প্রতিষ্ঠিত প্রাণ,খণ্ডিত দৈবরূপে।
রূপদর্শী নাভির গভীরে নেশাজাত মধুফুল !
আর এক পোঁচ মাটি। অহম -দাম্ভিকা-সৌন্দর্য রূপিণী।
মৃত্তিকাশ্বরী।সুউচ্চ চূড়া।বৃন্তে অমৃতরেণু।চূড়ান্ত দৃষ্টিসুখ।
চক্ষুর সৃষ্টিসুখ!
আহ !এস ঘাম-জলে।খসে যাক পাপড়ি-ঈশ্বরীমাটি।
ওম শ্রমণা, প্রিয়তমাষু।
পয়যোনি সম্ভূতা।
আমি ডুব ডুব সাঁতার।আমি জন্মদাতা-আমি জন্মপিতা।
কাপড়ে জড়াবার আগে মাত্র একটিবার...অপরূপ নোনাজল।
কুমোরটুলির স্বাদ, অধোবদনা দেবী ঠোঁটে মেখে নাও।
জোয়ারের স্রোত।তোমাতেই জায়া-প্রিয়া-ভার্যা।
এস মৃন্ময়ী,যুবকক্ষীর নদে -আবক্ষ অবগাহনে।
বল,দেবী আমার
এক পটুয়া জীবন কি যথার্থ নয় মাটি ভালবাসার?
এই সংখ্যায় আমার সম্পাদকীয় লিখেতে মোটেই ইচ্ছে করছে না ।এই সংখ্যায় শুধু গল্প করবো আপনাদের সাথে ।জীবনের গল্প,আলোর গল্প,যাবতীয় রঙ ও শব্দ পতনের গল্প- এই গল্পের মধ্যে যে কাশ-চারাটি মাটি,জল পেয়ে তরতর করে আকাশের দিকে মাথা দুলিয়ে হাওয়া মাখবে আমরা সেই দৃশ্যটুকুকে কেবল দৃষ্টিবন্দী করে খুঁজে নেবো বিসর্জনের পরের আগমনী ছন্দকে ।জটিল সংখ্যাতত্ত্ব জীবন। ঢাক বাজছে। মায়েরা সিঁদুর খেলছে। কাঁসর বেজে চলেছে । জল বয়ে চলেছে জলের দিকে । কম্পাস দিক নির্ণয় করছে দিকের দিকে । একটা ঘটমান বর্তমানের ওপর চেপে বসছে বিষাদের বিস্বাদ মেঘ । মেঘটা অনেক দূর থেকে বিসর্জিত হয়ে এখানে পৌঁছেছে । ওখানের ফাটামাঠ , শুকিয়ে যাওয়া পুষ্করিণী , হলদে গাছের পাতারা ভেবেছিল বৃষ্টি হবে সেখানে । ছিটেফোঁটা হল , তারপরে বিসর্জনের দিকে এগিয়ে চলল মেঘ । অন্য দ্রাঘিমায়। অন্য রঙের পৃথিবীর দিকে । মানে কোথাও বিসর্জন মানে কোথাও আগমনী । কোথাও পাতা হলুদ তো কোথাও সবুজের মানপত্র । সময়ের কোন চিত্রটাকে রাখবে ? একটা চিত্রের মধ্যে আর একটা চিত্রের গুপ্ত অবস্থান যীশু হন্তারকরা মাপতে পারেনি সেদিন । কৃষ্ণার বস্ত্র হরণের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত কাপড়-কলের মালিক শ্রীকৃষ্ণকে মাপতে পারেনি সেদিন ।
হারুণ চাচা । চাচা ৭০ বছরে স্ত্রী বিয়োগের পরে নাতি নাতনির সংসারে বুকের মধ্যে উজানটানের হাওয়ার হাহাকার টের পেলেন । চাচার ছোটছেলে সবে ২১ । কলেজে পড়ে । চাচা নিকা করলেন বছর ৩৫ এর আফরিন বিবিকে ।চৌকস । ৪ ছেলের মা আফরিন ।হালিম আলী মরার পরে শরীরের মাঠ ফাঁকা । তাছাড়া হারুণ চাচা ৪ বিঘে ধানী জমি লিখে দিয়েছে । চাচার মনে পড়ে সালমার কথা । এত বছর প্রিতিপালন করেছে , ছেলেপুলে মানুষ করেছে , রাত হলে বিছানায় এসে শুত যখন , চাচার কলজেতে বান ডেকে উঠত । হুহু হুহু হাওয়া দিচ্ছে । সেই সলমার বিসর্জন হয়ে গেল । টিকটিক । খনা । আফরিন এলো । টিকটিক খনা । চাচা পিঠে হাত বোলাতে - বোলাতে বুঝল , মোটেই ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় , মোটেই বিসর্জন ততটা অর্থবহ নয় যতটা মানুষ মুখে বলে । আর কপাল পোড়া হলে বিসর্জন নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায় । ছোট-ছেলেকে শেষ পর্যন্ত মোমগলা ত্বকে আফরিন গিলে নিল যেদিন , হারুণ খড়খড়ে নদীর পাড়ে বাবলা গাছের নীচে বসে ডাকলেন , সালমা বিবি দেখতে পাচ্ছ ? আর দেখল জল থেকে উঠে আসছে জলপরী সালমা ।
অথচ তারাদের মতো যাপনও বিদ্যমান,ভাসমান ।ভাসাহীন মানে অযুথ রোশনী মুছে যায় ধরে নিলে প্রকৃতিবাদকে অস্বীকার করতে হয় । অথচ 'তারা' জানে পুনরায় ভাসতে গেলে , জেগে উঠতে হলে , মুছে যাওয়া দৈব সংকল্পের নির্দেশ । মুছে যাওয়াটা খুব জরুরী পুনরায় জেগে উঠবার জন্য । ধরা যাক , সেই হাতঘড়িটার কথা , শুনেছিলে একদিন , দেখেছিলেও বা , কিংবা দেখা হয়নি , হয় না , হবে না । শুধু একটা কাঁটা অথবা তিনটে কাঁটা আর টিকটিক টিকটিক একটা উদ্দেশ্যে-নির্মিত শব্দ । তবে কি চলে যাওয়ার মধ্যে চিতাভষ্ম ? কোথাও শুনতে পাওয়া যায় ১২ টার ঘর পেরিয়ে গেলে আবার ১২ টা ফিরে আসে ! আসে , আসেই তো ! ১১টা ৫৯ বিসর্জনের সন্ধি মুহূর্ত , ১২ -টা শূন্য , ১২ টা০১ ভ্রূণের নির্মাণ , অর্থাৎ ফেরতমুখী বিমান । ফেরতযোগ্য অভিপ্রায় গুলো থাকে বলেই মানুষের মুখে সর্বদা নির্মাণের রৌদ্রসঙ্কেত । বিসর্জন একটা আর্ট । স্কুল- কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট এর মধ্যে সেই আর্ট খুঁজলে তার পতন শূন্য । বিসর্জন কাঁঠালি কলা , ঈশ্বর শুধু বোঝেন দ্বিতীয়বার ও এই কলার প্রয়োজন , তাই কলার উৎপাদন রাখেন সচল । ওই উৎপাদন বিসর্জনকে নিয়ন্ত্রণ করে সজাগ রাখে আগমন,চলাচল।
