টান---
হাতের হুঁকোতে দুটো জোর টান মেরে বাঁহাতে সেটা পাশে বসে থাকা নলিনের দিকে বাড়িয়ে দিল সিদ্ধেশ্বর। কানটা খাড়া করে কি যেন শুনল বাতাসে। ‘ঠিকই শুনছো, সিধুদা, বিশের গলাই ওটা। আহাঃ গলা তো নয়, যেন পৌষমাসে রায়বাড়ির খেজুর গাছের ধোঁয়া ওঠা মিষ্টি রস’।
‘চুপ থাক, নলিন। আমি মরতাছি নিজের জ্বালায়, আর তর গান শুনে খেজুর রসের কথা মনে আইল। হারামজাদা আজ বিশ দিন হইল ঘর ছাড়া। কুথায় গেসে, কেন গেসে কিছুই কইয়া যায় নাই। বাড়িতে বউডার মুখের পানে চাইতে পারি না, বাচ্চা মাইয়াটা বাবা বাবা কইরা হেদাইয়া মরতাসে। আর এইডারে দ্যাখ, গলা ছাইরা গান করতে করতে ফিরতাছে যেন রাজ্য জয় কইরা আইল’। শেষের কথাটা একটু আস্তেই বলল সিদ্ধেশ্বর। ওর ছোট ছেলে বিশ্বেশ্বর বা বিশু তখন কাছা কাছি চলে এসেছে। ওর গানের কথাও এসে বিঁধছে বসে থাকা এই কজনের কানে,
‘পাগলা কানাই বলছে রে ভাই এমন ঘরে বসত করি
ও আমি দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই
পাইলাম না ঘরামী।
যদি ঘরামী পাইতাম সারিয়া নিতাম যত বেশি কম-ই
ঘরের উঁচা দোপা কোণাকুণি।
ঘরের মধ্যে চব্বিশ বাতি সদরওয়ালার খেলা
যেদিন উত্তর হইতে আসবে সাপট মারবে ভীষণ ঠেলা
সে সাধের ঘর পড়িয়া রবে কেবল ধরার খেলা’
বাবা ও তার বন্ধুদের দেখে মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল বিশুর, ও জানে বাবা না বলে যাওয়ার জন্য ক্ষেপে আছে, তাই আবার গলা ছাড়ল—
‘সেদিন বন্ধ হবে সদরওয়ালা।
ঘরের মধ্যে অকূল নদী দেখে ছাতি ফাটে
ওরে চার মুড়ায় চার জন জপ করতেছে
সেই না নদীর ঘাটে
ওরে মুরশিদের মুখের কথা শুনে প্রাণ
চমকে চমকে ওঠে
ও আমার ঘরে যখন তুফান ওঠে’।
বসে থাকা চার বুড়োর সামনে এসে, থমকে দাঁড়াল বিশ্বেশ্বর। ‘বাবা, আমি চইলা আইসি। ঘরে সক্কলে ভাল আছে তো?’ ওর ফর্সা গায়ের রঙে পড়েছে সামান্য তামাটে ছাপ। পিঠে একটা বড় থলে। বেশ অনেকটাই বড়। কিন্তু বিশুর শক্তপোক্ত কাঁধে সেটা যেন একটা পুঁটলি মতো পরে রয়েছে।
‘হ ভালই আছে। তবে তুই কাউরে ভাল থাকতে দিলে তো। কাউরে কিছু না কইয়া কুথায় যে উধাও হইয়া যাস। বাচ্চা মাইয়াটা সারা দিন বাবা বাবা কইরা ঘুইরা বেড়াইতেসে এদিক সেদিক, হক্কলরে জিগাইতেসে তোর খবর। তা এইবার কোন রাজ্য জয় কইরা আওন হইলো শুনি?’ সিদ্ধেশ্বরের গলায় ব্যঙ্গ থাকলেও, ছেলের জন্য একটা প্রচ্ছন্ন গর্বের রেশও ছিল।
‘সে বহু দূর, বাবা। আমি কইলে তোমরা যাইতে দিতা না। পালা করতে করতে চইলে গেসিলাম কলকাতার কাছেই। কত যে ভিড় হইছিল পালায় কি কমু। আমারে তো কলকাতার দলে গান গাওনের জন্য ডাকও দিছে। বকশিসই পাইছি তিনশ টাকা। ছাড়তেই চাইতেছিল না, আমি জোর কইরা চইলে আইছি। আজ ষষ্ঠী, আমি জানি মাইয়াটা একটা জামার জন্য, আমার কাছ থেকে চাওয়া লাল জামাটার জন্য বইস্যা থাকবে। তাই চইলা আইলাম। দুদিন পরে আবারও যাইতে হইবো। দশমী থেকে লাগাতার পালাগান চলবো। আমার গান না হইলে পালা জমবোই না’
