অংশু প্রতিম দে

মায়াজম
0
মিসিং লিঙ্ক



-“তব্রত রায়কে চেনেন নিশ্চয়? এমএলএ দেবব্রত রায়ের ছেলে?”
-“চিনি। এখানে থাকে না।”
-“হ্যাঁ, মাস ছয়েক আগে এলাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে গেছিল। শিপ্রা মিসিং কেসের অন্যতম সাসপেক্ট।”
-“সাসপেক্ট আবার কি! শিপ্রা নামের মেয়েটির কেসে কিছু ছিল না মশাই। পড়তে এলাকার বাইরে যাতায়াত করতই। একদিন রাতে বাড়ী ফেরেনি। উঠতি বয়সের ব্যাপার, কারো সাথে পালিয়েছে নিশ্চয়।”
-“এতকিছুর পরেও আপনার এই স্টেটমেন্ট!”
-“নাতো কি বলব! খোঁজাখুঁজি করেও মেয়েটাকে পাওয়া যায়নি। কেউ কিডন্যাপ করলে বা হারিয়ে গেলে ঠিক বার করতাম। কেউ যদি নিজে থেকে হারিয়ে যেতে চায় তাহলে তাকে কি আর পাওয়া যায়?”
-“মেয়েটার বাবার অভিযোগ ছিল আপনারা কেসটা প্রথমে নিতেই চাননি।”
-“সাবালক মেয়েকে যদি পাওয়া না যায় তাহলে ২৪ ঘন্টা বাদেই খোঁজখবর শুরু হয় সেটা জানেন বোধয়। আমরা প্রথমে আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের বাড়ীতে খোঁজ করতে বলেছিলাম বাড়ীর লোকেদের।”
-“এরপরে যখন ঋতব্রতর নাম এল কেসে সেইসময় তাকে ডেকে জেরা করা, বা সেই বন্ধ জুটমিলে সার্চ করা সেসব কিছুই করেননি।”
-“সমর পাল বলেছিল ওর মেয়েকে নাকি ঋতব্রত আসা যাওয়ার পথে বিরক্ত করত। শুধুমাত্র এই কথার ভিত্তিতে কিছু করা যায় নাকি। হাই-প্রোফাইল বাপের ছেলে, অনেক আটঘাট বেঁধে এগোতে হয়। তবু ঋতব্রতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল বৈকি। ও অভিযোগ অস্বীকার করেছিল।”
-“বহুদিন ধরে বন্ধ থাকা জুটমিলে এমএলএর ছেলেকে সাগরেদসহ সন্ধ্যের দিকে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যেত। ওটাই ছিল ওদের ঠেক। শিপ্রার মোবাইলের লাস্ট লোকেশন জুটমিলের আশেপাশেই ছিল। সেই রাতের পর থেকে শিপ্রার মোবাইল আর চালু হয়নি। আপনার মনে সন্দেহ হয়নি যে ওই রাতে শিপ্রার সাথে কিছু হয়েছিল ওই বন্ধ জুটমিলের ভেতরে! তারপরে ওকে গুম করে দেওয়া হয়েছে।”
-“সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু প্রমাণ চাই যে! ঘটনার রাতে ঋতব্রত ওর বাড়ীতেই ছিল।”
-“এই স্টেটমেন্টের সত্যাসত্য যাচাই করেছিলেন?”
-“স্বয়ং এমএলএ সাহেবের স্টেটমেন্ট। তাছাড়া আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও জানা যায় যে ঋতব্রত ওইদিন বাড়ীতেই ছিল সারাদিন।”
-“আশেপাশে কান পাতলে তো আরো অনেক কিছুই শোনা যায় প্রবীরবাবু। আপনি এমএলএ দেবব্রত রায়ের বিশেষ স্নেহভাজন আর ঋতব্রতর বিভিন্ন খুচরো পাপ ঢাকা দেওয়ার অন্যতম যন্ত্রী।”
-“মিঃ বটব্যাল আপনি একটা কেসের তদন্তে এসেছেন। যা যা জানতে চাইছেন বলছি। সহযোগিতা করছি আপনার সাথে। নাউ ইউ আর গোয়িং টু ফার!”
