জলকে চলে জান্নাত। এখন মধ্য রাত্রি।ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে শুনছে সানাই। কাঁখের পাতলা কলসটা নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে সে। খুরশিদ জান্নাতকে এই অবস্থায় দেখে জানতে চায়,“পানির ওপর ভেসে ভেসে কে বাজায় অমন জাহান্নামের বাঁশি?”
জবাব দেয়না জান্নাত। ভাগীরথীর কোলে ভাঁজ ভাঙা ঝিনুকের মতো জান্নাতদের আজন্ম পরিচিত এই ঝিল। এই ঝিলের পাড়েই উর্বশী জান্নাত বড় হয়ে উঠেছে। বাপের মৃত্যুর পর খুরশিদ আলম থাকে ওর সাথে। সবাই বলে,“সামান্য একটা টাঙ্গা আর ঘোড়ার লোভে খুরশিদ আলম জান্নাতের ভাড়াখাটা গোলাম হয়ে গেল। না হলে ওই শরীরে কী এমন ক্ষমতা আছে জান্নাতকে সে বিবি হিসাবে পরিচয় দেয়?”
খুরশিদের বয়েস এমন খুব একটা বেশি না। কিন্তু বরাবরের জন্যে জান্নাত কলস উপচানো যৌবনের মালকিন। এর আগেও নাকি দু’ দুজন ঘোড় সওয়ারীর সাথে সে সংসার পাততে চেয়েছিল।...টেকেনি। তৃতীয় চাঁদে এল খুরশিদ। কিন্তু কেন যে সে খুরশিদের মতো পলকা খড়কুটো দিয়ে ঘর সাজানোর ছেলেখেলায় মেতে থাকে, এটা একমাত্র জান্নাত আর তার আল্লাই জানে!
ইদানীং রাত হলে ইরানি অস্থির হয়ে ওঠে। ইরানি খুরশিদের ঘুড়ী। এই ঘুড়ীটি সে জান্নাতের কাছ থেকে একপ্রকার অলিখিত যৌতুক হিসাবেই আদায় করেছিল। গত মাসে ওর গায়ে কারা যেন আগুন ছুড়ে মেরেছে। পিঠভর্তি দগদগে ঘা আর একবুক খিদে নিয়ে চিঁহি চিঁহি করে চিৎকার জুড়ে দেয় ইরানি। এমন চিৎকার করে, পাশের প্রতিবেশীরা রাত্রে একটু ঘুমোতে পর্যন্ত পারে না। এমনকি ঘুমন্ত খুরশিদের মুখ থেকেও এখন উড়ে আসে গাল খিস্তি। খুরশিদের রক্ত গরম। সে দা কাটারি নিয়ে ধেয়ে আসে! বাধ্য হয়ে জান্নাতকে রাতের অন্ধকারে ঝিলে নামতে হয়। ঘড়া ঘড়া পানি তুলে ওর ঘাড়ে পিঠে ধারানি দিলে তবেই ঘোড়াটি শান্ত হয়। আজ জান্নাত যখন পানি তুলছিল, সহসা খুরশিদের কানে এল সেই রাগিণী! খুরশিদ অশান্ত হয়ে উঠল। সে গলা ছেড়ে হাঁক ছাড়ল, “কে গো ওখানে?” হাঁক শুনে রাতের পাখিরা আচমকা ডানা ঝাপটে খ্যাঁক খ্যাঁক করে ডেকে ওঠে।
খুরশিদ এখন প্রায়শই দেখতে পায় উঁচু পদ্মপাতার আড়াল নিয়ে এগিয়ে আসে ক্ষীণ একটুখানি আলো। আলোটি তিরতির করে কেঁপে ওঠে। কাঁপতে কাঁপতে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। আবার দপ করে জ্বলে ওঠে। জান্নাত পানিতে ঢেউ দেয়, আর অহেতুক সময় অতিবাহিত করে। খুরশিদের ধৈর্য ছলকে ওঠে। একটি নৌকো। ওটি কাছে এসেও আসে না। শ্যাওলাঘেরা ঝিলের পানিতে দাঁড়িয়ে একা একাই টাল খায় জান্নাত।
দুমাস আগের কথা। সরকার থেকে সবে বাইরের লোক ভেতরে, আর ভেতরের লোক বাইরে আসা যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। অচল দিনের এমন এক সন্ধ্যা জান্নাত দেখল ওর ইরানির সামনের দুটো পা ফুলে ফুলে গেছে। রাতে ল্যাম্ফো জ্বেলে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কিছু বুঝল না। সকাল হতে না হতেই ওর নজরে এল ইরানির আরও একটি পা ফুলে একেবারে ঢোল হয়ে উঠেছে। কাপড়ের দলা দাঁতে চেবাতে চেবাতে পাড়ার হাতুড়ে হেকিম কাদের আলীর কাছে গেল জান্নাত। কাদের আলী নিজের বুদ্ধির ওপর একশ শতাংশ আস্থা রেখে জানাল,“দৌড় ছুট করা পশু জানোয়ারকে বসকে বসকে খাওয়ালে অমন হবেই!”
-“কিছুই কি করা যায়না নানাজি?”
-“মানুষের গায়ে হাত ঠ্যাকানো যাচ্ছে না, আর তো সামান্য দু টাকার ঘোড়া!”
কোনও উপায় অবিধে না পেয়ে একদিন সন্ধ্যাবেলা সুরমা আতর মেখে জরির ঘোমটা উড়িয়ে জান্নাত আবদার জানাল, “চলো!”
-কোথায়?”
-“বেগম বাগিচায়।”
খুরশিদ লজ্জা পেল খুব! সে আপত্তি করে বলল,“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?”
জান্নাত নাছোড়বান্দা! সে নিজেই টাঙ্গা টেনে এনে ইরানির পিঠে চাপিয়ে দিল। বাধ্য হয়ে খুরশিদ বন্ধ বেগম বাগিচার ফটকের চারপাশে যে সকল সৌধ সমাধি, যুদ্ধক্ষেত্র, গোলাবারুদের নিদর্শ যতটুকু পারল দূর থেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল।
জান্নাত আক্ষেপ করে বলে, “আমাকে কী ফকিন্নির মেয়ে পেয়েছ?”
খুরশিদ বোকার মতো হেসে ওঠে,“দরবারের বাইরে যারা থাকে তারা ফকিন্নিই তো! বিশ্বাস না হয় আরেক পাক ঘুরিয়ে আনি?”
-“অতশত বুঝিনা। আমার দরবার খুলে দেখাও!”
-“কী যে বল! এখন সব বন্ধ না!”
জান্নাত খুরশিদের কাঁধের গামছা টেনে ধরে খিলখিল করে হেসে ওঠে,“চোরা নালা খোলা আছে নিশ্চই? ওখেনেই নাও ঝাঁপ দিই!”
কিন্তু দুদিনেই খুরশিদ আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। জান্নাতও তার টাঙ্গা বন্ধ রাখতে চায় না। কেননা ইরানিকে বসিয়ে রাখলে তার পড়াপড়ুটে হবার সম্ভাবনা প্রবল! তাছাড়া ‘সরকারের আদেশ উঠে গেলে সবাই যখন ঝমঝমিয়ে কাজে নামবে! তখন তার সংসার চলবে কী করে!’
আজকাল খুরশিদও বলে,“হাত পা গোটো করে বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন গা গতর সব টসটস করে।” জান্নাত ইরানির গলায় ঘণ্টিগুলো বেঁধে দেয়। ফোলা পা। তবু ওর ওপরেই আটকে দেয় লোহার বেড়ি লাগানো ভারি ভারি ঘুঙুর। চাবুক দিয়ে ব্যথার পায়ে বাড়ি মারে। ইরানি লাফিয়ে ওঠে। ঝনাৎ করে বেজে ওঠে ঘণ্টি আর ঘুঙুর! এরপর কাঁধে টাঙ্গা চাপিয়ে দিয়ে নিজেও ছড়ি হাতে ওর সাথে হাঁটতে শুরু করে। ইরানি খানিক খানিক খোঁড়ায়, খানিক খানিক দৌড়ায়। জান্নাত নিজেও দৌড়াতে শুরু করে। ফাঁকা রাস্তা খাঁ খাঁ গলি! অনেক রাত অব্দি শোনা যায় ঝুমঝুম ঝুমঝুম ঠুনঠুন ঠকঠক! একদিন হঠাৎ কারা যেন সদলবলে জান্নাতের পথ আটকে টাঙ্গাটাকে টেনে ধরল। তাদের গায়ে ঘামের গন্ধ, চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। জান্নাত ওদের কাউকেই চেনে না। সে জাফর শেখের আমবাগানের ভেতর দিয়ে কবরস্থান হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ফিরে এল। সকাল হতে না হতে রটে গেল জান্নাত চরিত্রহীন! ঘরবন্দি মানুষের মুখে মুখে এখন একটাই চর্চা, “জান্নাত হল সাক্ষাত জীন পরী! এর আগে আরও অনেকের কলিজা খেয়েছে! মেয়েমানুষ হয়ে এতো আস্পর্ধা হয় কী করে?”
