অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

মায়াজম
0
বাঙালি এবং বাংলা ভাষায় ধর্ম-সংকট

(প্রথম পর্ব)
প্রশ্ন দিয়েই শুরু হোক এই প্রবন্ধ। প্রশ্নটা হল – বাংলা ভাষা কাকে বলে ? বস্তুত বাংলা ভাষা কাকে বলে, তার সংজ্ঞা দেওয়া খুব মুশকিল। বাংলা ভাষা কোনটা ? কলকাতার মান্য ভাষা ? ঢাকার মান্য ভাষা ? নাকি সিলেট বা চট্টগ্রামের বাংলা ভাষা ? নাকি মেদিনীপুর বা বর্ধমানের বাংলা ভাষা ? সবই যদি বাংলা ভাষা হয়, তবে কেন নোয়াখালির বাংলা ভাষা মেদিনীপুরের বাঙালি বোঝে না ? বর্ধমানের বাঙালি কেন ঢাকার ভাষা বোঝে না ?
বোঝেন কি ? দেখুন তো – একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল (কলকাতা), এক লোক্কার দুটা পো থাইল (মেদিনীপুর), য়্যাকঝোন্ ম্যানশের দুটা ব্যাটা ছিল (মালদাহ), এক লোকের দু বেটা রাহে (রাঁচির সরাকি), এক লোকের দুটা বেটা ছিল (মানভূম), এক লোকের দুটা ছা ছিল (সিংভূমের ধলভূম), অ্যাক জন মানশির দুটো ছাওয়াল ছিল (খুলনা, যশোহর), য়্যাক ঝনের দুই ব্যাটা ছৈল আছিল (বগুড়া), একজন মানশের দুইকনা ব্যাটা আছিন্ (রংপুর), একজন মানশের দুইডা পোলা আছিল (ঢাকা), য্যাক জনের দুই পুৎ আছিল (ময়মনসিংহ), এক মানুশর দুগুয়া পুয়া আছিল (সিলেট),  একজন মানুশর দুগুয়া পুয়া আছিল (কাছাড়), মুনি আগোর পুতো দুগো আসিল (মায়াং), এগুয়া মানশের দুয়া পুয়া আছিল (চট্টগ্রাম), একজন তুন দিবা পোয়া এল (চাকমা), একজনের দুই হুত আছিল (নোয়াখালি)। দেখুন একটিই বাক্য, তার কত রূপ। সবগুলিই বাংলা ভাষা হলে একজন আর-একজনের ভাষা শুনে মুখ টিপে হাসে।
আদি বাংলা ভাষার যে রূপ, সেই ভাষাই-বা কে বোঝে ?  আদি বাংলা ভাষা বলতে বোঝায় চর্যাপদগুলিকে, যা বৌদ্ধগান ও দোহা বলেও পরিচিত। প্রায় ৪০০ বছর আগের বাংলা হরফে লেখা সেই বাংলা হল – “কেহো কেহো তোহোরে বিরুআ বোলই/বিদুজণলোঅ তোরেঁ কণ্ঠ ন মেলই।” অথবা “শাখি করিব জালন্ধরি-পাএ/পাখি ণ রাহঅ মোরি পাণ্ডিআচাএ।” অথবা “কাহ্নে গাই তু কামচণ্ডালী/ডোম্বিত আগলি ণাহি চ্ছিণালী।” বাংলা ভাষার এই রূপকে বলা হয় বাংলা ভাষার শৈশব অবস্থা।
তারপর সময়ের স্রোতে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। যুগে যুগে ভাষাবিদরা এসেছেন এবং ভাষা সংস্কার করে রূপ বদল করেছেন।এ বিষয়ে সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যিনি নিয়েছিলেন, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তবে সমসাময়িক মদনমোহন তর্কালংকারের ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। বিদ্যাসাগর না জন্মালে মদনমোহন তর্কালংকারই হতেন আধুনিক বাংলা ভাষার পথ-প্রদর্শক। বাংলা ভাষার দুটি রূপ – একটি সাধু, অপরটি চলিত রূপ। সাধু রূপ অভিজাত রূপ, চলিত রূপ সাধারণের। মানুষের মুখের ভাষা যেমন পৃথকভাবে সাধু ভাষার চল ছিল, তেমনি চলিত ভাষার চলও ছিল। চলিত ভাষায় সাধু ভাষার মিশ্রণও ছিল। এখনও আছে, তবে মুখের বা কথ্য ভাষায়। সাধু ভাষা যখন লেখ্য হয়, তখন সাধু-চলিত মিশ্রণ গুরুচণ্ডালী দোষ বলে পরিত্যাজ্য। সাধু ভাষা হিন্দু বাঙালি পণ্ডিতদের ভাষা। তাঁদের বাংলা যে উচ্চবর্গীয় ভাষা, সেটা প্রমাণ করার জন্যই চলতি বা কথ্য বাংলা থেকে তারা পৃথক একটা ধারা গড়ে নিলেন। সেটাই সাধু ভাষা বলে পরে স্বীকৃতি পেল। এখানে শুধু যে ইতরজনকে অগ্রাহ্য করার মানসিকতা ছিল, সেটাই নয়। ঘোরতর সাম্প্রদায়িক মনোভাবও ছিল। বাংলা যাত্রা-থিয়েটার-সিরিয়াল-নাটকে আমরা দেখেছি ইংরেজ চরিত্রগুলি এক বিশেষ ধরনের বাংলা বলেন। যেমন -- ‘হামি ঠোমাকে যাইটে ডিবে না’ অথবা “এই ঘোষণা ডিকে ডিকে ছড়াইয়া দাও।” কোম্পানির সিভিলিয়ানরা এদেশে আসার পর স্থানীয়দের সঙ্গে কথোপনের তাগিদে তাঁদের অবশ্যই বাংলা আর হিন্দুস্তানি শিখতে হত। প্রথমে বারাসাত ক্যাডেট কলেজ আর তারপর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে। শেখাতেন কারা ? হিন্দু পণ্ডিতরা। বাংলার আম-জনতা যে ভাষায় কথা বলেন, সেখানে বহু ফারসি ও আরবি শব্দ ঢুকে পড়েছিল মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবে। সমগ্র ভারতে মুসলিম শাসনের ফলে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার মতো বাংলা ভাষাতেও আরবি ও ফারসি শব্দের প্রবেশ ঘটেছিল। মুসলিম শাসনামলে ফারসি ভাষাই ছিল সরকারি ও কাজের ভাষা। তাই ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষার মতো মুসলিম শাসনামলে ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে ফারসি ভাষা শিখতে হত। মুসলিমরা তো বটেই, বহু শিক্ষিত বাঙালিও ফারসি শিখেছিলেন। রামমোহন রায়ের সাহিত্যে ফারসি ভাষার প্রাবল্য দেখা যায়। আবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষা যেন সংস্কৃত ঘেঁষা। প্রচুর তৎসম শব্দের ব্যবহার। এখনকার বাঙালিদের কাছে সেই ভাষা অতি দুর্বোধ্য এবং সমাসবদ্ধ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যে সংস্কৃত অনেকটা সরিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষা অনেকটা প্রাঞ্জল হল, সুমধুর হল।