-“যে সে কেস নয়। কদিন আগে আপনাদের ওই এমএলএর ছেলে ঋতব্রত কলকাতার হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল অত্যন্ত যখম অবস্থায়। মাল্টিপল স্ট্যাবিং। খুবই সীরিয়াস ইঞ্জুরি। নিশ্চয় শুনেছিলেন। এতদিন সে কোনো বয়ান দেওয়ার মত অবস্থায় ছিল না। আজ সকালে কিছুটা রিকভার করার পরে বয়ান দিয়েছে ঋতব্রত। আর বয়ান দেওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই আচমকা মারা গেছে সে। ডাক্তারের বক্তব্য কোনো কারণে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে হার্ট ফেল করেছে ঋতব্রতর।”
ঋতব্রতর মারা যাওয়ার খবরটা জানতেন না লোকাল থানার অফিসার ইন চার্জ প্রবীর সেন। শুনে রীতিমত অবাক হলেও প্রবীর গলাটা যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেই জানতে চাইলেন, “কী বলেছে ঋতব্রত বয়ানে?”
-“ওর এই অবস্থার জন্য সরাসরি শিপ্রাকে দায়ী করেছে সে। শিপ্রা কলকাতায় বেশ কিছুদিন ধরেই ওকে ফলো করছিল। একদিন ঋতব্রত বন্ধুদের সাথে পার্টি করে অনেক রাতে নিজের ডেরায় ফিরছিল। ফেরার পথে নির্জন রাস্তায় শিপ্রার দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়েছিল। এও বলেছে শিপ্রা হসপিটালেও নাকি এসেছিল। ঋতব্রত বয়ান দেওয়ার সময় অদ্ভুত এক ভয়ের দৃষ্টিতে বারেবারে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল আর বলছিল শিপ্রা ওকে কিছুতেই বেঁচে থাকতে দেবে না। আরেকজন যে শিপ্রার সর্বনাশ করেছে তাকেও ছাড়বে না।”
-“সর্বনাশটা কী? ঋতব্রত কিছু বলেছে নাকি সেই ব্যাপারে?”
-“না, সেইজন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। যদি কিছু আলোকপাত করতে পারেন।”
-“না, এই ব্যাপারে আর কিছু বলার নেই আমার।”
(২)
এক চুমুকে প্রথম গ্লাস শেষ করে এখন একটু মাথাটা হাল্কা লাগছে প্রবীর সেনের। এমনিতেই এত কাজের চাপ, তারপরে দুপুর হতে না হতেই কলকাতা থেকে আসলো উটকো এই ঝামেলা। কলকাতায় ঋতব্রত রায়ের ওই বয়ান আর তারপরে আচমকা মারা যাওয়ার পরে সেই ব্যাপারে তদন্ত শুরু হতেই মাস ছয়েক আগের এই শহরতলীর ছোট একটা কেস নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে। আর ওই কেসের তদন্তাকারী অফিসার থাকার জন্য আজ প্রবীরকেও কম হেনস্থা হতে হল না! তবে কলকাতা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের এই ইয়ং অফিসারকে খুব একটা পাত্তা দেননি প্রবীর। বেশী পড়াশোনা করার জন্য ডিপার্টমেন্টে কল্কে পেতে পারে কিন্তু এই এলাকাটা প্রবীরের। ওই বটব্যল ওর কিস্যু করতে পারবে না। কাল সকালেই মানে মানে ঠিক কেটে পড়বে।
আর শিপ্রার কেসটাতে কিছু ছিলই না। শিপ্রার বাবা সমর পাল হৈচৈ করেছিল বলে ভালোমত তদন্ত হয়েছিল সেসময়, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। এখন ঋতব্রত জখমি অবস্থায় কী বলতে কী বলেছে! শিপ্রার পক্ষে ওসব করা সম্ভবই না। সারাক্ষণ ওইসব আজগুবি কথাবার্তা শুনে মাথাটা ধরে গেছিল প্রবীরের। এক পেগ স্কচ শরীরটা চাঙ্গা করে দিয়েছে। আরেক পেগ এবারে স্নায়ুর ওপর দখল নিচ্ছে। মালতীর ডেরায় নতুন একটা মাল এসেছে। মালতী কালই বলছিল এখনো অব্ধি ভার্জিন নাকি! শালা, বেশ্যার আবার ভার্জিনিটি! তবে সেদিন দূর থেকে মেয়েটাকে দেখে কচি আর বেশ গরম মাল মনে হয়েছিল প্রবীরের। আজ রাতে তাহলে হাতেখড়ি হয়েই যাক মেয়েটার। প্লেইন ড্রেসে কোয়ার্টার ছেড়ে বেরিয়ে পশ্চিম প্রান্তে মালতীর বেশ্যাখানার দিকে বাইক ছোটালেন প্রবীর। শরীরটা এখন গরম কিছু চাইছে।
(৩)
-“ঘর অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?” নতুন মাগীটার আবছা অন্ধকার কামরায় ঢুকে বিরক্ত হলেন প্রবীর।
-“লাইট জ্বললে আমার লজ্জা করে।”
-“শালা, ছেনালি হচ্ছে? সবকিছু ভালোকরে না দেখলে আমার আশ মেটে না।”
-“দেখা যাচ্ছে তো স্যর। এই যে আমি। কাছে আসুন না।”
-“লাইট জ্বালাতে কী হচ্ছে তোর?”