কেউ বলে, “রাতে রাতে লোক চালান করে জান্নাত!”
-“লোক চালান না ছাই! একরত্তি ছোকড়া পারেনা তাই বলো! এখন গোস্ত রুটির গামলা দেখিয়ে ঝদি বা দু পয়সা আয় হয়!”
কেউ বলে, “ও তো বাইজীদের বংশধর! এসব মেয়েরা কখনোই সুবিধের হয়না! তুই বাঁচতে চাইলে এখনো পালা খুরশিদ!...ওর দ্বারা সবই সম্ভব!”
এসব কথা যতোই শোনে, ততোই মরে যেতে ইচ্ছে হয় খুরশিদের। সে জান্নাতকে বারণ করে। জান্নাত শোনে না। একরোখা রথের মতো সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম প্রাণীটার রশি ধরে সে হাঁটতে থাকে,... হাঁটাতেই থাকে!
একদিকে অপবাদ অন্যদিকে বিদেশী পর্যটকদের নিয়ে ভাড়া খাটার অভিযোগে বার বার চাপ আসতে থাকে খুরশিদের ওপর। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা জান্নাত আস্তাবলে গিয়ে দেখল তার প্রিয় ইরানি দগদগে পোড়া গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা! বিশেষত কাঁধের কাছটায় এমনভাবে আগুন দিয়ে দাগিয়ে দিয়েছে ওকে, যাতে সে আর ইহজীবনে টাঙ্গার ভার বইতে না পারে!
এখন সকাল হতে না হতেই প্রতিবেশীদের ঘর থেকে নানা রকম বিরক্তিসূচক মন্তব্য আর গালমন্দ আসতেই থাকে। এসব শুনতে শুনতে কান ঝাপাপালা হয়ে আসে জান্নাতের। খুরশিদ জান্নাতকে বোঝায়,“ইরানিকে ছররায় পেইঠকে দিই, গোর দিক।”
জান্নাত রাজি হয়না। অনেকদিন হয়ে গেল আয় রোজগার বন্ধ। খুরশিদও আর আগের মতো ইরানির জন্যে গুড়ের পানি ভুষি ছোলা মিহি তুষ এসব কেনে না। লাগাম খোলা ইরানি এখন অবহেলা আর অনাদরে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। মাঝে দুদিন হেকিম ডেকে এনেছিল। কিন্তু কোথায় ইরানি? কে যেন বলল, “সে তো কাঠগোলা বাগানের পাশদিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলাম।” টাঙ্গা টেনে টেনে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে ইরানির, সেও আর একটি দিনের জন্যেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। খুরশিদ তার কাঁধে টাঙ্গা চাপাক আর না চাপাক, এখন সে একা একাই বন্ধ কাঠগোলা বাগান, মীরজাফরের সমাধিক্ষেত্র, জাহানকোষা কামানের আশপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে ঘাস খেয়ে বেড়ায়। খুরশিদ ক্ষুধাপেটে ইরানিকে কিছুদিন খুঁজে বেড়িয়েছে। কিন্তু আর কদ্দিন! ইদানিং অনেক রাতে ইরানি ফিরে আসে। শুরু করে দেয় রোজকার মতো চিঁহি চিঁহি বিলাপ। জান্নাত ওকে শাপ শাপান্ত করে। ইরানি অসহায় চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে জান্নাতের দিকে। বার বার গলা বাড়িয়ে ওর কাছে কী যেন চায়। জান্নাত দেখে ইরানির খালি গলা, খালি পা।... পেতলের ঘণ্টিগুলো কারা যেন খসিয়ে নিয়েছে ওর বেড়ি থেকে। জান্নাত চোখ থেকে ঘুম মুছে, কলস নিয়ে দুপদাপ করে পা ফেলতে ফেলতে নামে ঝিলের জলে।
একদিন রাতে ঘোড়াকে স্নান করিয়ে ঘরে ফিরতে অনেকটা দেরি হয়। খুরশিদ পায়ে পায়ে নেমে এসে ঝিলের পাঁড়ে দাঁড়ায়। খুরশিদ সন্দেহের চোখ নিয়ে জান্নাতের দিকে চেয়ে থাকে। শুতে গিয়েও চোখের পাতাজোড়া এক করতে পারেনা খুরশিদ। বিছানায় বার বার ঠেলে ওঠে। বিড়ি জ্বেলে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে, “হারামখোর! এক শালার মেয়েলোক নিয়ে ফুর্তি করবার জন্যেই রাজ্যটা রসাতলে চলে গেল। তা না হলে আজ বাংলার এই দুর্গতি দেখতে হবে কেন!”
পূর্বজনমের অপ্রকাশিত আখ্যান শোনার মতো আগ্রহ নিয়ে জান্নাত খুরশিদের গায়ের কাছে সরে এল, “মানে?”
-“নবাব নিজে এইপথে একদিন বাইজী আনাত। টাকা ফুরিয়ে গেলে শেঠজীর কাছে হাত পাততেও কোনোদিন নাকি বানচোতের শরমিন্দা ছিল না!”
-“কী বল! নবাবজাদারা আজও কি আছেন?”
-“থাকতেই পারে। না থাকার কী আছে। কলিজাখাকির বংশধরেরাও সব মরেছে নাকি মনে করেছ! সব আছে। তা নাহলে আজ আমার মতো ছেলেদের কপাল পোড়ে কখনো?”
জান্নাত টের পায় খুরশিদেরও ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ভাঙছে!
ইরানির ঘা একটু একটু করে শুকিয়ে আসছে। কিন্তু রাত গভীরে ঝিলের পানিতে ঢেউ দেওয়ার মতো ব্যাপারটা আজ একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে জান্নাতের। এখন সে সাঁতার কাটতে কাটতে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়। খুরশিদ ঘর থেকে উঁকি মেরে দেখে। নৌকোটি আজ ওর খুব কাছ দিয়ে চলে গেল। জান্নাত কলসের ওপর বুক বাধিয়ে সাঁতরাচ্ছে। বড়বড় পদ্মপাতার আড়ালে সবটুকু ভালোভাবে দেখা যায় না। পর্দার আড়ালে ছইয়ের নিচে কে যেন আধশোয়া অবস্থায় পড়ে আছে। ‘ওটাই কি তাহলে নতুন নবাবজাদা?’ খুরশিদের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল! একটা কাটারি নিয়ে ঝিলের ধারে এসে দাঁড়াল।
এখন জান্নাতের নতুন জ্বালার নাম আফসানা। সে প্রায়ই আসে। আফসানা জান্নাতের প্রায় হাঁটুর বয়সী। আফসানার বাপ তাহের। সে এলাকার প্রভাবশালী ঠিকাদার। লকডাউন উঠে গেলে খুরশিদকে সেন্টারিং কাজ শেখাবে বলে কথা দিয়েছে তাহের। আগে জান্নাতের আখার ধারে এসে খুরশিদ এসে হাতে হাতে সাহায্য করত। আটটা বাজবার আগে কাপড়ে দুটো ভাতরুটি বেঁধে, ইরানিকে নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু এখন সকাল হতে না হতেই আফসানা এসে হাজির হয়। আফসানা কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে কী যেন আনে! খুরশিদ ওগুলো খায়। আফসানার সাথে খোশগল্প করে। কারোর কাছে নালিশ জানাতে পারেনা জান্নাত। ক্ষোভে দুঃখে অপমানে আত্মগ্লানিতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। কোনও কোনও দিন ইরানিকে খুঁজবার অছিলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। এখন ঘুমের মধ্যে সে প্রায়শই দেখতে পায়, ভাগাড়ের ভ্যাবাচ্যাকা পশুকে ক্ষুধার্ত হায়েনা যেমন খেলিয়ে খেলিয়ে খোবলায়, খুরশিদকেও আফসানা তার বুকের ওপর নিয়ে অমনিভাবে খ্যালাচ্ছে!
একদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুঙুর আর ঘণ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে জান্নাতের। উঠোনে নেমে এল জান্নাত। দেখল অন্ধকারে নিক্তি হাতে দাঁড়িয়ে আছে আফসানা। ইরানির অলংকারগুলো আফসানা তার হাতের তালুতে তুলে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলছে, “আরও আনা লাগবে। আব্বা যা হিসেব দিয়েছে তাতে এইকটা মালে পুরো মাসের মদের দাম শোধ হবে না!”
নিরুপায় খুরশিদ ঘর থেকে অ্যানামেলের কলসীটা এনে আফসানার হাতে তুলে দিতেই জান্নাত বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল! খুরশিদও হায়েনার মতো হুংকার দিয়ে উঠল, “সরে যা বলছি! নইলে তোকেও ইরানির মতো জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেব!”
জান্নাত শিউরে উঠল,“ইরানির গায়ে তাহলে তুমি আগুন দিয়েছিলে?”
খুরশিদ কথা বলে না। কিন্তু আফসানা ছাড়বার পাত্রী নয়। শুরু হল তুমুল ধস্তাধস্তি! জান্নাতের হাতের কলসীটা ছিটকে গিয়ে পড়ল ঝিলের জলে। নিকষ অন্ধকারে অ্যানামেলের কলসটি বগবগ শব্দ করে ডুবতে শুরু করল। খুরশিদকে ছেড়ে দিয়ে জান্নাত ঝিলের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
অনেকদিন হল ইরানি আর আসেনা। জান্নাতও কোথায় গেল কে জানে! এখন সে ঘরে বাইরে একেবারে একা। এমনকি উঠোনে পায়ের শব্দ হলেও ভাবে, ওই বুঝি জান্নাত এল। খুরশিদ বাইরে বেরিয়ে যায়। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় ঝিলটার পাঁড়ে। ওটাই তার সকাল সন্ধ্যার আয়না! ঘণ্টার পর ঘন্টা একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোনও কোনোদিন পায়ে খিঁচ ধরে যায় ওর। এখানে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল কত কী ভাবে খুরশিদ! হঠাৎ একদিন খুরশিদের কানে এল সেই সানাই। নিঃসঙ্গ জগতের হৃদয় নিঙড়ানো বেদনার মতো কেউ যেন দ্রিমিদ্রিমি লয়ে একটানা বাজিয়ে এইমাত্র থামিয়ে দিল। সেই কান্না বোঝাই নৌকোটি, জান্নাত যার গল্প বলত। সেটি আজ খুরশিদকে অবাক করে দিয়ে ছাতিম গাছের ছায়া ছুঁয়ে দাঁড়াল। খুরশিদ উৎসুক হয়ে ঝুঁকে পড়ল ওর খোলে,“আরে! মঈনুল চাচু আপনি? এখানে? কী ব্যাপার?”
-“এট্টু আগুন হবে রে? দিশলাইটা পানিতে পড়ে ভিজে গেছে। বিড়ির নেশায় সেই সন্ধ্যেরাত থেকে টক ঢেঁকুর উঠছে!”
খুরশিদ আগুন দিতে নৌকায় উঠল। কিছুদিন আগে তুফান বয়ে গেছে। এখনো হাওয়ায় দাপট খুব। কাঠি ঠোকার আগেই নিভে যেতে লাগল। খুরশিদ গুড়ি মেরে ছৈএর তলায় ঢুকতে গেলে মঈনুল বাধা দিল, “ওর নিচে অন্য আরেকজন আছে। যেওনা।”
খুরশিদ জিভ কেটে তৌবা তৌবা বলে নেমে যাচ্ছিল। মঈনুল বলল,“ব্যাটাছেলে হয়ে লজ্জা পাবার কী আছে!... গুড়োর মাথানিতে দেখ আছে।”
দেশলাই আনতে গিয়ে খুরশিদের হাতে উঠে এল ছোট্ট একটা টেপরেকর্ডার জাতীয় যন্ত্র।
-“এটা কী চাচা?”
-“এদিকে দাও বলছি।”
রেকর্ডারটি মোহিত মন্ত্রে বেজে উঠল।
খুরশিদ অস্ফুটে বলে উঠল, ‘হায় আল্লা! এই তাহলে সেই সানাই? এইবার বুঝলাম!’ কিন্তু মঈনুলের মতো মানুষেরাও আজকাল এইসব ধান্দায় আছে দেখে খুরশিদ হাসবে না কাঁদবে,... কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
-“কী ব্যাপার চাচু? মাথায় এসব ভূত চাপল কবের থে’? রাত জেগে এই জলকাদার মধ্যে কারে সানাই শোনাও শুনি?”
-“রক্তের মধ্যে এই নেশা আজও রয়ে গেছে বাপ। চাইলেই কী আর এই আসক্তি থেকে রেহাই মেলে গো?”
গুড়োয় বসেবসে অনেক গল্প করল মঈনুল, এককালে তার বাপ চাচারা নাকি নৌকোয় ভেসে ভেসে সানাই বাজাত। লক্ষনৌ থেকে নবাবরা যখন বাঈজী আনাত, তখন এঁরা পানিপথেই এভাবে আদাব জানাতই, এছাড়াও পরবর্তীকালে জাফরপুত্র ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের খোশ খামোশ মেটাতেও অনেকসময় এই ঝিলের পানিতে অনিন্দ্য আলাপে কাঁপন তুলতেন । এরজন্যে নবাব দরবারে এঁদের বাকি আর পাঁচজনের চাইতে আলাদারকম খাতির যত্ন ছিল। এরপর তো সবই ইতিহাস। পরবর্তী দুতিন বংশধর এই ঝিলে মুক্তচাষের বরাত আদায় করেছিলেন। কিন্তু এখন এ ঝিল সম্পূর্ণ নিষ্ফলা। দুয়েকটা হাঙর গোছের শোল বোয়াল ছাড়া তেমন কিছুই নেই। রাত জেগে ঝিলের বুকে মোটা নাইলনের দড়ি টাঙিয়ে ‘দোন’ বায় মঈনুল। বড়বড় বঁড়শিতে করে কাঁকড়া, ব্যাঙ আর চালানি কচ্ছপের চারা গেঁথে ঝুলিয়ে রাখে জলের ওপরে। ওরা যখন জল থেকে হাত খানেক উঁচুতে হাতপা ছুড়ে ছটফট করে, তখন গভীর জলের রাঘব বোয়ালরা বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওগুলো খাবে বলে। আর কোনোপ্রকার একটাকে বাগে আনতে পারলেই....! গল্পগুলো বলতে বলতে বিড়ির আগুন নিভে আসে মঈনুলের মুখে। একঘেয়ে সানাইয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে খুরশিদ। সে টেপরেকর্ডারটি বন্ধ করে দেবার জন্যে অনুরোধ জানায়।
মঈনুল হেসে বলে,“সবে নেশাটা লেগে এসেছে বাপ, এখনি বন্ধ করলে লম্বা একটা রাত জাগি কোন আসক্তিতে বলত?”
-“বলেন কী! আপনি সানাই বাজিয়ে নেশা করেন?”
-“শুধু কী আমার একার নেশা! দেখছ না চারহাত দিয়ে কাঁদা কাঁকলেও এই পানিতে আজ আর এককুচি মুক্তো মেলে না! লোকশ্রুতি পুরাণে না কোথায় যেন এমন একটা শুনেছিলাম, হিন্দুদের কোনও যজ্ঞে সরোবর থেকে তুলে আনা পদ্মে সৌরভ কম পড়েছিল! তাতে দেবতারা ভীষণ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন! এরপর ইন্দ্র এসে নাকি পাঁকের সাথে চন্দন মিশিয়ে দেবার নিদান দিয়েছিলেন। এই যেসব ঈদগা মাজার সৌধ সমাধি মসজিদ মন্দির দেখছ, কেউই কি আর আগের মতো অসীম ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে কি? পলক পড়ার আগেই পানিতে আছাড় খেয়ে খেয়ে পড়ছে দেখছনা?”
