অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

মায়াজম
0
দুর্গা দুর্গতিনাশিনী নয়!



দুর্গা শব্দের ব্যুৎপত্তি হল দুর্ (দুঃখ) গম্ (গমন করা, জানা) + অ (র্ম্ম) = দুর্গ + আ (স্ত্রীং)। অর্থাৎ যাঁকে দুঃখে জানা যায়। কিংবা যিনি দুর্গ অর্থাৎ সংকট থেকে মুক্তি দেন। শব্দকল্পদ্রুমে আছে, যিনি দুর্গ বা দুর্গম নামে অসুরকে হত্যা করেছিলেন, তিনিই দুর্গা – “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা”। হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে – “দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিত। উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।। রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ। ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।” অর্থাৎ ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। পুরোটা সাজিয়ে নিলে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হল – দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে, যে দেবী “নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ”(সমস্ত দেবতা সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা। শব্দের ব্যুৎপত্তি যাই-ই হোক না-কেন, দেবী দুর্গা কখনো কোনোদিনই মানুষের সংকট মোচন সক্ষম হননি। তিনি সংকটমোচনকারী কেবল পুরাণের কাহিনিগুলিতেই। বাস্তবে তাঁর কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই।
যাই হোক, হিন্দুরা তাঁকে মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করে। দুর্গার অন্য নামগুলি হল – চণ্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুরসংহারিণী বা মহিষাসুরমর্দিনী, নারায়নী, মহামায়া, কাত্যায়নী ইত্যাদি। প্রত্যেক রূপেই আছে পৃথক পৃথক অসুর হত্যার কাহিনি। এঁদের কারোর আঠারোটা হাত, কারোর ষোলোটা হাত, কারোর দশটা হাত, কারোর আটটা হাত, কারোর-বা চারটি হাত। তবে দশ হাতের দুর্গা বা দশভূজাই বেশি জনপ্রিয়।তাঁর বাহন সিংহ এবং মহিষ নামক এক অসুরকে হত্যারত অবস্থায় দেখা যায়। বাংলার দুর্গাপুজোই অন্যত্র নবরাত্রি উৎসব হিসাবে উদযাপিত হয়।


বাংলায় মূলত বছরে দু-বার দুর্গাপুজো হয়। একটি আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া, অপরটি চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপুজো। বাংলায় বাঙালিদের কাছে শারদীয়ার দুর্গাপুজোই সবচেয়ে জনপ্রিয়। সারা পৃথিবীর বাঙালিরা এই সময়ের পুজোটিকেই মহাসমারোহে উদযাপন করে। এই পুজোকে অনেকে অকালবোধন বলে। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পুজো করছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাঁদের পুজো অনুচিত সময়। অকালের পুজো বলে এই পুজোর নাম হয় ‘অকালবোধন’। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পুজো করেছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পুজো করেছেন। এই জন্য স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে শরৎকালে দুর্গাপুজোর বিধান দেওয়া হয়েছে। বাংলার দুর্গাপুজোয় বোধনের মন্ত্রে উচ্চারিত হয় – “ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ। অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা।। অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।” অর্থাৎ “হে দেবী, রাবণবধে রামকে অনুগ্রহ করার জন্য ব্রহ্মা তোমার অকালবোধন করেছিলেন, আমিও সেইভাবে আশ্বিন মাসের ষষ্ঠী তিথিতে সন্ধ্যায় তোমার বোধন করছি”। কৃত্তিবাস ওঝার লেখা রামায়ণে রামচন্দ্রের তত্ত্বাধানে দুর্গাপুজোকেই অকালবোধন বলে। কারণ এই পুজো অকালে করা হয়েছিল লংকেশ্বর রাবণকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। কাহিনিটি এইরূপ – কৃত্তিবাসি রামায়ণ অনুসারে, রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। শিব তাঁকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন, শিবের স্ত্রী দুর্গার পূজা করে তাঁকে তুষ্ট করতে। তাতে রাবণ বধ রামের পক্ষে সহজসাধ্য হবে। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম শরৎকালে দুর্গার বোধন, চণ্ডীপাঠ ও মহাপূজার আয়োজন করেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম কল্পারম্ভ করেন। তার পর সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। হনুমান তাঁকে ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করে এনে দেন। দুর্গা রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। একটি পদ্ম না-পেয়ে রাম পদ্মের বদলে নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলে দুর্গা ‘আবির্ভূত’ হয়ে রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন। দুর্গাপুজোর অন্যতম অংশ হল সন্ধিপুজো। পুরাণ মতে দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধরত, তখন তাঁর দুই সেনা চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই ব্যক্তি দুর্গাকে আক্রমণ করে। তখন দুর্গার তৃতীয় নয়ন থেকে এক দেবীর আবির্ভাব হয়, যিনি চণ্ড ও মুণ্ডকে হত্যা করেন। এই কারণে দুর্গার অন্য নাম চামুণ্ডা। সন্ধিক্ষণে আসলে চামুণ্ডারই পুজো হয় ১০৮ পদ্ম ও ১০৮ প্রদীপ জ্বালিয়ে।


পদ্মফুল প্রসঙ্গে ব্যাখ্যাকারেরা বলেন -- পদ্মফুলের জন্ম পাঁক বা কাদায় জন্মায়। পাঁকে জন্ম হলেও পাঁক থেকে ওঠে গায়ে পাঁকের দাগ না নিয়ে। পদ্ম আসলে আমাদের এই ইঙ্গিতই দেয় যে, পরিবেশ শেষ কথা নয়। খারাপ পরিবেশে জন্ম নিয়েও অনেক ভালো কাজ করা যায়। পদ্ম যেহেতু কাদায় জন্মেও কাদা নিজ শরীরে না লাগিয়ে বেড়ে ওঠে, তেমনি মানুষেরও উচিত পরিস্থিতির দাস না-হয়ে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো। সংসারের আবর্জনা যেন মানুষের বিকাশে বাধা না-হয়। ১০৮ টা কেন ? কেন কম বা বেশি নয় ? হিন্দুশাস্ত্র মতে, ১০৮ সংখ্যাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু দেবতাদের থাকে অষ্টোত্তর শতনাম। ১০৮ পদ্ম, ১০৮ প্রদীপ। যোগের ক্ষেত্রেও ১০৮ সংখ্যাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আয়ুর্বেদ মতে, আমাদের শরীরে ১০৮ টি ‘পয়েন্ট’ আছে। হিন্দুশাস্ত্র যন্ত্রের পুজোয় বিশ্বাস করে। তাই শ্রীচক্র যন্ত্রে ৫৪ টি করে কোনো পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন হিসাবে দেখা হয়, যার থেকে সৃষ্টি, অর্থাৎ এখানেও ১০৮। তবে বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপুজোর কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।

যে সমস্ত পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা বিষয়ে আলোচনা পাওয়া যায়, সেগুলি হল – মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী ভাগবতে। এছাড়া দুর্গার বর্ণনা পাওয়া যায় মহাভারতের বিরাটপর্বেও। ঋগ্বেদে দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগ্বেদোক্ত দেবীসূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসাবেই মান্যতা দেওয়া হয়। দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। দেবী দুর্গা শাক্ত ধর্মে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব ধর্মে তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈবধর্মে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী হিসাবে অর্চনা করা হয়। হিন্দুধর্মে দুর্গা হল পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। কেনোপনিষদে বর্ণিত হৈমাবতীকে দুর্গা হিসাবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যিনি হরি সহায়িনী তথা হরিভক্তিপ্রদায়িনী। দুর্গাদেবীর ভিন্ন ভিন্ন অবতারগুলি হল -- কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদণ্ডিকা, সতী, পার্বতী, কৌশিকী ইত্যাদি। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, গণেশের জননী। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলিতে এবং আগমনী গানে দুর্গারূপে শিবজায়া হিমালয়-দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলি এবং তাঁর বিবাহিত জীবনের অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়।

জাপানে ১৮ হাতের দুর্গা রূপে প্রচলিত আছে। সম্ভবত ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়েই মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দুর্গার এমন রূপ জাপানে পৌঁছায়। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পুজোর প্রচলন ছিল জানা যায়। আর্য সভ্যতায় দেবতাদের প্রাধান্য থাকলেও, অনার্য সভ্যতায় কিন্তু দেবীদের প্রাধান্য ছিল। তাঁরা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। সিন্ধু সভ্যতা এবং ব্যবিলনীয় সভ্যতাতেও মাতৃপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আদি পর্ব থেকে শুরু সিংহবাহিনী দেবীর পুজো। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় সিংহবাহিনী দেবী ইনান্নার খোঁজ পাওয়া যায়। কুশান রাজা কনিষ্কের মুদ্রাতেও সিংহবাহিনী দেবী নানার খোঁজ পাওয়া যায়। এমনকি তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানেও প্রচলিত ছিল দেবীর মাহাত্ম্য।


খ্রিস্টীয় ৪০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়কালে শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ হয়। খ্রিস্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ ‘দেবীমাহাত্ম্যম্’। এই সময়েই মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলি মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। ‘দেবীমাহাত্ম্যম্’ গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতা সংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানগুলি একত্রিত করা হয়। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব নবম সহস্রাব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষিত হয়। মহাযান বৌদ্ধধর্মের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চিন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়। কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়া দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে। জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলো মধ্যে প্রাচীনতম মূর্তির তারিখ আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীর। ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎবিখ্যাত মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। ১৫০০ থেকে ১৬০০ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরও পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে। কম্বোডিয়া থেকে যে দুর্গা মূর্তিগুলি উদ্ধার হয়েছে, সেগুলির অধিকাংশই চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুরমর্দিনী। মূর্তিগুলির বৈশিষ্ট্য হল, এখানকার মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর ক্ষমতা ধারণ করেছেন, যা তাঁর চতুর্ভুজের শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম থেকে প্রতিষ্ঠিত।


দুর্গাকে অনেকে শস্যের দেবীর বলে থাকে। তাই তিনি ‘শাকম্ভরী’ বলে পরিচিতা। কিন্তু দুর্গাকে শাকম্ভরী বলার যৌক্তিকতা কী? শাকম্ভরী বিষয়ে চণ্ডীতে উল্লেখ আছে একটি শ্লোক। সেখানে বলা হয়েছে – “হে দেবগণ, অনন্তর আমি আত্মদেহসমুদ্ভূত প্রাণধারক শাকসমূহ দ্বারা যতদিন না বৃষ্টি হয়, ততদিন পর্যন্ত সমগ্র জগৎ পরিপালন করিব। এই জন্য আমি শাকম্ভরী বলিয়া জগতে খ্যাতিলাভ করিব।” ‘শাক’ শব্দটার মধ্যে দিয়ে এখানে জগতের সমস্ত শস্যকে বোঝানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি শুধু শস্যরক্ষার দেবী নন, তিনি স্বয়ং শস্য। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেছেন – “…. এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে এর পূজা করা হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজামূলে বোধহয় এই শস্যদেবীরই পূজা। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। … বলা বাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটি সচেতন চেষ্টা। এই শস্যদেবীর মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ। সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদি মাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।”