আসলে এই উৎসবের রোশনাই ঠিক কী?স্মৃতিভ্রম শৈশব!ঝলমল আনন্দ!কলকল ভাবনারা বয়ে যায়।তা সে যাক।ব্যক্তিগত রিনরিনে প্রেম-বিচ্ছেদকে স্বীকার করে নিয়েও তার উর্দ্ধে কী কিছু থেকে যায় না এই ষোলআনা বাঙালিয়ানা উৎসব মেজাজে।কলেজ পড়ুয়াদের ভিড়ে হারালে শোনা যায়-Fuck চিপ সেন্টিমেন্ট,বিসর্জন টিসর্জন কিছু নয় 24*7 ঢিনচ্যাক।না না চমকে যাওয়ার কিছু নেই।এই প্রশ্ন নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম আমাদের চার পাশে জেগে থাকা স্পন্দনরত কিছু বিভিন্ন বয়সী মানুষের কাছে।তাদের দৃষ্টির ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করতে করতে মায়াজম যেন সন্ধান পেয়েছে আগামীর জিয়ন কাঠির-আসুন দেখে নেওয়া যাক তাদের চোখে দুর্গাপুজো আসলে ঠিক কী?
দুঃখনাশিনী দুর্গা
শামিম আহমেদ(প্রাবন্ধিক,শিক্ষক দর্শন বিভাগ, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির,বেলুড় মঠ)
‘দুর্গা’ কথাটি ‘দুর্গ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। দুর্গ বলতে আমরা বুঝি এমন জায়গা যেখানে সহজে শত্রুরা প্রবেশ করতে পারে না। সেই হেতু দুর্গ অনেকখানি নিরাপদ জায়গা। এই ‘দুর্গ’ কথাটি এসেছে ‘গম্’ ধাতু থেকে। ‘গম্’ ধাতুর অর্থ গতি, গমন, প্রাপ্তি, জ্ঞান, অতিক্রম। সেই জন্য ‘দুর্গ’ কথার প্রাথমিক মানে হল অশক্যগমন বা অসাধ্যগমন। সেখানে সহজে ঢোকা সম্ভব নয়। এই সব কথা আমরা প্রসিদ্ধি থেকে জানি। এই ক্ষেত্রে শব্দের অবয়বশক্তি থেকে যে অর্থ আমরা পাই, তা প্রসিদ্ধি থেকে প্রাপ্ত অর্থের অনুরূপ। এমনই এক অপরাজেয় দৈত্য ছিলেন দুর্গ, যাকে নাশ করেছিলেন এক দেবী। সেই দেবীই দুর্গা। দুর্গা হলেন দুঃখে প্রাপ্যা। এই দুঃখ, কষ্ট, জরা মানুষের প্রধান শত্রু, সে অপরাজেয়ও বটে। তাকে জয় করতে পারেন যিনি সেই মহাবিঘ্নাদিনাশিনী দেবী হলেন দুর্গা। দ-কারে তিনি দৈত্য ধ্বংস করেন, উ-কারে নাশ করেন বিঘ্ন, র-কারে তিনি রোগজরা থেকে মুক্তি দেন, গ-কারে হয় পাপনাশ এবং আ-কারে নাশ হয় ভয়শত্রু। কখনও তিনি নববর্ষা কুমারী, কখনও নীলী, আবার অপরাজিতা। দৈত্য কে? সে অসুরপ্রকৃতি জন—কৃষ্ণ নাহি মানে, তাতে ‘দৈত্য’ করি মানি। চৈতন্য না মানিলে তৈছে ‘দৈত্য’ তারে জানি। এই কথা চৈতন্যচরিতামৃতে আছে।
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।
(পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪ থেকে উদ্ধৃত)
এই জগতে নানা প্রকারের দুঃখ। সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের সাম্যাবস্থা হল প্রকৃতি। রজোগুণ বড়ই চঞ্চল, তার এক পরিণাম হল দুঃখ। এই দুঃখের আবার তিনটি ভাগ—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। ইন্দ্রিয়, মন ও দেহ থেকে উৎপন্ন দুঃখ হল আধ্যাত্মিক; ভূত থেকে জাত—মানুষ, পশুপাখি, সরীসৃপ থেকে উৎপন্ন দুঃখ হল আধিভৌতিক; আধিদৈবিক দুঃখ হল অধিদেবভব—দেবযোনী প্রভৃতি থেকে সংঘটিত। এই দুঃখ হল সকল বন্ধনের মূল। তা থেকে জীব মুক্তি পেতে চায়। এই যন্ত্রণার রাজ্যই দুর্গ নামক অসুর বা দৈত্য, তাকে যিনি বিনাশ করেন তিনি মুক্তি বা দুর্গা।