খুরশিদ তন্ময় হয়ে শোনে,“এরা তো সৌধ। এদের এসব শুনিয়ে লাভ?”
মাঝবয়সী মঈনুল কথা বলে যেন নবাব বাদশার মতো, “লাভ ক্ষতির হিসেব দিয়ে জগতে অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। দেখবে হাজার বছরের পুরোনো পাথরের গায়েও কিছু প্রাণ চাপা পড়ে থাকে। জ্ঞানীরা যাকে বলে জাগ্রত ফসিল। আমাদের সাদা চোখের আড়ালে আরও কিছু আত্মা থাকে। আর সেই ক্ষুধিত আত্মাদেরও কিছু দাবিদাওয়া থাকে!”
-“বলেন কী!”
-“আসল কথা হল জগতের সমস্ত সম্পর্কটাই একটা সরু সুতোয় বাঁধা! আর সেটা হল সুর। আর এটুকু ছাড়া সমস্ত সৃষ্টিই অসুন্দর! এ কারণে এমন কিছু কিছু কিছু রীতিনীতি বা পরম্পরা আছে, যেগুলো কিনা একমাত্র সৃষ্টির স্বার্থেই ধরে রাখতে হয়।
-“কোই আগে তো এমন শুনিনি?”
-“আগে এতো কোলাহল ছিল! কানে আসত না। এখন কোলাহল থেমেছে, তাই হয়ত শুনতে পাচ্ছ!” খুরশিদ মঈনুলের জীবনের প্রতি এই আশ্চর্য দায় দেখে একদম চুপ করে থাকে।
-“কী হে, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? পাতলা পাতার কাছে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে দেখো, সেটাও আজ বাঁশির মতো শোনাবে!”
হঠাৎ অদূরে পাতার আড়ালে জলে ঘাইমারা শব্দ হতেই খুরশিদ চঞ্চল হয়ে উঠল, “দড়ি চাগাও চাচা। আজ লিচ্চই বিরাট সাইজের বোয়াল গেঁথেছে মনে হচ্ছে!”
-“বোয়াল না কি অন্যকিছু কে জানে!”
-“অন্যকিছু মানে?”
এবার মঈনুল কিছুটা রহস্য মাখিয়ে বলতে শুরু করল,“আর বল কেন! সেদিন শেষরাত। হঠাৎ দোনের দড়িতে টান পড়ল খুব। আমি আনন্দে নৌকো নিয়ে চোঁ চোঁ করে ছুটছি। ও মা! দেখি এ তো মাছ না! আমি তো খুব ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম এ কী! এটার সাথে বড় বঁড়শি এমনভাবে পেঁচিয়েছিল, ছাড়াতেই পারলাম না। বেচারা তখনো খুব ঝাপটাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি দড়ি কেটে দিলাম। আর অমনি সড়াৎ করে সরে গেল! একটা লম্বা লগি দিয়ে অনেকটা খুঁজলাম। কিন্তু এই রাক্ষুসী ঝিলে একবার যে তলিয়ে যায় চাইলেই কি আর টেনে তোলা যায়?”
খুরশিদের অস্থিরতায় নৌকোটি ভীষণরকম টাল খেয়ে উঠল!
-“তুমি কি কাউকে খুঁজছ খুরশিদ?”
সে কোনও রকম জাবাবদিহি না করেই ঝপ করে জলে ঝাঁপ দিল।
এমনসময় ছইয়ের ভেতর থেকে ডাক এল,“মাঝি, ভেতরে এসো।”
-“বেচারা তলিয়ে যাবে তো!”
-“তলাবে না। পারলে ওর পিঠের ওপর একগাছি বঁড়শি ছুড়ে মারো। সাঁতারাতে শিখুক!”
-“আর যদি নৌকো সুদ্ধ তোমাকে টেনে নিয়ে যায়?”
সহসা জলতরঙ্গের মতো ঘুঙ্গুরের বোল বেজে উঠল, “তুমি তো আছ!”
রাত বুঝি আর বেশি বাকি নেই। এখন মীড়ে বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে বৃন্দাবনি সারং।
মঈনুল জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ইরানিকে পেয়েছ?”
-“হ্যাঁ!”
-“কোথায়?”
জরির পাতলা পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এল একখানি হাত,“ওই তো!”
মঈনুল দেখল বেগম বাগিচায় নাচমহলের মাথার ওপর ভেসে রয়েছে আধপোড়া চাঁদ!
মঈনুল আবার জিজ্ঞাসা করল, “আর তোমার টাঙ্গা?”
পূর্বের মতোই ভেসে এল আবেশ মাখানো উত্তর,“ওই যে পানিতে ভাসিয়ে দিলাম! এ জন্মের মতো ওর গায়ে কেউ যাতে আর আগুন ঠেকাতে না পারে তেমন জায়গায় এ নসিবের তক্তাখানা ডুবিয়ে দাও দিকিনি!”
সার্থক শিল্পীর প্রথম এবং প্রধান শর্তই হল হল প্রকৃতি ও মানব মনোবিশ্লেষণের যথার্থ রূপায়ন। আমাদের চিরচেনা জগত ওর তার বাসিন্দারা সুদক্ষ শিল্পীর শব্দস্পর্শে নবরূপে ধরা পড়ে। যা সাধারণের চোখে পড়ে না, মনে ধরে না, তাকেই শব্দশিল্পী তুলে ধরেন অনায়াসে তাঁর শব্দকৌশলে। নারীর মন সম্পর্কে সংস্কৃতকার বলছেন "দেবা ন জানন্তি,কুত মনুষ্যা।" শিল্পী কিন্তু নারী হৃদয়ের অতল সিন্ধু থেকে ভালোলাগা- মন্দলাগা, চাওয়া-পাওয়া, কামনা-বাসনার মুক্তো সংগ্রহ করেন সুদক্ষ ডুবরির মতো। এই ডুব সন্তরণ প্রকৃত শিল্পী ছাড়া সম্ভব নয়। এদিক থেকে বিচার করলে গল্পকার উত্তম বিশ্বাস একজন সুদক্ষ শব্দশিল্পী, এবং অবশ্যই নারীর হৃদয়সিন্ধুর দক্ষ ডুবুরি।
উত্তরমুছুনগ্রাম্যবধূ যেমন সযত্নে সুনিপুণ হাতে নকশীকাঁথা বুনে চলেন, গল্পকার উত্তম বিশ্বাস তেমনি পরম মমতায় দক্ষ শিল্পীর ন্যায় বুনেছেন শব্দতন্তুতে তাঁর "বৃন্দাবনী স়ারং" গল্পখানি। বাংলার ইতিহাস সমৃদ্ধ এক অঞ্চল আলোচ্য গল্পের ভিত্তিভূমি। উদার আকাশ, নির্জন প্রান্তর, অমলিন নদীনালা খালবিল সেই ভিত্তিভূমির দোসর। তাদের সঙ্গেই নিয়েই লেখক ডুব দিয়েছেন নারী হৃদয়ের অতলে। জন্নত শুধুই এক নারীর নামমাত্র নয়, প্রেমের বৃন্দাবনে তার কামনা রাধার মতোই উচ্ছ্বল। তবে তার কাছে শুধুই "কানু বিনে গীত নাহি" সত্যি নয়, প্রস্ফুটিত শতদলে শত মধুকরের মতো তার দেহসৌরভে বহু পুরুষ কামনা পিয়াসী। সে যেন এক অধরা মাধুরী। গল্পের গীতিময়তায় আপাততুচ্ছ ঘটনাও অপূর্ব রহস্যময় ও পরম রমণীয়। জীবন জীবিকার উপকরণ মনুষ্যেতর প্রাণী ঘোড়াটাও যেন মানুষের ভাষা পেয়েছে গল্পের কাব্যময়তায়।
"আই ওয়ান্ট টু ডাই বিটুইন ইউর লিপ"... পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শনে প্রেমের এক অনুপম বহিঃপ্রকাশ। আমাদের প্রাচ্যকবিও মরতে চেয়েছেন, তবে ঠোঁটে নয়,চোখে।...