সিদ্ধেশ্বর উঠে পড়ল। ‘চল আমিও আগাই বাড়ির দিকে। আসি রে, নলিন পরে একবার আসিস, কথা আছে তোর লগে’। পা বাড়ালো বাপ বেটায় ঘরের দিকে। রাস্তায় চলতে চলতে ভাবছিল, এই ছোট ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। একে ঘরে আটকানোর জন্য মেজ ছেলে হৃদেশ্বরের আগেই ওর বিয়ে দিয়েছিল। কল্যাণীও ওকে বশ মানাতে, ঘরমুখো করতে পারে নি। টান বলতে এখন ফুটফুটে মেয়ে দূর্গা। ওর টানেই ঘুরে ঘুরে আসে ছেলেটা। বেশিদিন থাকে না বাইরে। চিন্তায় ভাঁজ পড়ল সিদ্ধেশ্বরের কপালে। এই ছেলে বিবাগী হয়ে যাবে এমনটাই বলেছিল ওদের গুরু মহারাজ।
মাটির রাস্তা, দুধারে ছোট বড় ডোবা, মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে পথ, পথের শেষে, বাঁশঝাড়, কলা বাগান, ফল ফলাদির বেশ বড় জায়গা জুড়ে ওদের বাড়ি। বেড়াটা এর মধ্যেই লাগানো হয়েছে মনে হয়, সদ্য চাঁচা বাঁশগুলো সুর্যের আলোয় চক চক করছে।
খানিকটা কাছাকাছি যাওয়ার আগেই, বেড়ার আগল খুলে তীরের মতো ছুটে এল একটা কিছু। ‘বাবা আইছে, বাবা আইছে’ চিৎকারে আশপাশ মাত করে ফেলল ওই একরত্তি মেয়ে।
বিশু হাতের পোঁটলাটা ধরিয়ে দিল বাবার হাতে, নিজে এগিয়ে গেল তারপর দুহাতে জড়িয়ে শূন্যে উঠিয়ে নিল দূর্গাকে। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে একই সাথে হাসতে, কাঁদতে লাগল দূর্গা। ওকে জড়িয়ে ধরে বিশুও হাতের পিঠে চোখ মুছল।
আরেকপ্রস্থ মান অভিমান, রাগারাগি অপেক্ষা করছিল বাড়ির ভেতরের মানুষগুলোর থেকে। মাকে প্রণাম করতে গেলে করুণা বলল, ‘থাক, হইসে, ঘর থিকা বাইর হইলে তো কারর কথা মনেই পড়ে না তর। এমন লক্ষিমন্ত বউ আর হিরার টুকরা মাইয়া ছাইরা ক্যামনে তুই বাইরে থাকস আমার মাথায় ঢুকে না’।
এককোণে জড়সড় হয়ে, জলভরা চোখে অপেক্ষা করছিল কল্যাণী, ওর দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা চাপা ব্যথা অনুভব করল বিশু। একগাল হেসে বলল, ‘আরে সংসার করসি যখন তহন রোজগার তো করতে হইব। বাবারও তো বয়স বাড়তাসে। একা কত চাপ নিবো আমাদের জইন্য। আইয়া তো পড়সি, দুদিন বাদে আবারো যাইতে হইব’।
দূর্গা বাবার হাঁটুর ওপরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘আর যাবা না বাবা, এখানেই কাম কাজ করো, দাদুর লগে। আমার যে মন খারাপ হইয়া যায়। মা রোজ কান্দে, ভাল্লাগে না, আমিও কান্দি মার সাথে’।
বিশু মুখ তুলে তাকালো কল্যাণীর দিকে। সত্যিই এই কদিনে মুখে কালি ঢেলে দিয়েছে যেন। আঁচলের খুঁটোয় চোখ মুছছে আবারো। মেয়ের হাত ধরে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে ও বলল, ‘এমন কইরা বলতে নাই মা দুগগা। তার চাইতে এখন আমারে একটু নাইয়া আইতে দাও, পরে তোমার লাইগ্যা কি আনছি দেখামু অনে’।
