অন্য পূজা , অন্য উৎসব
পূজার সঙ্গে লোকায়াতের একটা বিরোধ জন্মলগ্ন থেকেই । যাগ যজ্ঞ বেদ বিধি বৈদিক সংস্কৃতি , পূজায় তন্ত্রের অবদান । বাঙালির উপরে বেদ থেকেও প্রভাব বেশি তন্ত্রের । মূলতঃ অষ্ট্রিক সংস্কৃতিজাত বর্ণশংকর বঙ্গজাতীয় জীবনে মাতৃপুজার প্রভাব জন্মজাত । পাশাপাশি একটি সহজিয়া বোধ পূজাকে রূপান্তরিত করেছে প্রেমে । 'আমি কী মার তেমন ছেলে ,মাকে রাখবো দূরে পূজার ছলে '( ফকিরহাট, দূর্গাপ্রসন্ন )
গোটা বিষয়ের মূলে ব্রাহ্মণ্য ও ননব্রাহ্মণবাদের জীবন দর্শন কাজ করছে । বেদে পূজা ছিল না । বাঙালি ব্রাহ্মণ বেদবাহিত নন কোনকালেই । বেদে যাগ যজ্ঞ জপ তপ হোম প্রধান । সমিধ আরোহনকারী বৈদিক খাদ্যাভ্যাসেও মুক্ত মনা ছিল । সোমরস ও পশুর মাংসে কোন নিষেধ ছিল না । 'বাহ্য পূজা অধমাধম' --এইভাবেই বেদ তপঃকে ভজনশিরোমণি করেছে ।
তন্ত্র শক্তির অনুসন্ধানী । শক্তির অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিজের ভিতরে বিশাল শক্তি ভাণ্ডার আবিষ্কার করে হতবাক হয়ে গেছে । যা দেখে পরবর্তীতে লালন বলেছেন , 'যাহা আছে ভাণ্ডে তাহা আছে ভাণ্ডে'। প্রতিমা( সিম্বল) কীভাবে ঢুকলো সেটা গবেষণার বিষয় । পুরাণ যুগ থেকে ভারতীয় জনজীবনে শক্তি আরাধনায় মাতৃ রূপটি বিস্তৃত হতে শুরু করে । মহাভারতে সখা কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে দুর্গতি নাশিনী শক্তির স্তব্ধ করেছিলেন । মহাভারতে সেই স্তব দুরগাস্রোত্র রূপে খ্যাত হয়ে আছে ।
তার থেকে উদ্দৃত কিয়ংদংশ ,--
‘ত্বং ব্রহ্মবিদ্যা বিদ্যানাং মহানিদ্রা চ দেহিনাম ।
স্কন্দ মার্তভগবতি ! দুর্গে ! কান্তার বাসিনী ।
--হে কার্তিকেয় জননী ! ভগবতি ! দুর্গে ! মহারন্যবাসিনি ! আপনি বিদ্যার মধ্যে মহাবিদ্যা এবং প্রাণীগণের মহানিদ্রা !
অর্জুন বলছেন ,
- মহাশূলাস্ত্রে ! খড়গ ও মুদ্গ্রাধারিনি ! কৃষ্ণানুজে , জগতপ্রাচীনে নন্দগোপ কুলোদ্ভবে আপনাকে প্রণাম । ইত্যাদি ১৩টি স্তব রয়েছে অর্জুনের ।
এখানে সম্পূর্ণ রূপে তন্ত্রের প্রতিধ্বনি শোনা যায় । সপ্তপদী চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে আছে ঋষি কর্তৃক ৩৫টি স্তোত্রে অর্জুনের কণ্ঠ শোনা যায় ।
এর আগে রামায়ণ যুগেও রাবণ বধের জন্য দেবি শক্তির শরণাপন্ন হয়েছিলেন
রঘু বংশ কুলতিলক রামচন্দ্র । ১০৮টি নীল অপরাজিতা দিয়ে শরতকালে দেবি স্তুতি এবং অকালবোধনের আধ্যাত্মিক বা জাগতিক ব্যাখা সর্বজনবিদিত ।
তবে শক্তিপ্রধান চর্চা হচ্চে নিগম । সপ্তশতী চণ্ডী তার প্রামান্য গ্রন্থ । বেদ জ্ঞানভিত্তিক , উপনিষদ তার ভাব নির্যাস ।