"প্রহর শেষে আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম
আমার সর্বনাশ।"
খুরশিদও মরতে চেয়েছিলো জন্নতের চোখে, কিন্তু জন্নতের যৌবন শতদল শুধুই এক মধুকরে তৃপ্ত নয়। প্রবাহিত রক্তে যে তার বাঈজীর চপলছন্দ। নৃত্যরত সে ছন্দ ছড়িয়ে পড়ে "বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে"। তার দেহসৌরভে আবার নতুন মধুকর মধু আহরণের আয়োজন করে। " ভোরের আকাশে শেষ প্রহরের শুকতার দেখা যায়। ক্লান্ত স্বরে বেজে উঠে "বৃন্দাবনী সারং"। সমাচ্ছন্ন সেই সুরে সব ভেসে যায়। সংসার-সমাজ ঘোড়া-গাড়ী সবই। নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে ভেসে চলাই যে প্রেমের ধর্ম,যৌবনের ধর্ম, জীবনের ধর্ম।
দাদাভাই,
মুছুনজীবনে আর কিছু না পেলেও এগুলিই দিয়েই আমি আমার ঘরদোর সাজিয়ে নেব!
আপাদমস্তক গীতিময়তায় মোড়া এক নিপুণ, নিপাট সরস গল্প। এক নিঃশ্বাসে শেষ না করে ছাড়া যায় না এমন পাঠ। এত সূক্ষ্মভাবে, এত অসাধারণ মুন্সিয়ানায় নারী চরিত্র আঁকতে আমি সাম্প্রতিক কালে আর কোনো গল্পকারকে দেখেছি বলে মনে করতে পারিনা। জান্নাত, খুরশিদ বা মঈনুল চাচা, ঠাসা বুনোটে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে সবকটি চরিত্রই। ভাষার গতিময়তাও অপূর্ব! সবথেকে বেশী আকৃষ্ট হলাম এই অদ্ভুত সুন্দর লিরিক্যাল শব্দশৈলীতে। বিষয়বস্তুর সাবলীল প্রকাশে খুব সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে জান্নাতের দুঃখ, বেদনা, আকাঙ্খা আর স্বপ্নময়তার দ্বন্দ্ব।
উত্তরমুছুনআবার যদি রূপকের পর্দাটা সরিয়ে দিই, তাহলেই যেন জান্নাত প্রতিভাত হয় এক অধরা কাঙ্খিত ভোগ্যবস্তু হিসেবে যা হয়তো বা স্বর্গেরই নামান্তর। খুরশিদ অতৃপ্ত, আত্মসর্বস্ব, ঈর্ষাপরায়ণ, নৃশংস স্বার্থপরতার প্রতিভূ যে কোনোদিনই নিবেদন করতে শেখেনি। তাই জান্নাত (স্বর্গ অর্থে বা পরম পাওয়া অর্থে) তার অধরাই থেকে যায়। আর যতদিনে তার প্রকৃত উপলব্ধি হয় ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ইরানী সেই দলের প্রতিনিধি যারা সবকিছু থেকেও সারাজীবন শুধুই অন্যের বোঝা বয়ে গেল, শুধুই অত্যাচারিত হল। সমস্তকিছু থেকেও যারা কোনোদিনই বুঝলো না, কেন তাদের কোনোকিছুতেই অধিকার নেই।
মঈনুল চাচা আসলে পরমেশ্বরের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। শিল্পের প্রতি তার অমোঘ টান, দুর্দম নেশা, ক্লান্তিহীন, চাওয়া-পাওয়াহীন আত্মোৎসর্গ করা নিবেদন। পার্থিব লোভ লালসা থেকে বহুযোজন দূরের সেই স্নিগ্ধ ভালোবাসা তাই অনায়াসেই তার ঝুলিতে ভরে দেয় জান্নাতের সুখ।
এমন গল্প শুধু যে ভাবায় তাই নয় বরং এক স্বর্গীয় আবেশে মুগ্ধ করে রাখে।
গল্পকারকে আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা।
বাবু,
মুছুনআর জীবনের সৌভাগ্য ছিল, তাই তোমাদের মতো পাঠকের প্রশ্রয় পেলাম!
ভালোবাসা নিও।
প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর 'বিবিধ' প্রবন্ধ গ্রন্থের একস্থানে বলেছিলেন -" আধুনিক ইংরাজি কবি ও আধুনিক বাঙালি কবিগণ সভ্যতা বৃদ্ধির কারণে স্বতন্ত্র একটি পথে চলিয়াছেন। পূর্ব্ব কবিগণ, কেবল আপনাকে চিনিতেন,আপনার নিকটবর্তী যাহা,তাহা চিনিতেন...।এক্ষনকার কবিগণ জ্ঞানী-বৈজ্ঞানিক,ইতিহাসবেত্তা, আধ্যাত্মিকতত্ত্ববিৎ।নানা দেশ,নানা কাল,নানা বস্তু তাহাদিগের চিত্ত মধ্যে স্থান পাইয়াছে। তাহাদিগের বুদ্ধি বহুবিষয়িনী বলিয়া তাহাদিগের কবিতা বহুবিষয়িনী হইয়াছে। তাহাদিগের বুদ্ধি দুরসম্বন্ধগ্রাহিনী বলিয়া তাহাদিগের কবিতাও দুরসম্বন্ধ-প্রকাশিকা হইওয়াছে।"আমার মতে বর্তমান যুগের ছোট গল্পকারদিগের সম্বন্ধেও বঙ্কিম বাবুর উক্ত মন্তব্যটি সমানভাবে প্রযুক্ত।কেননা একালের উদীয়মান গল্পকার উত্তম বিশ্বাসের বর্তমান গল্পে যেভাবে একইসঙ্গে ইতিহাস চেতনা, সমাজ চেতনা, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি মানব মনের গূঢ় মনস্তত্ত্ব ফুটে উঠেছে তাতে এ কথাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
উত্তরমুছুনরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'কর্তার ভূত' গল্পে প্রাচীন ভারতের পঞ্চত্ত্বপ্রাপ্ত সর্বাঙ্গসুন্দর সভ্যতার প্রেতযোনিকে অঙ্কন করেছিলেন নিখুঁত তাত্ত্বিকতার মোড়কে, উক্ত গল্পেও দেখা যায় মধ্য-বাংলার পঞ্চত্বপ্রাপ্ত নবাবী আমলের ভাঙাচোরা ফসিলের পাসে দ্রিমি দ্রিমি রবে টিকে থাকা নবাবী কক্ষপথে আবর্তিত অতি দূর ছায়াময় উত্তরসূরীদের একপ্রকার অপাঙক্তেয় জীবনালেখ্য অঙ্কন করলেন গল্পকার উত্তম বিশ্বাস অতি সহৃদয়তা ও ঐতিহাসিক সমাজ-বাস্তবতায়।বিশেষ করে জান্নাতের হৃদয়-তন্ত্রীতে প্রেম-মনস্তত্ত্বের যে বীণাধ্বনি উথলিত হতে শুনি তা এককথায় অনবদ্য।একমাত্র বিশ্বপ্রকৃতিই জান্নাতের হৃদয়-যন্ত্রণাকে অনুধাবন ও প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছিল।তাইতো জান্নাত তার বিপন্নতার মুহূর্তে বার বার খুরশিদ নয় বরং ঝিলের ধারে ছুটে গিয়েছে,সেখানকার দ্রিমি দ্রিমি রবে উথলিত বীণাধ্বনিতে অবগাহন করে ক্লেদাক্তময় জীবনের সকলপ্রকার ক্লিন্ন-কদর্যতা দূর করতে চেয়েছে।ইরানীর শারীরিক বাহ্য জ্বালার পাশাপাশি নিজের অন্তর্জ্বালাকে বিদূরিত করে শরীর ও মনকে একটা আবেশে মুড়ে দিতে চেয়েছিল।
পুরো গল্পটাই মনস্তাত্ত্বিকতার মোড়কে পরিবেশিত। গল্পের শুরুতেই দেখা যায়, জান্নাত রসপিয়াসিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাই জলের জন্য মধ্যরাতে ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে আকণ্ঠ সানাইয়ের সুর-সুধা পান করে তৃপ্তি পেতে চেয়েছে। আসলে সে যে সৌখিনতার পূজারিণী তার পরিচয় তার কাখের পাতলা কলসটা।
