প্রতিদিন দুপুর হলেই রুমি ছটফট শুরু করে |কখন আসবে মালতী মাসি ! আসলে এই সময়টা মালতীর কাছে গপ্পো শোনে রুমি | চন্দ্রিমা অবশ্য মাঝে মাঝে খুব রেগে যায় | রেগে উঠে মেয়ের উপরে , বলে আমি যে তোকে রোজ রাতে গল্প শোনাই তাতে মন ভরে না ! তখন তো দেখি ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাও | কেন শুনি ! রুমি বোদ্ধার মত বলে , নিজের মাকে বোঝায় ," আসলে মা মালতি মাসির গল্পগুলো পুরোটাই এন্টারটেইন | কেমন সুন্দর ভূতের গল্প, পেত্নীর গল্প ,রাক্ষস খোক্ষস ! খুব মজা লাগে | কিছু চিন্তা করতে হয় না, শুধু শুনে যাও | তোমার গল্পে অনেক ভাবতে হয় ! তোমার গল্পে মরাল , এথিক্স ,নীতি ,উচিৎ -অনুচিত , অনেক ভাবতে হয় | এন্টার টেন হয় না |মেয়ের কথা শুনে ক্ষেপে যায় চন্দ্রিমা | " মাথায় যা এল হালুম হুলুম শুনিয়ে গেল | তুমিও শুনে গেলে, বাহ ! কোনও অর্থ নেই , কিছু এলাং ফেলাং কথা !! রাবিশ ! পুরো সময়টাই নষ্ট | আরে কোয়ালিটি টাইম বলে একটা ব্যাপারতো আছে |
মা যাই বলুক রুমি কিন্তু বড্ড নাছোড়বান্দা | মালতিকে ছাড়বেই না || গল্প শোনাতেই হবে | যা কিছু ! বানিয়ে বানিয়ে |
আজকাল মালতির সাথে মোটে চন্দ্রিমার বনছে না | একটু ভুল ত্রুটি হলেই চন্দ্রিমার মুখে একটাই বাক্য , এবার মালতিকে ছাড়াতেই হবে , দেখি একটা নতুন কাজের লোক দেখব | রুমির ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে | তবে আজকাল ব্যাপারটা একটু বেশি হচ্ছে বটে | মাঝেমধ্যেই ছুটি করে মালতি | আবার গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া বিকেলে নিজের 10 বছরের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আসে | লক্ষ্মী বাসন মাজে , মালতী অন্য কাজগুলো সেই ফাঁকে সেরে ফেলে | ওর কাজের বোঝাটা একটু হালকা হয় | চন্দ্রিমা মোটেই পছন্দ করে না এই ব্যাপারটা | বাসনে এঁটো লেগেই থাকে | কি মুশকিল ! বাচ্চা মেয়ে ! কিছু বলাও যায় না | আসলে রুমি বোঝে | মালতির হয়েছে কোন ব্যামো | অতো কাজ আর করতে পারে না | লক্ষী , রুমিকে বলে " মার শরীরটা ভালা না , বাবা সকল রান্ধন করে |মা কয় ঠিক হইয়া যামু , পরে ডাক্তার দ্যাখামু | কিন্তু শরীর ঠিক হয় না | চন্দ্রিমাকে এসব বলতে গেলেই এক ধমক খাবে রুমি| তার ওপর ফাঁস হয়ে যাবে রুমি আর লক্ষ্মীপুট পুট করে গল্প করে |চন্দ্রিমার এসব পছন্দ নয় | চাকরের সাথে আবার বন্ধুত্ব কেন |নিজের বরাবরের সাথে বন্ধুত্ব করতে হয় | নজর টাকে ওপর দিকে রাখ | জজ ব্যারিস্টার এর মেয়ে হলে কি চন্দ্রিমা না করবে ! তখন বারেবারে বলবে ওরে ওদেরকে বাড়িতে ডাকিস | বলবে, জানিস তোর জন্মদিনে ওদের ফুল ফ্যামিলি কে আমরা ইনভাইট করব | রুমি অবশ্য মানা করে না | ভালোই তো | ওরা তো একই স্কুলে পড়ে | তবে একটা শর্ত ! লক্ষ্মী কিন্তু সকাল থেকেই থাকবে ওর সাথে | খাবে, নাচবে ,গাইবে , এটাই কন্ডিশন রুমি জানে চন্দ্রিমা মোটে দেখতে পারেনা লক্ষ্মী কে | বলবে, কি রকম দেখতে ! দেখলেই নোংরা নোংরা লাগে, মুখটাও কেমন ! চিরি ছাঁদা নেই !
চন্দ্রিমা মেয়ের এই শর্তে রাজি হয়ে যায় |তবে চন্দ্রিমা ঠিক করেই রেখেছে আবার যদি মালতি ওর মেয়ে লক্ষ্মী কে নিয়ে আসে ওকে ছাড়িয়ে দেবেই | আরে চাইল্ড লেবার এও তো ফাঁসতে পারে |একেবারে ভুল কথা তো নয় !! গতকাল রাতেই চন্দ্রিমা ওর বাবাকে ,মানে রুমির বাবা কি বলেছিল এই সব | রুমি সব শুনেছে |
আজতো লক্ষীকে দেখেই রুমির কপালে হাত কি সর্বনাশ | মালতি ভেতর ঘরে ঝাড়ু দিতে গেল | সেই ফাঁকে রুমি এসে লক্ষী কে বলল ,তুই চুপ করে বসে থাকে | তোকে মাজতে হবে না ,তোর বাসোনএ এঁটো থাকে |
-------------------------- কিন্তু তুমি কেন ? মাসি রাগ করবে তো !