রামমোহন রায় – “উত্তর বেদার্থনির্ণয়কর্ত্তা মুনিগণের বাক্যে পরস্পর বিরোধ আছে এ নিমিত্ত যদি বেদ বিচারণীয় না হয়েন তবে পরস্পরবিরুদ্ধ যে ব্যাসাদি ঋষিবাক্য তাহা কি রূপে বিচারণীয় হইতে পারে অতএব এই যুক্তির অনুসারে পুরাণ এবং [৯] ইতিহাস প্রভৃতি যাহা ঋষিবাক্য তাহাও বিচারণীয় না হইয়া সকল ধর্ম্মের লোপাপত্তি হয় দ্বিতীয়ত এ স্থলে জিজ্ঞাস্য এই যে দুর্জ্ঞেয় নিমিত্ত বেদ যদি ব্যবহায্য না হয়েন তবে আপনারা গায়ত্রী সন্ধ্যা দশ সংস্কার প্রভৃতি বেদমন্ত্রে করেন কি পুরাণবচনে করিয়া থাকেন।” (গোস্বামীর সহিত বিচার, ১৮১৮)
বিদ্যাসাগরের বাংলা – “নবজলধরকলেবর মহাবল পরাক্রান্ত অসুরেরাও গিরিনিক্ষেপ দ্বারা দেবদল দলন করিতে আরম্ভ করিল। তখন আকাশমণ্ডল হইতে অতি প্রকাণ্ড ভয়ানক ভূধর সকল পরস্পরাভিঘাতপূর্বক বহুবিধ জলধরের ন্যায় সমস্ততঃ পতিত হইতে লাগিল। এইরূপ অবিরত অদ্রিপাতে অভিহতা হইয়া সদ্বীপা সকাননা পৃথিবী বিচলিতা হইল।” (মহাভারতের উপক্রমিকা, ১৮৬০)
বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা – “পরাণ দেখিল সর্ব্বস্ব গেল। মহাজনের ঋণও পরিশোধ করিতে পারিব না, জমীদারের খাজানাও দিতে পারিব না, পেটেও খাইতে পারিব না। এত দিন পরাণ সহিয়াছিল – কুমীরের সঙ্গে বাদ করিয়া জলে বাস করা চলে না। পরাণ মণ্ডল শুনিল যে, ইহার জন্য নালিশ চলে। পরাণ নালিশ করিয়া দেখিবে।” (সাম্য, ১৮৭৯)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতো ভক্তি করিত। অবশেষে অন্নপূর্ণা বিহারীকে নিজে ডাকিয়া কহিলেন, “সে কি হয় বাছা। না দেখিয়া বিবাহ করিবে, সে কিছুতেই হইবে না। যদি পছন্দ না হয় তবে বিবাহে সম্মতি দিতে পারিবে না, এই আমার শপথ রহিল।” নির্ধারিত দিনে মহেন্দ্র কলেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া মাকে কহিল, “আমার সেই রেশমের জামা এবং ঢাকাই ধুতিটা বাহির করিয়া দাও।” মা কহিলেন, “কেন, কোথায় যাবি ?” (চোখের বালি, ১৯০৩)
এখানে চারজন বিখ্যাত লেখকের সাধু ভাষায় লিখিত বিভিন্ন সময়ের বাংলা ভাষার নমুনা তুলে ধরলাম। লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন কতটা পরিবর্তন হচ্ছে বাংলা ভাষায়। রামমোহনের উদ্ধৃতাংশটি ভালোভাবে লক্ষ করুন। দীর্ঘ বাক্যের উদ্ধৃতি এবং কোনো ছেদচিহ্নের ব্যবহার নেই বাক্যশেষে একটি দাড়িচিহ্ন ছাড়া। ভাষারও অনেক তফাৎ লক্ষ্যণীয় আছে। সময় যত এগিয়েছে ততই বাংলা ভাষা সহজ থেকে সহজতর হয়েছে, আড়ষ্টতা মুক্ত হয়ে বাংলা ভাষা ক্রমশ মিষ্টি হয়ে ওঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে বাংলা ভাষা অনন্য সাধারণ রূপ পায়। বাংলা ভাষা বিবিধ ভাব-কল্পনার আদর্শ বাহন হয়ে ওঠে। তাঁর ভাষা হয় সংগীতময় ও সংকেতময়। তবে সমসাময়িক সাহিত্যিক বা বাংলা ভাষার সাধকরা কেউ কেউ তাঁকে অনুসরণ করলেও বেশিরভাগই তাঁর সুচারু ধারা অনুসরণ করেছেন, তা বলা যায় না। তখনো মান্য বাংলা ভাষা গড়ে ওঠেনি। যে যে-ধারা পারছে সে সেই ধারায় লিখছে। ডি এল রায় বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাংলা ভাষার কথাই ধরি না কেন। ১৯০৯ সালে তিনি লিখলেন ‘সাজাহান’ নাটকটি। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখলেন চলিত ভাষায়।
চলিত ভাষার প্রচলন অবশ্য টেকচাঁদ ঠাকুরের লেখনী ধরে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই বছরটাকে বলা যায় যুগসন্ধি।এই সময়ে নানা দিক দিয়ে যুগের পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। তাঁর মধ্যে টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটি ভাষার প্রকাশে রীতির পরিবর্তনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যাপক উন্নতির সূচনা হয়। আলালের ঘরের দুলালের মধ্য দিয়ে শুরু হল চলিত ভাষার দুরন্ত যাত্রা। আলালের ঘরের দুলালকে চলিত ভাষার মাইলস্টোন বলা যায়। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটি পরিবর্তন যুগের স্মরণ চিহ্ন স্বরূপ আজও আক্ষয় মহিমায় বিরাজ করছে। এই ভাষা-রীতিকে সেই যুগসন্ধিক্ষণের স্মারক গ্রন্থ এবং নতুন ধারার জয়স্তম্ভ বললেও অন্যায় হয় না। ‘মাসিক পত্রিকা’ বাংলা সাহিত্যজগতে যাঁরা বিপর্যয় ঘটিয়েছিল, তার মধ্যে প্যারীচাঁদ অন্যতম। প্যারীচাঁদ ছাড়াও আর-একজন ভাষা-বিপ্লবী হলেন রাধানাথ। এছাড়া কিশোর কালীপ্রসন্নের হাত ধরে সেটাই প্রবল আকার ধারণ করে প্রাচীনপন্থীদের চিত্তবিক্ষোভের কারণ হয়েছিল। সমসাময়িক ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় সেই বিক্ষোভের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে আলালি ভাষা ও রুচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। চলিত ভাষাকেই আলালী ভাষা বলা হত। চলিত ভাষাকে ‘আলালি ভাষা’ হিসাবে এটাই সর্বপ্রথম প্রয়োগ। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ গ্রন্থে আলালি ভাষার সার্থকতা স্বীকার করেন। নতুন ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রক্ষিতে আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন – “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কৃত-বহুল রচনার বিরুদ্ধে একটা revolt হইয়াছিল। বোধ হয়, ১৮৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাধানাথ সিকদার ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একখানি কাগজ বাহির করেন, তাহাতে অনেক চলিত ভাষা ব্যবহৃত হইত। একটা প্রবন্ধের মধ্যে ‘Xenophon থেকে ভাঙ্গা’ এই শব্দযোজনা ছিল। তিনি তাঁহার ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এ সেই tendency-র চূড়ান্ত করিয়া যান।” শুধু রাধানাথ শিকদারই নয়, শিবনাথ শাস্ত্রীও এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। তিনি তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখলেন – “একদিকে পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অপরদিকে খ্যাতনামা অক্ষয়কুমার দত্ত – এই উভয় যুগপ্রবর্ত্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত-বহুল হইয়া দাঁড়াইল। … অনেকে এরূপ ভাষাতে প্রীতিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ লোকের নিকট, বিশেষতঃ সংস্কৃতানভিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিকট ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন ও দুর্ব্বোধ্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। … যখন বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়বাবুর সংস্কৃত-বহুল বাঙ্গালার ভার দুর্ব্বহ হইতে লাগিলে, তখন ১৮৫৭, কি ৫৮ (১৮৫৪) সালে, ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে এক ক্ষুদ্রকায়া পত্রিকা দেখা দিল। …টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙ্গালার প্রথম উপন্যাস। …আলালের ঘরের দুলাল বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগ আনয়ন করিল। এই পুস্তকের ভাষার নাম ‘আলালী ভাষা’ হইল।তখন আমরা কোনও লোকের ভাষাকে গাম্ভীর্য্যে হীন দেখিলেই তাহাকে আলালী ভাষা বলিতাম। এই আলালী ভাষার উৎকৃষ্ট নমুনা ‘হুতুমের নক্সা’। … এই আলালী ভাষার ভাষার সৃষ্টি হইতে বঙ্গ-সাহিত্যে গতি ফিরিয়া গেল। ভাষা সম্পূর্ণ আলালী রহিল না বটে, কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রী রহিল না, বঙ্কিমী হইয়া দাঁড়াইল।” রাজা রামমোহন রায় সে সময়ের প্রথম গদ্য লেখক। তার পর যে গদ্যের সৃষ্টি হল, তা লৌকিক বাংলা ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপের। বাংলা ভাষা দুটি স্বতন্ত্র ভাষায় পরিণত হয়েছিল। একটির নাম সাধুভাষা, অর্থাৎ সাধুজনের ব্যবহার্য ভাষা। আর অন্যটি অপর ভাষা, অর্থাৎ সাধু-ভিন্ন অপর ব্যক্তিদের ভাষা। এখানে ‘সাধু’ অর্থে ‘পণ্ডিত’ বুঝতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান” প্রবন্ধে লিখছেন -- “আমি নিজে বাল্যকালে ভট্টাচার্য্য অধ্যাপকদিককে যে ভাষায় কথোপকথন করিতে শুনিয়াছি, তাহা সংস্কৃতব্যবসায়ী ভিন্ন অন্য কেহই ভালো বুঝিতে পারিতেন না। তাঁহারা কদাচ ‘খয়ের’ বলিতেন না, -- ‘খদির’ বলিতেন; কদাচ ‘চিনি’ বলিতেন না  -- ‘শর্করা’ বলিতেন। ‘ঘি’ বলিলে তাঁহাদের রসনা অশুদ্ধ হইত, ‘আজ্য’-ই বলিতেন, কদাচিৎ ‘ঘৃত’-এ নামিতেন। ‘চুল’ বলা যাইবে না, -- ‘কেশ’ বলিতে হইবে। ‘কলা’ বলা হইবে না, -- ‘রম্ভা’ বলিতে হইবে। ফলাহারে বসিয়া ‘দই’ চাহিবার সময় ‘দধি’ বলিয়া চীৎকার করিতে হইবে। আমি দেখিয়াছি, একজন অধ্যাপক একদিন ‘শিশুমার’ ভিন্ন ‘শুশুক’ শব্দ মুখে আনিবেন না, শ্রোতারা কেহ শিশুমার অর্থ জানে না, সুতরাং অধ্যাপক মহাশয় কি বলিতেছেন, তাহার অর্থবোধ লইয়া অতিশয় গণ্ডগোল পড়িয়া গিয়াছিল। পণ্ডিতগণের কথোপকথনের ভাষাই যেখানে এইরূপ ছিল, তবে তাঁহাদের লিখিত বাঙ্গালা ভাষা আরও কি ভয়ঙ্কর ছিল, তাহা বলা বাহুল্য। এরূপ ভাষায় কোনও গ্রন্থ প্রণীত হইলে, তাহা তখনই বিলুপ্ত হইত; কেন না, কেহ তাহা পড়িত না।”
সংস্কৃত পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজে খুব একটা সংস্কৃত লিখতে চাইতেন না। কিন্তু সংস্কৃত ভাষার প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাকে বাংলা ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বটে। কেনই-বা তিনি সংস্কৃতের প্রয়োজনীয় বিষয়কে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন, তার উত্তর পাওয়া যায় প্রাচীন ভারত ও সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদী কাণ্ডজ্ঞানের মধ্যে। বিদ্যাসাগর এই সংস্কৃত বিষয়ক হিঁদুয়ানিকে মোটেই স্বীকার করেন না। এমনকি সংস্কৃতকে অজর-অমর-আদি-অকৃত্রিম ভারতীয় ভাষা বলেও মনে করেন না। তিনি মনে করতেন সংস্কৃত ভাষাও বহিরাগত। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষার প্রকাশক্ষমতা সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন একথা অবশ্য সত্য।  সেই ভাষার সাহিত্যও তাঁর মনোহরণ করেছিল। পাশাপাশি সংস্কৃতকে অপরিবর্তনশীল হিন্দু-ভারতের সম্পদ হিসেবেও তিনি বাঙালিদের ঘাড়ের উপর মোটেই চাপিয়ে দিতে চাননি। শ্রদ্ধা আলাদা বিষয়, আর সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি আর-এক বিষয়। বিদ্যাসাগর বরাবরই সেটাকে পৃথকভাবেই দেখতেন।