শস্য আর শস্যদেবীর সাধনার সন্ধান পাওয়া যায় রামায়ণে।সেই কারণেই সম্ভবত বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রচিত রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ বধার্থে অকালে দুর্গাপুজোর কাহিনি জুড়ে দিয়েছেন। জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রামায়ণের উৎস কৃষি’ গ্রন্থে রামকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘রমণস্থান’ হিসাবে। তিনি কার সঙ্গে রমণ করছেন ? সীতা কে ? সীতা লাঙ্গলরেখা, হলাগ্র, শস্যাধিদেবতা। রামও কিন্তু নবজলধর শ্যাম। অর্থাৎ তিনি শস্যের প্রতীক। লেখক মনে করেন, শস্যদেবী দুর্গার পুজো রাম গ্রহণ করেছে। তীর-ধনুক হাতে বীরত্বপ্রদর্শনকারী রাম শুধুমাত্র শিকারজীবী সম্প্রদায়ের কালের নয়, ইতিমধ্যে যখন ধীরে ধীরে কৃষিব্যবস্থা ও কৃষিযুগও শুরু হয়ে গেছে, তখন কৃষিবিদ্যা শিক্ষা ও প্রয়োগের উষাকালের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগের আরম্ভ হয়ে গেছে। কৃত্তিবাসের অহল্যা উদ্ধারের কাহিনির মধ্যেও রামচন্দ্রের সঙ্গে কৃষির যোগসূত্র পাওয়া যায়। রামের পাদস্পর্শে পাষাণী অহল্যার (পাথুরেবা অনুর্বর জমি) প্রাণসঞ্চার হয়। অতএব এমন মানুষই শস্যের পূজারী হবেন, এতে আশ্চর্যের কী ? দুর্গাকেও শস্যের দেবী ভাবতেও কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়।


বাঙালির দুর্গা কিন্তু উমা। তিনি ফি বছর পোলাপান সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন। বির্সজনে চোখের জলে বিদায় দেন বাংলার মায়েরা। তবে কারোর কাছে তিনি দুর্গা, কারোর কাছে তিনি পার্বতী, কারোর আবার তিনি মহিষাসুরমর্দিনী। তাহলে দেবীর বোধন কেন ? বোধন তো দেবদেবীদের জাগানোর জন্য প্রয়োজন হয় ! দেবী দুর্গা কি তবে ঘুমোচ্ছিলেন ? তাহলে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সকল কাজকর্ম কে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন ? – প্রশ্ন করেছেন পণ্ডিত যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর ‘বিদ্যানিধি’ (১৯৫১) গ্রন্থে। এসময় দেবদবীরা যদি ঘুমিয়েই থাকেন এবং তাঁদের জাগাতে বোধন করতে হয়, তাহলে দুর্গাপুজোর কয়েকদিন পরই কালীপুজো, তাঁকে বোধন করতে হয় না কেন ? পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর চক্রবর্তী মনে করেন – দুর্গার কোনো সন্তানসন্ততি থাকতে পারে না। চণ্ডী উদ্ধৃত করে তিনি বলেন – দুর্গাকে সেখানে শাকম্ভরী এবং কুমারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং তিনি আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক বা শারীরিক কোনোভাবেই তিনি সন্তানের জন্ম দিতে পারেন না।


কালিকাপুরাণ অনুসারে দুর্গাপুজো হওয়ার কথা মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে। কিন্তু ওই দিন যে সরস্বতী পুজো হয় ! দেবীপুরাণ অনুসারে সরস্বতী ও লক্ষ্মীপুজো প্রথম শুরু হয়েছে রাজস্থানে। সপ্তম শতাব্দীতে। পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর চক্রবর্তী বলেছেন, সরস্বতী ও ভদ্রকালী মিলেমিশে দুর্গা। বোধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্গাপুজো হওয়ার কথা সূর্যের দক্ষিণায়নের সময়। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই সময়কে শরৎপ্রবেশ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, যে সময় শরৎকাল শুরু হয়। বাংলায় বর্ষাকালের পরেই শরৎকাল আসে। যদিও শরৎকালেও যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হয়। আমাদের যদি অকাল বোধন মানতে হয়, তাহলে এটাও মানতে হয় যে রাম বর্ষাকালেই যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বর্ষাকাল তো যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত সময় নয় ! প্রত্যেক দেশেই আবহাওয়া ও জলবায়ু ভেদে নানাপ্রকারের সময়কাল আছে, যা সেনাবাহিনীর কাছে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত হতে হবে। যেমন ভারতের মতো দেশে বর্ষাকাল কখনোই যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত নয়। আমরা জানি আজাদ হিন্দ ফৌজ মণিপুর ও নাগাল্যান্ডকে ব্রিটিশমুক্ত ফেলে, সেসময় প্রবল বর্ষণে আজাদ হিন্দ বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। কুরুক্ষেত্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধ সবই শীতকালেই সংঘটিত হয়েছে। শীতকালই যুদ্ধের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। এমন হলে তো বাংলায় দুর্গাপুজোর সঙ্গে অকাল বোধনের যৌক্তিকতাই হারিয়ে যায়।
বাংলায় সব দুর্গাপুজো একরকম নয়। নানা বৈচিত্র্যে ভরা। যেমন -- এক অদ্ভুত দুর্গার পুজো হয় কেতুগ্রামের গোঁসাইগ্রাম এলাকার রায়বাড়িতে। এখানে কাটামুণ্ডু দুর্গাপুজো হয়। ৩০০ বছরের এই পুজোয় দুর্গার মূর্তি শুধুমাত্র গলা কাটা মাথা। গলার নীচ থেকে নেই। কেন এমন পুজো ? গল্প আছে – একদিন রায়বাড়ির জমিদার দিঘিতে স্নান করতে যান। স্নান করতে গিয়ে দেখেন এক অপরূপ সুন্দরী নারী স্নান করছেন। জমিদার জানতে চাইলেন – “কে তুমি ?” সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী ভ্যানিশ হয়ে গেল। জমিদারবাবু বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার সময় ঘোরের মধ্যে চলে গেলে তিনি স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেলেন দেবীকে। সেই দেবী বলছেন – “আমি দুর্গা। তোর পুজো নিতে এসেছি। আমাকে যে রূপে দেখছিস, সেই রূপেই পুজো করবি।” জমিদারবাবু ধড়হীন কাটামুণ্ডু দেবীকেই দেখেছিলেন। সেই থেকেই রায়বাড়িতে ধড়হীন কাটামুণ্ডু দুর্গাপুজো হয়ে আসছে।
আর-একটি বিচিত্র দুর্গাপুজো হল নবদ্বীপে। নবদ্বীপের ঠিক উল্টোদিকেই সোমড়াবাজার। এখানকার দুর্গা তিন হাতের। অষ্টাদশ শতকে মুর্শিদাবাদে নবাবের দেওয়ান ‘রায়রায়ান’ রামচন্দ্র সেন নবাবের সাহায্যে প্রভূত সম্পত্তির মালিক হন। কিন্তু মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কোনো এক কারণে রামচন্দ্র সেনের বাবাকে কারাদণ্ড দেন। শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ। সেই বিরোধ মেটাতে রামচন্দ্র সেনকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ২০ বিঘে নিষ্কর জমি দান করেন। এখানকার দুর্গাও স্বপ্নাদিষ্ট। সেই দুর্গা বলেছিলেন – “আমার তিন হাত থাকবে প্রকট। বাকি সাত হাত থাকবে লুকোনো। প্রকটিত তিন হাত হল সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়। মূর্তির দুটি হাত ডানদিকে এবং একটি হাত বামদিকে। ডানদিকের একটি হাতে খড়গ, অন্য হাতে ত্রিশূল এবং বামদিকের একটি হাতে সাপ আছে।
নবদ্বীপের থেকে খানিক দূরে পাটুলি গ্রামে ৩০০ বছর ধরে এক ধরনের দুর্গাপুজো হয়। বেশ অদ্ভুত। এখানে বৌদ্ধমতে দুর্গাপুজো হয়। দুর্গার মাত্র দুটি হাত, দশটি নয়। দেবীমূর্তির ঠিক পিছনেই দালানের কুলুঙ্গিতে বসানো থাকে বুদ্ধদেবের মূর্তি। অনুপস্থিত শিব। এমন মূর্তির স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালংকার। গল্প এমন –তাঁকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন – “আমি বলাগড়ের মান্নাবাড়ি থেকে তোর বাড়িতে আসতে চাই।” জবাবে মদনমোহন তর্কালংকার বলেন – “আমি গরিব মানুষ। কী খাওয়াব তোমায় ?” মদনমোহনের আর্তি শুনে দেবী বলেন – “আমার দুটি হাত থাকবে। দশ হাতে খাব না আমি। আমায় থোড়-মোচায় পুজো দিবি। মণ্ডা-মিঠাই লাগবে না।” প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এখানে আগে জ্যান্ত মানুষ বলি দেওয়া হত। এখন চালের পিটুলির মানুষ বলি দেওয়া হয়।

বাঁকুড়া জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে বাউড়ি সম্প্রদায়। ৩৫০ বছর আগে বাঁকুড়ার সাহারজোড়া গ্রামে বাউড়ি সম্প্রদায়ের উদ্যোগে শুরু হয় দুর্গাপুজো। গল্প আছে, বাউড়ি সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি মাঠে হলকর্ষণের সময় মাটির নীচ থেকে দুর্গার তিনটি চোখের আদলে তিনটি শিলাখণ্ড পান। সেই শিলাখণ্ডকেই মহামায়া রূপে পুজো শুরু করেন বাউড়ি পরিবার। পুরোনো ঐতিহ্য মেনে আজও প্রতিমা তৈরি না-করে মন্দিরে থাকা তিনটি শিলাখণ্ডকেই প্রতিমা রূপে পুজো করা হয়।
সীমান্ত-শহর বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার প্রাচীন দুর্গাপুজো হল ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামাবাড়ির পুজো। এখানে দুটি প্রমাণ সাইজের হাতে অসুর বধ করতে দেখা গেলেও বাকি আটটি হাত অতি ক্ষুদ্র। এই প্রতিমাকে তাই ‘বিড়ালহাতি’ বলে। ৩৫০ বছরের এই পুজোর সূচনা করেন গৌড়হরি বন্দ্যোপাধ্যায়। গৌড়হরি বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, কোন্ রূপে তাঁর পুজো হবে। এমন মূর্তিই পূজিত হয়ে আসছে। গৌরহরি ছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটো দাদু।