তাড়াহুড়ো করে স্নান সেরে এসেই খেতে বসে গেল বিশু। দূর্গা আর বাবার কাছছাড়া হচ্ছে না। পাছে বাবা আবার চলে যায়। ওর খাওয়া হয়ে গেছিল, কিন্তু আবারো অভ্যেস মতো বাবার সাথে বসে গেল। বাবা মেখে খাইয়ে দেবে এক দুই দলা, এটা সেই ছোট্টবেলা থেকেই শুরু হয়েছিল।
এতদিন যাত্রাদলের সাথে দুবেলা ভাত ডাল কুমড়োর ঘ্যাঁট খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গেছিল ওর। আজ ক্ষেতের চালের ভাত, কলাইয়ের ডাল, গাছের পটল ভাজা, আলু পোস্ত আর চুনোমাছের চচ্চড়ি যেন অমৃত মনে হল। খেয়ে দেয়ে, বাইরের দাওয়ায় পাটি পেতে সাথে আনা পোঁটলাটা খুলল।
দূর্গার জন্য লাল টুকটুকে জামা, বাবার জন্য, দাদাদের জন্য সস্তার পাঞ্জাবি পাজামা, মা, বড়বৌদি মায়ার জন্য শাড়ী সব একে একে বের করে তুলে দিল হাতে। বাবার হাতে পাঁচশ টাকাও গুঁজে দিল।
দূর্গা এবার বলল, ‘বাবা, মায়ের জন্য কিসসু আনো নাই তুমি, এডা কেমন হইল?’ মুখটা ভার হয়ে গেল মেয়ের। এবার আরেকটা প্যাকেট বের করে কল্যাণীর হাতে তুলে দিল বিশু। হাসি ফুটল মেয়ের মুখে।
ঘর থেকে দুটো বালিশ নিয়ে এসে পাটির ওপরে রেখে বলল, ‘আমিও তোমার লগে শুইয়া পড়ি এখানে। বাবা একটা গান শুনাও না আমাদের। তারপর ঘুমাইও’।
সবাই বলে উঠল, ‘হ হ ঠিকই কইসে দুগগা। শুনাইয়া দে তর পালা গান একখান’।
বিশু কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘নাঃ পালা গান না, আমি তোমাগো বাংলা সিনিমার গান শুনাই একখান। রেডিওতে শুনছিলাম বহুদিন আগে, তারপর ভুইল্যা গেছিলাম। এবার হেইডা অনেকবার শুইন্যা উঠাইয়া নিছি’। কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে হয়তো মনে করে নিল পুরো গানটা, তারপর ওর দরাজ গলায় গেয়ে উঠল-
ভোলা মন, মন আমার
মনের কথা কারে বলি আর ,
এমন করে ছিঁড়ল কেনে একতারাটির তার
কাঁদতে গিয়ে হাসি কেনে, হাসতে গিয়ে কাঁদি
ভালোবাসার আদালতে হইলাম আমি বাদি
সংসারে যে সাজিলাম রে সং এই বুঝেছি সার
মনের কথা কারে বলি আর
এমন করে ছিঁড়ল কেনে একতারাটার তার
তোর উদাস বাউল নেই কো বাউল আর
ভোলা মন.........................................’
বিশুর গলা ভেঙ্গে এল আবেগে, গানের কথায়। চোখের কোণে দেখা দিল জল। এই গান শুনতে শুনতেও তো কেঁদেছে ও। কি যেন একটা আছে, কেমন করে যেন টেনে নিয়ে যেতে চায় বাহির পানে। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল সব কটা চোখ একদৃষ্টে ওকেই দেখছে। আবার ধরল গান-
এত বড় আকাশ তবে
জীবন কেনে ছোট
পীরিতি ফুল মন বৃথে ঝরবে জেনেই ফোট
জানি না তো কে যে আমার
আমিই যে হায় কার
মনের কথা কারে বলি আর
এমন করে ছিঁড়ল কেনে একতারা টির তার
তোর উদাস বাউল নেই কো বাউল আর
ভোলা মন, মন আমার
খালি গলায় পুরো গানটা গেয়ে শেষ করার পর বারান্দায় থাকা সবার চোখে জল চলে এল। ছোট্ট দূর্গা তো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। ওকে বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরে বিশু হাসল, ‘এই পাগলী মা আমার, কান্দিস ক্যান তুই?’