অপরদিকে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ১৮৩৮ সালে ‘পারসিক অভিধান’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, যিনি যে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন, বিদ্যাসাগর সেই সংস্কৃত কলেজেরই পণ্ডিত ছিলেন। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার কেন এই বিশেষ অভিধানটি লেখার প্রয়োজন বোধ করলেন ? বস্তুত এই অভিধানটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার থেকে আরবি-ফারসি শব্দগুলিকে বর্জন করে ফেলা। বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে যে যে  শব্দগুলি (যেমন – দোকান, পর্দা ইত্যাদি) সমৃদ্ধ হয়ে আছে, সেগুলি যে ‘অসংস্কৃত’ উৎস থেকে এসেছে জয়গোপাল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যবনদের হাতফেরতা হয়ে আসা এই শব্দগুলিকে বাংলার ভাণ্ডার থেকে বাতিল করা উচিত। কারণ যবনরা বহিরাগত। তার বদলে চালু করা হোক পরিশুদ্ধ সংস্কৃত উৎস-জাত শব্দ। রক্ষণশীল জয়গোপাল মনে করতেন দোকানের বদলে ‘বিপণী’ লিখলেই হিন্দু তাঁর অতীতকে ফিরে পাবে, হিন্দুত্বকে পুনর্নির্মাণ করা যাবে। বিদ্যাসাগর তাঁর পাণ্ডিত্য ও যুক্তিবোধ দিয়ে জয়গোপালের এই অতীতচারী হিন্দু-মনোভাবের বিরোধিতা করেছিলেন।  জয়গোপাল আরবি-ফারসিকে বহিরাগত ভাষা হিসাবে দেখেন এবং সংস্কৃতকে প্রাচীন হিন্দু-ভারতের ভাষা হিসেবে অটল ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি। সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের ধারণা তাঁর ‘সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’ নিবন্ধে স্পষ্ট করেছেন। তাঁর বক্তব্য – “সংস্কৃত ভারতবর্ষের আদিম নিবাসী লোকদিগের ভাষা নহে; সংস্কৃতভাষী লোকেরা, পৃথিবীর অন্য কোন প্রদেশ হইতে আসিয়া, ভারতবর্ষে আবাস গ্রহণ করিয়াছেন।” এই প্রসঙ্গে পণ্ডিত কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের বক্তব্যও স্মতর্ব্য। তিনি বলেছেন – “এক হিন্দিভাষী পণ্ডিত এক বার তাঁর কাছে এসে সংস্কৃত ভাষায় কথা-বার্তা বলছিলেন। বিদ্যাসাগর তাঁর কথার জবাব সংস্কৃতে না-দিয়ে হিন্দিতে দিচ্ছিলেন। তিনি জানতেন যে নব্য ভারতীয় ভাষাগুলি ক্রমে বিকাশ লাভ করছে, সেই ভাষাগুলিকে মর্যাদা দিতে হবে। সংস্কৃত আদি ভাষা বলে মাননীয় ও অপরিবর্তনীয় ভাবে অনুসরণযোগ্য, এই একভাষাসূত্র অর্থহীন।
ফলে শুরু হল বাংলা ভাষার ভাঙাগড়া। মোট কথা সে সময়ে বাংলা ভাষা সংস্কৃতের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের মুখের ভাষাই লেখ্য ভাষা হয়ে উঠতে থাকল। বাংলা ভাষা আর পাণ্ডিত্যের সাধু ভাষা (লেখ্য ভাষা) হয়ে থাকতে চাইল না। মানুষ যে ভাষারীতিতে কথা বলে বাংলা সাহিত্যের ভাষারীতিও সেই পথেই ক্রমশই সাবলীল হতে থাকল। সেই ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত, পরমাদরে।
যে আলালের ঘরের দুলালের ভাষারীতি নিয়ে এতগুলো কথা বলা হল, সেই ভাষারীতি সামান্য চাক্ষুষ করব না ! আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থে চলিত ভাষার আদি রূপ – “মুনসি সাহেবের দুর্গতির কথা শুনিয়া বাবুরাম বাবু বলিলেন – মতিলাল তো আমার তেমন ছেলে নয় – সে বেটা জেতে নেড়ে – কত ভাল হবে ? পরে ভাবিলেন যে ফার্সির চলন উঠিয়া যাইতেছে, এখন ইংরাজী পড়ান ভালো। যেমন ক্ষিপ্তের কখন কখন জ্ঞানোদয় হয় তেমনি অবিজ্ঞ লোকেরও কখন কখন বিজ্ঞতা উপস্থিত হয়। বাবুরাম ঐ বিষয় স্থির করিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন আমি বারাণসী বাবুর ন্যায় ইংরাজী জানি – “সরকার কম স্পিক নাট” আমার নিকটস্থ লোকেরাও তদ্রূপ বিদ্বান্, অতএব একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট পরামর্শ লওয়া কর্ত্তব্য।”
এই হল আদি চলিত ভাষার আঁতুরঘর। চলিত ভাষার প্রচলন বটে, কিন্তু সাধু-বর্জিত হল না মোটেই। সাধু ভাষার খোলস ছেড়ে সাধু-চলতি মিশ্রিত এক বিজাতীয় ভাষার উদ্ভব হল, যা গুরুচণ্ডালি দোষ বলে চিহ্নিত হল। গুরুচণ্ডালি দোষে দুষ্ট হয়ে কয়েক যুগ কেটেও গেল। আজও বহু বাঙালি সাধু-চলিত মিশ্রিত ভাষায় লেখালেখি করে থাকেন। তবে গুরুচণ্ডালী দোষযুক্ত বাংলা পরীক্ষার হলে লিখলে নম্বর কাটা গেলেও তার বাইরে গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট বাংলাভাষাকে সাধারণ মানুষ তেমন ধষ্টব্যের রাখেন না।
বাংলা ভাষার বিবর্তন অবশ্যই জারি থাকল সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে। সাধারণ মানুষ গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট বাংলা ভাষা লিখলেও ক্রমশ বাংলা সাধু-বর্জিত হয়ে প্রকৃত চলিত ভাষায় রূপান্তরিত হল বাংলা সাহিত্যে। প্রকৃত চলিত ভাষার একটি নমুনা – “কী ভুলো মন দেখুন আমার। নিজের কথাই বকে মরছি। কিন্তু আমার কথা তো জানতে চান নি আপনারা। চেয়েছেন তাঁর কথা জানতে। সুতরাং আমার কথা থাক। আমি শুধু প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাইছিলাম যে আমি ভারতীয় সেনা কিনা সে বিষয়ে সে বিষয়েই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল আমার। জীবনের বিশটা বছর সে কথা আমার খেয়াল ছিল না। জানলাম প্রথম – যেদিন তামিলনাদের এই নায়ার পরিবারটিকে জাহাজে ঠাঁই দেওয়া হল না, আমরা ভারতীয় বলে।”(আমি নেতাজিকে দেখেছি, নারায়ণ স্যানাল)
