ঝুমা চৌধুরী - মায়াজম

Breaking

১৭ এপ্রি, ২০২০

ঝুমা চৌধুরী

ফ্লাইং ট্রপিজ







"মেদনিপুরের আয়না-চিরন, বাঁকুড়ার ঐ ফিতা/আর যতন করে বাঁধলি মাথা তাও তো বাঁকা সিঁথা৷"
কল্কি আয়নাতে নিজের দিক থেকে চোখ সরাতেই দেখতে পেলো বাঁশি হাতে শ্যাম কে। মুখ বেঁকিয়ে বললো "আ মরণ আর কি!! ঢঙে আর বাঁচি না।" শ্যাম আবার ধরলো দু কলি, "পেছপারিয়া রাজকুমারি গলায় চন্দ্রহার/দিনেদিনে বাইড়ছে তুমার চুলেরই বাহার" কল্কি এক ঝটকায় শ্যামের কলারটা ধরে কাছে টেনে এনে বললো "বলি সব পিরিত কি এখানেই দেখাবি না কি আমাকে তোর সঙ্গেও নিয়ে যাবি!!" শ্যাম বাঁশিটা বাক্সের ওপর রেখে বললো,"আজই ভাগ চলতে হ্যায়!!সাহস আছে!" ধরাম করে কল্কির বুকের মধ্যে ড্রাম বাজলো। ভয় না উত্তেজনা ঠিক বুঝলো না কল্কি।শুধু মায়ের মুখটা মনে পড়লো।পান চেবানো লাল ঠোঁট।পিকদানি নিয়ে বারবার পিক ফেলে আর হাতের ইশারায় মেয়েদের বেছেবেছে বুড়োহাবড়া কিংবা চোয়ারে ছেলে ছোকরাদের সাথে ঘর ভাগ করে দেয়।কল্কি তো সেই কোন ছোটো থেকেই এমনই দেখে এসেছে। এই যে শ্যাম কতো মেয়ে নিয়ে এসেছে তার মায়ের কাছে।দালাল বলে তার বড়ো নামডাক এ পাড়ায়।যে এতোদিন এতো মেয়ে ফুসলে এনে এ পাড়ার মাথা পরমা মাসীর হাতে তুলে দিয়েছে সে কিনা আজ এই পরমা মাসীর মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাবে! "কাজটা কিন্তু খুব সহজ নয় রে শ্যামবাবু।ধরা পড়লে সোজা উপরে পাঠিয়ে দেবে মা।" শ্যামের পিঠে আঙুল চালাতে চালাতে বললো কল্কি।শ্যাম কল্কিকে ধাক্কা দিয়ে বললো "আরে জান তেরে লিয়ে কুছভি।"
সে রাতেই কিন্তু সেই অসাধ্য কাজ সাধন করে দেখালো শ্যাম।কল্কির হাত ধরে ট্রেনে চেপে সোজা বেনারস।ভোরে পৌঁছিয়েই একটা ঝুপড়িতে এনে তুললো কল্কিকে।কিছু পরে ফিরে এসে একটা ছোটো ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললো " নে সেজে নে।" লাল একটা সস্তার শিফন। লাল টিপের পাতা।একটা পাউডার।একটা লাল লিপস্টিক। কল্পি খুব যত্ন করে সাজিয়ে নিচ্ছিলো নিজেকে এমন সময় চকচকে একটা পাঞ্জাবি পরে শ্যাম এসে ওর হাত ধরে টানলো।পাশেই এক মন্দিরে সিঁদুর পরলো কল্কি,টেনে নিলো একমাথা ঘোমটা।বেশ্যাপাড়ার পরমা মাসীর মেয়ে বউ হলো শ্যামের।
যদিও সেদিন ছিলো অমাবস্যা তবুও সে রাতে জ্যোৎস্না নামলো ওদের ঝুপড়িতে।ফাঁটা বেড়া টপকে ভালোবাসার জোয়ার আসলো।পরেরদিন সকালে শুরু হলো সংসারের খুঁটিনাটি।
