অনন্য বাঙালি
সার্কাস আসলে এক বিশিষ্ট বিনোদন বা বিনোদন প্রক্রিয়া যা প্রায় সব ধরণের মানুষকে নির্মল আনন্দ দান করে।একদল প্রশিক্ষিত মানুষ তাদের শারীরিক কলাকৌশল, মূকাভিনয়, ভাঁড়ামি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে নিজেদের নিয়োজিত করে এই অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়াটিতে।শুধু মানুষ নয়, মনুষ্যেতর কিছু প্রাণীও এখানে খেলায় অংশগ্রহন করে।সার্কাস শব্দটি ল্যাটিন শব্দদ্ভূত।ল্যাটিন circus শব্দটি থেকে, যেটি গ্রিক শব্দ kipkoc থেকে এসেছে, যার অর্থ বৃত্ত বা রিং। সার্কাস একদিকে দেখাবার, অন্যদিকে দেখবার আসনখানিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ, খেলা দেখানো হয় গোলাকারে বা চক্রাকারে।ঠিক তার চারপাশে, বৃত্তাকারে দর্শকদের আসন তৈরি করতে হয়।এমনভাবে আসন তৈরি করতে হয় যাতে পেছনের দর্শক ও খেলা উপভোগ করতে পারে।প্রাচীনকালে রোম, মিশর, গ্রিসে বিভিন্ন ধরনের খেলা দেখানো হতো এবং জন্তুজানোয়ার সহযোগে পরিবেশিত হতো।।তৎপরবর্তী ভারতবর্ষ তথা বাংলায় এই খেলায় পারদর্শিতা দেখা যায় এবং তা আপামোর দর্শককে মুগ্ধ করে।গৌরবান্বিত এ অধ্যায়ের কথা আমরা কতোটুকু জানি!এক অসম সাহসী বাঙালি নবযুবক তার অদম্য ইচ্ছাশক্তিতেই গড়ে তুললেন এমন অনবদ্য ইতিহাস!
অদ্ভূতভাবে অষ্টাদশ শতকে পরাধীন ভারতবর্ষে সার্কাসের দল খুলেছিলেন এক বাঙালী, প্রিয়নাথ বসু। এইসূত্রে মনে করতে পারি, নবগোপাল মিত্রের কথা।যিনি একটি টাট্টু ঘোড়া সহযোগে খেলা দেখাতেন , সঙ্গে জিমন্যাস্টিক।যদিও সার্থকভাবে এটিকে সার্কাস বলা চলে না।এরপর তাঁর জামাই, রাজেন্দ্রলাল সিংহ 'গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস' নামে একটি দল তৈরি করেন মির্জাপুরে।এইসূত্রে মনে করতে পারি নাট্যকার মনোমোহন বসুর পুত্র প্রিয়নাথ বসুর নাম,তাঁর প্রধান শখ ছিলো শরীলচর্চা করা।সে সময় তিনি আহিড়ীটোলায় ব্যায়ামশিক্ষক গৌরহরি মুখোপাধ্যায়, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় আখড়া তৈরি করেছিলেন।তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্র প্রিয়নাথকে বেশ কিছু আখড়ার দায়িত্বভার দিয়েছিলেন।এই আখড়াগুলির কাজ চালাতে চালাতে প্রিয়নাথবাবু নিজস্ব কিছু আখড়া তৈরি করেন স্বতন্ত্র ভাবে, যেটি প্রথম তৈরি করেন তার নিজের বাড়ি কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে।মনে মনে সার্কাসের দল গড়ার অদম্য গুপ্ত বাসনা।গুপ্ত, কারণ পিতা মনোমোহন বসু অত্যন্ত অখুশি পুত্রের এই পেশাতে।তিনি নারাজ।কোনোভাবেই ছেলেকে সাহায্য করতে চান না।কিন্তু অদম্য সাহস, মনোবলকে আশ্রয় করে তিনি দিশা নির্ণয় করতে লাগলেন। বাড়ির মহিলাদের কাছে সাহায্য চাইলেন, তা পেলেন।বন্ধুবান্ধব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো।এতেও কি আর্থিক সমস্যা মেটে?তবু হাল ছাড়লেন না।দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে বাড়ি ছাড়লেন।সঙ্গে নিলেন কিছু জিমন্যাস্টিক খেলোয়াড়কে।এই সামান্য মূলধনে বিভিন্ন জমিদারবাড়িগুলোতে খেলা দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন।সেরকম বড়োসড়ো কোনো আয়োজন ছিল না।বসবার জন্য বাঁশের তৈরি মাচান, বাঁশের মাথায় আলো জ্বালিয়ে আলোর ব্যাবস্থা করলেন।বড়োসড়ো নামডাক হয়ে গেলো।আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এটুকু ব্যবস্থা গ্রামবাংলার মানুষজনের কাছে বিরাট ব্যাপার।প্রিয়নাথের আয় বাড়তে লাগলো, সাথে নামডাক।এরপর কলকাতায় ফিরে এসেই উপার্জিত টাকা দিয়ে সার্কাসের প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম কিনে ফেললেন।এবং দলের নাম তৈরি করলেন, Professor Bose's Great Bengal Circus. বাঙালির তৈরি প্রথম সার্কাস দল।