অথ কেশ মুণ্ডন কেস কথা
আশ্বিন মাস। ফুরকিফুরি হিম হিম হাওয়া বইছে। মহালয়ার সন্ধ্যে। ছেলের হাত ধরে বেড়িয়েছি বেহালা বাজারে। এখানে ওখানে শুরু হয়ে গেছে শেষ পর্বের পূজার সাজের প্রস্তুতি পর্ব। কেননা, বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব আমাদের দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছে। আশ-পাশ থেকে ভেসে আসছে শ্রুতিমধুর চন্ডীপাঠ তার সঙ্গে বিশিষ্ট নেতাদের বক্তৃতা। আজ মহালয়ার দিনেই মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে উদ্বোধন। উৎসবের আগমনে ঝলমল করছে দশদিক। আকাশে বাতাসে ছুটির আমেজ।
সেই আমেজ সঙ্গে নিয়ে আমরা চললাম বেহালা তথা কোলকাতার এক নামি ইউনিসেক্স পার্লারে। আমাদের ছোটবেলায় মেয়েদের আর ছেলেদের আলাদা আলাদা সেলুন ছিল। এখন বিশ্বায়নের বাজার। শিক্ষা-দীক্ষা,
আচার- আচরণ, সাজ-সজ্জা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি থেকে শুরু করে হেয়ার কালারিং সবেতেই গ্লোবালাইজেশনের ছোঁয়া। আর সেই ছোঁয়াতে লেখালেখি, নাচাগানা মায়
খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে পরিধানের বস্ত্র সব কিছুতেই ফিউশনের রমরমা। মানে, গ্লোবাল দেশী আর কি! তাই ইটালিয়ান সেলুনকে টা-টা, বাই-বাই জানিয়ে চললাম বি হানি নাম্নী ইউনিসেক্স পার্লারটিতে।
অবিশ্যি এই স্যালোঁটিতে পদার্পণের নেপথ্যে ছোটখাটো একটি কাহিনী আছে। সেটি না বললেই নয়। আমার ছেলের বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকায় ছেলের যাবতীয় দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়। ছেলের চুল যে দ্রুততায় বাড়ে সেই দ্রুততায় তার বাবার আসার সময় হয় না। কাজেই ছেলের চুল কাটাবার গুরুদায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়। প্রথম প্রথম ছাদের ওপর টুল পেতে আমি নিজেই দক্ষ হাতে কাঁচি চালাতাম। পরে দেখা গেল গিনিপিগটির এই পরীক্ষা - নিরীক্ষা একেবারেই
না-পসন্দ। অতএব নিয়ে চললাম পাড়ার মাথায় ছোটখাটো একটি জেন্টস সেলুনে। সেখানে গিয়ে আমার চার বছরের ছেলে কোলকাতা শহরের বিখ্যাত স্যালোঁগুলি সম্বন্ধে একটি ছোটখাটো বক্তৃতা দেওয়ায় সেলুনের নাপিতের কাছে আমাকে মুখ লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। তদুপরি, আমার ছেলের চুল কাটানোর পালা আসার আগে যে ভদ্রলোকের চুল এবং দাড়ি কাটা চলছিল তিনি ওই কাঁচিতে তাঁর সুদীর্ঘ নাকের চুল কেটে দিতে ফরমায়েশ করেন ওই নাপিতকে। তাই দেখে চুল না কাটিয়ে আমি ছেলেকে নিয়ে মানে মানে কেটে পড়ি। এরপরই আমি খুঁজে খুঁজে এই ইউনিসেক্স এবং এলিট স্যালোঁটিকে বার করি।
তো সে যাই হোক। এবার আসি আজকের কথায়। বি হানিতে পৌঁছে দেখি এলাহি কাণ্ড। সে কি বিশাল কর্ম যজ্ঞ। সুবিশাল দেওয়াল জোড়া আয়নার সামনের চেয়ারগুলো দখল করে নিয়েছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ মানুষীর দল। কেউ কালো চুলে সবুজ রং করাচ্ছেন তো কেউ মুখে ভূতের মতন মাস্ক পরে চক্ষুকোটরে শসার খণ্ড লাগিয়ে ধ্যানমগ্ন। কারো কারো চুলে আবার ইস্তিরি বুলানো হচ্ছে আর মর-মর ফর-ফর আওয়াজে চুল থেকে গরম ধোঁয়া উঠছে। আমার ছেলে ঘুরে ফিরে বিজ্ঞের মত এইসবই নিরীক্ষণ করছে। আর পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে আমি তটস্থ হয়ে আছি যে এই সেলুনটিও না বেহাত হয়ে যায়!
হঠাৎই শুনলাম,-------" ওরা কি মেখেছে গো?"
চুলে ইস্তিরি চালাতে চালাতে মেয়েটি উত্তর দিল --------"ওরা ফেসিয়াল করছে।"
--------"সে আবার কি গো?"
--------"ওটা করলে সুন্দর দেখতে লাগে।"
-------"ও আচ্ছা! আমাকেও করে দিও।"
এরই মধ্যে এক ভদ্রলোকের ফেসিয়াল শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমিও আশান্বিত যে এইবার আমার ছেলের পালা এল বলে! কিন্তু হা হতোস্মি!
এরপরে যা শুনলাম তারপর আমার আর ওখানে একমুহূর্তও থাকা চলে না। শুধু শুনলামই না দেখলামও। দেখলাম যে আমার চার বছরের ছেলে ওই ভদ্রলোকের নাকের সামনে গিয়ে ওনার গাল টিপে টিপে দেখছে আর বলছে------
"হেই! এখনও তো তুমি সুন্দর হলে না!!!"
ভদ্রলোকের বিস্ফারিত নাসা আর রক্তচক্ষু দেখে বগলদাবা করে ছেলেকে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে আমি দে দৌড়। 'আমি যাই বঙ্গে আমার কপাল যায় সঙ্গে!'
দূর থেকে ভেসে আসে মাইক ও ঢাকের শব্দ। গণেশ আর গণেশজননী একে অপরকে আঁকড়ে ধরে আনন্দে মেতে ওঠে। ঘরেই আজ তাদের দুর্গোৎসব
সুচিন্তিত মতামত দিন