দেখতে দেখতে ছ'টা বছর কেটে গেছে।অভাব সামলে কিছুটা স্বচ্ছলতা এসেছে।রাতে শ্যাম মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে।কল্কি রাগ করলে গান গেয়ে তাকে সোহাগ দেখায় শ্যাম।ঘর জুড়ে হেঁটে বেড়ায় একজোড়া কচি পা,বছর পাঁচেকের চন্দা।কিন্তু সুখের ঘরে দাগ কাটে অসময়।এর পকেট থেকে মানিব্যাগ ওর গলার চেন এই সব কাজ তো কম বিপদজনক নয়!! তবু পেট কি সাওয়াল।এমনই এক কাজের সময় ছুটে পালাতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে শ্যাম।মাথাটা গুড়োগুড়ো হয়ে গিয়েছিলো।গুড়ো হয়ে গিয়েছিলো কল্কির শাঁখা, হাঁ করে বসে ছিলো সে শ্যামের লাশের পাশে।চোখে এক ফোঁটা জল নেই।বুকে কি ভারী পাথর! চন্দা শুধু মা কে ঠেলছিলো "খেতে দে খেতে দে" বলে।এমনই সময় চন্দার হাতে একটা শাল পাতা করে বোঁদে
তুলে দিলো বছর পঞ্চাশের ভুঁড়ি ওয়ালা কালোপানা লোকটা।নাম তার দীননাথ।ঝুপড়ির মালিক সে।পরের প্রায় আড়াই মাস চালটা তেলটা সেই পৌঁছে দিয়ে যেতো।তারপর সে রাতেও আসতে লাগলো।অবশ্য ঘরে তার বউ আছে। দুই মেয়ে আছে, ছেলে ছেলের বউ আছে।অগত্যা কল্কি হলো দীননাথের রক্ষিতা। আবার সে সিঁদুর পরলো।গয়না পরলো অনেক। চন্দা গেলো বোর্ডিং স্কুলে।এরপর চন্দাকে কোনোদিনও ঝুপড়িতে আনেনি কল্কি।চায় নি তার ছায়া চন্দার ওপর পড়ুক।মাঝেমধ্যে সেই যেতো দেখা করতো।দূরে কোথাও ডেকে পাঠাতো।দুটো কথা বলে চলে আসতো।যদিও বেশ কয়েক বছর দীননাথই সব খরচা চালিয়েছিলো কিন্তু বছর ছয়েক পর থেকেই আসাযাওয়া কমেছিলো দীননাথের।দেওয়া থোওয়াও তেমন ছিলো না।সেই সময় গোরা বাবু, চন্দন বাবু এদের আবির্ভাব হলো। কল্কি ফুরিয়ে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে।কিন্তু সে তখন নিরুপায়। চন্দাকে ভদ্রোলোকের মতন মানুষ করতে হবে যে!!এ ভাবে কেটে গেলো আরো তিনটে বছর।চন্দা তখন প্রায় পনের কি ষোলো। এক বসন্তের সকাল বিষাক্ত হলো আবার নিয়তির পরিহাসে। সেদিন হস্টেল ছেড়ে হঠাৎই চন্দা ঝুপড়িতে হাজির। দুদিন আগেই তো কল্কি গিয়েছিলো চন্দার সাথে দেখা করতে!দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দার চোখের দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠলো কল্কির। চন্দার দুচোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে।কল্কি কাঁপা স্বরে বললো "চন্দু বেটা!!তুই!"
"কেনো মা আশা করো নি!!কি ভেবেছিলে আমি কোনোদিন কিছু জানতে পারবো না!!" বলে ওঠে চন্দা।ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কল্কি। চন্দা হঠাৎ এসে কল্কিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।বলতে থাকে "নিজেকে এই ভাবে কেনো শেষ করে দিলে মা! আমার জন্য!! দুজনে না হয় মুটে মজুর খাটতাম মা!" কল্কি কিছু বলতে পারে না। বলতে পারেনা তার স্বপ্নে দেখা চন্দুর ভদ্রপাড়ায় বেড়ে ওঠা আটপৌরে রূপটার কথা, বলতে পারে না তার স্বপ্নে দেখা চন্দুর অফিস বাড়ির কথা, চন্দুর শ্বশুরঘরের কথা।শুধু চোখের জলের সাথে বইতে থাকে স্বপ্নের রঙ।