দুর্গা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা ব্যক্তির স্বপ্নাদেশে নানা রূপে পরিবর্তিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এতটাই রূপ বদল হয়েছে যে, সব জানা সম্ভব নয়। সব আলোচনাও সম্ভব নয়। ভাগবত পুরাণে দুর্গাকে বলা হয়েছে, তিনি সব ধরনের শবরদের আরাধ্যা – “সর্বশবরানাং ভগবতী”। শবরদের দুটি ভাগ – একটি পর্ণশবর, অপরটি নগ্নশবর। পর্ণশবরদের দুর্গার নাম ‘পর্ণশবরী’। তাহলে নগ্নশবরদের দুর্গার নাম কি ‘নগ্নশবরী’ ? নগ্ন শবররা উলঙ্গই থাকেন। পর্ণশবরীরা লজ্জা নিবারণ করে পাতার পোশাকে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে দুর্গা যখন নগ্নশবরী এবং অবশ্যই গোষ্ঠীর প্রধানা, তখন আমরা তাঁকে জেনেছি ‘অপর্ণা’ নামে। দশমহাবিদ্যায় দুর্গার প্রথম যে রূপ পাই, সেটাই অপর্ণা। পর্ণশবরীর দুর্গা যদি পাতার পোশাক পরিধান করেন, তবে নগ্নশবরীর দুর্গা কেন পোশাক পরিধান করবেন ? নগ্ন থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। গ্রামবাংলায় বনদুর্গা পূজিত হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি দুর্গার বদলে ‘চণ্ডী’ নামেই পরিচিতা। এছাড়া নবদুর্গা, শুভদুর্গা, রালদুর্গা, শুভচণ্ডী, রণচণ্ডী, রথাইচণ্ডী, ওলাইচণ্ডী, উড়নচণ্ডী, অবাকচণ্ডী, বসনচণ্ডী, উদ্ধারচণ্ডী, বকাইচণ্ডী, ঢেলাইচণ্ডী, মঙ্গলচণ্ডী, জয়মঙ্গলচণ্ডী, কলুইমঙ্গলচণ্ডী, হচিষমঙ্গলচণ্ডী, সংকটামঙ্গলচণ্ডী, নাটাইমঙ্গলচণ্ডী প্রমুখ দেবীরূপও পাওয়া যায়।

প্রসঙ্গত ভারতে প্রথম দুর্গা মূর্তিটির সন্ধান মেলে প্রথম খ্রিস্টাব্দের রাজস্থানের নাগোর নামে গ্রামে। এই মূর্তিটা ছিল মহিষমর্দিনী, মহিষাসুরমর্দিনী নয়। তিনি গৌরবর্ণা নন, কৃষ্ণ বা কালো রঙের। এই দুর্গার কোনো হাতে কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই। যদিও হাত মাত্র দুটি, স্বাভাবিক মানুষের মতোই। নগ্নশবরী মহিষমর্দিনী দুর্গা এখানে সম্পূর্ণ নগ্ন। নগ্ন অবস্থায় তিনি মহিষের লেজ মুচড়িয়ে ফসলের ক্ষেত থেকে তাড়াচ্ছেন। প্রায় উলঙ্গিনী দুর্গাকে পাওয়া যায় মধ্য ভারতেও, চতুর্থ শতকে। তাঁর উর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত। আর কোমর থেকে উরু পর্যন্ত যেটুকু বস্ত্র আছে, তা শতছিন্ন। এই দুর্গার চারটি হাত, যিনি মহিষাসুরকে হত্যা করছেন। এই মহিষাসুরের সারা শরীর মহিষের হলেও, মাথাটা কেবল মানুষের।

প্রাচীন দুর্গামূর্তিগুলিতে দুর্গাকে মূলত মহিষ বা মোষ হত্যাকারিণী হিসাবেই পাওয়া যায়, মহিষ নামের কোনো ভয়ংকর অত্যাচারী অসুর নয়। ষষ্ঠ শতাব্দীর ‘শিলাপদ্দিকারম’ গ্রন্থে যে দুর্গার উল্লেখ আছে, সেখানেও কোনো মহিষাসুরকে পাই না। উল্লিখিত দুর্গার চারটি হাত। ডানদিকের একটি হাতে ত্রিশূল। বাকি দুটি হাতে আছে যথাক্রমে শঙ্খ ও চক্র। বাকি রইল একটি হাতে, সেটি বরাভয় মুদ্রা। তিনি কাটা একটি মহিষের মুণ্ডুর উপর দাঁড়িয়ে আছেন।

এক শতাব্দী থেকে আর-এটি শতাব্দীতে যত পৌঁছেছে, দুর্গার হাত ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মহিষ বা মোষ থেকে মহিষাসুরে রূপান্তরিত হয়েছে। দুর্গা হয়ে গেলেন মহিষমর্দিনী থেকে মহিষাসুরমর্দিনী। কেন মহিষাসুর ? অনেকে বলেন, মহিষাসুর হলেন অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত। তাঁকে এক অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করেন আর্যদেবী দুর্গা। সেই কারণেই বোধহয় আজও অসুর পুজো হয়। ঝাড়খণ্ড ও জলপাইগুড়ি জেলায় ‘অসুর’ নামে একটি আদিবাসী গোষ্ঠী বসবাস করে। ঝাড়খণ্ডের এই অসুর সম্প্রদায়ের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় দশ হাজার। মহিষাসুরের উপাসক বিহার, মধ্যপ্রদেশ, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যায়। তাঁরা দাবি করেন যে, তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর। এরা দুর্গাপুজোর সময়টাতেই মহিষাসুরের পুজোর মধ্যে দিয়ে শোক পালন করেন। পুরুলিয়ার ভুলুরডিতে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অসুরপুজো শুরু হয়, ২০০৩ সালে। নৃতাত্ত্বিকদের মতে বাংলার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর (নিষাদ, কোল, ভীল ইত্যাদি) মানুষেরা অনার্য অসুর গোষ্ঠী। আদিবাসী লোককথা অনুযায়ী ‘হুদুড়দুর্গা ঘোডাসুর’, অর্থাৎ রাজা মহিষাসুর যুদ্ধে বিদেশি আর্যনারী কর্তৃক পরাজিত হয়ে রাজ্যপাট হারায়। বাঙালি জীবনে ষাঁড়, বলদ, মহিষ বা মোষই প্রধান। তাঁদের রক্ষাকর্তা হলেন মহিষাসুর। সেই রাজা মহিষাসুরকে হত্যা করেন দুর্গা। উদ্দেশ্য, বৈদিক তথা হিন্দুত্বের বশ্যতা স্বীকার করানো। দুর্গা হলেন বিপদরক্ষিণী মাতৃত্বের প্রতীক দেবী, অন্যদিকে অসুর হল অনুন্নত ঘৃণ্যতম জীব। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মহিষাসুর সাহদত দিবস’ পালন করে ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা। বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং মূলনিবাসী বহুজন সমাজ নিজেদের মহিষাসুরের উত্তরসুরী বলে চিহ্নিত করে। দাশাই পরব অসুর আদিবাসীদের একটি শোকপালনের পরব। পাঁচদিন ধরে চলে এই শোকপালন। কারণ বিদেশিরা তাঁদের প্রিয় রাজাকে এক নারীকে দিয়ে হত্যা করিয়েছে। তাই নারীর ছদ্মবেশে যোদ্ধারা তাঁদের রাজাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। আবার মুণ্ডা, কোল সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা দাবি করেন দুর্গা তাঁদের মেয়ে। হাঁড়ি সম্প্রদায়েরও দাবি দুর্গা (চণ্ডী) তাঁদের মেয়ে। দেবতারা তাঁকে দিয়ে তাঁদের রাজাকে হত্যা করায়। আজও তাঁরা ‘হায় রে, ও হায় রে’ বলে ভুয়াং নাচের মাধ্যমে তাঁদের রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। মালদা, দিনাজপুর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতেও অসুরপুজো ছড়িয়ে গেছে। তাঁদের কাছে এটা মানবতার পুজো। অসুরের (সুরাপায়ী নয় যাঁরা) পুজো। সুষমা অসুর এবং তাঁর আদিবাসী গোষ্ঠী ঝাড়খণ্ডের লতেহার জেলার সখুপানি গ্রামের বাসিন্দা। সুষমা অসুর জানিয়েছেন, তাঁরা দেবী দুর্গার পুজো করেন না। মহিষাসুর হত্যার দিন, অর্থাৎ দশমী বা দশেরা অন্যরকমভাবে পালন করেন অসুর সম্প্রদায়। দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে মহিষাসুরের দেহের যে যে জায়গা থেকে রক্তপাত হয়েছিল, অসুর সম্প্রদায়ের লোকেরা সেইসব জায়গায় তেল লাগান। এছাড়া শোকগাথা পাঠ হয়। মেয়েরা সাদা থান পরেন। ‘আলাসা সাঁওতাল’ নামক আদিবাসী সম্প্রদায় মহিষাসুরের সঙ্গে সঙ্গে রাবণের মৃত্যুর শোকও পালন করেন। ঝাড়খণ্ডের ঘাগরা, চৈনপুর, বিষণপুর গ্রামের বাসিন্দারা তাঁদের ঘরের জানলা-দরজা সব বন্ধ করে রাখে, যাতে দুর্গাভক্তদের আয়োজিত পুজোর চারদিন আলোর রোশনাই আর ঢাকের আওয়াজ কানে না আসে। এঁদের প্রত্যেকেরই পদবি ‘অসুর’। যেমন – বিমল অসুর, সুমন অসুর, কমলা অসুর, সুষমা অসুর ইত্যাদি। এঁদের কাছে দুর্গাপুজো কোনো পুজো নয়, একটি হত্যাকাণ্ড। সুমতি অসুর মনে করেন, “এই উৎসব আমাদের পূর্বপুরুষদের অপমান করার সামিল। মানুষকে হত্যা করা কোনো উৎসব হতে পারে না।”