এই দুর্গারূপী মুক্তি নিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শন অনাদিকাল থেকে চর্চা করে এসেছে। তাই মুক্তি বা দুর্গা এক নন, তিনি বহু—কখনও তিনি নির্বাণ, কখনও তাঁর নাম নিঃশ্রেয়স, কখনও তিনি মোক্ষ নামক পরম পুরুষার্থ। বিভিন্ন মানুষ নানা প্রকারে বিঘ্ন নাশ করার চেষ্টা করেন। বিঘ্ন বা দুঃখযন্ত্রণানাশের নানা পথ—তাই দুর্গা কোনও একক শক্তি নন, তিনি সকলের মিলিত শক্তি। অশুভ-র বিরুদ্ধে শুভ, অবিদ্যা নামক অন্ধকারের বিপক্ষে জ্ঞানরূপী আলো, অধর্ম বা নীতিহীনতার বিরুদ্ধে ধর্ম বা নৈতিকতা, ঘৃণার প্রত্যুত্তরে ভালবাসা, দাঙ্গার জবাবে শান্তি—তিনি নানা রূপে বিরাজমান। এই দুর্গার প্রতীকীরূপ তাই বহুভূজা—সেই সব হাতে থাকে নানা অস্ত্র। কখনও তিনি অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা কিংবা দশভুজা, বা অষ্টভুজা অথবা চতুর্ভুজা। দেবী দুর্গার নানা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়। অনেকটা দশের লাঠির মতো। আঠারোটি হাতের পিছনে আছে প্রতীকী অর্থ। আঠারো পর্বে যেমন মহাভারত, আবার আঠারো দিনে সংঘটিত হয়েছিল মহারণ। এমন এক মহাকাব্যে দেবী দুর্গার কোন পরিচয় পাওয়া যায়?
বনপর্বে দেখি, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা নানা স্থান পর্যটন করে একদিন দ্রৌপদীসহ এসে পৌঁছলেন মৎস্য নগরে। প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির মনে মনে দুর্গার স্তুতি করছিলেন। আর বার বার তাঁকে ত্রিভুবনেশ্বরী বলে সম্বোধন করছিলেন। এই ত্রিভুবন আসলে তিন প্রকার দুঃখ, যার ঈশ্বরী বা নাশিকাশক্তি হলেন দুর্গা। অজ্ঞাতবাস বড় কঠিন সময়। খাওয়াদাওয়ার অসুবিধার পাশাপাশি রয়েছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। ধরা পড়ে গেলে আবার বারো বছর অজ্ঞাতবাস। তাছাড়া বনে জঙ্গলে দুর্গম জায়গায় নানা রকমের কষ্ট, কখনও কাঁটার আঘাত, আবার কখনও বিষধর সর্পের ভয় কিংবা বনের হিংস্র পশু ধেয়ে আসার ভীতি। শরীর এবং মনের কষ্ট তো আছেই। এক কথায় ত্রিবিধ দুঃখে পাণ্ডবরা বিধ্বস্ত। এমন সময়ে দেবী দুর্গা যিনি দুর্গতিনাশিনী বলে পরিচিত, তাঁকে ডাকা ছাড়া পথ নেই। যুধিষ্ঠির যখন দেবীবন্দনা করছিলেন, তখন তাঁর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হল, দেবী দুর্গা যশোদাগর্ভসম্ভূতা এবং নন্দগোপকূল-জাতা।
অত্যাচারী রাজা কংস একদিন দৈববাণী শুনতে পান, দেবকীর অষ্টম সন্তান তাঁকে হত্যা করবেন। তখন তিনি সাবধান হয়ে দেবকী ও তাঁর স্বামী বসুদেবকে কারাগারে বন্দি করেন। বন্দি অবস্থায় তাঁদের ছয়টি সন্তান হয়, প্রত্যেকটি শিশুকে কংস হত্যা করেন। সপ্তম সন্তান বলরাম দেবকীর গর্ভ থেকে প্রতিস্থাপিত হলেন রোহিণীদেবীর গর্ভে। রোহিণী বসুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী, তিনি থাকেন গোকুলে। ভাদ্রমাসের পূর্ণিমায় বলরামের আবির্ভাব। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে, গভীর রাতে কৃষ্ণ নামক অষ্টম পুত্র জন্মলাভ করেন দেবকীর গর্ভে। পিতা বসুদেব সদ্যোজাত শিশু কৃষ্ণকে গোকুলে গোপরাজ নন্দের ঘরে গোপনে প্রেরণ করেন। সেই রাতে নন্দের স্ত্রী যশোদার কন্যা যোগমায়া জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আসলে দেবী মহাশক্তি। বসুদেব কৃষ্ণকে যশোদার ঘরে রেখে ওই সদ্যোজাত কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে মথুরায় প্রত্যাবর্তন করেন। যোগমায়া কংস কর্তৃক শিলাতলে বিনিক্ষিপ্তা হয়ে আকাশে অন্তর্হিতা হয়েছিলেন। এই দেবী দিব্যমাল্যবিভূষিতা, দিব্যাম্বরধরা ও খড়্গখেটকধারিণী। তাঁর বর্ণ বালার্কসদৃশ, তাঁর আনন পূর্ণচন্দ্রনিভ এবং তিনি চতুর্ভুজা ও চতুর্ব্বক্ত্রা। তিনি কৃষ্ণবর্ণা ও অষ্টভুজারূপেও পূজিতা। তাঁর ওই অষ্ট হস্তে থাকে বর, অভয়, পানপাত্র, পঙ্কজ, ঘন্টা, পাশ, ধনু ও মহাচক্র। তাঁর দিব্য কুণ্ডল, মাথায় উৎকৃষ্ট কেশবন্ধ এবং তার উপর দিব্য মুকুট। বেণী কটিসূত্র অবধি লম্বিত। দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিনী এবং বিন্ধ্যবাসিনী। যুধিষ্ঠিরের স্তবে তুষ্টা দেবী দুর্গা তাঁকে নির্বিঘ্নে অজ্ঞাতবাসের বর দান করে অন্তর্হিতা হন। মহাভারতের বিরাটপর্বে আছে—দুর্গাত্তারয়সে দুর্গে তত্ত্বং দুর্গা স্মৃতা জনৈঃ (৬/২০)। সকল প্রকার দুর্গতি থেকে উদ্ধার করেন বলে উপাসকরা দেবীকে দুর্গা-নামে স্তুতি করে থাকেন।