আজকের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের যে বাংলা ভাষা, তা একান্তই হিন্দু বাঙালিদের ভাষা। সংস্কৃত-মুক্ত বাংলা ভাষা। পাশাপাশি আর-একটি বাংলা ভাষারীতি বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত আছে। সেই ভাষাতে আরবি-ফারসির শব্দ-আধিক্য লক্ষ করা যায়। হিন্দু বাঙালিরা সংস্কৃত মুক্ত বাংলা ভাষায় লেখ্য ভাষা ও কথ্য ভাষায় সংস্কৃত-মুক্ত চলিত ভাষা ব্যবহার করলেও, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরা আরবি-ফারসি মুক্ত হতে পারেনি। বরং বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে। হিন্দু বাঙালির বাংলা ভাষা আর মুসলিম বাঙালির বাংলায় পৃথকীকরণ সম্পন্ন হয়েছে। সেই কারণেই বোধহয় হিন্দু বাঙালিদের মুখে শোনা যায় --- “আমরা বাঙালি, ওরা মুসলমান”। অর্থাৎ মুসলিমরা বাঙালি নন। কেন বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের বাংলা ভাষা আর বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বাংলা ভাষা পৃথক হল ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আরও অনেক পিছনের দিকে হাঁটতে হবে।

(দ্বিতীয় পর্ব)
ভারতে মুসলিম শাসকদের প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে। কারণ মুসলিম শাসকরা হয় আরব দেশ, নয় মঙ্গোলিয়া, নয়তো আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন। রাজভাষাই হল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা কাজের ভাষা। সুলতানি শাসনামলে আরবি ছিল বাংলার মুসলমানদের ভাষা, ধর্মীয় ভাষা। আর ফরাসি ছিল রাজ-সরকারের ভাষা।তৎকালীন সময়ে ফারসি রাজভাষা হলেও গৌড়ের স্বাধীন সুলতানেরা দেশি বাংলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজাদের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের জন্য প্রচুর যোগ্য হিন্দুদের বড়ো বড়ো রাজপদে নিয়োগ করেন। মুসলিম শাসকদের উদারতায় মুসলিম শাসনের উপর হিন্দু প্রজাদের আস্থা বৃদ্ধি পায়। সেই আস্থা থেকে হিন্দু কর্মচারীরা রাজভাষা ফারসি শিখে নিলেন এবং মুসলিম শাসকদের রাজকার্যে সহযোগিতা করতে শুরু করেছিলেন। মুসলিম শাসকরাও হিন্দু কবিদের কাব্যচর্চায় উৎসাহ দিতে থাকলেন। তেরো শতকের শুরুতেই বহিরাগত তুর্কি সেনারা ধর্মে ইসলাম অনুসারী হলেও সংস্কৃতিতে পারসিক বা ফারসি। তাঁরা বাড়ির ভিতর নিজেদের মধ্যে তুর্কি ভাষায় কথাবার্তা বললেও রাজদরবারে সরকারিভাবে ফারসি ভাষায় কাজকর্ম করতেন। আবার ধর্মাচরণে ব্যবহার করতেন আরবি ভাষা। এভাবেই রাজার ভাষার প্রভাব প্রজাসাধারণের উপর পড়তে শুরু করে দেয়।
চোদ্দো শতকের শেষ দিকে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’, বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’, বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’, কবীন্দ্র পরমেশ্বরের ‘মহাভারত পাঁচালী’, শ্রীকর নন্দীর ‘অশ্বমেধ পর্ব’, দ্বিজ শ্রীধরের ‘বিদ্যাসুন্দর’, শাহ মোহাম্মদ সগিরের ‘ইউসুফ জোলেখা’-র মতো কালজয়ী কাব্য রচিত হয়েছিল। শাহ মোহাম্মদ সগিরের ‘ইউসুফ জোলেখা’-ই ছিল প্রথম মুসলমান রচিত বাংলা কাব্য। 
এ সময়ই মুসলমান শাসনের প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ ঢুকে পড়ে। বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবি-ফারসির মিশ্রণে এক অন্য ধারার বাংলা ভাষার উদ্ভব হল। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শেষ স্বাধীন পাঠান সুলতান দাদ খাঁ কররানির পতন পর্যন্ত গৌড়ের দরবারে বাংলা ও সাহিত্যের প্রভূত কদর ছিল। সেই সময়ে স্থানীয় প্রজাদের সঙ্গে দরবারের লোকজনদের ওঠা-বসা, লেনদেন ও ভাবের আদানপ্রদানে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এও আরবি-ফারসির ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে যায়। তবে মোগল শাসকরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহ না-দেখালেও সে সময়ের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ও স্থানীয় জমিদারদের পৃষ্টপোষকতায় সাহিত্য ধারা অব্যাবহত ছিল। এ সময়ই বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যে জনজীবনে বহুল ব্যবহৃত তদ্ভব ও দেশি শব্দের পাশাপাশি আরবি-ফারসি শব্দও স্থান পেয়েছে। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কাব্যও আরবি-ফারসি শব্দের কুশলপ্রয়োগরীতি তাঁর  ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য সুললিত করেছে। আঠারো শতক নাগাদ রামমোহন রায়ের মতো হিন্দু ব্যক্তিরাও আরবি-ফারসি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝাই প্রথম সেই বিদ্রোহী, যিনি সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মকথা বাংলা ভাষায় লেখার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাংলা ভাষায় রামায়ণ করেন। এরপর বাংলার সুলতানদের এবং দরবারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রেরণায় সংস্কৃত ছেড়ে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চাতে মনোনিবেশ করেন বাংলার কবিগণ। তবে একথাও মনে রাখা দরকার, সংস্কৃত রাজভাষার মর্যাদা হারালেও মুসলমানদের একটা অংশ সংস্কৃত চর্চা করতেন। কিন্তু সুলতানেরা পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করাতে উৎসাহ জুগিয়ে যেতেন। সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায় বাংলা ভাষায় অনূদিত হতে থাকল রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের মতো গ্রন্থগুলি। উদারমনস্ক মুসলিমদের প্রচেষ্টাতেই সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মগ্রন্থগুলি আমরা বাংলা ভাষাতে পাই। তবে সবাই তো উদারমনস্ক হতে পারে না। কিছু সংকীর্ণমনা মওলানা ধর্মগ্রন্থগুলি