-“লাইট জ্বললে তো আপনার ফিউজ উড়ে যেতে পারে, তাই ভাবছিলাম...”
-“কী! এত বড় কথা। শালী তুই জানিস না আমি কে! তোর ওই মালতীমাসীকে বলে রোজ রাতে আমার কোয়ার্টারে তোর ডিউটি লাগাচ্ছি আমি। সারারাত ধরে খাটানের ব্যবস্থা হলে তোর এই হেক্‌ড়ি কতদিন থাকে...” রাগে দাঁত কিড়মিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে থেমে গেলেন প্রবীর। এরমধ্যে ঘরের লাইটটা জ্বলেছে আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে প্রবীর প্রচণ্ড চমকে গেছেন। শিপ্রা, মালতীর বেশ্যাকোঠায় শিপ্রা! ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে প্রবীর সেনের দিকে।
নাহ, এটা হতেই পারে না। নেশার ঘোরে কাকে দেখতে কাকে দেখছেন তিনি!
-“কি হল দারোগাবাবু, বোলতি বন্ধ্‌! বলেছিলাম না, লাইট আপনি সহ্য করতে পারবেন না।”
-“শাট্‌ আপ! আর আর এক পা এগোবে না।” মেয়েটা কাছে চলে এসেছে। সেই রাতের ড্রেসটাই ওর গায়ে। মেয়েটার শরীর থেকে চেনা গন্ধটা নাকে এসে ধাক্কা দিয়ে প্রবীরকে নিয়ে যাচ্ছে ছয় মাস আগের বৃষ্টিভেজা রাতে।
প্রবীর ছুটছেন পাগলের মত। পেছন ঘুরে তাকাচ্ছেন বারবার, যেন কেউ তাড়া করেছে তাঁকে। কবরখানার পেছনের জঙ্গলের দিকে যাচ্ছেন তিনি। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না আজ। ঋতব্রতর মতন ইয়ং ছেলে ভুলভাল দেখলেও উনি একজন দুঁদে পুলিশ অফিসার। ক্রাইম ঘাঁটার এতদিনের অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে। কোনো ফাঁক রাখেন না তিনি কাজে।
সেইরাতে ঋতব্রত আর তিনি দুজনে মিলেই খেয়েছিলেন শিপ্রাকে। কিন্তু তারপরে মেয়েটাকে মেরে ওই কবরের পেছনে জঙ্গলে পুঁতে দিয়েছেন। কোনোভাবেই বেঁচে যাওয়ার তো কথা নয়। তাহলে আজ কোথা থেকে আসছে শিপ্রা? ছুটতে ছুটতে কবরখানার পেছনে পৌঁছে গেছেন প্রবীর। ওই তো ওখানেই পোঁতা আছে মেয়েটার লাশ। একবার পরখ করে দেখে নিলেই হল, সব ঠিক আছে কিনা!
পাগলের মত মাটি খুঁড়ে চলেছেন প্রবীর। অন্য কোনোদিকে তাঁর খেয়াল নেই। খেয়াল করলে দেখতে পেতেন কলকাতা থেকে আগত অফিসার মিঃ বটব্যল ফোর্স নিয়ে এগিয়ে আসছে প্রবীরের সদ্য খোঁড়া গর্তটার দিকে। বেশ কিছুটা মাটি তোলার পরে সেখানে একটা মানুষের কঙ্কালের অস্তিত্ব স্পষ্ট হচ্ছে।
-সমাপ্ত-

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)