খুরশিদ জান্নাতের ছায়াসঙ্গী হলেও তার হৃদয়-গাঙে ডুব দেওয়ার মতো পুরুষোচিত শক্তিসামর্থ্য কিম্বা মানসিক সরসতা তার মধ্যে কিছুই ছিল না।তাই পানির ওপর থেকে ভেসে আসা জাহান্নামের বাঁশির শব্দ কর্ণগোচর হয় না তার।আসলে খুরশিদের চাহিদা পুরোটাই বস্তুগত কিন্তু জান্নাতের চাহিদা পুরোটাই মর্মগত- আর সে কারণেই দুজন পরস্পরের এত কাছে থেকেও কেউ কারো পরিপূরক হয়ে উঠতে পারেনি।
আসলে সংসারে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা শুধু বস্তুগত জাগতিক বিষয়-ব্যাপারে আপনাকে বেঁধে রাখতে পারে না, তাদের চাহিদা দুর্নিবার, এই বস্ততান্ত্রিক-জগৎ নিরপেক্ষ ঐ ওপারের সুদূরালোকের আহ্বানধ্বনি তাদের হৃদয়-তন্ত্রীতে এমন ঝংকার ধ্বনি তোলে যেন পারাবতী শ্রীরাধিকা..., এক দুর্নিবার আকর্ষণে শুধু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের সন্ধানে প্রিয় সন্নিধানে বিরামহীন ছুটে চলা। আর তাছাড়া জান্নাত তো সুরলোকের বাসিন্দা, সেখানকার মর্ত্যভাব- তিরোহিত নান্দনিক আবাহন গীতি তাকে কাতর করবে,পীড়িত করবে এতে আর আশ্চর্যের কী।(ক্রমশ)
২য় অংশ
উত্তরমুছুনতাই অন্ধকারে ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা জান্নাত খুরশিদের আহ্বানে মোটেও বিচলিত হয় না।
ভাগিরথীর কোলের ভাজভাঙা ঝিনুকের মতো আজন্ম পরিচিত এ ঝিল নবাবী আমলের মতিঝিল হলেও আসলে এ যেন জান্নাতের হৃদয়-পুরে অবস্থিত স্বচ্ছ অথচ গভীর মানসসরোবর। পার্থিব-পাপ-ক্লিষ্ট ধূলিমলিন মর্ত্য-মানুষের অবগাহনের কোন অধিকার বোধ হয় নেই এ ঝিলে, তাই কষাড় পদ্ম আর শ্যাওলা দামে আবক্ষ আচ্ছন্ন এ ঝিলের মহিমা শুধু যেন জান্নাতই বোঝে।
জান্নাতের সুগভীর প্রেম-মনস্তত্ত্ব কিম্বা তার সীমাহীন রসের ছিটেফোঁটাও পান করতে সক্ষম হয়নি খুরশিদ। শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যে মোহিত পতঙ্গের মতো তার চতুর্পাশে উড়ে বেড়িয়েছে। যদি সে জান্নাতের প্রকৃত প্রেমপূজারী হত তাহলে শুধুমাত্র তার জুড়িগাড়ির লোভে পড়ে থাকত না।আসলে সে জান্নাতের ভাড়াটে গোলাম। বলা যেতে পারে জান্নাতের শখের রাখাল খুরশিদ। তাই তার শরীর কিম্বা মনে পৌরুষেয় কোন লক্ষ্মণ না থাকা সত্ত্বেও হান্নাতের ছায়াসঙ্গী হতে পেরেছে সে।
জান্নাত যেন কূলপ্লাবী ভরাযৌবন-বেগবতী দুর্বারগতি তটিনী-স্বরূপা। বরাবরের জন্য সে কলস উপচানো যৌবনের মালকিন। তার উচ্ছ্বসিত যৌবনের তরঙ্গায়িত ভরাকোটালের দুর্বার গতিতে পুরুষ নামক নদীতটভূমির পাড় নিরন্তর ভেঙেই চলেছে সে।যে কারণে খুরশিদের আগেও দু দুটো ঘোড়সওয়ারী জান্নাত নামের এই তীব্র খরস্রোতয় বিলীন হয়ে গেছে।তারা কেউ-ই জান্নাতের তীব্র যৌবনাবেগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। কিন্তু খুরশিদের মতো পলকা খড়কুটোও জান্নাতের প্রবল তরঙ্গসঙ্কুল যৌবনাবেগে টিকে গেল।এখানেই মানবের প্রেমমনস্তত্ত্বের বীজ প্রথম প্রোথিত হল,নতুন মোড়ে বাঁক নিল গল্প।কি দুর্নিবার আকর্ষণে খুরশিদের মতো পলকা খড়কুটো দিয়ে ঘরসাজানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে জান্নাত। হয়তোবা জান্নাত এরকম কাউকে চেয়েছিল যাকে সে নিজের মতো করে চালনা করতে পারবে,কেননা সে যে তার হৃদিপুরের একমাত্র সাম্রাজ্ঞী।
জান্নাতের ঘোড়া ইরানি আসলে বিগতযৌবনা ও জৌলুসেরই প্রতীক। তাই তার গতিছন্দ কিম্বা নৃত্যভঙ্গিতে এখন আর রসিকজনেরা সম্ভোগ-তৃপ্তিতে তুষ্ট হতে পারেন না,আর সে কারনেই ইরানির গতিবিধিটা পর্যন্ত তাদের অসহ্য হয়ে ওঠে বলেই তারা ইরানিকে আগুনে জ্বালিয়ে শেষ করে দিতে চাইলেন। হয়তো যন্ত্রনায় আর লজ্জায় তার পরও দুর্বার প্রাণাবেগেএই ইরানির মতো ব্রাত্যজনেরা সমাজের কোন এক অন্ধকার কোনে কোনপ্রকারে মনুষ্যেতর প্রাণী হয়ে বেঁচে থাকে। পরম দয়ায় কিম্বা কর্তব্যে জান্নাত কিম্বা খুরশিদ কেউ-ই ইরানিকে ফেলে দিতে পারে না।আসলে জান্নাত ও তার সহচরী ইরানি এমন এক সমাজের বাসিন্দা যেখানে তারা নিজেদের হৃদয় -ক্ষতকে দিনের আলোয় নিরাময় করবার শক্তি কিম্বা সাহসটুকু কিছুই পায়না,সে আলো এতোটাই রূঢ়।যেকারণে ইরানির দগ্ধ ক্ষত নিরাময়ের জন্য জান্নাতকে রাতের অন্ধকারকে বেছে নিতে হয়।এখানে গল্পকারের সুগভীর জীবনদর্শন তার মুন্সিয়ানায় প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।সমাজের ব্রাত্যজনেরাও ভাষারূপ পাই।
খুরশিদের সহধর্মিণীর মতো জীবন-যাপন করলেও জান্নাতের অবস্থান ছিল খুরশিদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে।তাই খুরশিদের মরা গাঙের শুকনো চড়ায় রসের জোয়ার আনতে চেয়েও ব্যর্থ হয় জান্নাত। যেকারণে কোন এক রাতের অন্ধকারে খুরশিদ ও জান্নাত দুজনেই সেই হৃদয়প্লাবী সম্মোহন-ধ্বনি শুনতে পেলেও খুরশিদ তার মর্মোদঘাটনে ব্যর্থ হয়। তাই শূন্য হাক পেড়ে বলে-"কে গো ওখানে?" এবং তার এই নিরস কর্কশ কণ্ঠের তীব্র ধ্বনি-ঝংকারে বনের পাখিরা পর্যন্ত চকিত বিহ্বল হয়ে পড়ে।(ক্রমশ)
৩য় অংশ