বাংলা অনুবাদে কাঠি দিয়ে থমকে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি ফারসি ভাষাতে কোরান অনুবাদ করতে গিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ একদল মৌলভি দ্বারা প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। এরপরেও পাশাপাশি মুসলিম লেখকরা সংস্কৃত গ্রন্থগুলি আরবি-ফারসি ভাষাতেও অনুবাদ করতে থাকে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদারের মতো লেখকদের বাংলাতে আরবি-ফারসির ব্যবহার বৃদ্ধিতে বাংলা ভাষার এক অন্যরকম শ্রীবৃদ্ধি হয়। তবে কাজী নজরুল ইসলামের কবি-সাহিত্যিকদের বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি মুখর হয়ে উঠল। কাজী নজরুলের বাংলা ভাষার একটা নমুনা দিই। তাহলে ব্যাপারটা একটু বোঝা যাবে – “আমি আল্লার ডাকে ছুটে যাই যবে তুমি মোনাজাত করগো নীরবে/তুমি যে খোদার দেওয়া – সওগত সম বেহেস্তের সাথী/তুমি যে ঈদের চাঁদ/তব তরে জাগিয়া কাটাই রাতি/তুমি নারী আগে আনিলে ইমান দীন ইসলাম পরে/তুমি যে বিজয়ী খোদার রহম আনিয়াছ জয় করে।” অথবা “আসিছেন হবিবে খোদা, আরশ পাকে তাই উঠেছে শোর/চাঁদ পিয়াসে ছুটে আসে আকাশ পানে যেমন চকোর/কোকিল যেমন গেয়ে ওঠে ফাগুন আসার আভাস পেয়ে/তেমনি করে হরষিত ফেরেশতা সব উঠলো গেয়ে।” এখানে লক্ষ করুন ‘আল্লা’, ‘মোনাজাত’, ‘খোদা’, ‘সওগত’, ‘বেহেস্ত’, ‘ইমান’, ‘দীন’, ‘রহম’, ‘হবিবে’, ‘আরশ’, ‘পাক’, ‘শোর’, ‘পিয়াসে’, ‘ফেরেশতা’ শব্দগুলির ব্যবহার একমাত্র মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরাই ব্যবহার করতেন। হিন্দু বাঙালি সাহিত্য ও মুখের ভাষায় পর্দা, দৌলত, মস্তান, বাবা ইত্যাদি আরবি-ফারসি শব্দগুলির ব্যবহার করলেও নজরুল ব্যবহৃত শব্দগুলি কখনোই ব্যবহার করেনি। যদিও বহু হিন্দু ব্যক্তিত্ব আরবি-ফারসি ভাষাশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও আরবি-ফারসি যথেচ্ছ ব্যবহার করেননি। বরং বলা ভালো পর্তুগিজ, ইংরেজি, জাপানি, তুর্কি ইত্যাদি সমস্ত বিদেশি শব্দ আত্মসাৎ করে হিন্দুদের এক বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। এমন অনেক বিদেশি শব্দ হিন্দু বাঙালিদের বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে আছে, সেসব শব্দ যে বাংলা নয়, একথা বিশ্বাসই হয় না। কয়েকটা উদাহরণ রাখা যাক – আরবি : আক্কেল, আসল, এলাকা, ওজন, খবর, খালি, খেয়াল, গরিব, জমা, জিনিস, তারিখ, বদল, নকল, বাকি, হিসাব ইত্যাদি। ফারসি : আন্দাজ, আয়না, আরাম, আস্তে, কাগজ, খারাপ, খুব, গরম, চশমা, চাকরি, চাদর, জায়গা, দেরি, বাগান, রাস্তা, পছন্দ, হিন্দু (ধর্ম অর্থে নয়, ভারতীয় বা ভারতবর্ষীয় অর্থে) ইত্যাদি।তুর্কি : দাদা, বাবা, চাকর, চাকু, তোপ ইত্যাদি। জাপানি : বোকা, হাসি, চা, লিচু, রিকশা ইত্যাদি।ওলন্দাজ : ইস্কাবন, রুইতন, হরতন, টেক্কা, তুরুপ ইত্যাদি। পর্তুগিজ : ইস্ত্রি, আলমারি, ইস্পাত, চাবি, জানালা, তামাক, পেরেক, বারান্দা, ফিতা, বোতাম, সাবান, কাজু, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি। ইংরেজি : আফিম, অফিস, জেল, পুলিশ, ব্যাংক, ভোট, কাপ, গ্লাস, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি। উল্লিখিত শব্দগুলি বিদেশি শব্দ বটে, কিন্তু এগুলিও বাংলা ভাষা হয়ে গেছে। অথচ এগুলি কোনোটাই বাংলা শব্দ নয়। যদিও শব্দগুলি হিন্দু-মুসলিম বাঙালি নির্বিশেষে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক আরবি-ফারসির ব্যবহার উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালিই করে। আজও বাড়ির দলিল-দস্তাবেজে আরবি-ফারসির আধিক্য বহমান।বিশুদ্ধ বাংলায় জমির দলিল লেখার প্রচলন হয়নি। তার কারণ দলিল-লেখকদের একটা বড়ো অংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের।
এখন কথা হল হিন্দু বাঙালিদের বাংলা ভাষার চেয়ে মুসলমানদের বাংলা ভাষা আরবি-ফারসির এত আধিক্য কেন ? কেন এমন সব আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হয়, যা হিন্দু বাঙালিরা ব্যবহার করে না ? এরও একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুত বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুর ভাষা এক হলেও উভয় পক্ষের শিক্ষাদীক্ষা এবং ধর্মীয় আদর্শে স্বাতন্ত্রতা আছে। এজন্য একের আদর্শ, ভাব, চিন্তাপ্রণালী ঠিক অন্যের মতো কখনোই হতে পারে না। তার মানে বাঙালি বলা যাবে না, তা তো হয় না। ধর্ম এক হয়েও ভাষা ও মানসিকতার পৃথকতা থাকে। মেদিনীপুরের ভাষা ও মানসিকতা আর উত্তর ২৪ পরগনার ভাষা ও মানসিকতা পৃথক, তেমনি বরিশালের ভাষা ও মানসিকতা আর সিলেটের ভাষা ও মানসিকতাও পৃথক।   সাহিত্যের ক্ষেত্রেও উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি আছে, থাকবেও। ভারত ভাগের পর এই সীমারেখা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় আড়াআড়িভাবে।  