কুরুক্ষেত্রে মহারণের শুরুতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখা অর্জুনকে বললেন, হে অর্জুন! তুমি দেবী দুর্গার স্তব করো। অর্জুন রথ থেকে নেমে পড়লেন। তার পর কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবীর স্তুতিগান করলেন। সেই স্তুতিতে তৃতীয় পাণ্ডব বললেন, দেবী দুর্গা যোগীদের পরম সিদ্ধিদাত্রী, ব্রহ্মস্বরূপিণী, সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়ের হেতু, জরামৃত্যুরহিতা, ভদ্রকালী, বিজয়া, কল্যাণপ্রসূ, মুক্তিস্বরূপা, সাবিত্রী, কালরূপিণী, মোহিনী, কান্তিমতী, পরমা সম্পৎ, শ্রী, হ্রী ও জননী। এই স্তুতিতে যে সব শব্দ পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগ শব্দ পরম ব্রহ্মের বাচক। জগতের আদি মহাশক্তি তিনি। অর্জুনের পূজায় প্রসন্না দেবী তাঁকে শত্রুজয়ের বর প্রদান করলেন। এই কাহিনী ভীষ্মপর্বে রয়েছে।
দেবী দুর্গা মহাদেবের পত্নী। অনুশাসনপর্বে উমামহেশ্বর-সংবাদে এই সিদ্ধান্ত রয়েছে—দেব্যা প্রণোদিতো দেবঃ কারুণ্যার্দ্রীকৃতেক্ষণঃ। শল্যপর্বে তিনিই শৈলপুত্রী—শৈলপুত্র্যা সহাসীনম্। হিমালয়ের কন্যারূপে দেহধারণ করেছিলেন বলে তিনি শৈলপুত্রী।
এই সব কথা পড়ে, বিশেষত দর্শন ও সংস্কৃতির নানা শাখা অবলোকন করে বোঝা যায়, দেবী দুর্গা একক কোনও শক্তি নন। তিনি এই জগতের নানা শক্তির সমাহার। তাই ভক্তরা তাঁকে শক্তির দেবী হিসাবে পূজা করেন। এই শক্তি শুভ। বৈদিক সাহিত্যেও দুর্গার নানা উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেই সব তত্ত্বকথা আধিবিদ্যক। সাধারণ মানুষ সেই বৈদিক সাহিত্যের সহজ রূপ পুরাণে দেবীর সম্যক পরিচয় পেতে পারেন। দুর্গার সবিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি রয়েছে ভারতীয় তন্ত্র ও পুরাণে। যে সমস্ত পুরাণ ও উপপুরাণে শক্তির দেবী দুর্গা সম্পর্কে আলোচনা আছে, সেগুলি হল: মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন। তিনি যে একক শক্তি নন, সকলের মিলিত শক্তি তা পুরাণ পাঠ করলে বোঝা যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলা হয়েছে। মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরকে নিবৃত্ত করার জন্য ব্রহ্মা দ্বিতীয় বার দুর্গাপূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামক এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে মহাদেব সঙ্কটে পড়লে তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। তার পর থেকে নানা রকম যন্ত্রণা, সঙ্কট, দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন শক্তির আরাধনার প্রচলন হয়। এই শক্তির সম্মিলিত রূপই দেবী দুর্গা। মজার ব্যাপার, শক্তির এই রূপকে শিবের নারী-অংশ বলা হচ্ছে যার পূজা করছেন ব্রহ্মা ও বিষ্ণু। মহাদেবও সঙ্কটমোচনের জন্য তাঁর শরণ নেন। দেবীকে কেন্দ্র করে শৈব-বৈষ্ণবদের যেমন একটি সমন্বয় ঘটেছে, তেমনি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরেরও এক ও অদ্বিতীয়া আরাধ্যা হয়ে উঠেছেন দুনিয়া জাহানের শক্তিরূপিনী নানা প্রকৃতি।
অগ্নি রায়(সাংবাদিক )
শারদীয়া দুর্গোতসব শৈশবের সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দেয় প্রতি বছর। বাবার কিনে দেওয়া নতুন জামা কাপড়ের গন্ধ, কবে কী পরা হবে তার লিস্ট করে চলা পুজোর একমাস আগে থেকে। এক অফুরান আনন্দের পাঁচদিন স্মৃতিতে ঘাই মারে। যে আনন্দের চাপে মনে হতো দম আটকে আসছে কিন্তু ভেবে পেতাম না তার কার্যকারণ আলাদা করে কোনটা। অবাধে আলুকাবলি ঘুগনি কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়ার আনন্দ, নাকি ফোসকা পায়ে প্যান্ডেল থেকে প্যান্ডেলে হেঁটে চলা মিছিলের অংশী হয়ে, নাকি সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বাড়ির বাইরে থাকতে পারার সুখ-- আলাদা করে বুঝতে পারতাম না। চুলে পাক ধরার সময় থেকেই আমার পুজো অতীতমুখী। ক্যাপ পিস্তল কোমরে গুঁজে পাড়ার পুজোমন্ডপকে দুর্গ বানিয়ে চলত যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। মাঝে ব্রেক নিয়ে পাড়ার বারোয়ারি পুজোর কিছু ফাইফরমাস খেটে দেওয়া। আর একটু বড় হওয়ার পর পাঁজরের দুদিকে যখন পাখা টের পেলাম তখন প্রথম সিগারেট, পাশের পাড়ার গভীর চোখের মেয়েটিকে অঞ্জলি অছিলায় একটু আলাদা করে দেখে নেওয়া। মাইকে তখন আমার পুজার ফুলের সঙ্গে ভালবাসা হয়ে গেছে। মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে রাতে প্যান্ডেলের পিছনে অন্তাক্ষরী। দশমীর রাতের হাহাকার আর মনখারাপকে গিলে ফেলে প্রাত্যহিকতায় ফেরা। পুজো এলে প্যান্ডেলে গিয়ে সেই অল্পবয়সী ছেলেটাকে খুঁজতে থাকি। হাতে ক্যাপ পিস্তল নিয়ে দৌড়ে আসছে মন্ডপের দিকে। ওর গায়ে বাবার কিনে দেওয়া নতুন জামার গন্ধ।
ঘরের উৎসব
আমার পুজোর ক্রমবিকাশটি অনেকটা খরোষ্ঠী লিপির মত। হিয়েগ্লিফিক থেকে ফিনিশিয় লিপি
হয়ে গান্ধার প্রাকৃত।ঐশ্বর্য্যবোধের রূপান্তর। মৌলিক বৈভব থেকে বহিরাঙ্গের সৌন্দর্য্যবৃদ্ধির ইতিকথা।
আমার ছোটবেলায় বাবার ঘরের পশ্চিমের জানালা দিয়ে ভাগীরথীর রূপালি ধারা দেখতে দেখতে
শিউলিতে কুঁড়ি আসতো সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে। দোপাটির লাল, সাদা, গোলাপী কৌটায়
মোড়ানো মুক্তোদানায় মত শিশিরে সকাল মুখ দেখে ভাবতে পারতো, সে ই নদী হলো।
মেঘপেঁজার অবশিষ্ট দিয়ে তৈরি হতো কাশের নিশান। বহুলব্যবহৃত ঘাট থেকে দুরে শ্মশানের
দোরগোড়ায় কে নৌকা বেঁধে ভুলে যেত যেন। ধরাবাঁধা কাজে ফাঁকি দেওয়া চন্দ্রবাক,
কাদাখোঁচা, গাঙচিল তার গলুইয়ে বসে ভরা নদীর জলে পেতে দেওয়া নীল আকাশের
ছায়ার পটভূমিকায় নিজেদের সাজিয়ে ভারি আহ্লাদিত হতো। অবসারপ্রাপ্ত মেঘ হতো
ঢাক। আর হাওয়া, বিদ্যুতের ষড়যন্ত্রী ঢাকী অকালনিনাদে আমার ছোট্ট বুকে ভয় ধরিয়ে দিত।
যদি বৃষ্টি হয়!
ছোট্ট গ্রাম আমার। কৃষ্ণসাগর বাগানের ঘুপচি কোণে বনপলাশ গাছের প্রায়ান্ধকার
সানুদেশে হঠাৎই এক ইঁটের স্তূপ দেখেছিলাম যে,তা কাউকে বলিনি। স্বর্ণলতার
ঘেরাটোপ চুঁইয়ে যে রোদ পড়তো ইঁটের শ্যাওলার ওপর, তাতে কত কি লেখা
কল্পনা করে নিতাম যেন। কোনটা গজমোতির আকারের। কোনটা দাদুর দামোদর
গোপালের মত হামাগুড়ি ছায়াখোকা। মেটেরঙের গোসাপের গায়ে বিকেলের পড়ন্ত
রোদ্দুর পড়তো। মনে করতাম সোনার গোসাপ যেন। কিন্নরী সন্ধ্যায় পরমাপ্রকৃতির
বৈতালিক লক্ষ্মীপেঁচা মিঠে স্বরে হুট হুট শব্দে ডাকতো। টুটুনমাসীর আঁকা রঙ্গোলির
সাতরঙ ময়ূরপেখমের মত ঝলমল করে উঠতো নিকানো উঠানে। খিড়কির পুকুরে
ভেসে বেড়াতো দুধসাদা হাঁস।গভীর রাতে আমার সম্পত্তি সেই ইঁটের স্তূপের নীচের
গুপ্তধনের কুঠুরি থেকে মেঠো ইঁদুর আসতো চোখে খসে যাওয়া তারার আলোর
গুঁড়ো মেখে। গুপ্তধনের ঠিকানা লিখে রেখে যেত নখের আঁচড়ের খরোষ্ঠী লিপিতে।
সাকুল্যে দুটো কি তিনটে পুজো হতো পুরো গ্রামে। ছোট ছোট। বিরাট অন্ধকারের
মাঝে মাঝে আলোর দ্বীপের মত।
বাবা মায়ের সাথে দুটো পুজো। চপ বেগুনি। জিলিপি।
তারপর আবার বাবা মায়ের মাঝে শুয়ে নদীর জলে চিকচিকে দুঃখে দশমীর পথ দেখা।
অল্প অল্প হিম হিম হাওয়ায় জিউলিগাছ আর "আনন্দমেলা"র পাতা উড়তো।
"মান্ধাতার টোপ আর ঘনাদা ","প্রফেসর রন্ডির টাইম মেশিন ","পাগলাসাহেবের কবর ",
"কার্ভালোর বাক্স "। আর আমার মনের গুপ্তকক্ষে চিররহস্যাবৃত সেই ইঁটের স্তূপ,
যার অনেক নীচে হয়তো কোনও গোপন কক্ষে এখনো দীপ জ্বলে ওঠে। পঞ্চদীপাধার
ষড়োপচারে একশত আট ইন্দিবরপূর্ণ নৈবেদ্য সাজিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ পদ্মচোখ মুদিত
করে করজোরে বন্দনা করেন,
ইয়া দেবি সর্বভূতেষু,
শান্তিরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমহঃ....