ফোঁপাতে ফোপাতেই দূর্গা বলল, ‘তুমি আবার চইল্যা যাবা বাবা। আমি এই গান শুইন্যাই বুঝছি, এতবড় আকাশের লাইগ্যা মন কেমন করে তোমার। যায়ো না বাবা, আমাদের সাথেই থাকো’।
হাতের পিঠে চোখের জল মুছে, বিশু হাসার চেষ্টা করল, ‘এইবার ঘুইরা আসি, আর যামু না। আমার গান না হইলে পালা যে জমব না, মা। তুমি ঘুমাইয়া পড়ো। অনেক বেলা হইছে’।
আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি, কিন্তু রোদের তাপ বড্ড বেশি এখনো। একটু বেলা অবধি ঘুমিয়ে, উঠে ন্যাকড়ার বানানো পুতুল নিয়ে খেলতে বসেছে দূর্গা, দাওয়ার এক কোণে। আজ আর সিদ্ধেশ্বর বাইরে যাইনি। দাওয়ায় বসে কল্যাণীর বানিয়ে আনা চা খাচ্ছে। বিশুর কাছ থেকে টুকটাক কথা বলে জেনে নিচ্ছে শহর কলকাতার হাল হকিকৎ। ক্ষেতের আলু ভাজা দিয়ে এক ধামা মুড়ি ভেজে নিয়ে এল কল্যাণী।
একে একে সবাই এসে দু এক মুঠো করে খেতে লাগল। বড় বৌদি মায়া এসে বসল, ফিস ফিস করে বলল, ‘ঠাকুরপো, হেই শহরে বলে মাইয়াগুলান খুব সুন্দর, একদম সিনিমার নায়িকা সাইজ্যা থাকে। দেখো আবার আমাগো কলিরে ভুইল্যা যায়ো না অদের দেইখ্যা। তোমার গলা শুইন্যা হাবুডুবু না খায় অরা’।
কল্যাণী, শ্বশুরের কান বাঁচিয়ে বলল, আঃ দিদি, কি সব যে কও না?’
‘শুন, তর ভালোর লাইগ্যাই কইতাসি। আমাগো ঠাকুরপো, সিনিমার নায়কদের তুলনায় কম কিসে? আগে থিকাই সাবধান কইরা দেওন দরকার’। বিশুর এসব কথা ভালো লাগেনা। যাত্রাদলেও দুএকটা মেয়ে একটু গায়ে পড়া স্বভাবের, কথায় কথায় গা ছুঁয়ে কথা বলে, অস্বস্তি হতো বিশুর। একদিন এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘কথা কওনের জন্য মুখ লাগে, হাত না, হাতটা নিজের কাছেই রাখেন’।
ওদের পালার অধিকারী ছিলেন কাছেই, তার কানেও গেছিল কথাটা। মেয়েটাকে এক ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘তরে যদি আর ওর কাছে পিঠে দেখি, দূর কইরা দিমু। অসভ্য মাইয়া কোথাকার, মানুষ চেনে না’। আর বিরক্ত করেনি ওকে সে।
রাতে বাড়ির পোষা হাঁসের ডিমের ডালনা হয়েছিল, এক কড়াই ঝোল। ওই ঝাল ঝাল ঝোল দিয়েই ভাত খেয়ে নিল বিশু। দূর্গাও বেশ ঝাল খেতে শিখে গেছে। এই কয়েকদিনে মেয়েটা যেন অনেক বড় হয়ে গেছে, একবারের জন্যও বাবাকে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না।
রাতে দূর্গা ঘুমিয়ে পড়ার পর, ফিসফিস করে ও বলল, ‘কল্যাণী, তুমিও কি রাগ করছ আমার ওপরে? কি করি কও, পয়সা রোজগার এই গ্রামে বইস্যা হইব না, কলকাতায় গুণীর কদর আছে, পয়সাও ভালো দেয়। ভাবতাসি, ঠিকমত গুছাইয়া নিলে তোমাগো লইয়া যামু’।