আজকের এই আলোচনা তন্ত্র মন্ত্র বা উপন্যাস ভিত্তিক শাক্ত সাধনার নয় । বরং কঠিন শক্তিতত্ত্ব বাঙালির হিয়া মথিত অমিয়া বাহিত হয়ে যখন স্নেহের দুলালী বা আত্মজনের মা হয়ে উঠেন , তখন ভক্তসন্তান মা-কন্যার দোলায় দোলায়িত হয়ে সর্ব জগতের কঠিন তত্ত্বকথাকে কী করে মাটির আঙিনায় অনায়াস করে তুলেন । হ্যাঁ ভালোবাসার সহজসাধন এইভাবেই ভাবের দেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল অন্য এক উৎসবের । ভারতবর্ষে এই ভাবের সাধন শুরু হয় কবে তা গবেষণা লব্ধ বিষয় । তবে সুফিরা এইদেশে না এলে ভাবজগত নিয়ে এই বিপুল যজ্ঞ সাধিত হত কিনা সন্দেহ । বাঙালির ভাব জগতের মুখ্যপুরুষ অবশ্যই শচীর দুলাল নদের চাঁদ । এই চাঁদ শব্দটি সুফি বাহিত । সুফিরা চন্দ্র উপাসক , বেদ সূর্য উপাসক ।
সহজ প্রেম সাধনা বা সহজিয়া , যাদের উৎসব কোন পালা পার্বণ ধরে আসে না । আরাধনা তাঁদের নিত্য । বিগ্রহ তাঁদের মানুষ । ‘শোন হে মানুষ ভাই , সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই’। মানুষ ভজনা নিগূঢ় ভজনা । অন্তর্মুখে নিত্যমানুশের অনুসন্ধান সর্ব সাধনার সার । লালন ও বলেছেন চেতন মানুষের কথা , মনের মানুষের কথা । দূর্গাপ্রসন্ন বলেছেন ,’মনের মানুষ পাই যদি পায়ে ধরে সাধি’ ।
বিগ্রহ থেকে বের হয়ে গিয়ে প্রেম নির্ভর সাধনা সুফিদের আগেও ভারতবর্ষে ছিল । বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যের আড়বাড় সম্প্রদায় রামানুজ , মাধ্য সম্প্রদায় , পশ্চিমে সন্তদাস , নামদেব , একনাথ রামানুজ , মাধ্য সম্প্রদায় ; পরবর্তীতে উত্তর ভারতে রবিদাস কবীর নানক ইত্যাদিতে । পূর্ব ভারতে মাধবেন্দ্র পুরী বাহিত হলেও তাতে ফ্ল ধরে চৈতন্য মহাপ্রভুর সুবিশাল প্রেমধারায় । বৈষ্ণবরাই প্রেমের চাষ শুরু করেন এবং ব্যাপ্তি দেন । তাতে উৎসব নিত্য , পুজা নয়ন ধারায় প্রবাহিত । বাংলাদেশে শাক্তগণ মহাপ্রভুর করুণাবিগ্রহের দ্বারা প্রভাবিত হন । রামপ্রসাদ রামকৃষ্ণ কমলাকান্তের জন্ম দেয় বাংলার মাটি । এই ধারা বেয়ে বাংলার মাটি প্লাবিত হয়েছে রামপ্রসাদের ভাবজোয়ারে । ভক্তিই সার । ভক্তিই ভাবস্বরুপা । চৈতন্য এর পুরোধা । আরেকটু এগিয়ে নিয়ে বলছেন , রাগানুগা ভক্তি । ভক্তি কামহীন প্রেম যুক্ত হলেই রাগানুগা ।
'আমায় দে মা তবিলদারি আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী' । সম্বন্ধ ডুরে বাঁধা পড়লেন অব্যক্তশক্তি , বিশুদ্ধ জ্ঞান , চিন্ময়ী সৎ চিদ আনন্দময় । হয়ে গেলেন তিনি জগতজননী । শারদ প্রভাতে সর্বভূত সনাতনী হয়ে গেলেন কারোর কাছে কন্যা , আবার কারোর কাছে মা ।