অনেকে মনে করেন, একদা ফসলের ক্ষেতে এক দঙ্গল বুনো জঙ্গি মহিষের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। সেই মহিষের দল ক্ষেতের পর ক্ষেত ফসল নষ্ট করে দিচ্ছিল। কেউই সেই বুনো মহিষদের বাগে আনতে পারছিল না। মহিষের শিংয়ের বহু শবর আধিবাসীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। এমতাবস্থায় এক সাহসিনী শবরকন্যা মহিষনিধনের সংকল্প কাঁধে তুলে নেন এবং মহিষদের নির্বংশ করে ফসল রক্ষা করেন। শবরদের কথা আগেই বলেছি। অর্থাৎ দুর্গা এখানে শবর জনজাতির প্রতিনিধি।
দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র লোক-দেবতাদের বার্ষিক উৎসবে মোষ বলি দেওয়া হয়। এখানকার এই ব্যাপক পশুবলির প্রধান অংশই মোষ। তেলুগুভাষীদের গ্রামে পেড্ডাম্মার পুজো শেষে মোষ বলি হয়। বলিপ্রদত্ত মোষগুলির সারা শরীরে হলুদ মাখানো হয়। তারপর তাদের গলায় পরানো হয় নিমপাতার মালা। দুপুরবেলা দুটো নাগাদ মোষটিকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। গ্রামের ‘অস্পৃশ্য’ জাতি মালা ও মাদিগারা ‘দেবীর বলি মোষ আসছে’ বলতে বলতে বাজনা বাজাতে থাকে। এরপর বলি। বলির পর মোষের কাটা মাথার সামনে মোষেরই সামনের দুটি পা আড়াআড়িভাবে রাখা হয়। মোষের কাটা মাথার উপর রাখা হয় একটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ। বলির মাংসের একমাত্র দাবিদার মালি ও মাদিগা সম্প্রদায়ের মানুষরা। গ্রামের নাম গুড়িবাদ। মুসলিপত্তনম থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি তেলুগু গ্রাম। এই গ্রামে দেবী পাল্লালাম্মার পুজো হয় মোষ বলি দিয়ে। বলিপ্রদত্ত মোষটির নাম হয় ‘দেবরাপোটু’। বলির পর মুণ্ডুহীন ধড়টি নিয়ে গ্রামবাসীরা ‘পোশি, পোশি’ বলে চিৎকার করে গ্রাম পরিক্রমা করে। ‘পোশি পোশি’ মানে খাবার এসেছে। কন্নড় ভাষাভাষী অঞ্চলেও মোষ বলি দেওয়া হয় দেবতার উদ্দেশে। তামিল ভাষাভাষী অঞ্চলের গ্রাম-দেবতা ‘মাদুরাইপরণ’ বা ‘মুনাদিয়ান’-এর বার্ষিক উৎসবে মোষ বলি দেওয়া হয়। বলির পর মোষের কাটা মুণ্ডু রাখা হয় পিদারি দেবীর সামনে। স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন, পিদারি দেবী মোষের রক্ত পান করেন। [এ বিষয়ে আরও জানতে চাইলে অচিন্ত্য বিশ্বাসের অনূদিত (মূল লেখক : হেনরি হোয়াইটহেড) ‘দক্ষিণ ভারতের গ্রাম দেবতা’ গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন।]


অতএব লক্ষ করলে দেখা যায়, মোষ বলি মূলত দলিত আদিবাসীরাই দিত এবং তার মাংস খেত। দক্ষিণ ভারতের গ্রাম-দেবতারদের সামনে যাঁরা মোষ বলি দেয় তাঁরা সবাই তথাকথিত নিচু জাতের মানুষ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তেলুগু কবি ও প্রাবন্ধিক কাঞ্চা ইলাইয়া তাঁর ‘Buffalo Nationalism’ গ্রন্থে লিখেছেন – “মোষকে সর্বপ্রথম পোষ মানায় দ্রাবিড় মানুষরা। আর্য ব্রাহ্মণরা পশুপালন জানত না। গো-জাতীয়তা হল দ্রাবিড়-বিরোধী ও দলিত বহুজন বিরোধী। মোষ পালন শুরু করেছে ভারতের আদিম জনজাতি। মোষ কখনোই ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের দৃষ্টিতে পবিত্র নয়। এদেশে গোরু পবিত্র, মোষ ঘৃণ্য। ঠিক যেমন দলিত আদিবাসী বহুজন সমাজের কৃষ্ণ সুন্দরীদের উপেক্ষা দেখায় ভারতবর্ষ।” এই তত্ত্বকে দাঁড় করালে দুর্গা মোষ নিধন ঘৃণার প্রতিভূ হয়। ঘৃণ্য, তাই বধযোগ্য।
মহিষাসুরের মহিষকে একরকমভাবে পাওয়া গেল। এবার চলি মহিষাসুরের অসুরের সন্ধানে। অসুর একজন পূর্ব সেমিটিক দেবতা। মেসোপটেমীয় ধর্মের অ্যাসিবিয়ান প্যানথীয়ন মধ্যে তিনি প্রধান। ইনি প্রধানত মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান নাম ইরান) উত্তরের অর্ধেক এবং উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কিছু অংশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মাইনর অঞ্চলে পূজিত হতেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রাচীন অসুরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী অসুরনগরের দেবতা ছিলেন অসুর। উৎসগতভাবে অসুরের কোনো পরিবার ছল না। পরবর্তীতে দক্ষিণ মেসোপটেমীয় প্রভাবে তাঁকে নিপ্পুরের প্রধান দেবতা এনিলের সমতুল বিবেচনা করা হয়। খ্রিস্টপূর্বাব্দ তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরু থেকে খ্রিস্টপূর্বাব্দ আঠারো শতকে হামুরাবি ব্যাবিলন ভিত্তিক একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত এনিল দক্ষিণ প্যানথিয়নের প্রধান দেবতা ছিলেন। এরপরে দক্ষিণে মারদুক এনিলের স্থানে প্রধান দেবতা হিসাবে পূজিত হতে থাকেন। উত্তরে এনিলের স্ত্রী নিনিল এবং তাঁর পুত্র নিনুর্তা ও জাবাবাকে অসুরের স্ত্রী-পুত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এটা খ্রিস্টপূর্ব চোদ্দো শতক থেকে শুরু করে সপ্তম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন অসুরীয় রাজত্বকালের বিজয়ের সময়ে দেবতা অসুরের আধিপত্য বিস্তারের জন্য রাজকীয় প্রোপাগান্ডা চালানো হত যে, পরাজিত পক্ষ হেরে গেছেন, কারণ তাঁদের দেবতা তাঁদেরকে ত্যাগ করেছেন। কিছু পণ্ডিত মনে করেন, আসারীয় আইকনোগ্রাফিতে বারবার যে পাখাওয়ালা সূর্যদেবতার কথা বলা হয়েছে, তিনি আসলেই অসুর। অনেক আসারীয় রাজা নিজেদের নামের সঙ্গে অসুর নাম যুক্ত করেছেন। যেমন – আসুরনাসিরপাল, আসুর আহা ইদ্দিনা, আসুরবানিপাল প্রমুখ।