মেয়ের ওপর দিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে কল্যাণী বিশুর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘নাঃ দাদু, ঠাম্মারে ছাইড়া দূর্গা যাইবো না, আবার তোমারেও ছাড়ব না। আমি বলি কি, আরেকটু বড় হোউক, বুদ্ধিসুদ্ধি হোউক, তখন এইসব শুইন্যা আর মানা করবো না’। বৌয়ের হাতটা মাথা থেকে টেনে নিজের গালের সাথে চেপে রাখল বিশু, একসময় ওইভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোরবেলাতেই বাবার আনা লালজামা গায়ে দিয়ে, দূর্গা গ্রামের পূজা মণ্ডপে চলে গেছে। জোর করে কল্যাণীকে বলে স্নান করেছে যাওয়ার আগে। বিশু একটু গড়াগড়ি দিয়ে বেলাতেই উঠেছে ঘুম থেকে, মুখ ধুয়ে দাওয়ায় গিয়ে বসেছে মাত্র, দেখে ওর বাবা হন্তদন্ত হয়ে আসছে বাড়ির দিকে, দূর থেকেই চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, ‘দূর্গা ঘরে আইছে?’ করুণা বাইরে এসে বলল, ‘ঘরে নাই তো, ও তো সক্কাল বেলাতেই কিচ্ছু না খাইয়া মণ্ডপে গেল গিয়া, দেখো খুঁইজা, কোথাও খেলতাসে বন্ধদের লগে। পারলে ধইরা আনো, খাওয়াইয়া দিই কিছু’।
সিদ্ধেশ্বর চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে ওরে পাওয়া যাইতেসে না ঘণ্টা খানেক ধইর্যা। পুরোহিত ঠাকুর কইলেন ফুল আননের লাইগ্যা গেছে কোথায় য্যান, সেই শুইন্যা, আমি ভাবছি ঘরে আইছে হয়তো। হায় ভগবান, গেল কই মাইয়াডা?’
কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাড়ির সবাই, ঘরদোর ফেলে রেখে খুঁজতে বেরিয়ে পরল দূর্গাকে, খুঁজতে লাগল আশপাশের বাড়ির সকলেও, ফুটফুটে এই মেয়েটা যে গ্রামের সবার কাছেই খুব প্রিয়। শেষ পর্যন্ত পুরোহিত মশাইয়ের সহকারী বুড়ো খুঁজে বের করল দূর্গাকে।
গ্রামের শেষ মাথায়, বড় ঝিলটার চারধার গাছপালা, বাঁশবন এসবে ঘেরা। তারই একপ্রান্তে, বাঁশবনের কাছেই ঝাঁঝির মধ্যে পা আটকে গেছিল দূর্গার, ছোট্ট হাতের মুঠোয় ধরা অনেকগুলো ডাঁটি সমেত পদ্মফুল। অনেককটা ফুল হাত থেকে ছড়িয়েও পড়েছে পাশে। পরনের লাল ফ্রকে কাদা নেই কিন্তু জলে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। পড়ে আছে একদম জলের কিনারে।
ঝিলটা দূরে নয় বলেই বুড়োর চিৎকার কানে এসেছিল বিশুর, একদৌড়ে পৌঁছেই লাফ দিয়ে জলে নেমেছিল, তারপর, মেয়েকে বুকে তুলে নিয়ে মণ্ডপের সামনে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছিল একটা মাদুরের ওপরে। পুরোহিত ছুটে এসে বলেছিলেন, ‘তোরা সর, আমাকে দেখতে দে, এখনো প্রাণটা আছে কিনা। যদি না থাকে তবে এই সপ্তমীতেই আমি মা দূর্গার বিসর্জন দিয়ে দেবো। বাবার ঘর ছেড়ে যাওয়া আটকানোর জন্য না খেয়ে, নতুন জামা পরে, মাদূর্গার পায়ে দেবে বলে পদ্ম আনতে গেছিল ও, মা কি এভাবে ওকে টেনে নিতে পারবেন?’
