দৃষ্টিদান
মহালয়ার আগের রাত। ওই দেখুন ,পুজোদালানে বসে আছেন রায়চৌধুরী পরিবারের তিন মধ্যবয়ষ্ক সদস্য, দুশ্চিন্তায় সকলের কপালে কঠিন ভাঁজ।
-কী করা যায় মেজদা?
-বুঝি না রে কিছু।অনন্তজ্যাঠা চিরকাল আমাদের ঠাকুর গড়ে আসছে। তোর মনে আছে,আমরা সব তখন ইস্কুলে পড়ি,বাড়ি ফিরেই ছুটে আসতাম ঠাকুর গড়া দেখতে। প্রথমে বাঁশের কাঠামোর ওপর খড় বেঁধে প্রতিমার আকার দেওয়া,তারপর মাটি চাপানো,একমেটের পর দোমেটে, হাত পা আঙুল বসানো, প্র্রতিমার গায়ে কাঁচা হলুদের সোনারংউজ্জ্বল বেনারসী,সর্বঅঙ্গে অলংকার সজ্জা।
- আমি অপেক্ষা করতাম চক্ষুদানের সময়টার জন্য।মহালয়ার দিন একদিকে আকাশ বাতাস জুড়ে বাজছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় “যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা ।নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ “,
আর আমাদের দালানে গঙ্গাস্নান করে ভেজা গায়,ভেজা কাপড়ে জ্যাঠা উঠছে মায়ের চক্ষুদান করতে।প্রথমে উর্দ্ধনেত্র,তারপর বাম ও দক্ষিণ নেত্র -আঁকতে আঁকতে জ্যেঠার নিজের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ত,কিন্তু তুলির একটি আঁচড় এদিক ওদিক হত না।মনে হত,শান্ত,মায়াময় অথচ তীক্ষ্ণ আঁখি মেলে মা দেখছেন তাঁর সন্তানদের।
- কিন্তু এবার কী হবে? কে ভেবেছিল জ্যাঠার একমাত্র ছেলেটার এমন অ্যাকসিডেন্ট হবে!দৈত্যের মত ট্রাক একেবারে পিষে দিয়েছে ,আহাহা।এই সামনের মোড়েই তো পড়েছিল। জ্যেঠাজেঠি সেই থেকে হাসপাতালে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে।
-মায়ের প্রতিমা তো সম্পূর্ণ প্রায়। চক্ষুদানটুকুই বাকি আছে।কাল একবার কুমোরটুলিতে গিয়ে খোঁজ করি,কেউ যদি চক্ষুদান করে দিতে রাজি হয়।
-তাই কর,আর তো উপায় দেখি না।কত বচ্ছর ধরে জ্যাঠা----
হাসপাতাল
-তুমি কি পাষাণ! তুমি অমলের বাবা না?কখন কি ঘটে তার ঠিকানা নাই,তুমি এখন হাসপাতাল ছাইড়্যা কই যাও? আমার যে বড় ভয় করে গো!
-এইহানেই বইয়া থাকো,ধৈর্য ধরন তো লাগবই। আমি একটু আসতাসি।যাইও না গো কোথাও,অমু যদি ডাকে-
ঠাকুরদালান
-এ কি জ্যাঠা,তুমি এখানে? এত রাত্রে!অমল কেমন আছে?
-রাইত আর কই?ভোর হইতাসে,মহালয়া পইড়্যা গেসে।জগৎরে ডাকেন,প্রদীপটা ধরুক,মায়ের চক্ষু আঁকি।
-তুমি,তুমি এখন চক্ষুদান করবে?অমলের এই অবস্থায়!
-অমল ভাল নাই,ডাক্তার কইয়া দিসে আর বড়জোর ঘন্টাখানেক।
-তবু তুমি এখনি ছুটে এলে মায়ের চক্ষুদান করবে বলে?
-হ,অখনই করুম।দেবীর চক্ষু কর্ণ কিছুই নাই সে আমি জানি। আজ কত বৎসর ধইরা প্রতিমা গড়ি, তিলে তিলে গইড়্যা তুলি ভুবনেশ্বরীর রূপ,কোন ত্রুটি কোনদিন হইতে দিই নাই।কাল থিক্যা আমরা বুড়াবুড়ি মার চরণে পইড়্যা আসি, তবু তিনি আমাগো দয়া করলেন না।বাইশ বৎসরের জুয়ান পুলা আমার,কত যন্ত্রণা পাইয়া যাইতাসে।তবু চক্ষু আঁইক্যা দিই,তারপরই তো বায়নার টাকাটা পামু। না পাইলে আমার অমুর ঘাটকাজ হইব কিসে?
প্রাচীন, সুনিপুণ হাতের টানে জ্বলে ওঠে প্রতিমার ত্রিনয়ন।
সুচিন্তিত মতামত দিন