অসুর হল হিন্দু পুরাণ অনুসারে দেবশত্রু মহাবল জাতিবিশেষ। যেমন দৈত্য, দানব ইত্যাদি। বেদের প্রাচীনতর অংশে এবং পারসিক আবেস্তায় অসুর > অহূর = দেবতা।অসুর একটি বিলুপ্ত প্রাচীন ভাষা। খ্রিস্টীয় আট শতকের আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থে নগ্ন (নিকোবর), বালি ও যবদ্বীপের র-কারবহুল এক প্রকার ভাষার উল্লেখ আছে। এ ভাষাই ‘অসুর ভাষা’ নামে পরিচিত। এ ভাষায় যাঁরা কথা বলত তাদেরকে ঋগ্বেদে ‘অসুর’ বলা হয়েছে। বৃহৎ বঙ্গেও এই ভাষার প্রচলন ছিল। বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, গৌড় ও পুন্ড্র অর্থাৎ পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের লোকেরা এই ভাষায় কথা বলত বলে ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থে তাঁদের ‘অসুর’ ভাষাভাষী বলা হয়েছে -- “অসুরানাং ভবেত বাচা গৌড়পুন্ড্রোদ্ভবা সদা”। তাঁরা ছিল আদিস্তরের অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠী। ভারতের কোল-মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান ভাষা এখনও ‘অসুর’।অর্থাৎ ‘অসুর’ ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁরাই ‘অসুর’। প্রাচীন রাঢ় এবং সুহ্ম প্রদেশে খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক থেকে এই ‘অসুর’ ভাষার প্রচলন থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময় জৈন প্রচারক মহাবীর এখানে এলে লোকে ‘ছু ছু’ বলে চিৎকার করে তাঁকে কামড়ানোর জন্য কুকুর লেলিয়ে দিত। ‘ছু ছু’ অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা। এ থেকেই বাংলায় ‘চু চু’ বা ‘তু তু’ ধ্বনিতে কুকুর ডাকার রেওয়াজ চালু হয়। এ দুই অঞ্চলের সাঁওতাল ও কোলদের পূর্বপুরুষরা এই ভাষায় কথা বলত। পরবর্তীতে অসুরদের দেবতাদের আজন্ম শত্রু বলে হিন্দু পুরাণসমূহে দেখানো হলেও আগে অসুররাও পেত দেবতাদের সমমর্যাদা। অসুরদের ইতিহাসের শুরু ও প্রথম উল্লেখ ঋগ্বেদে, যেটি মুখ্য পুরাণগুলির থেকে প্রায় হাজার দুই বছর আগে লেখা। শুরুর দিকে রচিত মণ্ডলগুলিতে, যেমন দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডলে, দেবতাদের বার বার সম্বোধন করা হয়েছে ‘অসুর’ বলে। দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডলে মোট উনত্রিশ বার বিভিন্ন দেবতাকে ‘অসুর’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার অগ্নিকে ‘অসুর’, মোট সাতবার। এছাড়াও সবিতা, রুদ্র, মিত্র-বরুণ, পর্জন্য, অর্যমা, বায়ু – সকলকেই ‘অসুর’ বলা হয়েছে। পঞ্চম মণ্ডলের এই ঋক্‌টা দেখা যাক – “অগ্নি হব্য প্রদান করিলে তৃপ্তিলাভ করেন, তিনি অসুর, সুখদাতা, ধনাধিপতি, গৃহদাতা, হব্যবাহক, সৃষ্টিকর্তা, দূরদর্শী, আরাধ্য, যশস্বী ও শ্রেষ্ঠ (ঋগ্বেদ ৫/১৪/১)”; এরকম উদাহরণ পঞ্চম মণ্ডলেই আরও আটবার আছে। ষষ্ঠ মণ্ডলের এক জায়গায় (ঋগ্বেদ ৬/২২/৪) দেখা যাচ্ছে ইন্দ্রকে অসুরাঘ্ন অর্থাৎ অসুরহন্তা বলা হয়েছে, সেটাই প্রথমবার অসুরদের সঙ্গে ইন্দ্রের কোনো যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে দেখা যাচ্ছে, সেখানে দেখি ইন্দ্র পিপ্রু নামের এক অসুরকে পরাজিত করেছেন (ঋগ্বেদ ১০/১৩৮/৪)। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের আরও কয়েক জায়গায় এবং অথর্ববেদ, বহুবার দেবতাদের হাতে অসুরদের যুদ্ধে পরাজয়ের কথা দেখি’। ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাভাষী জনজাতিগুলি, যাঁদের সাধারণ ভাবে আর্য বলা হয়, তাঁদের ভারতবর্ষে আসার মাইগ্রেশান পথে পড়েছিল ইরান। আর্যদের একটি শাখা সেখানে বিকশিত হয়। সেজন্য প্রাচীন ইরানীয়ানদের ধর্মগ্রন্থ জেন্দ-আবেস্তার ভাষার সঙ্গে প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতের অনেক মিল দেখতে পাই। পারসিকরা অগ্নি উপাসক। এদিকে অগ্নি হলেন ঋগ্বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা। আবেস্তার প্রধান আরাধ্য আহুরা মাজদা হচ্ছেন প্রধান দেবতা এবং আবেস্তার দেবতারা হলেন মন্দ’। সেসময় বৈদিক যুগের প্রভাবে ইরানীয়রাও ক্রমশ একেশ্বরবাদের দিকে ঝুঁকছিল। তাঁদের কাছে বৈদিক ভারতীয়দের বহুদেবতার পূজা নিন্দনীয় মনে হল এবং দেবতারা মন্দ লোক হয়ে দাঁড়াল। উল্টোদিকে ভারতীয়রাও অসুরদের মায়াবী ও মন্দ বলতে লাগল। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের আর-একটা সুক্তে (ঋগ্বেদ ১০/১২৪) অগ্নি বলছেন – “আমি পিতা অসুরকে বিদায় জানাচ্ছি। আমি অ-দেবতাদের থেকে দেবগণের কাছে গুপ্তপথে ফিরে এসেছি ও ইন্দ্রকেই বরণ করছি। আমি ফিরে আসার পর অসুরদের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।” এই শ্লোকের মধ্য দিয়ে এখানে প্রচ্ছন্নভাবে দেবতা (সুর) ও অ-দেবতাদের (অসুর) দ্বন্দ্বের কথা বলা হচ্ছে, যার শেষে অগ্নি ঋগ্বেদের দেবতাদের কাছে ফিরে আসেন। বেদে ১০৫ বার ‘অসুর’ শব্দের উল্লেখ আছে। তার মধ্যে ৯০ বারই প্রশংসাসূচক। যেমন -- “অসুরঃ অসু ক্ষেপণে শত্রুণ্ ইত্যসুরঃ”। যাঁরা শত্রুদের উপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে পটু তাঁরা অসুর। এবং “অসুন্ প্রাণান রাতি দদাতি ইত্যসুরঃ”। যাঁরা প্রাণদান করে, যাঁদের মধ্যে দুর্দম প্রাণশক্তির প্রকাশ দেখা যায়, সেই সমস্ত শক্তিশালী বীররাই অসুরপদবাচ্য। বৈদিক যুগের শেষভাগে যজ্ঞবাদী আর্যদের সঙ্গে অসুরদের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। আর্য অসুরজাতির অধিকাংশ ভারত ত্যাগ করে পারস্য ও তুর্কীস্থানে গিয়ে বাস করতে থাকেন। বাকিরা যাঁরা রইলেন, তাঁরা প্রয়াগ, ছোটোনাগপুর, তিব্বত ও কামরূপের দিকে চলে যান। অসুরদের যে বড়ো দলটি ভারতের বাইরে চলে গিয়েছিল, আজ থেকে ৫০০০ হাজার বছর আগেই তাঁরাই ব্যাবিলনে এক সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এই সাম্রাজ্যের নামই অসুর বা আসীরিয়া। টাইগ্রিস নদীর উপকূলে এদের যে রাজধানী স্থাপিত হয়, সেই রাজধানীর নাম অসুর। ভারতীয় অসুররা দুর্গ নির্মাণে দক্ষ ছিলেন। বেদে এ বিষয়ে বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। শম্বর অসুরের ছিল ৯০ টি দুর্গ (ঋগ্বেদ ১/১৩০/৭)। বর্চী অসুরের লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা ছিল, তিনি নিজেও ছিলেন দুর্দান্ত বীর (ঋগ্বেদ ১০/১৫১/৩। পিপরু অসুরের বড়ো কেল্লা ছিল। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে দেখি ইন্দ্র পিপরুর কেল্লা নষ্ট করে দিচ্ছেন (ঋগ্বেদ ১০/১৩৮/৩)।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে -- “জম্বুদ্বীপের তামাম সভ্যতা সমতল ক্ষেত্রে, বড়ো বড়ো নদীর উপর, অতি উর্বর ভূমিতে উৎপন্ন — ইয়ংচিকিয়ং, গঙ্গা, সিন্ধু, ইউফ্রেটিস তীর। এ সকল সভ্যতারই আদি ভিত্তি চাষবাস। এ সকল সভ্যতাই দেবতাপ্রধান। আর ইউরোপের সকল সভ্যতাই প্রায় পাহাড়ে, না-হয় সমুদ্রময় দেশে জন্মেছে — ডাকাত আর বোম্বেটে এ সভ্যতার ভিত্তি, এতে অসুরভাব অধিক। বর্তমানকালে যতদূর বোঝা যায়, জম্বুদ্বীপের মধ্যভাগ ও আরবের মরুভূমি অসুরের প্রধান আড্ডা। ওই স্থান হতে একত্র হয়ে পশুপাল মৃগয়াজীবী অসুরকুল সভ্য দেবতাদের তাড়া দিয়ে দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিয়েছে। ইওরোপ খণ্ডের আদিমনিবাসী এক জাত অবশ্য ছিল। তাঁরা পর্বতগহ্বরে বাস করত। যাঁরা ওর মধ্যে একটু বুদ্ধিমান, তাঁরা অল্প গভীর তলাওয়ের জলে খোঁটা পুঁতে মাচান বেঁধে, সেই মাচানের উপর ঘর-দোর নির্মাণ করে বাস করত। চকমকি পাথরের তীর, বর্শার ফলা, চকমকির ছুরি ও পরশু দিয়ে সমস্ত কাজ চালাত।” নর্ডিক আর্য আগমনের বহু পূর্বে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে আলপাইন মানবগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। এই আলপাইন মানবগোষ্ঠীর এক বৃহত্তম অংশকে আবার অসুর জাতিও বলা হয় । প্রাচীন পারস্যের অসুর সভ্যতাই ছিল বিশ্বের এক বিস্ময়। একথা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য যে, তাম্রযুগে আবার প্রাচীন পারস্যের এই অসুর সভ্যতাই হল বিশ্বের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা । রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে -- “আর যে সময়ে তথাকথিত পশুপালক নর্ডিক আর্যরা ছিলেন ভারতীয় অসুরদের কাছে যাযাবর পশু-মানব বলেই গণ্য।” সিন্ধু সভ্যতা প্রবর্তনের সমসাময়িককালে এই অসুর জাতির এক বৃহত্তম অংশ পূর্ব ভারতেও এক নতুন সভ্যতা প্রবর্তন করেন। পূর্বভারতেও কেবলমাত্র আলপাইন অসুর জাতির দ্বারা করতোয়া এবং গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল উন্নত নগরকেন্দ্রিক আর এক অসুর সভ্যতা। যার অধীশ্বর ছিলেন আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুর জাতির গর্বিত কোল, শরব, পুলিন্দ, ডোম, চণ্ডাল (নমঃ), পৌণ্ড্র, কৈবর্ত্য, ইত্যাদি সম্প্রদায়সমূহ। অতীত বঙ্গ রাজ্যে ছিল যেমন নমঃশূদ্রদের (চণ্ডাল) আধিপত্য, আসামের কামরূপে ছিল কৈবর্ত্যদের আধিপত্য, তেমনি পৌণ্ড্রদের আধিপত্য ছিল পৌণ্ড্র রাজ্যে। সপ্তম শতকেও কামরূপের রাজারা দানবাসুর, হাটকাসুর, সম্বরাসুর, রত্নাসুর, নরকাসুর প্রভৃতি অসুরদের পূর্বপুরুষ বলে পরিচয় দিতেন। মহাভারতের আদি পর্বেই দেখা যায় অসুররাজ বলির পাঁচ পুত্রের নামানুসারে পূর্বভারতের পাঁচটি রাজ্যের নামকরণ হয় যথাক্রমে অঙ্গ (পূর্ব বিহার), বঙ্গ, কলিঙ্গ (সুবর্ণরেখা নদী থেকে গোদাবরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত উড়িশা ও অন্ধ্রের কিছু অংশ), সুহ্ম ও পুণ্ড্র (দক্ষিণ বঙ্গ)। ডঃ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারছি – “বৈদিক যুগে আর্যরা বিহারের মিথিলা পর্যন্ত দখল করলেও, শেষপর্যন্ত তাঁরা পূর্ব ভারতের আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুর জাতির কাছে বারংবার পরাজিত হয়ে পূর্বভারত দখলের যাবতীয় স্বপ্ন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ এই অসুর জাতির যেমন ছিল এক বিশাল হস্তীবাহিনী, তেমনি ছিল তাঁদের শক্তিশালী এক রাজতন্ত্রও। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (১/১৪) এই অসুর জাতির রাজতন্ত্রের মধ্যে একমাত্র প্রাচ্যদেশেই এই একরাট বা সম্রাট ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।”
বৈদিক অসুরই পারসিক ধর্মগ্রন্থ জেন্দ-আবেস্তাতে ‘আহুর’। পরবর্তীকালে ‘অসুর’ শব্দের অর্থ বদলে গিয়েছে। মহাভারতের মতে, দেবতার সঙ্গে বিরোধ করে এবং সমুদ্র মন্থনকালে যাঁরা অমৃতের ভাগ থেকে বঞ্চিত হয়, তাঁরাই ‘অসুর’ নামে অভিহিত হন। ঐতরেয় ও শতপথ ব্রাহ্মণের মতে, প্রজাপতির প্রাণবন্ত নিঃশ্বাস থেকে অসুর সৃষ্টি হয়েছিল। বিষ্ণুপুরাণের মতে, ব্রহ্মার জঙ্ঘা থেকে অসুরদের জন্ম হয়েছিল। এঁরা যাগযজ্ঞ ধ্বংস করত। এঁরা অন্ধকারের প্রতীক। অসুরদের মধ্যে তিনজনকে প্রধান হিসাবে ধরা হয়। এই তিনজন অসুর হলেন হিরণ্যকশিপু, বলি ও প্রহ্লাদ। এঁরা অসুরদের ‘ইন্দ্র’ নামে পরিচিত। এছাড়া পুরাণখ্যাত অসুরদের মধ্যে ছিলেন মহিষাসুর, শুম্ভ, নিশুম্ভ, মধু, কৈটভ প্রমুখ।
এবার আসা যাক দুর্গার মহিষাসুর প্রসঙ্গে। মহিষাসুর ছিলেন শূর। শূর শব্দের অর্থ রাজা। উপজাতীয়রা রাজাদের রাজমুকুটে গোষ্ঠীর প্রতীক বা টোটেম ব্যবহার করতেন। প্রাণীদেরকেই তাঁরা টোটেম হিসাবে বেছে নেন। আমরা রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণগুলিতে প্রচুর টোটেমের কথা জানতে পাই। যেমন রামায়ণের গরুড় একটি টোটেম। প্রাণীগুলিকে তাঁরা বেছে নেন বিশালত্ব, শৌর্য, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি গুণের কারণে। সেই সূত্রেই আমরা পুরাণগুলিতে পাই বকাসুর, হস্তিকাসুর, মহিষাসুর, বিড়ালাক্ষি নামে অসুরদের। বাস্তবে তাঁরা অতি প্রতাপশালী ও নির্ভীক রাজা ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের রাজ্যপাটও ছিল। যেমন মহিষাসুর ছিলেন মহীশূরের রাজা। অসম যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে তাঁরা ধ্বংস হলেও তাঁদের বংশধররা আজও আছেন।
মহিষাসুর হিন্দু পুরাণে বর্ণিত একটি চরিত্র। বিভিন্ন প্রাচীন হিন্দু কাহিনিতে মহিষাসুরকে ‘অপদেবতা’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কাহিনি এরকম -- রম্ভ নামক এক অসুর মহাদেবকে তপস্যায় প্রীত করে তাঁর নিকট ত্রিলোকবিজয়ী পুত্রবর প্রার্থনা করায় মহাদেব তাঁকে সেই বর প্রদান করেন। রম্ভ এই বরলাভ করে অসুররাজ্যে ফেরার পথে এক মহিষরূপী অপ্সরাকে দেখে কামার্ত হন। কামার্ত রম্ভ ওই মহিষীকে হরণ করে বনের মধ্যে তাঁর সঙ্গে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হন। যৌনমিলনের পরে ওই অপ্সরাকে বিবাহ করে রম্ভ। বিবাহের পর পুনরায় তাঁরা যৌনমিলনে আবদ্ধ হলে মহিষীরূপী অপ্সরার পিতা মহিষের রূপ ধারণ করে মিলনরত রম্ভকে হত্যা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর যক্ষরা তাঁর মরদেহ চিতায় স্থাপন করে। রম্ভর স্ত্রী শোকাহত মহিষী সহমরনের উদ্দেশ্যে চিতায় আরোহণ করেন। চিতায় অগ্নিসংযোগ করলে চিৎকার করে ওঠে মহিষীরূপী অপ্সরা। তখন তাঁর গর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয় তাঁর মহিষরূপ ও রম্ভের মিলনজাত সন্তান। অর্ধেক মহিষ ও অর্ধেক মানুষ -- মহিষাসুর। তখন রম্ভ পুত্রস্নেহবশত চিতা থেকে উত্থিত হন এবং নব উত্থিত রম্ভের নাম হয় ‘রক্তবীজ’। শিব বরপ্রভাবে মিলনকালেই গর্ভসঞ্চার হয়েছিল মহিষীর। তাঁর পশুরূপের সঙ্গে মিলনের ফলে জ্বলন্ত চিতা থেকে জন্মায় অর্ধ মহিষ অর্ধ মানবরূপী মহিষাসুর। কিছুকাল পরেই অপ্সরীর সঙ্গে যৌনমিলনের ফলে জন্মায় অপর পুত্র রক্তবীজ। বর প্রভাবে জন্মগ্রহণ করে মহিষাসুর অতীব দুর্দান্ত হয়ে উঠে এবং দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে। বিতাড়িত দেবগণ শিব ও বিষ্ণুর কাছে তাঁদের দুঃখের কাহিনি নিবেদন করলে তাঁদের একত্র সহযোগিতায় দুর্গার আবির্ভাব হয়। দুর্গা যুদ্ধ করে যে অসুরকে হত্যা করেন, তিনিই মহিষাসুর। আর-একটি কাহিনিতে পাওয়া যায়, সেখানে দেবী ও মহিষাসুরকে একই দেহ বলা হয়। মহিষাসুররূপী মহাদেব দেবীকে সাধনায় তুষ্ট করে বর চান, তিনি যেন যজ্ঞের ভাগ পান। দেবী মহাদেবের এই আবেদনে জানান – অসম্ভব। যজ্ঞের অংশ বিভাজিত হয়ে গেছে। তবে তিনি পুজো পাবেন। মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো হলে তাঁর উদ্দেশ্যেও নৈবেদ্য প্রদত্ত হবে। আমাদের দেশে মহিষাসুরমর্দিনী পুজোপদ্ধতিতে এই রীতি প্রচলিত আছে।
মাইশোর বা মহিশুর বা মহীশূরে যাঁরা গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই রাস্তায় রাস্তায়, বড়ো বড়ো জংশনে পুরুষ্টু গোঁফ, বড়ো বড়ো চোখ, ডান হাতে উদ্যত তলোয়ার এবং বাম হাতে ফণা-উদ্যত কোবরা সংবলিত বিশালাকৃতি মূর্তি দেখেছেন। এই মূর্তিই মহিষাসুরের মূর্তি। এই মহিষাসুরের নামেই এই শহরের এমন নাম। মাইশোরে মহিষাসুরের মূর্তি কেন?
হিন্দুপুরাণ অনুসারে মহিষাসুর নিজের ইচ্ছানুসারে কখনো মানুষ, কখনো মোষ, কখনো-বা অন্য কোনো প্রাণীর রূপ ধারণ করতে সক্ষম ছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্যকে ‘মহিষ-মণ্ডল’ বলা হত। জনশ্রুতি হল, মহিষাসুরের সাম্রাজ্য ছিল এই মাইশোর অঞ্চলেই। অন্য এক কাহিনিতে পাওয়া যায়, দুর্গার রূপে মোহিত হয়ে মহিষাসুর দুর্গাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। দুর্গা মহিষাসুরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব সহ আরও কয়েকজন দেবতাদের দেওয়া ভয়ংকর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দুর্গা সিংহের পিঠে চেপে মহিষাসুরের রাজ্য আক্রমণ করেন। টানা নয়দিন যুদ্ধ চালিয়ে মহিষাসুর বাহিনী প্রায় নিচিহ্ন করে দেন সমবেত শক্তিসম্পন্ন দুর্গা। দশমদিনে এসে দুর্গা স্বয়ং মহিষাসুরকে হত্যা করতে সক্ষম হন। মাইশোরে অবশ্য দুর্গা ‘চামুণ্ডেশ্বী’ বা ‘চামুণ্ডী’ নামেই পরিচিতা। মাইশোরের শাসক ওধেয়ার রাজবংশের কুলদেবী হওয়ার কারণে তিনি এই শহরের উপাস্য রূপে পূজিতা হন। তবে মাইশোরের সর্বত্র মহিষাসুরের আধিপত্য প্রশ্নাতীত।
দুর্গার বাহন কে ? সোজা উত্তর – সিংহ। দেখা যাক, সিংহ কীভাবে দুর্গার বাহন হল। বলে রাখি, দুর্গার সিংহবাহিনী রূপটা শুধু বাংলা তথা ভারতেই নয়, ভারতের বাইরেও এরূপে পাওয়া গেছে। দেবী দুর্গা কেন বাংলায় সিংহবাহিনী ? বাংলার দুর্গা তো বাঘ্রবাহিনী হওয়ার কথা। এর কোনো মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা আছে কি ? মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা বলছে – মানুষ সর্বদাই কাছের বা চেনা শত্রুকে বেশি বিপজ্জনক মনে করে। বাংলা তথা সুন্দরবন বা তরাই অঞ্চলে বাঘই জগদ্বিখ্যাত, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। আমাদের খুব চেনা শত্রু (শত্রু হলেও তাঁদের হত্যা করা নিষিদ্ধ বর্তমান আইনে) বলাই বাহুল্য, এখানে বাঘেরও কমতি নেই। অপরদিকে গির অরণ্য বা হিমালয়ে সিংহের প্রাচুর্য, আমাদের অচেনা শত্রু। তাই সিংহের পিঠে দেবীকে চড়িয়ে দিলে দেবী তাকে নিজেই সামলে নেবেন। উলটোদিকে দেখুন, পাঞ্জাব-হিমাচলে দেবী দুর্গা বাঘ্রবাহিনী, অচেনা শত্রু। দুর্গা এখানে বাঘ্রবাহিনী ‘মা শেরাওয়ালি’। শের অর্থ বাঘ।
আবার ফিরে আসি দুর্গার কাছে। পৌরাণিক কাহিনিতে নারী চরিত্রগুলির আসল নামগুলি গোপন করে স্থাননাম দেওয়া হয়েছে। যেমন গান্ধার দেশ বা রাজার মেয়ে গান্ধারী, মদ্র রাজার মাদ্রী, কুন্তীরাজের মেয়ে কুন্তী, কোশলরাজের মেয়ে কৌশল্যা, কেকয়রাজের মেয়ে কৈকেয়ী ইত্যাদি। এইভাবে দুর্গার বাসস্থান খোঁজা যায়। দুর্গা আসলে বিন্ধ্যবাসিনী। দুর্গা স্বয়ং গোষ্ঠীপ্রধানা, যিনি মোষগোষ্ঠীর আধিপত্য ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য কায়েম করেছেন। বিন্ধ্য অঞ্চলের দুর্গ এলাকার গভীর জঙ্গল-ঘেরা রাজ্যেই ছিল সম্ভবত দুর্গার রাজত্ব, যিনি শবরগোষ্ঠীর কর্ত্রী। দুর্গের মেয়ে বলেই হয়তো পুরাণে তিনি দুর্গা। আমরা জানি কোলরাজা সুরথ দুর্গারই প্রত্যক্ষ সাহায্যে তাঁর হৃত রাজ্য ফিরে পেয়েছেন।
দুর্গা ভারতীয় হিন্দু দেবী হলেও তিনি সর্বভারতীয় দেবী হয়ে উঠতে পারেননি, যতটা তিনি একান্ত বাঙালিদেরই দেবী হয়ে উঠেছেন। বাঙালির দেবী গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী পুত্রকন্যা (কখনো-বা দেবীর সখী জয়া ও বিজয়া এবং পতি মহাদেব সহ) একই চালচিত্রে রেখে বাঙালির দুর্গা-কল্পনা। বাঙালির নিজস্ব চালাঘরের আদলে উলটানো ডিঙির মতো বাঁকানো চালচিত্রকে পিছনে রেখে দেবীর অবস্থান। এই চালচিত্রে চিত্রিত হয় শিবঠাকুর, শিবঠাকুরের বাড়ি, গণেশ-জননীর ছবি ইত্যাদি। চালচিত্রের দুইপ্রান্তে আঁকা হয় দেবীযুদ্ধের ছবি। একদিকে রক্তবীজ অসুরদের সঙ্গে সিংহবাহিনী চামুণ্ডা, অপরপ্রান্তে শুম্ভ ও নিশুম্ভের সঙ্গে দেবীর যুদ্ধ। চালচিত্রের মাঝামাঝি অংশে অঙ্কিত হয় রামের রাজ্যাভিষেক, বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের লীলা ইত্যাদি। চালচিত্রের একেবারে উপর দিকে শিবের পাশে উপবিষ্ট ব্রহ্মা, ইন্দ্র, নারদ এবং ছাগমুণ্ডুধারী রাজা দক্ষ। এই হল বঙ্গভূমির বাঙালির দুর্গা।
দেবী দুর্গা কয়টি হাত ? প্রথম যে দুর্গার মূর্তিগুলি পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেবী দুর্গার হাত মাত্রই দুটি। সময়ের প্রদক্ষিণে দেবীর হাত নানা সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। ১৯৯২ সালে জনৈক মূর্তি গবেষক দুই বাংলার (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) সত্তরটি পাথরের মূর্তি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, আট ধরনের দেবীর হাতের সংখ্যা পাওয়া যায়। যেমন – চতুর্ভূজা, ষড়ভূজা, দশভূজা, দ্বাদশভূজা, অষ্টাদশভূজা এবং দ্বাত্রিংশৎভূজা। তবে আট হাত ও দশ হাতের সংখ্যাই বেশি। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত দশভূজামূর্তিই মানুষের কাছে আদর্শরূপে গ্রহণীয় হয়েছে। শুরুতে দুই হাতের দুর্গা পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে হাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ‘পাতালভৈরবী’ নামে যে দুর্গার পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁর আঠারোটি হাত। উপজাতীয়দের তান্ত্রিক মতে যে কয়টি রূপ পাওয়া যায়, তার মধ্যে অন্যতম এই পাতালভৈরবী বা আঠারো হাতে দুর্গা। এইভাবে ষোলো হাতের ও ছত্রিশ হাতের দুর্গাও পূজিত হয় কোথাও কোথাও। এমনকি হাজার হাতের দুর্গাও পাওয়া গেছে। গত বছর দেশপ্রিয় পার্কের এক সর্বজনীন ক্লাবে হাজার হাতের দুর্গাকে উপস্থাপন হয়েছিল। শুধু যে জোড় হাতের দুর্গা পূজিত হয়, তা কিন্তু নয়। বিজোড় হাতের দুর্গাও পূজিত হয়। বলাগড় থানার সোমড়াগ্রামে দেওয়ান রামচন্দ্র সেনের রাজবাড়িতে ত্রিভূজা দুর্গাও পূজিত হয়। এই দুর্গার ডানদিকের দুটি হাতে খড়্গ ও বর্শা থাকে এবং বামদিকের একটি হাতে অসুরের চুল ধরা আছে। কলকাতার প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে মেয়েদের উদ্যোগে যে দুর্গাপুজো হয়, সেটি পঞ্চভূজা। মধ্যপ্রদেশের ভিল অধ্যুষিত অঞ্চলের উদয়গিরিতে বারো হাতবিশিষ্ট দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। পঞ্চম শতাব্দীর এই মূর্তিতে দেবী শূল দিয়ে মহিষাকৃতি এক দানবকে হত্যা করছেন। নালন্দা মিউজিয়ামে আদি-মধ্যযুগের একটি গোধাবাহনা চতুর্ভূজা ব্রোঞ্জের মূর্তি আছে। গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের মুদ্রায় আছে অষ্টভূজা দেবীমূর্তি। তবে বিভিন্ন সময়ে যেমন যেমন মূর্তি পাওয়া দেবী দুর্গা নগ্ন থেকে পরনের পোশাক কটিবস্ত্র থেকে ক্রমশ সভ্য পোশাকে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানের দুর্গা বেনারসী, সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়িও পরিধান করছেন। একই সঙ্গে তাঁর বাহন বদলে বদলে গেছে – কখনো সিংহ তো কখনো বাঘ, কখনো-বা হরিণও। আর রূপসৌন্দর্য ? বঙ্কিমীভাষ্যে তিনি – “বৃষস্কন্ধ, শালপ্রাংশু, গুরুনিতম্বিনী, পিনোন্নতপয়োধরা ও ক্ষীণ কটি”। ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
হাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন আর্যসমাজীয়ের একটা অংশ। ব্যাখ্যাটি হল – দুর্গার আসলে দুটিই হাত। বাকিগুলি রূপক। এই রূপকগুলি এসেছে সামাজিক দৃষ্টিকোণ তথা প্রয়োজনীয়তা থেকে। সমাজ বর্ণবিভাজিত হওয়ার পর চার বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) চার হাত হিসাবে দেবীর চারটি হাত কল্পনা হয়। তারপর একই যু্ক্তিতে হাতের সংখ্যা আট হয়। এবার প্রশ্ন উঠল, সমাজে নারীদের স্থান কোথায়? তাঁদের অংশগ্রহণই-বা কতটুকু ? ভাবা হল, নারীরা অর্ধেক আকাশ। অতএব পুরুষদের প্রায় সমান সমান। অথচ হাতের সংখ্যায় নারীরাই বাদ ! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের হাতগুলি তো নারীদের নয়, ওগুলো পুরুষদের। কারণ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে নারীরা কখনোই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ইত্যাদি। কারণ “বামন চিনি পৈতা প্রমাণ বামনী চিনি কিসে রে”। আসলে নারীর কোনো নির্দিষ্ট বর্ণ হয় না। নারীর বর্ণ হলেও, তা পরিবর্তনশীল। বিবাহসূত্রে নারীর বারবার বর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। জন্মের সময়ের বর্ণ বিয়ের পরেই বদলে যায়। নারী একাধিক বিয়ে করলে একাধিকবার বর্ণ পাবে। সেই জটিলতাকে মাথায় রেখেই মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পুজো করা হয়েছে দুই বাহুবিশিষ্ট নারীশক্তিকে। চার বর্ণের পুরুষের আট হাত পিছন থেকে যুক্ত হয়েছে এবং সামনের দুটি নারীহাত দিয়ে ত্রিশূল ধরে অসুরকে হত্যা করছে।