দূর্গার অসাড় শরীরের ওপরে ঝুঁকে আস্তে আস্তে ওর বুকের ওপরে দুহাত দিয়ে চাপ দিতে শুরু করলেন পুরোহিতমশাই। বেশ খানিকক্ষণ এভাবেই কাটল, এরই মধ্যে কল্যাণী ছুটে এসে চিৎকার করে আছড়ে পড়ল দূর্গার ওপরে। সেই চাপেই হোক বা পুরোহিত মশাইয়ের হাতের গুণে, একটা বড় শ্বাস নিল দূর্গা, তারপর ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল পেটে জমা জল। তার দমকে কাশতে শুরু করল দূর্গা। চোখ মেলল, প্রথমে মাকে, তারপর ঝুঁকে থাকা বাবাকে দেখে হাসল ওই কষ্টের মধ্যেও।
বেশ খানিকক্ষণ পর, গরম দুধ খাইয়ে ওকে একটু চাঙ্গা করে তোলার পর আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি মা দূর্গাকে দেখসি বাবা, ওই ওপরে মেঘের মধ্যে ভাইস্যা যাচ্ছিলাম আমি, মা দূর্গা হাতের তরোয়াল ফেলায় দিয়া আমার হাত ধইরা নীচে নিয়া আসল। কইল তোর বাবা আর তরে ছাইড়া যাইব না। সত্যি বাবা তুমি আর যাইবা না তো?’ তারপরই বলল, ‘আমি যে পদ্ম আনছিলাম সেইগুলা কই গেল? ওগুলা আজকের পুজায় দিতে হইব তো। জানো তো বাবা মা দূর্গা আমার কাছ থিকা পদ্ম নিসে নিজে হাতে, কইসে আমার জন্যই তো আনতে গেসিলি এগুলো’।
ওর হাতের মুঠোয় থাকা পদ্মফুলগুলো পুরোহিতের সহকারী বুড়ো একপাশে সরিয়ে রেখেছিল। পুরোহিত মশাই সেগুলো তুলে নিলেন সযত্নে। বললেন, ‘আজ এই ফুলেই মায়ের পুজো হইব, মায়ের মাইয়া নিজে হাতে উঠায় আনছে এই ফুল’। বলে মণ্ডপের দিকে ঘুরেই অস্ফুটে চিৎকার করে উঠলেন।
সবার নজর ওনাকে অনুসরণ করল। মা দূর্গার মুর্তির বাম দিকের পঞ্চম হাতে থাকা অস্ত্র, মানে তরোয়াল বা খড়্গটা পড়ে আছে সিংহের কেশরের ওপরে, তার বদলে হাতে ডাঁটিশুদ্ধু একটা পদ্ম, তখনো জল ঝরছে তা থেকে। পুরোহিতমশাই উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘আমি ওর কাছে ছুটে আসার সময়েও তো খড়্গটা মায়ের হাতেই ছিল, তবে কি সত্যিই মা হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিয়ে ওকে ফিরিয়ে আনলেন আমাদের কাছে? ওর হাত থেকেই গ্রহণ করলেন এই ফুল?’
দুচোখ জলে ভরে এল ওনার। ফিরে এসে হাঁটুগেড়ে বসলেন দূর্গার সামনে, ওর হাতদুটো হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে সশ্রদ্ধায় মাথায় ঠেকালেন। তারপর ধরা গলায় বললেন, ‘মায়ের আশির্বাদে, মায়ের হাত ধরে ফিরে এসেছে এই মেয়ে, একে সাবধানে রাখিস বিশু। এই মেয়ে সবার মুখ উজ্জ্বল করবে একদিন, এই গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে’।
বিশু তখন মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে, চোখবুঁজে, জোড়হাত করে ওর সুরেলা, দরাজ গলায় গান ধরেছে, কবি রজনীকান্তের সেই বিখ্যাত রচনা —
“আমিতো তোমারে চাহিনি জীবনে, তুমি অভাগারে চেয়েছ; আমি না ডাকিতে, হৃদয় মাঝারে
নিজে এসে দেখা দিয়েছ!
চির আদরের বিনিময়ে সখা! চির অবহেলা পেয়েছ; আমি দূরে ছুটে যেতে দু’হাত পসারি’, ধ’রে টেনে কোলে নিয়েছ!”
দূর্গাকে বুকে আঁকড়ে রেখে বিশু গাইছে, দুচোখ বেয়ে বইছে অকাল শ্রাবণের বারিধারা। আর যে গাইতে পারেনা ও। বুকের মধ্যে থেকেই দূর্গা বলে উঠল, ‘কান্দো কেন বাবা, এই গানটা কি এখানেই শ্যাষ হইয়া গেল?’