উত্তরমুছুনখুরশিদের চোখের সম্মুখে পদ্মপাতার আড়ালে সমাগত চঞ্চল আলোর কাঁপন কিম্বা জান্নাতের হৃদয় -সরোবরে উত্থিত ঢেউয়ের নাচনে খুরশিদ মগ্নচৈতন্যের ওপারে বসবাসকারী বাসিন্দায় পরিনত হয়,তার ধৈর্য ছিলকে ওঠে।আসলে জান্নাতের রসপিপাসার উৎসমূল কোনখানে তাকে অনুধাবন করবার মতো সুক্ষ্ম মননশক্তি খুরশিদের নেই।না থাকাটাই স্বাভাবিক -,কারণ খুরশিদ কোন রসের হাটের ব্যাপারী নয়।সে শুধু ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে-"শ্যাওলা ঘেরা ঝিলের পানিতে দাঁড়িয়ে একা একাই টাল খাই জান্নাত।"আসলে এ গল্পে বর্ণিত পদ্মবন যেন যৌবন -প্রবর্ধিনী নন্দনকাননেরই সামিল,সেখানকার স্বচ্ছ সরোবরে ইচ্ছেমতো রাতবিরেতে অবগাহন করেভ জান্নাত তার অতৃপ্ত যৌবনজ্বালাকে প্রশমিত করতে ছেয়েছে।
নদীর স্রোত হারিয়ে গেলেই বদ্ধ জলাজঙ্গলে পরিনত হয়ে উঠতে তার বেশি দেরি লাগে না।সে নদীর যাবতীয় প্রাণাবেগ কোথায় যে হারিয়ে যায় তার কোন ঠিকানাও থাকে না! এরকমই এক স্রোতহারা নদী যেন জান্নাতের পালিতা ইরানি। সে এখন অকেজো অসাড় জীবে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে। সবকটা পা ফুলে তার অচল হয়ে যেতে বসেছে।বলাইবাহুল্য হেকিম কাদের আলীর মনস্তাত্ত্বিক মহৌষধীতেও যা আর নিরাময় হবার নয়।অর্থাৎ যৌবন একবার বিগত হয়েছে যার,পা থাকলেও সে আসলে খুঁতোরই সামিল।এর উপরেও আবার বিধি বাম,-বাইরে শুরু হয়েছে ভীষণ এক দুরারোগ্য ব্যাধির বাড়বাড়ন্ত। যে-কারণে প্রাণপণ প্রার্থনার পরও জান্নাতকে শুনতে হয়-"মানুষের গায়ে হাত ঠেকানো যাচ্ছে না,আর তো সামান্য দু'টাকার ঘোড়া।"অর্থাৎ অপাঙক্তেয় ব্রাত্যজনেরা সমাজ-চোখে কতটা উন্নাসিকতার শিকা তা এ বক্তব্যে স্পষ্ট।
কিন্তু জান্নাতও অত সোজা পাত্রী নয়।সহজে হাল ছাড়তে চায় না সে।ছলনার বিদ্যায় সে স্বয়ংসিদ্ধা,পূর্ণকলাবতী।পুরুষের কাছ থেকে কীভাবে প্রার্থিত ধন আদায় করে নিতে হয়,সে বিষয় তার নখদর্পনে। এহেন পুরুষ নামের নাগরকে মোহিত করতে সুরমা আতর আর জরির ঘোমটায় নিজেকে সজ্জিত করে তার পরম প্রার্থিত রসতীর্থ নিষিদ্ধ বেগম বাগিচায় উপস্থিত হয়।খুরশিদ লজ্জা পেলেও জান্নাত নাছোড়বান্দা, খুরশিদের লজ্জা কিম্বা সংকোচের কোন ধার সে ধারে না।ফলত নিজেই একসময় ইরানির ঘাড়ে টাঙ্গা চাপিয়ে সওয়ারিনী হয় সে।জান্নাত এখানে যেন শ্রীরাধিকার ন্যায় সমাজ-বিগর্হিত অবৈধ প্রণয়-সংবেগে দুর্বার গতিতে ধাবমানা হয়েছে।কোনরকম মনগড়া সামাজিক অনুশাসন তাকে বেঁধে রাখতে পারে নি।
(ক্রমশঃ)
৪র্থ অংশ
উত্তরমুছুনবাইরে থেকে দরবারের জীর্ণ কঙ্কালসার অট্টালিকার প্রাণহীন প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে জান্নাতের তৃষ্ণার্ত চোখদুটো কাকে যেন খুঁজে বেড়া। হয়তো বা তারই কোন পূর্বসূরী এই নবাবী দরবারের মেহেফিলকে বীণাধ্বনি আর ঘুঙুরের ঝংকারে মুখরিত করে রেখেছিল।আজ তাই জান্নাত মনে মনে বেগম জাহানারাতে পরিনত হয়ে ওঠে।নবাবী মজলিসের ঝাড়বাতির আলোয় নহবতী তালে তার হৃদয়বীণা তরঙ্গিত উত্থিত হয়,কোমরখানি যেন দুলে ওঠে।নারীর মনস্তত্ত্ব উদঘাটনে এখানেই তো গল্পকারের মুন্সিয়ানা।জান্নাত যে ফকিন্নির মেয়ে নয় তা শুধু খুরশিদকে না বরং সকল সহৃদয় পাঠকে বুঝিয়ে দিতে কসুর করেনি।বন্ধ দরবারের আগল ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছে সে।খুরশিদের মতো অপক্ক অরসিকের পক্ষে জান্নাতের হৃদয়ের কোন গোপনতম প্রকোষ্ঠে রসের কেমনতর ধারা নিরন্তর বয়ে চলেছে তা অনুধাবন করা একপ্রকার দুঃসাধ্য জেনেই খুরশিদকে সে বলেছে-"অতশত জানিনা।আমার দরবার খুলে দেখাও।"কিন্তু এখানে ব্যর্থ খুরশিদ।তাই আর কোন উপায়না পেয়ে শেষে চোরা নালায় ঝাপ দিতে চেয়েছে জান্নাত।জান্নাতে মানসিক দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়।সে অস্থির হয়ে ওঠে।অপেক্ষা নামক বিষময় প্রহর জ্বালায় দগ্ধ হতে শুরু করে সে।খুরশিদ তার ছায়াসঙ্গী হলেও দুদিনেই সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।কিন্তু জন্নাত তার টাঙ্গা বন্ধ রাখতে পারেনা,কেননা এ টাঙ্গাই যে তার মূল চালিকাশক্তি,তার সমগ্র জীবনের সঞ্জিবনীসুধা।
এরপর খুরশিদ আস্তে আস্তে একসময় কাজের মানুষে পরিণত হয়ে ওঠে।কাজ না করে ঘরে বসে থাকলে গা-গতর টসটস করতে শুরু করে।কিন্তু সময়ের তাগিদে আর জীবন ও জীবিকার অনিবার্যতায় জান্নাতকে কঠোর হতে হয়।ইরানির পাগুলো ব্যথায় টসটস করলেও জান্নাত বাধ্য হয় তার ঐ ব্যথা পায়েই লোহার বেড়ী আর ঘুঙুর বাঁধতে কিম্বা কাধে টাঙ্গা চাপিয়ে দিতে।ব্যথাদীর্ণ ইরানি লাফিয়ে উঠলেও আপনা জীবনাবেগকে সে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারে না।তাই ফাঁকা রাস্তা কিম্বা শূন্য গলিতেও"অনেক রাত অবধি শোনা যায় ঝুমঝুম ঝুমঝুম ঠুনঠুন ঠকঠ!"তারপর কোন এক অযাচিত পিছুটান জান্নাতের গতিকে অবরুদ্ধ করে দেয়।একদল মানুষ যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ আর চোখেমুখে স্পষ্ট আতঙ্কের বলিরেখা- যেন জান্নাতের পথ আগলে দাঁড়ায়।যেন এরাও জান্নাতেরই কোন জগতের বাসিন্দা।কিন্তু এদের সম্মুখে জান্নাত তার আপন স্বরূপ গোপন রাখার অভিপ্রায়ে"জাফর শেখের আম বাগানের ভেতর দিয়ে কবরস্থান হয়ে হাপাতে হাপাতে বাড়ি ফিরে আসে। সময়ের ঘূর্নিপাকে অসহায় দিশাহীন জীবনের যেন পথহারা সঙ্গী এরা সবাই।
(ক্রমশ)
মানব মনের অসাধারণ বিশ্লেষণ। এই লক্ডাউনের পরিস্থিতিতে জান্নাত, খুরশিদ বা মঈনুল চাচা, সবকটি চরিত্রই বাস্তবমুখী।
উত্তরমুছুনভাষার ব্যবহার ও শব্দ চয়নও অপূর্ব, এক অদ্ভুত কোমল ও সুন্দর লিরিক্যাল। গল্পে সাবলীলভাবে জান্নাতের দুঃখ-বেদনা,চাহিদা, আর খুরশিদের বাস্তব বুদ্ধিহীনতা ফুটে উঠেছে । গল্পের শেষে টার্নিং পয়েন্ট যখন জান্নাতের কণ্ঠে শুনি "তলাবে না। পারলে ওর পিঠের ওপর একগাছি বঁড়শি ছুড়ে মারো। সাঁতারাতে শিখুক!"