দেশের যেখানে যত দুর্গামূর্তি আছেন, সবখানেই দুর্গা একাই আছেন। রণরঙ্গিনী বেশেই আছেন। সন্তানসন্ততি কেউ নেই। ব্যতিক্রম কেবল এই বাংলায়। শুধু বাংলায় বললে ভুল হবে। বরং বাঙালি যে রাজ্যে বা যে দেশেই দুর্গাকে নিয়ে যাক-না কেন, সন্তানসন্ততি সেখানেই হাজির। আমরা দুর্গার সঙ্গে পাই আরও চারটি মূর্তি – লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। এঁরা দুর্গার কে ? সন্তানসন্ততি ? বাঙালিরা মনে করেন, মা দুর্গা বাপের বাড়ি আসছেন, সঙ্গে তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে। বিজয়া দশমীর দিন শিব এসে হাজির হবেন এবং কৈলাশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। “যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা আমার কত কেঁদেছে।” – এই আগমনী গানে বাঙালি মায়েরা দেবী দুর্গাকে আনতে বলেন না, বলেন কন্যা গৌরী বা উমাকে আনতে। এদিকে উমা কিন্তু শ্যামাঙ্গী বা শ্যামবর্ণা, অপরদিকে গৌরী হলেন গৌরবর্ণা। উমা তপস্যায় শ্যামবর্ণা ঘুচিয়ে গৌরবর্ণা হয়েছেন। গণেশ দুর্গার পুত্রসন্তান নয়, পার্বতীর। সেই কারণেই গণেশের মন্ত্রে ‘পার্বতীপ্রিয় পুত্রায়’ বলা হয়েছে, ‘দুর্গাপ্রিয় পুত্রায়’ বলা হয়নি। আমরা শিবরাত্রিতে হর-পাবর্তীর মূর্তি পুজো করি। সেখানে পার্বতীর কোলে থাকে তাঁর পুত্র গণেশ। দেবী চামুণ্ডা কর্তৃক চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই দৈত্য হত্যার পর দৈত্যরাজ শুম্ভ প্রচণ্ড ক্ষেপে দেবীর উপর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে দেবী নানা রূপের নারীশরীর ধারণ করেন। সবকটা রূপের বর্ণনা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। একটি রূপ হল কৌমারী – কুমার, অর্থাৎ কার্তিকের শক্তি। এঁর গায়ের রং কাঁচা সোনার মতো হলুদ, লাল শাড়ি পরনে, ময়ুর বাহন। অতএব দেখা যাচ্ছে কার্তিকও দুর্গার পুত্রসন্তান নয়। লক্ষ্মী ও সরস্বতী দেবী দুর্গার কন্যা নন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর তিনটি চরিত্রের কথা বলা হয়েছে। (১) মহাকালী, যিনি মধুকৈটভ হত্যার কারণ। (২) মহালক্ষ্মী, যিনি মহিষাসুর হত্যা করেন। (৩) মহাসরস্বতী, যিনি শুম্ভ ও নিশুম্ভকে হত্যা করেন। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে দেবীর কোনো চরিত্রের সঙ্গেই শিবের বিয়ে হয়নি। বিপন্ন দেবতাদের আহ্বানে আবির্ভূতা অসুর নিকেশ করেছেন, আর কাজ সম্পন্ন হলে অন্তর্হিতা হয়ে গেছেন। শিবের বিয়ে করার কোনো সুযোগই নেই। অতএব গণেশ ও কার্তিক যেমন দুর্গার ছেলে নয়, ঠিক তেমনি লক্ষ্মী ও সরস্বতীও দুর্গার মেয়ে নয়। অনুরূপ শিবঠাকুরও দুর্গার স্বামী নয়। তিনটি চরিত্রেই দুর্গা অবিবাহিতা, কুমারী। অন্য এক ব্যাখ্যা থেকে পাচ্ছি – ভগবান যখন সৃষ্টি করেন, তখন তিনি ব্রহ্মা – তাঁর চার হাতে ধরা থাকে চারটি বেদ এবং যজ্ঞ করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। সেই একই ভগবান যখন জীবজগৎকে পালন করেন, তখন তিনি বিষ্ণু – তাঁর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। ভগবান যখন জগৎ সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন, তখন তিনি শিব। ঈশ্বরের কাজ করার ক্ষমতাকে শক্তি বলা হয়। শক্তিকে মাতৃরূপে দেখা হয়। যেমন ব্রহ্মার সৃষ্টি করার শক্তিকে বাকদেবী সরস্বতী বলা হয়। বিষ্ণুর জগৎপালন করার শক্তিকে লক্ষ্মী বলা হয়। শিবের প্রলয় ঘটানোর শক্তিকে বলা হয় কালী। এইভাবে একেশ্বরবাদ তত্ত্বের ‘ভগবান’ বা ‘ঈশ্বর’ থেকে বহুত্ববাদে এসে রূপকার্থেই হাজার হাজার দেবদেবীদের কল্পনা।