মাথা নেড়ে বিশু জানালো ‘না’। দূর্গা ছোট ছোট হাতে বাবার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘তবে গাও না বাবা, পুরাটা শুনাও’। মেয়ের অনুরোধ ফেলতে পারে না বিশু, আবারো সুরের জালে আবদ্ধ হয়ে যায় সকলে। বিশু গায়-
“ও পথে যেও না ফিরে এস”, ব’লে, কানে কানে কত ক’য়েছ; আমি তবু চ’লে গেছি; ফিরায়ে আনিতে পাছে পাছে ছুটে গিয়েছ।
এই চির-অপরাধী পাতকীর বোঝা, হাসি-মুখে তুমি ব’য়েছ; আমার নিজ হাতে গড়া বিপদের মাঝে,
বুকে করে নিয়ে রয়েছ!”
পুরোহিত মশাই, সেখানেই বসে পড়লেন। দুহাত
জড়ো করে শুনতে লাগলেন সেই অদ্ভুত গান, তার তো বটেই, উপস্থিত সকলের চোখ দিয়ে গড়াতে লাগল জল। সেই গানের মধ্যে দিয়েই আরাধনার শুরু হল মায়ের। মা দূর্গার। চোখের সামনে এমন এক অবিশ্বাস্য চমৎকার দেখার সৌভাগ্য হওয়ার জন্য সকলেই নিজেকে ভাগ্যবান ভাবছিল। গান শেষ হওয়ার পরও তার রেশ রয়ে গেল সবার মনে।
দূর্গা জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, এই গানটা তুমি কোত্থেকে শিখলা, নিজে বানাইছ?’ বিশু তখনো ভিজে থাকা একমাথা চুলে গাল পেতে দিয়ে বলল, ‘না রে মা, আমি মুখখু শুখখু মানুষ, এমন গান লিখার ক্ষমতা কি আমার আছে, এই গান লিখ্যাছিলেন কান্তকবি, রজনীকান্ত সেন, আমি কলকাতায় শুনছি এই গান। গানটি গাইয়া ছিলেন, বাংলাদেশের শিল্পী নিলুফার ইয়াসমিন। আমি শুনছি আমাদের অধিকারির কাছে থাকা রেকর্ডে। বারবার শুইন্যা উঠাইয়া নিসিলাম। কান্তকবির কথা আমারে শুনাইছিলেন অধিকারী মশায়। এমন কবি, সংগীত রচয়িতা আমাগো দ্যাশে কমই জন্মাইছে, কিন্তু ভগবান বড় তাড়াতাড়ি তারে কাছে টাইন্যা নিছিল’।
‘আর হইব না, এমন সব গান এখানে, এইখানে তো পাওন যাইবো না, আর তোরে ছাইরা আমি আর কুত্থাও জামু না মা। আর গান গামু না, আমি এখন থিকা তর দাদুর, জ্যাঠাদের লগে কামই করুম’। বিশুর গলায় যেন এক হাহাকারের সুর শোনা গেল। দূর্গা বড় বড় চোখে বাবার মুখের দিকে তাকাল, তারপর বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘না বাবা, গান তোমার প্রাণ, তোমারে গাইতেই হইব। তুমি যাবা, পালাগান করবা কিন্তু একখান কথা শুনতে হইব আমার’।
বিশু মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কও মা কি কথা শুনতে হইব তোমার?’
‘এই বারের মতো না বইল্যা এমন ভাবে যাইতে পারবা না। যখনি যাবা আমাগো বইলা যাইতে হইব। তাইলেই আমি তোমারে যাইতে দিমু। কি শুনবা আমার কথা?’ দূর্গার পাকাবুড়ির মতো কথা শুনে চোখে জল নিয়েও হেসে ফেলল সবাই। বিশুর পাশ থেকে কল্যাণীও টেনে নিল মেয়েকে বুকে।
পুরোহিত হাতজোড় করে বিশুকে বললেন, ‘আমি তোকেও প্রণাম জানাই। বাগদেবী স্বয়ং অধিষ্ঠান করছেন তোর গলায়। ছাড়িস না গান বাবা। ছড়িয়ে দে এই সুর, ভাব সবার মাঝে’।
তারপর সারা গ্রামের লোকেদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আজ থেকে প্রতি বছর মায়ের মুর্তি এই ভাবেই তৈরি হবে, বাম দিকের পঞ্চম হাতে কোন অস্ত্র থাকবেনা। সেই অস্ত্র এইভাবেই পড়ে থাকবে সিংহের কেশরের ওপরে। মায়ের খালি হাতে রোজ থাকবে একটা করে পদ্মফুল। এই রূপেই পূজা হবে মায়ের। আমাদের দুর্গা মায়ের’।
সুচিন্তিত মতামত দিন