আজ পরমা মাসির মুখোমুখি কল্কির মেয়ে চন্দা শ্রীবাস্তব।সেদিন হোস্টেলের থেকে বেশ কিছুটা দূরে দেখা করতে আসা কল্কি আর চন্দাকে দেখেছিলো যে নারায়ণ সে মাসীর খাস লোক।কল্কিকে দেখে সে চিনেছিলো সঙ্গেসঙ্গেই। পরমার কথাতেই কল্কির পিছু নিয়ে ঝুপড়িতে গিয়ে জোগাড় করে ছিলো যাবতীয় খবর। পরমা মা হতে পারেনি কোনোদিন, শুধু আগুন পুষছিলো মনেমনে।অপমানের আগুন।শুঁড়ি গলির পরমা মাসীকে ধাপ্পা দিয়ে তারই মেয়ে ভেগে গেলো!! এ সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় নি।কল্কির অতীত আর বর্তমানের পাতা খুলে দিয়েছিলো চন্দার সামনে।বলেছিলো " শুন বেটি।তোর মা কে আমি শেষ করে দেবো।" পা জড়িয়ে কাঁদছিলো চন্দা।এক লাথি মেরে চন্দাকে ছিটকে ফেলেছিলো।মুখ বেঁকিয়ে বলেছিলো "বেশ রসোরসো হয়েছিস তো!মা কে বাঁচাবি! আয় আমার ডেরায়।পারবি!!কোনো চালাকি করিস না যেনো।তাহলে যেমন আমি ভুলে গেছি কল্কি বলে আমার কোনো মেয়ে ছিলো তেমন ভুলে যাবো চন্দা বলে আমার তুই নাতিন আছিস!"
অনেক রাস্তা পেরিয়ে ছুটে আসছে কল্কি।তার মন বলছে চন্দার চোখে যে আগুন সে দেখেছে, চন্দা আজ তার পুরনো পাড়াতেই থাকবে।ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সি।ট্যাক্সি গলির মুখে দাঁড় করিয়ে ছুটতে থাকে কল্কি।বড়ো দরজার কাছে গিয়ে থমকে যায় কল্কি।চন্দার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা আধবুড়ো।চিৎকার করে চন্দাকে ডাকার আগেই মাথার ওপর ভারী কিছু পড়ে।কোনো রকমের পেছন ঘুরে সে দেখতে পায় তার মাকে।হাতে শাবল নিয়ে।বাকী সব আবছা হয়ে যায়।আস্তে আস্তে পরমাও আবছা হয়ে যায়।মাথা চুঁয়ে গরম রক্ত নেমে আসছে কল্কির।বন্ধ হচ্ছে চোখ।কল্কি সার্কাসের রিং এর মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে।রিং মাস্টার পরমা আঙুল তুলে নির্দেশ দিচ্ছে।পরমা আগুনের ওপর দিয়ে ঝাঁপ দিচ্ছে! মরন কুঁয়াতে সে আর চন্দা জীবনকে পরমার হাতে দিয়ে অসহায় ভাবে পাক খাচ্ছে!ফ্লাইং ট্রপিজে কল্কির মতন চন্দাও হাত বদল হচ্ছে কতো কতো বার! অবশেষে মোটা দড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কল্কির জীবন আর ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। শ্যাম চিৎকার করছে আর একটু, আর একটু!!কিন্তু পা ফসকে পড়ে যাচ্ছে কল্কি।ওই যে ছায়ার মতন ও কে!! নিশ্চয় ও ঈশ্বর!! প্রচন্ড জোরে হাতে তালি দিয়ে ও বলছে "জিন্দেগি এক সার্কাস হ্যায় জানাব"! আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে যাচ্ছে কল্কি।বাঁশি হাতে শ্যাম তখন খেলা শেষের ভূমিকায় জড়িয়ে ধরছে কল্কিকে।সুর ধরেছে সে.........
" কালো জলে কুচলা তলে ডুবলো সনাতন
আজ সারা না কাল সারা না পায় নে দরশন.."


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র