------------------------------ মা যদি আসে তুই আমাকে বলবি | তুই পাহারা দে ||
-------------------------------ভয় করছে দিদি
------------------------------মা কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে | আজ ও ঘুমবে টেনে | আসবে না দেখিস |
লক্ষী থেকে রুমি কত আর বড় ! ১২-১৩ বছর বয়স | কিন্তু বুদ্ধি একেবারে খাসা | হয়ে গেল কাজ | মালতি ভেতরের ঘরের সব কাজ সেরে এল | রুমি কে দেখেই চমকে উঠলো ! " সেকি রুমি দিদি মনি ! তুমি --
--------------------- চুপ চুপ\| চেঁচিয়ো না ! মা শুনতে পাবে | আর যদি মা দেখতো আজ লক্ষ্মীবাসন মাজছে , ঠিক তোমাকে ছাড়িয়ে দিত |
আহা ! আমি তো তোমাকে এত ভালোবাসি মালতি মাসি | তাইতো এমন টা করলাম |
রুমি চুপচাপ গিয়ে বসল ওর পড়ার টেবিলে | রং-তুলি নিয়ে শুরু হলো ওর ছবি আঁকা চন্দ্রিমা কিচ্ছুটি জানতে পারল না | মালতীর ইচ্ছে হলো ওকে জড়িয়ে ধরে চুমায় চুমায় ভরে দেয় ওর মুখটা |কিন্তু তা কি করে হয় ! ও বাড়ির ঝি | এভাবে কি মালিকের মেয়েকে আদর করা যায় ! তবু মালতি সামলাতে পারলো না | একবার আলতো করে রুমির গালটা ছুয়ে দিলো | রুমের মাথায় হাতটা রাখল | একটু ছুঁয়ে দেখল এই চমৎকার ,এমন সুন্দর মনের মানুষটিকে |
মালতি যেতে যেতে ভাবল রুমিকে কিছু দেবে | কিন্তু কি দেবে !! ওদের ঘরে সব দামি দামি জিনিস | আর মালতি ওরা বড় গরীব পরিবার |ওদের একফোঁটা সস্তার জিনিস কি নেবে রুমি ? তবু কিছু তো একটা দিতেই হবে | কাল মেয়েটার জন্মদিন আর মেয়েটা এতো ভালো ,এতো ভালবাসে !
আজ সকাল সকাল চলে এলো মালতি | দরজা খুলে চন্দ্রিমা অবাক হয়ে গেলো ,বাহ ! কি সুন্দর ! কেমন মিষ্টি !দৌড়ে এল রুমি | দেখেই চিৎকার করে উঠল , ওমা ! কি সুন্দর ! কি দারুন ! মালতি বলল ," এটা তোমার জন্য রুমি দিদিমণি !"
" কিন্তু এমন সুন্দর একেবারে তাজা জল পদ্ম কোথায় পেলে মালতি মাসি ! এসব কি এখানে পাওয়া যায় !
মালতী হেসে বলল , এই যে আমার লক্ষ্মী মুনি ! ওই তো কইল , মা দিদির খাতায় অনেক পদ্ম ফুলের ছবি আঁকে |দিদি পদ্ম ফুল ভালবাসে |
এতক্ষণে মুখ খুলল লক্ষ্মী | বলল , মা কইল আমাগো বাড়ির পিছে পুকুর এ অনেক পদ্ম ফুটেছে | আমি তাই নিয়া আইলাম | দিদি তুমার ভালো লাগছে ?
চমকে উঠলো চন্দ্রিমা , বললো কিন্তু তুই ওই পারে গেলি কি করে !
----------- কেন মাসি ! আমি সাতার দিছি ! আমি তো সাঁতরাইতে পারি |
---------- সেকিরে ! কিন্তু ওখানে যে একেবারে জঙ্গল ! সাপ খোপে ভরে আছে জায়গাটা !
------------- আমরা গরীব মানুষ দিদি , সাপ টিকটিকি ব্যাঙ সঙ্গে নিয়া আমরা থাকি | ওরা আমগো কিছু করে না , ওরা আমাকে বন্ধু ভাবে |
_________ তাই বলে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিবি !!
রুমি ফুলগুলো নিয়ে ঠাকুর ঘরে চলে গেল |ঠাকুরকে আজ জন্মদিনে এই ফুলেই সাজাবে | আর কটা ফুল টেবিলে ফ্লাওয়ার পটে রেখে দিল | বন্ধুদের সবাইকে দেখাবে | বলবে, আমার এইবারের জন্মদিনের বেস্ট গিফট |
চন্দ্রিমা আড়চোখে একবার লক্ষ্মী দিকে তাকাল ,বেশ মিষ্টি লাগছে তো আজ ওকে |
লক্ষ্মীর সহজ-সরল সুন্দর পবিত্র মনটা , ওর মুখমণ্ডলে ঠিক পদ্মর মত প্রস্ফুটিত |
সুচিন্তিত মতামত দিন