এই দলটিই সঠিক অর্থে সার্কাস দল হিসেবে তৈরি হয়ে উঠেছিলো।প্রিয়নাথের দলটির নামের শুরুতে প্রফেসর লেখা হয়েছিল কারণ বড়লাট লর্ড ডাফরিন তাঁর দলের ছেলেদের অনুশীলনে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, who is the Professor? গুনমুগ্ধ ছাত্ররা খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রিয়নাথবাবুর নাম করেছিলেন।Great Bengal Circus বিভিন্ন জায়গায় খেলা দেখাতে থাকে, তাতে প্রচুর সুনাম অর্জন করতে থাকেন তিনি।এই জনপ্রিয়তার স্বীকৃতি পেতে থাকে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে।বিভিন্ন প্রদেশের রাজা মহারাজের আমন্ত্রন আসতে থাকে।গোয়ালিয়রের মহারাজা তাঁর প্রদর্শনীতে মুগ্ধ হয়ে দুটি বাঘ উপহার দিয়েছিলেন এবং আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছিলেন।এই ক্রমান্বয়ে দলটি ভারতবিখ্যাত একটি সার্কাস দলে পরিণত হয়।সে সময় যখন ইংরেজদের দাপটে ভারত জর্জরিত, তখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা এই যুদ্ধ, কম সাহসিকতার পরিচয় নয়!খুব সহজ ছিলো না এ পথ।প্রিয়নাথের মতো সাহসী ও পেশার প্রতি একনিষ্ঠ মানুষ বলেই এই দল তৈরি ও তাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিলো।রাজেন্দ্রলাল সিংহের Great Indian Circus এর মূল পরিচালক ছিলেন বিদেশী।যদিও প্রিয়নাথ বসুর বেশিরভাগ খেলোয়াড়েরাই দেশীয়।যেই কারণে ধীরে ধীরে প্রায় সব সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে এ দলের প্রশংসা।এই দল ১৮৮৭ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি খেলা দেখাতে পেরেছিল।প্রিয়নাথের সার্কাসে ছিল দেশজ ছোঁয়া।বাঙালি পরিচালক থেকে ক্রিড়াবিদ, অশ্বারোহী, পশুশিক্ষক।
এখানে অদ্ভুতভাবে বাঙালি মেয়েরা পর্যন্ত ঘোড়ায় চড়া ও বাঘের খেলা দেখাতেন।প্রথম মহিলা সার্কাস খেলোয়াড়, সুশীলা সুন্দরী ও তার বোন কুমুদিনী এই সার্কাসে খেলা দেখাতেন।তার কথা লিখিত আছে Daily Telegraph (1901) এ। " The astinishing courage of one of the ladies, Miss Sushila makes the spectators sit spell bound when she enters with easy grace, a cage of two tigers and ........." সে যুগে দাঁড়িয়ে এ স্পর্ধা, বাঘের খাঁচায় এক মহিলা --- এ কৃতিত্ব মাপবার মতো শব্দ আসা উচিত নয় হয়তো।সে সময়ের ইতিহাস ছুঁলে বুঝতে পারি, আজ এ সময় দাঁড়িয়েও কল্পনা চাওলা হওয়া কতো কঠিন আর এক বঙ্গললনার এতো স্পর্ধা, সীমিত পোশাকে, সর্বসমক্ষে নিজেকে প্রকাশিত করা সেই শতকে দাঁড়িয়ে!!নারীশিক্ষার জন্য স্কুল ও ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি বা গৃহস্থরা প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি তাদের কন্যাসন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে, কুসংস্কারে পরিপূর্ণ পরিমন্ডলে দাঁড়িয়ে শত বাঁধা উপেক্ষা করে সুশীলা ও তার বোন আমাদের পথ দেখায় অনন্য সম্মানের।
আমরা বরাবর ই বাঙালি জাতিকে অলস ও পরশ্রীকাতর বলেই শুনি।কিন্তু প্রিয়নাথবাবু সেই বাঙালি যিনি পাশবালিশে বাঙালির নামকে উপেক্ষা করে সদর্পে, কৃতিত্বের সাথে জীবন বাজি রেখে সকলের মনোরঞ্জন করে গেছেন।অথচ বাঙালি হিসেবে আমরা প্রিয়নাথবাবু অথবা সুশীলার এতো বড়ো কৃতিত্বের কোনো খতিয়ান ই রাখিনি।এ বড়ো আশ্চর্য্য হৃদয় বিদারক ব্যাপার।বাঙালি মধ্যবৃত্ত নিম্নবৃত্ত সমাজ প্রতি মুহূর্তে যেন সার্কাসের দড়িতে ভারসাম্য রক্ষার স্পর্ধা দেখাই।পথ প্রস্তুত করি অপরকে খুশি রাখার।এও তো এক সার্কাস ই।খেলা সার্কাস আর জীবন সার্কাস কোথায় মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।।
সুচিন্তিত মতামত দিন