ওফ্ফ! অসাধারণ । একরাশ ভালোবাসা এমন গল্পের জন্য।
৫ম অংশ
উত্তরমুছুনএহেন ভয়ডরহীনা দুঃসাহসিনী জান্নাত নিজেকে বাঁচাতে একসময় পলায়নবাদী হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই তাকে শুনতে হয়-"জান্নাত হল সাক্ষাৎ জীন পরী!এর আগে আরও অনেকের কলিজা খেয়েছে সে!"
জান্নাতের মনের আকাশে ঘনিয়ে ওঠা ঘনকালো মেঘান্ধোকার তার চিরচেনা জগতের লোকমানসেও যেন প্রচ্ছন্ন এক কুহেলিকা জাল বিস্তার করে দিয়েছে।তাই কারো কাছে মনে হয় সে বুঝি জীনপরী,কারো বা মনে সংশয়ের কালো মেঘ দানা বাধে,হয়তো বা সে রাতে রাতে নিষিদ্ধ জগতে লোকচালানকারিনী কোন অশুভ-শক্তি ,আবার কেউবা মনে করে,নিজের শরীরি-মাংসল-সৌরভে সে বুঝি পুরুষের মনে সওদাগরি ব্যবসার বাজার বসিয়ে দিয়েছে!তাই গোস্ত আর রুটির গামলাকে টোপ কিম্বা চার রূপে ব্যবহার করতে চায় সে।আবার কারো দৃষ্টিতে জান্নাত শুধুই বাঈজীদের বংশধর।এহেন কুহকিনীর মায়াজাল থেকে মুক্ত করে দিতে খুরশিদের হিতাকাঙ্ক্ষী প্রতিবেশীর দল তাকে সাবধান করে দিয়ে বলে-"এসব মেয়েরা কখনোই সুবিধের হয়না!তুই বাঁচতে চাইলে এখনও পালা খুরশিদ! "আস্তে আস্তে জান্নাতের সঙ্গে খুরশিদের সম্পর্কের সমস্ত বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে।খুরশিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আর আপত্তি-ওজরের কোন মূল্যই থাকে না জান্নাতের কাছে।খুরশিদের কোন নিষেধ সে মানে না।অসহায় খুরশিদও একাকিত্বের অন্ধকারে বিপন্নতায় হাবুডুবু খায়।জান্নাতের নিকট সংস্রবে থাকার কারণে খুরশিদের দিকে অপবাদের ঝড় ধেয়ে আসতে থাকে। জন্নাতের জীবন ও জীবিকাও এই একই অনিবার্যতায় অনিশ্চয়তার ঘোলা স্রোতে খাবি খেতে শুরু করে।জান্নাত দেখতে পায়,ইরানি দগদগে পোড়া গা নিয়ে আস্তাবলে দাঁড়িয়ে থাকে।যেন ইরানির তপ্ত ঝলসানো শরীর জান্নাতকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে।ইরানির এই অসহায় অশরীরী দৃশ্য মড়ার উপর খাড়ার ঘা হানে জান্নাতের মনে।হয়তো ইরানি ইহজীবনে টাঙ্গার ভার আর বইতে পারবে না।একসময় প্রতিবেশীদের কটূক্তিতে জান্নাতের জীবন ফালাফালা হয়ে ওঠে। খুরশিদ বোঝাতে শুরু করে, ইরানির গোরে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
জান্নাত ও ইরানির জীবনে শুরু হয় ভাটার শোষণ। তাই খুরশিদ আগের মতো ইরানির জন্য গুড়ের পানি,ভূসির ছোলা কিম্বা মিহি তুস এসব কিছুই আর আনে না।চরম অবহেলা আর অনাদরে অভুক্ত ইরানি এখন এদিক সেদিক ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়।আসলে টাঙ্গার গতি ইরানির রক্তে বারুদের এমন এক বীজ বপন করে দিয়েছিল যে,একমুহূর্তের তরেও সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।তাই খুরশিদ তার কাধে টাঙ্গা না চাপালেও সে আপন খেয়ালে একা একাই বন্ধ কাঠগোলা বাগান,মীরজাফরের সমাধিক্ষেত্র কিম্বা জাহানকোষা কামানের আসপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।এহেন অসহায় ইরানির এই বিপন্নতার মুহূর্তে শুধু জান্নাতের সঙ্গসুধা কামনা করে সে আর-"বার বার গলা বাড়িয়ে ওর কাছে কী যেন চায়।"
নিষ্ঠুর সমাজ ইরানিকে আব্রুহীনা নিরঙ্কার করে দিতে ছাড়ে না।জান্নাত দেখে ইরানির খালি গলা,খালি পা।"পেতলের ঘন্টিগুলো কারা যেন খসিয়ে নিয়েছে ওর বেড়ি থেকে।"
খুরশিদ বোধহয় কোনদিনই জান্নাতের প্রকৃত স্বরূপ-সত্ত্বাকে চিনে উঠতে পারেনি। তাই জীবনের চরমতম মুহূর্তেও জান্নাতকে সে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে এবং তারই পরিনতিতে গালি দিয়ে জান্নাতকে বলে ওঠে-"হারামখোর!এক শালার মেয়েলোক নিয়ে ফূর্তি করবার জন্যেই রাজ্যটা রসাতলে গেল।"আসলে নারীর ভোগ-লালসার মধ্যেই যে বাংলার নবাবীর পতনের বীজ উপ্ত হয়েছিল,জান্নাতকে দেখেই তা যেন বুঝে গিয়েছিল বীতরাগ খুরশিদ। সে তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে জান্নাতকে সে বলে-"নবাব নিজে একদিন এইপথে বাঈজী আনাত।টাকা ফুরিয়ে গেলে শেঠজীর কাছে হাত পাততেও কোনদিন নাকি বানচোতের শরমিন্দা ছিল না।" (ক্রমশ)
Teenti manob choritra taara jeno teenti aalada somoy,vabna, ebong prekhit niye nijeder kaler dorpone dekhte cheyeche.tobe moinul chacha jeno oder dujoner moddhey onnyo aakprokar setu bondhon kore diye gelo. Tai khurshid jhapalo jole... Eta darun. Aar setting orthath charpasher je oitihasik bornonar dolil taa sotti osadharon . Aar bortmoman somoy k jevabe tule dhora holo (lockdown,kaaj naa thaka,dakhtarer prosongo) taa sotti onnyo matra diyeche golpo taa k...
উত্তরমুছুনThis completely my pleasure that I able to read this kind of short story in Bengali language. In this short story plot,diction,setting and character are unanimously unique i n my point of view.because of historical perspective and historical places of Bengal (Murshidabad) made a anicio-present supernatural romantic phenomena.
উত্তরমুছুনOn the other hand one of the best thing in this story contain the most present situation of the whole world. Lockdown, no work,doctors attitude all of this socio- political activities and perspective are used polyphonically, which was literally perfect in this present condition k personally know story writter UTTAM BISWAS and I read so many story.I hope he deserve a better very better places in our literature for his some of unique work...
Sanju Pramanik
A Research Scholar at CSSSC.
Another thing which about the love life of this story. It was completely different love matter for one hand on Jannat and other hand Khurshid. Writter project their love affection, but it also indicate something beyond on it. After sometime in this story Khurshid realised the real love life between them, rather he revive his love relationship in the touch of Moinul, (One of the mystic character of this story).Story writter use this character like a mirror to reflect Khurshid's mind about their past love life. It was Moinul who create a bridge from Khurshid mind to Jannat, that's why Khurshid ready to jump in the water to getting touch once again to Jannat.it was also indicate that Khurshid get a new edge of their past relationship.
উত্তরমুছুনIt was incredibly fantastic...
Sanju Pramanik