হয়ে গান্ধার প্রাকৃত।ঐশ্বর্য্যবোধের রূপান্তর। মৌলিক বৈভব থেকে বহিরাঙ্গের সৌন্দর্য্যবৃদ্ধির ইতিকথা।
আমার ছোটবেলায় বাবার ঘরের পশ্চিমের জানালা দিয়ে ভাগীরথীর রূপালি ধারা দেখতে দেখতে
শিউলিতে কুঁড়ি আসতো সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে। দোপাটির লাল, সাদা, গোলাপী কৌটায়
মোড়ানো মুক্তোদানায় মত শিশিরে সকাল মুখ দেখে ভাবতে পারতো, সে ই নদী হলো।
মেঘপেঁজার অবশিষ্ট দিয়ে তৈরি হতো কাশের নিশান। বহুলব্যবহৃত ঘাট থেকে দুরে শ্মশানের
দোরগোড়ায় কে নৌকা বেঁধে ভুলে যেত যেন। ধরাবাঁধা কাজে ফাঁকি দেওয়া চন্দ্রবাক,
কাদাখোঁচা, গাঙচিল তার গলুইয়ে বসে ভরা নদীর জলে পেতে দেওয়া নীল আকাশের
ছায়ার পটভূমিকায় নিজেদের সাজিয়ে ভারি আহ্লাদিত হতো। অবসারপ্রাপ্ত মেঘ হতো
ঢাক। আর হাওয়া, বিদ্যুতের ষড়যন্ত্রী ঢাকী অকালনিনাদে আমার ছোট্ট বুকে ভয় ধরিয়ে দিত।
যদি বৃষ্টি হয়!
ছোট্ট গ্রাম আমার। কৃষ্ণসাগর বাগানের ঘুপচি কোণে বনপলাশ গাছের প্রায়ান্ধকার
সানুদেশে হঠাৎই এক ইঁটের স্তূপ দেখেছিলাম যে,তা কাউকে বলিনি। স্বর্ণলতার
ঘেরাটোপ চুঁইয়ে যে রোদ পড়তো ইঁটের শ্যাওলার ওপর, তাতে কত কি লেখা
কল্পনা করে নিতাম যেন। কোনটা গজমোতির আকারের। কোনটা দাদুর দামোদর
গোপালের মত হামাগুড়ি ছায়াখোকা। মেটেরঙের গোসাপের গায়ে বিকেলের পড়ন্ত
রোদ্দুর পড়তো। মনে করতাম সোনার গোসাপ যেন। কিন্নরী সন্ধ্যায় পরমাপ্রকৃতির
বৈতালিক লক্ষ্মীপেঁচা মিঠে স্বরে হুট হুট শব্দে ডাকতো। টুটুনমাসীর আঁকা রঙ্গোলির
সাতরঙ ময়ূরপেখমের মত ঝলমল করে উঠতো নিকানো উঠানে। খিড়কির পুকুরে
ভেসে বেড়াতো দুধসাদা হাঁস।গভীর রাতে আমার সম্পত্তি সেই ইঁটের স্তূপের নীচের
গুপ্তধনের কুঠুরি থেকে মেঠো ইঁদুর আসতো চোখে খসে যাওয়া তারার আলোর
গুঁড়ো মেখে। গুপ্তধনের ঠিকানা লিখে রেখে যেত নখের আঁচড়ের খরোষ্ঠী লিপিতে।
সাকুল্যে দুটো কি তিনটে পুজো হতো পুরো গ্রামে। ছোট ছোট। বিরাট অন্ধকারের
মাঝে মাঝে আলোর দ্বীপের মত।
বাবা মায়ের সাথে দুটো পুজো। চপ বেগুনি। জিলিপি।
তারপর আবার বাবা মায়ের মাঝে শুয়ে নদীর জলে চিকচিকে দুঃখে দশমীর পথ দেখা।
অল্প অল্প হিম হিম হাওয়ায় জিউলিগাছ আর "আনন্দমেলা"র পাতা উড়তো।
"মান্ধাতার টোপ আর ঘনাদা ","প্রফেসর রন্ডির টাইম মেশিন ","পাগলাসাহেবের কবর ",
"কার্ভালোর বাক্স "। আর আমার মনের গুপ্তকক্ষে চিররহস্যাবৃত সেই ইঁটের স্তূপ,
যার অনেক নীচে হয়তো কোনও গোপন কক্ষে এখনো দীপ জ্বলে ওঠে। পঞ্চদীপাধার
ষড়োপচারে একশত আট ইন্দিবরপূর্ণ নৈবেদ্য সাজিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ পদ্মচোখ মুদিত
করে করজোরে বন্দনা করেন,
ইয়া দেবি সর্বভূতেষু,
শান্তিরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমহঃ....
শিশিরের ঘ্রান
কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য(সাহিত্যিক,অনুবাদক,দিল্লী)
দুর্গা পুজো মানেই কিছুটা সাদা ,কিছুটা নীল ও কালো মাখানো শৈশব আকাশ!পুজো মানেই একমাস ছুটি!ছুটি!পুজো মানেই বাটার নতুন জুতো!পুজো মানেই গোলাপি স্থল পদ্ম --কুয়াশা জড়ানো শিউলি আর শারদীয়া শুকতারা, কিশোর ভারতী--দেব সাহিত্য কুটির!