কারণ ভারত ভাগের আগে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কলকাতার লেখক-সাহিত্যিকদেরই একাধিপত্য ছিল। যদিও বাংলা সাহিত্যের আধুনিককাল আরম্ভ হয়েছিল পশ্চিমবাংলার মানুষের হাত ধরে। সে সময় পূর্ব বাংলার মানুষ ভাষা-সাহিত্যে পশ্চাৎপদ ছিল, একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিল মুসলিম শাসকেরা। সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁরাই বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা বানিয়েছিল। মুসলমানদের উৎসাহেই বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে শাসন-ক্ষমতা হারানোর শোকে মুসলমানেরা  নতুন শাসক ব্রিটিশের সঙ্গে অসহযোগিতায় করতে শুরু করল। ফলে মুসলমান কোন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি না হয়নি। যখন তৈরি হয়েছিল, তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফরায়েজি আন্দোলনের হোতারাই এর জন্য দায়ী। তাঁরা মুসলমানদের আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে নিয়ে যায়। এটা পিছিয়ে দেয় মুসলমানদের অনেক বছর। প্রায় শতাধিক বছর। আর সেসময়ে হিন্দু সমাজে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষরা জন্ম নিয়েছিলেন। যারা শিক্ষায় ওদের অনেক এগিয়ে নিয়ে যায়। মুসলিম সমাজে তার মতো কেউ এখনও জন্ম নেয়নি। যখন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল তখন কানাকড়িও ছিল না, লেংটিই হয়েছিল সম্বল। শিক্ষায় দীক্ষায় জ্ঞানে চিন্তাধারায় হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকে মুসলমান সম্প্রদায় বহু যোজন দূরে পিছিয়ে পড়ল। তার প্রভাব ভাষাতেও পড়ল। হিন্দুরা বেশি করে ইংরেজি আঁকড়ে ধরল। আর মুসলমান বেশি বেশি করে আরবি-ফারসি আঁকড়ে ধরল। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে বাংলায় যে রেনেসাঁ এসেছিল, তার ভাগিদার ছিল না মুসলিমেরা। তারা ইংরেজি শিক্ষা নেয়নি বলেই। এটা তো ঠিক, ইংরেজি না জানলে সে আমলে অন্তত রাজানুকূল্য পাওয়া যেত না। যেটা ঘটেছে মুসলিমদের সঙ্গে। ব্রিটিশরাজের আনুকূল্য থেকে মুসলমানরা চরমভাবে বঞ্চিত হল। যখন এদেশে মুসলিম শাসন ছিল, তখন ফারসি ভাষার ছিল জয়জয়কার। লক্ষ করে দেখবেন, অনেক হিন্দুও ফারসি শিখেছিল সেসময়ে, যাতে তাঁরা রাজদরবারে মুন্সির চাকরি পায়। ইংরেজি না শেখায় মুসলমানেরা সরকারি চাকরিতেও ছিল খুব কম।
ইংরেজদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলমানদের যে ক্ষতিসাধন হয়েছিল তা কোনোদিনই পূরণীয় হয়।
ইংরেজ শাসনের প্রতি মুসলিম প্রজাদের আস্থাহীনতা চরম ক্ষতি করেছে মুসলিম সম্প্রদায়কে। আবেগের দিক থেকেও মুসলিমরা ইংরেজ শাসন মেনে নিতে পারেনি তাঁরা। তার উপর ইংরেজরা যখন হিন্দুদের নানা সুবিধা দিতে থাকে, সেটা তাদের মনে অবহেলার জন্ম দেয়। তাঁরা সবক্ষেত্রে ইংরেজদের অসহযোগিতা করতে থাকে, আর ফলাফলে পিছিয়ে পড়ে। ১৭৯৩ সালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চালু করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এতে বাংলার হিন্দু জমির মালিকরা রাতারাতি সব জমির একমাত্র মালিক হয়ে যায়। তাঁদের ক্ষমতা ও আভিজাত্য বেড়ে যায় অনেক। আর দরিদ্র মুসলিম কৃষক, কৃষিকাজ করাটা আগে যাদের ছিল ইচ্ছাধীন, হিন্দু জমিদারির আওতায় আসাতে সেই প্রভুর জমিতে কাজ করতে ও জোরপূর্বক কর দিতে তাঁরা বাধ্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিপরীত ব্যাপার ঘটে হিন্দুদের ক্ষেত্রে। আগে রাজস্ব আদায়ের যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল, সেখানে মুসলিমদের সরিয়ে দেয় ইংরেজরা। বদলে তাঁরা অনুগত হিন্দুদের নিয়োগ করে উচ্চপদে। সুতরাং অভিজাত মুসলিমরা আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। পশ্চিম বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে ১৮২৭-১৮৩১ পর্যন্ত চলে বিদ্রোহ। এই দুই আন্দোলনে সহিহ মুসলিম হওয়ার তাড়নায় বাংলার মুসলমানেরা ধর্মীয় শিক্ষাকে অনেক বেশি আপন করে নিতে থাকে। ইসলাম ধর্মে অনৈসলামিক আচার ছেড়ে ফরজ পালনে মুসলমানরা উৎসাহী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু অমিল হল, হিন্দুরা শিক্ষাগ্রহণে সমাজে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে, কিন্তু মুসলমানেরা পারেনি। অথচ ঠিক এমন সময়েই বাংলার হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে থাকে। এ সময় একে একে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, অ্যাংলো হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ ও বেদান্ত কলেজ। মোটকথা, কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাকেন্দ্রে হিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে। কিন্তু বাংলার অধিকাংশ মুসলিম, যাঁরা গ্রামবাসী ও কৃষক, তাঁরা এ দুইটি আন্দোলনের প্রভাবে যত বেশি ইসলামসংলগ্ন হয়ে পড়ে, ততটাই দূরে সরে যায় ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ থেকে। এদিকে হিন্দুরা যত বেশি ইংরেজ হয়ে উঠছিল, মুসলমানরা তত বেশি আরবি হয়ে উঠছিল। অথচ পরিস্থিতি অন্যরকমও হতে পারত। হিন্দুরাও যদি ইংরেজদের সবরকমভাবে বর্জন করতে পারত, তাহলে ইংরেজরা ২০০ ভারতে রাজত্ব করতে পারত না। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে মুসলিমদের অনীহার বিষয়টা এখন যতই সমালোচনা করি না-কেন, তখন যদি হিন্দু-মুসলিম একই সঙ্গে এই ইংরেজি শিক্ষাটা না নিত, তাহলে কিন্তু ইংরেজদের পক্ষে ইংরেজির জন্য একটা পূর্ণ বিকশিত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি গঠন করা সম্ভব হত না। এই মধ্যস্বত্বভোগী কেরানি শ্রেণিটাই কিন্তু ইংরেজদের আরও দেড়শত বছর উপমহাদেশ শাসন করতে সাহায্য করেছিল। আধুনিক শিক্ষাগ্রহণে মুসলিমদের অনীহার বিষয়টাকেই কিন্তু গান্ধীর অহিংস নীতির মতো একটা ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার সুযোগ ছিল উপমহাদেশের নেতাদের। সেটা সফল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকত বিচ্ছিন্ন সশস্র আন্দোলনের চেয়ে জোরদার হত। কারণ সরাসরি যুদ্ধের সুযোগ সেখানে ইংরেজদের থাকত না। ইরেজ শাসনের ২০০ বছরে ২৪০-৩৫০ ট্রিলিয়ন পাউন্ড ভারত থেকে ইংল্যান্ডে পাচার হয়েছে। এই পাচারকৃত অর্থের বেশিরভাগই বন্ধ করে দেওয়া যেত, যদি কিন্তু ইংরেজি-বিরোধী আন্দোলনটাকে হিন্দু-মুসলিম যৌথভাবে একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত করতে পারত ১৮৫৭ সালের আগেই।
এবার হয়তো অনেকে বলবেন, তাহলে হিন্দুরাও তো মুসলমানদের অশিক্ষিত হয়ে পড়ত, সমাজে পিছিয়ে পড়ত। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য পরিষ্কার – ইংরেজি ভাষা না শিখলে জীবনে কোনো উন্নতি করা যাবে না, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। পৃথিবীর এরকম বহু দেশ আছে যেখানে ইংরেজি ভাষাকে বর্জন করেও উন্নতির শিখরে। থাইল্যান্ডে কখনো ইংরেজ বা অন্যদের কলোনি ছিল না। থাইল্যান্ডের উন্নতি কি এগিয়ে থাকা কোনো দেশ থেকে কম ? ভারতীয়রা হাজার বছর আগে থেকেই আরব বণিকদের সঙ্গে সফলভাবে বাণিজ্য করেছে ইংরেজি না জেনেই। ভাষা কখনোই অন্তরায় হয়নি। চিনেও ইংরেজরা তেমন কলকে পায়নি। চিন এখন উন্নতির শীর্ষে। জাপান ইংরেজি ভাষাকে ঘৃণা করে জাপানি ভাষাকেই সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়। চিন আর জাপানে বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজি ভাষা জানে না। জাপানে উন্নতি হয়নি ? মানুষ নিজেদের উন্নয়নের খুঁজে নিতে পারে, ইতিহাস সাক্ষী। আবার পশ্চিমী দুনিয়ায় বেশিরভাগ মানুষ চাইনিজ বা জাপানিজ ভাষা তাতে ব্যবসা-বাণিজ্য তো থেমে থাকেনি সব দেশের মধ্যে।  যে সময় ব্রিটিশ সারা বিশ্বে উপনিবেশ হয়নি, তখনও জ্ঞান চর্চা থেমে থাকেনি।
কিন্তু ভারত তথা বাংলায় ব্রিটিশদের উপনিবেশের ফলে বাংলার বাঙালিরা ভাষা সংকটের মধ্যে পড়ে গেল। ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করাই দায় হয়ে পড়ল। ভাষা এখন বিশুদ্ধতা ছাড়িয়ে সংকর ভাষায় রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাঙালির বাংলা ভাষা বিদেশি ভাষার মোড়কে সেজে উঠেছে। হিন্দু বাঙালির ভাষায় ইংরেজি, আর মুসলিম বাঙালির আরবি। পশ্চিমবাংলার ইংরেজি জানা বাঙালিদের কথোপকথনে কান পাতলেই টের পাবেন তাদের মুখের ভাষার বিশেষ বিশেষণ বেশিরভাগই ইংরেজি, তার ক্রিয়াপদ ও সর্বনামই শুধু বাংলা। সাধারণ মানুষের মুখে ভাষাতেও ইংরেজি কথা, যা তদ্ভব আকারে নিত্য চলছে। যেমন – পেনসিল, টেবিল, চেয়ার, হোটেল ইত্যাদি। বাঙালিরা নিত্যব্যবহার্য শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ দেখুন জাপানিরা ইংরেজির পরিবর্তে জাপানি প্রতিশব্দ ব্যবহার করে। জাপানি ভাষায় যথাক্রমে এমপিকচিল, চুকুয়ে, ইছু, হোতেরু ইত্যাদি।
বর্তমানে ইংরেজি শব্দ যেমন বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়েছে, তেমনি ইংরেজরা ভারতে শাসক হওয়ার আগেও অন্য নানা বিদেশি ভাষা আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষার ভিতর অবলীলায় ঢুকে পড়েছিল। বাংলা ভাষার শরীরে সেসব শব্দগুলি এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, সেগুলি বিদেশি ভাষা কি না জানিই না। যেমন – ঠান্ডা, আলু, মাছ, জুয়ো, তে-রাস্তা ইত্যাদি। ভারতে উপনিবেশের আগেও বিদেশিদের নিত্য আনাগোনা ছিল। নবাবি আমলেই কবি ভারতচন্দ্রের লেখা থেকেই জানতে পাই, তার সময়ে বিলেতি জাতি বাস করত। যেমন – ফিরিঙ্গি, ফরাসি, আলেমান, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ প্রমুখ। উল্লিখিত ছটি জাতের মধ্যে প্রথম দুটি ভাষাকে বলে রোমান্স (Romance) ভাষা, বাকি চারটিকে বলে জার্মানিক (Germanic) ভাষা। এই রোমান্স ভাষাই দেদার বাঙালির ভাষা, যা অজ্ঞাতসারে বাংলা ভাষায় বিলীন হয়ে গেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নবাবি আমলেই বাংলা ভাষা দু-হাতে বিদেশি শব্দ আত্মসাৎ করে নিজের দেহকে পুষ্ট করেছে। বিদেশি শব্দকে স্বদেশি করাই হচ্ছে বাংলা ভাষার চিরকালের ধর্ম।
কিন্তু বিদেশি তথা ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষাকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছিল যে, সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও মাঠে নামতে হয়েছিল। শুরু করলেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রকাশ। উদ্দেশ্য : ‘ইংরেজিপ্রিয় কৃতবিদ্যদের’ এবং সংস্কৃত পণ্ডিত্যাভিমানীদের’ উভয় গোষ্ঠীকেই নিন্দা করা। বঙ্কিমচন্দ্র সাধারণ সাহিত্যসেবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কায়মনোবাক্যে স্বদেশের, স্বদেশবাসীর মঙ্গলকামী। নিজেদের আত্মসম্মানে উজ্জীবিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। (চলবে)



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)