এতক্ষণ এক নিরামিষ দুর্গার আলোচনা করা হল। এবারের আলোচনা একটু আমিষ আমিষ মনে হবে। বহু শাস্ত্র ও পুথিতে দেবী দুর্গাকে প্রজননের দেবী বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি উদ্দাম যৌবন ও অবাধ মদ্যপানের দেবী। তামিল ভাষায় প্রধান মহাকাব্য পাঁচটি। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত মহাকাব্যটির নাম ‘শিলপদ্দিকারম’। রচয়িতা হলেন চের সাম্রাজ্যের রাজা সেঙ্গুত্তুভানের ‘ভাই’ বলে পরচিত পণ্ডিত ইলাঙ্গো আডিগাল। শিলপদ্দিকারম মহাকাব্যের কাহিনির সংক্ষিপ্ত রূপ হল এরকম – তাঞ্জাভুরের কাছে এক ধনী বণিকের মেয়ে কান্নাগি। সে স্থানীয় এক ধনী মৎসজীবীর ছেলে কোভালমকে বিয়ে করে। তাঁদের প্রেম-ভালোবাসা শৈশব থেকেই। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু কাল হল হঠাৎ তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশে। কোভালমের জীবনে প্রবেশ করল মাধবী নামের এক সুন্দরী। সুন্দরীর প্রেমে পড়ে কোভালম সর্বস্বান্ত। ঘরে যা ধন-সম্পদ ছিল, সব মাধবীর আঁচলে ঢেলে দিতে থাকল। একদিন কোভালম বুঝতে পারল – “এ কী করলাম !”। যখন বুঝলেন তখন তিনি নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য। ফিরে এলেন নিজের স্ত্রীর কাছে। স্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে বললেন – “চলো, আমরা অন্যত্র চলে গিয়ে নিজে ব্যাবসা করি”। কী দিয়ে ব্যাবসা করবে কোভালম ? ঘরে তো কানাকড়িও নেই। পতিব্রতা স্ত্রী ব্যাবসার পুঁজির জন্য শেষ সম্বল তাঁর পায়ের মুক্তো বসানো মল খুলে স্বামীর হাতে দেন। সেই মল সম্বল করে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বেরিয়ে পড়লেন অজানা পথে জীবিকার সন্ধানে। এক ঘন জঙ্গল বিধৃত দুর্গম পথ অতিক্রম করে পৌঁছলেন শবরযোদ্ধা মারবারদের এলাকায়। সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করলেন রাজা যুদ্ধে যাওয়ার আগে এক নগ্ন দেবীর পুজো করছেন। দেবীর নাম কোররাবাই। দেবীর একপাশে একটি সিংহ, অন্যপাশে একটি হরিণ। দেবীর চারটি হাত। সেই চারটি হাতে যথাক্রমে শূল, শঙ্খ, চক্র ও বরাভয়। মহিষ, অসুর বা মহিষাসুর কোনোটাই নেই। নেই গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। আছে অবাধ যৌনাচার। যুদ্ধে বিজয় প্রার্থনায় মদ্যপ যোদ্ধাভক্তরা নিজেদের গলা চিরে দেবীকে রক্তাঞ্জলি দিচ্ছেন এবং অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছেন। বোধহয় যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কায় জীবনের শেষ স্বর্গীয় যৌনসুখটি উপভোগ করে নিতে চায় তাঁরা। শুধুই যৌন উপভোগ হয়তো নয়, হয়তো উত্তরপুরুষ রেখে যাওয়ার তাগিদেই এই অবাধ যৌনাচার। কোভালম ও কান্নাগির দেখা সেই মূর্তিটিই তাঞ্জোরের পুণ্ডমঙ্গেশ্বর ও পুজাইয়ের মন্দিরে বিরাজমান।
জিমূতবাহনের প্রাচীন পুথি ‘কালবিবেক’, রঘুনন্দনের ‘অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব’, শূলপাণির ‘দুর্গোৎসববিবেক’ স্মার্ত গ্রন্থগুলিতে দুর্গাপুজোর সঙ্গে অবাধ মদ্যপান ও অবাধ যৌনচারের সম্পর্ক পাওয়া যায়। এঁদের রচনায় দুর্গাপুজোকে ঘিরে আমোদ-প্রমোদ, অবাধ মদ্যপানের সূত্র পাওয়া যাচ্ছে। তাঁদের ভাষ্যে উল্লেখ করা যায় – “আদিম রিপুর প্রবৃত্তি এবং অবাধ যৌনাচারের হুল্লোড় না-থাকলে দেবী তুষ্ট হন না। এমন না-করলে দেবী কুপিতা হয়ে উপাসকদের প্রাণভরে অভিসম্পাত করতেন।” তাহলে কি দুর্গাপুজো মানেই অবাধ মদ্যপান ও যৌনতার উৎসবে সিদ্ধ ? অবশ্য দেবী যদি নিজেই মদ্যপান করেন, তাহলে ভক্ত-উপাসকরাই-বা কেন মদ্যপান করবে না ! শ্রীশ্রীচণ্ডীতে মহিষাসুর হত্যার আগে স্বয়ং দেবী দুর্গা বলছেন – “তিষ্ঠঃ তিষ্ঠঃ ক্ষণং তিষ্ঠঃ”। এইপরেই দেবী আকণ্ঠ মদ্যপান করে নিলেন। মহাভারতের হরিবংশ অংশে আর্যাস্তব অনুসারে বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গার মদ আর মাংসে ব্যাপক আসক্তি ছিল। বাকপতি ও বাণভট্টের মতে -- শুধু মদ-মাংসই নয়, বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গা বিভিন্ন পশু সহ মানুষের রক্তও পান করেন। বস্তুত সর্বত্রই দুর্গাপুজোর সঙ্গে মদ্যপান ও যৌনতার নিবিড় যোগ আছে। অশ্লীলতার অনুসঙ্গে নয়, যৌবনের উদ্দীপনায়।