একটা সময় অর্থাৎ ছোটবেলা য়,আমাদের বাড়িতে মূর্তি গড়ে দুর্গা পুজো হতো।কার্তিক দাদু একমাস আগে মাটির মূর্তি গড়ে চলে যেতেন।রোজ স্কুল থেকে ফিরেই আগে দুগ্গা ঠাকুরের সাথে কিছু কাল্পনিক এক তরফা কথা হতো--
তোমার তিনটে চোখ কেন?
দশ টা হাত কেন?
সিংহ কে তুমি ভয় পাও না?
তারপর যখন রং করা হলে ধীরে ধীরে মাটির মূর্তি দেবী মূর্তি তে পরিণত হতেন--যষ্ঠী র দিন পুরুত দাদু প্রাণ সঞ্চার করার পর তিনি পুরোপুরি দেবী হয়ে যেতেন কেমন শিহরণ জাগতো!ভয় মাখানো একটা শ্রদ্ধা র ভাব আপ্লুত করে দিত--অঞ্জলি র পর কতো বর চাইতাম--ভোগ আরতি -রাতে বাড়ির প্যান্ডালে আমার দাদুর লেখা নাটক অভিনয়--কীর্তন গান--এবং বিজয়া দশমী তে মাকে বাড়ির পুকুরে ফেলে দিলে ডুকরে কেঁদে উঠতাম--আমার কাছে এটা হত্যা মনে হতো!!
তার পর বুঝতে শিখেছি এটা প্রতীকি পুজো।কিছুটা রিচুয়্যাল,কিছুটা পরম্পরা কিছুটা ধর্মীয় বিশ্বাস?
আজ আমার কাছে পুজো এক অসাধারণ মিলন উৎসব।চার পাঁচ দিন একেবারেই অন্য রকম ভাবে কাটানো।সময় এবং সামাজিক জটিলতার সঙ্গে সঙ্গে পুজোর চালচিত্র ও অনেক টাই বদলে গেছে--আমাদের এই স্টিরিও টাইপ জীবনে পুজো এক কাপ উপুড় করা আনন্দ!আর আনন্দ মানেই অমৃত!!
লিটল ম্যাগাজিন এর শারদ সংখ্যা গুলো আমার কাছে এক খোলা জানালার বাতাস--আজ দুর্গাপূজা আমার কাছে ধর্মের নাগপাশ ছিন্ন এক মানবিক মিলন উৎসব!এক মুক্ত সংস্কৃতির ঝলক!!
দুর্গা পুজো বললেই আমার ভেতরে ভক্তিভাবের চেয়ে আনন্দটাই বেশি জেগে ওঠে। সেই ছোটোবেলা থেকেই। তবে এই পুজো বা উৎসবের অর্থ যদি বলতে হয়, আমি বলব বয়স ও পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর অর্থও আমার কাছে পাল্টে গেছে। আমার মনে হয় সবার কাছে বেশিরভাগ শব্দের ক্ষেত্রেই এটা হয়। এটাই স্বাভাবিক। এমনকি জন্মদিন বা বিবাহ, এসবের অর্থও তো আমাদের কাছে এক এক বয়সে এক এক রকম ভাবে ধরা দেয়। একদম ছেলেবেলায় দুর্গা পুজো মানেই ছিল নির্ভেজাল আনন্দ। ভোর রাতে মায়ের পাশে শুয়ে মহালয়া শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়া। স্কুলের ছুটি, নতুন জামা-কাপড় কেনা, সকালে শিউলি ফুল তোলা, মাকে একটু বেশি করে কাছে পাওয়া। পড়াশোনা, বকাঝকাহীন কটা দিন। তারপর যখন একটু বড় হলাম দেখা দিল নতুন পোশাক, সাজগোজ, পরিবারের সঙ্গে প্যান্ডেলে ঘোরার আনন্দ। ছেলেদের চোরা মুগ্ধ দৃষ্টি উপভোগ করতে শিখেছিলাম এই পুজোমন্ডপেই। তারও পরে যখন অন্য রাজ্যে এসে সংসারী হলাম তখন এর অর্থ পুরো পাল্টে গেল। তখন এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল শিকড় ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা। সংসারের রোজনামচা থেকে কটা দিনের ছুটির রোমাঞ্চ। শিল্পী হিসেবে এই পুজোর মঞ্চে অনুষ্ঠান ও তার প্রস্তুতি ঘিরে এক অন্য উত্তেজনা উপভোগ করা। আর আজ এই বয়সে যখন এর অর্থ নিয়ে ভাবতে বসি তখন সব থেকে বড় বলে যে কথাটা মনে হয় তা হল সারা পৃথিবী জুড়ে এই যে চার দিনের এত আয়োজন, এত মানুষের আনন্দ ও আবেগ, এক নারী প্রতিমা তার মধ্যমণি হয়ে অধিষ্ঠিত। এই ভাবনাটুকুই যেন এক আলাদা জোর, ভরসা এবং আত্মবিশ্বাস জোগায়।
রূপং দেহি জয়ং দেহি
দুর্গাপুজো কথাটার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মেঘমন্দ্র স্বর, সোনালী গানের সুর। পুজো মানেই মায়ের কপালে জ্বলজ্বলে সিঁদূরের টিপ, বাবার সূর্য ওঠা মুখ, পাড়াপড়শির গায়ে নতুন কাপড়ের গন্ধ, পুজোবার্ষিকীর উজ্জ্বল পাতায় রঙচঙে গল্পের দল, রোশনাই, ঢাকের বাদ্য পার হয়ে কাশের বনে ছুটতে ছুটতে দূরে মিলিয়ে যাওয়া দুটি ভাইবোনের চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক। এই চিরচেনা ছবি ঝাপসা হয়ে আসে আজকাল। তার বদলে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা টইটুম্বুর কালো দিঘি, তার মেঘভাসা জলে গুটুরমুটুর গল্প করতে থাকে ক’টা ছাপোষা