যে উৎসব নিত্য , যে উৎসবের উপাদানই রস সেটি কিন্ত ভারতীয় পরম্পরার সঙ্গে সুফির ঘাটবন্ধন । অন্তরে প্রাণের প্রদীপ জ্বেলে নবরসের উপাদানে প্রেমিক নিত্য মজে রয় সেইরসে । রবীন্দ্রনাথ ও মজেছিলেন । সাধকপ্রেমিক অপূর্ব প্রেমরসের সন্ধান পেয়েছিলেন অন্তরের মণিকোঠায় । চণ্ডীদাস দাস বলেছেন ,'আমার বাহির দুয়ারে কপট লেগেছে ভিতর দুয়ার খোলা'। 'অন্তরে মন্তরে সাধি '। এ ও পূজার অঙ্গ । উৎসবের নিভৃত কোণ । সেই কোণে নিত্য আমি , নিত্য তুমির বাস । হৃদয়ে জানে হৃদয়ের খবর । সেই উৎসবে চৈতন্যদের রেখেছিলেন সাড়ে তিনজন পাত্র । বলেছিলেন অন্তরঙ্গ আস্বাদন । সহজিয়া রসে মিশ্রিত হয়ে চৈতন্য পরবর্তী অন্তরঙ্গ সুধারস লোকায়াতের মধ্যে তার সাধনপথ তৈরি করে নেয় । বৌদ্ধ সহজিয়া কালক্রমে বৈষ্ণব সহজিয়ার সঙ্গে মিশে নতুন এক ধর্ম বিপ্লবের সূচনা করে । ১৯ শতকে আউল বাউলের সংশ্রবে [লোকায়াত সহজধর্ম ( আউলিয়া ) বৃহৎবাংলার আবর্তে রাগানুগাকে আশ্রয় করে এগিয়ে চলেছে । সেখানে প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মেলা , হরদম হরসময় । সেখানে শরৎ আসে মায়ের মুখের হাসি হয়ে । শিউলি ঝরে মায়ের চরণ পাবে বলে ।সাধকপ্রেমিক নিত্য নবরসে প্রেমপুলকে মায়ের কোলে বসে জগতলীলা প্রত্যক্ষ করে নিশিদিন ।
- -'আমি কি মার তেমন ছেলে
মাকে রাখব দূরে পূজার ছলে।
পূজার যত ছলাকলা গঙ্গা জলে গেল ফেলা
আমার শুধু মা মা বলা আর সুধা খাওয়া বসে কোলে'( ফকিরকর্তা দূর্গাপ্রসন্ন দেব )
মায়ের সন্তান, মা যে জগতজননী । দুর্বল সন্তানের আবার সাধন কী ? ভজন কী ? শুধুমাত্র চাই অনুগত ভাবে মাতৃ শরণ। এখানেই চৈতন্যভাবের প্রবেশ । যাহা আছে দেহ তারে পাপ পুণ্যের বিচার কীরে ? মেরেছ কলসীর কানায়
তাই বলে কী প্রেম দিব না ? নির্বিচার আত্মসমর্পণ চৈতন্যপথ । সেই পথের সঙ্গে মিলে গেল সূফি আউলের কাতরতা
- ,"ভুবনমোহিনী মাগো কেন ভুলাস ছেলে ?
তাতে কী তোর সুখ বাড়ে মা যদি ছেলে তোরে ভূলে !
.....
মা মা বলে ডাকলে তোরে ব্যথা কী বাজে অন্তরে
তবে কাঁদব শুধু হায় হায় করে
ডাকব না আর মা মা বলে !" ( ফকিরহাট , পদকর্তা দূর্গাপ্রসন্ন দেব )
চণ্ডীর অচিন্ত্য শক্তি সন্তানের মা হয়ে প্রতিনিয়ত ক্ষরণ করে নব নব রস । কখনো বলে , " মা বেটি কী মাটির মেয়ে " মাটির মূর্তিতে কেন করবো পূজা । বরং মানব জন্ম আবাদ করে সোনা ফলাব । মা যে সর্বত্র সর্বজ্ঞ । তাঁকে 'কোথায় করি আবাহন কোথায় করি বিসর্জন, কিসে রহি অচেতন পূজি চৈতন্যরূপিনী'। অর্থাৎ সর্বসিদ্ধি দায়িনী কখনো কুলকুণ্ডলিনী , কখনো হ্লাদিনী । কখনো মা ,কখনো প্রিয় এইভাবে এক সত্তার বহুধা প্রকাশকে একসূত্রে গেঁথে লোকয়াত সহজিয়া নিরন্তর করে চলেছে নিত্য উৎসের অন্বেষণ ।
কুলকুণ্ডলিনী রূপে যিনি দেহস্থিত মূলাধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছেন , তিনিই মাতৃরূপেন জগতধৃতা । ব্রহ্মময়ী জননী সন্তানের হৃদয় ভুমি আলো করে আছেন থাকবেন । এই অন্বেষণ প্রক্রিয়াই সাধকের জীবনের নিরন্তর উৎসব ।
সুচিন্তিত মতামত দিন