পরিশেষে একটা প্রশ্ন মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। সবাই বলে দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। সত্যিই কি দুর্গা দুর্গতিনাশিনী? আমার পঞ্চান্ন বছরে যতগুলি দু্র্গাপুজো দেখেছি, সবক্ষেত্রেই দুর্গাকে দুর্গতিবাহিনী হিসাবেই পেয়েছি, দুর্গতিনাশিনী হিসাবে নয়। দুর্গতি নাশ করার কোনো ক্ষমতাই দুর্গার নেই। পৌরাণিক কাহিনিগুলিতে অসুর নাশ করেই দুর্গার ক্ষমতা শেষ। দুর্গা যদি পৃথিবীর দেবী হন, তাহলে দুর্গতির বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। যদি দেবীকে বাংলা তথা ভারতের দেবী হিসাবেও দেখি, তাহলে দেখব পুজোর প্রাক্কালে কোনো না-কোনো বছর হয় বন্যা, নয় সাইক্লোন, নয় ভূমিকম্প, নয় খরার মতো নানা দুর্যোগে মানুষের দুর্গতির সীমা থাকে না। কত বছর যে দুর্গাপুজোটাই করা সম্ভব হয়নি, তার বর্ণনা দেওয়া যায়। এ বছরই ধরুন-না, আসামে ১২ লক্ষ হিন্দু হঠাৎই রাষ্ট্রহীন হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে চোখের ভাসছে। তাঁদের উৎসব হারিয়ে গেল, আনন্দ হারিয়ে গেল, উদ্দীপনা হারিয়ে গেল ! বোধন হল না, তার আগেই বিসর্জন হয়ে গেল ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালির। কী অপরাধ ছিল তাঁদের ? দেবী দুর্গা কি পেরেছে তাঁদের চোখের মুছিয়ে দিয়ে দুর্গতি নাশ করতে ? পারেনি, পারবেও না। তবে দুর্গা যে একেবারেই দুর্গতি নাশ করতে পারে না, একথা নির্জলা সত্যের অপলাপ করা যায় না। ফি বছর দুর্গাপুজোকে ঘিরে হাজার হাজার কোটি টাকা হাত-বদল বা লেনদেন হয়। ধনীদের পকেট থেকে টাকা চলে আসে গরিবের কাছে। একটা পুজো যদি দশ কোটির হয়, সেই টাকা নানাভাবে আসে ধনীদের কাছ থেকে। সেই পুজোকে কেন্দ্র হাজার হাজার মানুষের রুজি-রোজগার হয়। সেই রুজি-রোজগার শুধু হিন্দুদেরই নয়, মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-শিখ সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায় প্রত্যক্ষে অথবা পরোক্ষে। সংগঠিত শ্রমিক হোক কিংবা অসংগঠিত শ্রমিক, চাকরিজীবীই হোক কিংবা বাড়ির কাজের মাসি, বস্তির মানুষই হোক কিংবা পতিতাপল্লির সদস্য – প্রত্যেকের হাতেই এসময় বাড়তি টাকা আসে, সমৃদ্ধি আসে। এই বাড়তি টাকায় অনেকের স্বপ্নপূরণ হয়। এইভাবেই দেবী দুর্গা সর্বজনীন হয়ে ওঠে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)