রাজহাঁস, আর ছিপ ফেলে পাড়ে বসে থাকা এক বিষণ্ণ ফেরিওয়ালা। ঢিমে আগুন রঙের পোশাক পরে দিঘির জলে থলকমলের মতো ফুটে থাকে তার বউ। চুল বেয়ে ভিজে বাদামী আলো ঝরে পড়ে জলের ওপর। আহা! যেন শরতরাতের শিশির। জলদেবীর মতো ভিজে পায়ে সে ঘাটে এসে উঠতেই কোথা থেকে লিকপিকে পায়ে ছুটে আসে তার কালোকোলো আধা উদোম ছানাপোনার দল। নতুন জামাপ্যান্টের বায়না নেই। পুজোর ছুটির উচ্ছাস নেই। ধামার মতো পেটগুলোতে খিদের ডঙ্কা বাজাতে বাজাতে , হনুমানের মতো লাফাতে লাফাতে স্থির বিশ্বাসে তারা মায়ের পেছন পেছন রাস্তার পাশের ওই দরমা বাঁধা বাড়িটার দিকে ছুটতে থাকে। বাচ্চাগুলো যেন অবিকল প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে হাত জোড় করে থাকা আমাদের চলচ্ছবি। আমরাও কেমন স্থির বিশ্বাসে “রূপং দেহি জয়ং দেহি” বলে ফি বছর চেঁচিয়ে চলেছি। তফাৎ একটাই। মেঘবর্ণা মেয়েটির 'নিরন্তর খিদে' নামক অসুরটির সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা নেই। তাই সে সন্তানের পিঠে গুমগুম করে কটি কিল বসিয়ে তাদের শান্ত করে। আর দশপ্রহরণধারিনী মা আমাদের 'সর্বগ্রাসী লোভ' নামক অসুরটিকে তার বাড়ন্ত বয়সেও সংহার করতে আসেন না। আমাদের পিঠেও ওই কিলটির বড়ো প্রয়োজন মা।
হারিয়ে পাওয়া শৈশব বা সাজুগুজু কথা
মহালয়ার ভোর , শিউলি কুড়োনো , সারাবছর ধরে জমানো পয়সার ভাঁড় ভাঙা - এই দিয়ে শুরু হ'ত আমার দুর্গাপুজো।
পাড়ার প্যান্ডেলে একচালার ঠাকুর হতো সেখানেই কাটতো পুজোর পাঁচটা দিন।
ভাঁড় ভেঙে যে পয়সা গুলো পেতাম সেই দিয়েই পুজোর কটা দিন মহানন্দে চলতো নাগরদোলা ,আলুকাবলি আর মীনাবাজার।
ষষ্ঠীর সকালে নতুন ছিটের জামায় কান্তা সেন্ট,
প্যান্ডেলের মাইকে নতুন সুরে কান পাতা আর দুপুরে প্যাণ্ডেল থেকে ফিরে পূজা বার্ষিকীর পাতায় ভরপুর সুখটান । অষ্টমীর সকালে একপেট খিদে নিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েই প্রসাদ খাবার হুড়োহুড়ি লেগে যেত।
সন্ধ্যায় গাজি সিল্ক কিংবা টেরিকটের জামায় লাগতো পুজো স্পেশাল তকমা। জামায় গা কুটকুট করলেও ওই জামাটার এক আলাদা সম্মান ছিল ।ঠিক যেমন সম্মান ছিল নতুন জুতোর ,যদিও পায়ে ফোস্কা টনটন করে জানান দিত পুজোর আনন্দ।
ফ্রক বাদ দিয়ে নবম শ্রেণীতে মা সালোয়ার কামিজ আর শাড়ি কিনে দিয়েছিল। প্রথম পুজোর শাড়িতে ঘনঘন আয়না দেখার সে কি ধুম!
সেবারের পুজোয় মা দূর্গা প্রতিমাও বেশ বড়ো হয়েছে। চোখ ধাঁধানো ডাকের সাজ ।
মণ্ডপে ভীড়ের মাঝে কারো সাথে আড়চোখে চোখাচোখি ।
মাসীর বাড়ি থেকে লুকিয়ে আনা আনন্দলোকের গল্পে হাত ধরাধরি আর চুমুর পাতাটায় অত্যন্ত গোপনে বারবার ফেরা।
পরদিন প্যান্ডেলে এসে সেই চোখ খুঁজে বেরানো।
এমনি করেই আমার দুর্গাপুজো বড়ো হয় আর আমি ধীরে ধীরে মেয়ে হতে শিখি।
'ভোগ' পরিপাটি
For me, Durga Puja is about the pandles. Every single one is different. For me Durga Puja is about
that delicious 'bhog'. I love eating whatever crispy, sweet, yummy I can find. I like buying new
clothes for the occasion. But I buy something roomy because I know the whole day we will be
seeing pandles. I love travelling all day. I love the thrill of seeing different places. eating different
food and enjoying that 'good old Pujo feeling'. (though I am not that old)
আমার কাছে দুর্গা পুজো আলাদা আলাদা প্যান্ডেলের। জিভে জল আনা 'ভোগ' এর। ভোগের মিষ্টি
আর ভাজা-ভুজিগুলো খেতে বেশি ভাল লাগে। পুজোর জন্য নতুন জামা কিনতে ভালবাসি। কিন্তু
জামাগুলো আরামদায়ক না হলে মুশকিল, সারাদিন প্যান্ডেল হপিং করে বেড়াতে হবে যে। আমি তো
সারাদিনই ঘুরতে ভালবাসি। নতুন নতুন জায়গায় যাওয়া আর নতুন নতুন খাবার খাওয়া, এটাই আমার
পুজোর পুরনো সুখস্মৃতি। ( যদিও, আমি তেমন পুরনো নই)
সুচিন্তিত মতামত দিন