাস-বেনিয়াপুকুর ছেড়ে যাননি। ঠিক তেমনই জিতেন পাল ছেড়ে যাননি ২৩ পল্লীর পুজো। সেই মণ্ডপ এখন পাকা হয়েছে আর জিতেন পালের শেষ করা মূর্তিটি ধাতুতে ঢালাই করে এখন চিরস্থায়ী ভাবে রয়ে গেছে সেখানে। উত্তরে সিমলা ব্যায়াম সমিতি আর বিবেকানন্দ স্পোর্টিং মুখোমুখি পুজো করতেন। সরু রাস্তা, তাই ওপরে মন্ডপ আর তার নীচ দিয়ে দর্শক এপার থেকে ওপারে চলে যাবেন। সিমলা ব্যায়াম সমিতিকে ছোট করে ‘সিমলে’ বলতেন স্থানীয় মানুষরা। সেই সিমলের পুজোয় গোরাচাঁদ পালের মূর্তি দেখলে নড়তে মন চাইতনা। কিন্তু পেছনে শয়ে শয়ে মানুষ। কোনও এক অদ্ভুত কারণে আয়োজকরা সে প্রতিমার ছবি তুলতে দিতেন না। তাই সে সব অসাধারণ মৃৎশিল্প ফিরে দেখার সুযোগ নেই। অন্যদের কিছু ছবি তাও পাওয়া যায়।
দুর্গাঠাকুর ভাসান আগে সবাই দশমীর দিনেই দিয়ে দিতেন। ব্যান্ডপার্টি আবশ্যক ছিল শোভাযাত্রায়। কালীপুজোর বিসর্জনে তাসা বাজলেও দুর্গাপুজোয় তাদের প্রবেশাশিকার ছিলনা। শাস্ত্রমতে কিন্তু দুর্গাপুজোর বিসর্জন হওয়ার কথা অন্যরকম। তাতে অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ, বারাঙ্গনা, এঁদের অংশগ্রহণ আবশ্যক। শোভাযাত্রার পথে একে অপরকে কর্দম, ধূলি ও পুষ্প নিক্ষেপ আবশ্যিক। অশ্লীল শব্দ সম্বলিত গান গাইতে হবে নারীপুরুষ উভয়কেই। বিসর্জনান্তে একে অপরকে আলিঙ্গনও করতে হবে। অবশ্য এমন প্রথা শাস্ত্রে থাকলেও আমরা জন্মাবধি কোথাও এমন হয়েছে শুনিনি। বরং খুব গাম্ভীর্য সহকারে ব্যান্ড বাজিয়ে শোভাযাত্রা হতো। গঙ্গায় প্রতিমা ভাসিয়ে দেবার পর নিজের নিজের পাড়ায় ফিরে অন্ধকার মণ্ডপে মাটির পিলসুজে জ্বলন্ত প্রদীপ দেখে বুকটা হু হু করে উঠত সকলেরই। কারণ এই কদিন ধরে কেবলই মায়ের মুখ দেখা হয়েছে নানা কাজের সুবাদে, অঞ্জলিতে, আরতিতে, বিনা কারণেও। আত্মীয়তার বন্ধনে জড়ানো হয়েছে নিরঞ্জনের পর মুখে পান বুলিয়ে মিষ্টি গুঁজে দিয়ে। এদিন শূন্য মন্ডপ হঠাৎ কেমন একটা অন্তহীন বিষাদের আবহ সৃষ্টি করত।
এখনকার পুজো অনেক পথে পেরিয়ে এসেছে। মাঝখানে চন্দনগরের টুনি বালবের সাজসজ্জা কে কত আনতে পারেন, তার দৌড় লেগেছিল। তারপর, বিভিন্ন অশাস্ত্রীয় বস্তুতে মণ্ডপ ও প্রতিমা বানানোর ধুম পড়েছিল। চিনেবাদামের খোলা, ধান, ঝিনুক, চক, পেরেক আরও কত কী। আসলে কিছুই হতোনা, মাটির প্রতিমা বানিয়ে ওপরে সে সব আটকে দেওয়া হতো। এর পর এল পুরষ্কারের ধুম। নানা করপোরেট সংস্থার স্পনসরিং আর পুরষ্কারের ঠেলায় থিম-পুজো বলে এক অদ্ভুত জিনিসের উদয় হলো। কারও মণ্ডপসজ্জার কোনও অর্থ থাক বা না থাক, টেলিভিশনের সাংবাদিক প্রথমেই গিয়ে জিজ্ঞা্সা করেন, এবারের থিম কী? সে থিমের যোগান দিতে বন্ধন রাহা, গৌরাঙ্গ কুইল্ল্যাদের উত্থান। পালবংশীয় কুম্ভকারদের বদলে সনাতন দিন্ডা, ভবতোষ সুতার, পিয়ালি সাধুখাঁরা, মানে আর্ট কলেজের পাশ করা শিল্পীরা চলে এলেন প্রতিমা গড়তে। শুধু তাই না, প্রতিমা ও কনসেপ্ট, একসঙ্গে প্যাকেজ হতে লাগল। দশমীর দিন প্রতিমা ভাসানো কবেই বন্ধ হয়েছে। কেউ কেউ আরও এক সপ্তাহ রেখে দেন। তারপর তো রিও ডি জেনেইরোর অনুকরণে কারনিভ্যাল চালু হয়ে গেছে।
কলকাতার পুজো, গ্রামগঞ্জেও একই হাওয়া, কত পথ চলে এল সেই সাবেক কালের বাঙালির উৎসব থেকে। এখন প্রাণহীন লাগে সবই।
অপূর্ব লেখা। পুরোনো গানের সুরের মতো নস্টালজিক করে তোলে...
উত্তরমুছুন