শীতকালটা কলম্বাসের দেশে বড়ই একঘেঁয়ে কাটে!...একদিকে হাড় হিম করা উত্তুরে বাতাসের দৌরাত্ম্য, অন্যদিকে দিগন্তবিস্তৃত নিথর, নিষ্প্রাণ বরফসাম্রাজ্য। যতই এই রূপোলী দেশের অপরূপ কথা আর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য জানলার ওপার থেকে সম্মোহিত করুক না কেন, নিউ ইয়র্কের হিউমিড সাবট্রপিকাল ক্লাইমেটে বরফবন্দি, নীরস ‘উইন্টার ব্লুজ’কে পরাস্ত করার জন্যে নানা ইনডোর প্রোগ্রামের প্ল্যান করে রাখা হয় আগে থেকেই। এবার আমাদের উইন্টার উইশলিস্টে তাই বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকোয়ারিয়াম! সতর্কবার্তা শুনেছিলাম, সপ্তাহান্তে অ্যাকোয়ারিয়ামে বেশ ভালো ভিড় হয়,কিন্তু তা যে ঠিক কীরকম-যাকে বলে ‘স্কোয়শড লাইক সার্ডিনস’,তা বেশ হাড়ে হাড়েই টের পেলাম!
প্রায় আড়াই লক্ষ স্কোয়ার ফুট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পাঁচতলা বাড়ির সমান সুবিশাল এই বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকোয়ারিয়াম আমেরিকার প্রথম দশটি ‘বেস্ট অ্যাকোয়ারিয়ামে’র মধ্যে অন্যতম,যার প্রতিটি তলায় রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নানা জলচর ও উভচর প্রাণীর সম্ভার। প্রায় তিরাশি লক্ষ লিটারেরও বেশী জলভান্ডার শরীরে মজুত করে এই অ্যাকোয়ারিয়াম আশ্রয় দিয়েছে প্রায় কুড়িহাজারেরও বেশী বিভিন্ন জলজ প্রাণীকে,তার মধ্যে প্রায় হাজার তিনশোরও বেশী প্রজাতি বিপন্ন। এই অ্যাকোয়ারিয়ামটির সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য হল পৃথিবীর জলজ সম্পদের সংরক্ষণকে উৎসাহিত করা,‘মেরিন অ্যানিমাল রেস্কিউ প্রোগ্রামে’র মধ্য দিয়ে সমুদ্রোপকূলে এসে আটকে পড়া অসহায়,আহত সামুদ্রিক প্রাণীদের উদ্ধার করে সমুদ্রে,তাদের সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া!
১৯৮১সালের আগস্ট মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের ইনার হার্বরে বাল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকোয়ারিয়ামটির উদবোধন করা হয়। পাঁচটি লেভেল বা ফ্লোর রয়েছে অ্যাকোয়ারিয়ামটিতে। প্রতিটি ফ্লোর এক একটি নির্দিষ্ট থিমকে প্রাধান্য দিয়েছে। টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল, মৃদু নীল ও সমুদ্রসবুজ আলোয় মোহময় এ এক রূপকথার পাতালপুরী যেন! 'পিয়ার থ্রি প্যাভিলিয়নে'র প্রথম লেভেলে রয়েছে 'ব্ল্যাকটিপ রীফ' যা আসলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরের সুবিস্তীর্ণ প্রবাল দুনিয়ার জলছবি। কোরালে পরিপূর্ণ এই প্রদর্শনীতে প্রায় সত্তর প্রজাতির মাছ রয়েছে-ব্ল্যাকটিপ রীফ হাঙ্গর,জেব্রা হাঙ্গর,গ্রীণ সী টার্টল। মেঝে থেকে ছাদ অবধি প্রলম্বিত ‘ভিউইং উইন্ডো’-কাচের সুবিশাল জানলার কাছে দাঁড়ালে মুহূর্তের জন্যে মনে হয়,আমরা নিজেরাও যেন এই অপ্রতিম জলজীবনেরই অঙ্গমাত্র। দ্বিতীয়তলায় রয়েছে 'মেরিল্যান্ডঃমাউন্টেনস টু দ্য সী', যেখানে মেরিল্যান্ডের অধিবাসী বুলফ্রগ,ডায়মন্ডব্যাক টেরাপিন(ছোট প্রজাতির কচ্ছপ) চলেফিরে বেড়াচ্ছে। শুনলাম পূর্ব, দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দা এই সুন্দর কচ্ছপগুলি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মেরিল্যান্ডের স্কুলগুলিতে একটি প্রোগ্রাম চালু হয়েছে,‘টেরাপিনস ইন দ্য ক্লাসরুম’। স্কুলগুলিকে পপলার আইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা একটি করে টেরাপিনছানার দায়িত্ব দেওয়া হয়,শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা সারা বছর ধরে সেটিকে পর্যবেক্ষণ করে বছর শেষে পপলার আইল্যান্ডে ছেড়ে দেয়। বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও প্রাণীদের সঙ্গে ছোটদের এই আত্মিক সংযোগ তৈরী করার এমন সুন্দর পরিকল্পনা সত্যিই প্রশংসনীয়!
তৃতীয়তলার আকর্ষণ 'সার্ভাইভিং থ্রু আড্যাপ্টটেশন',‘লিভিং সিশোর’।পৃথিবীর পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের মাধ্যমে বেঁচে থাকা প্রাণীদের নিয়েই এই প্রদর্শনী-প্রয়োজনে গায়ের রঙ বদলে ফেলা ‘জায়ান্ট প্যাসিফিক অক্টোপাস’,ছশো ভোল্টের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপন্নকারী 'ইলেক্ট্রিক ইল',গায়ের কালচে রঙের সাহায্যে লুকিয়ে থাকা ‘ব্ল্যাক গ্রুপার’।এই ব্ল্যাক গ্রুপার হল‘প্রোটোজাইনাস হার্মাফ্রোডাইটস’,সব মাছই স্ত্রীমাছ হিসেবেই জন্মায়,পরে একসময় প্রজননের প্রয়োজনে কিছু ব্ল্যাক গ্রুপার পুরুষে রূপান্তরিক হয়ে যায়। ব্ল্যাক গ্রুপারের কেয়ারটেকার জানালেন এই প্রাণীটি প্রতি সকালে জানলার কাচ পরিষ্কারের সময় তাঁকে সঙ্গ দেয়!‘লিভিং সীশোরে’র দুটি টাচপুলে উত্তেজিত খুদেদর্শকদের কাছে অ্যাকোয়ারিয়ামের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আটলান্টিক স্টিংরে বা মুন জেলিকে ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা বোধহয় এই প্রথম! সম্প্রতি ফ্লোরিডা অ্যাকোয়ারিয়ামের মুন বে এক্সহিবিটেও এইধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
চতুর্থ লেভেলের 'সী ক্লিফস, কেল্প ফরেস্ট, প্যাসিফিক কোরাল রীফ,আমাজন রিভার ফরেস্টে' রয়েছে অভাবনীয় বৈচিত্র্য। এখানে রয়েছে কৃত্রিমভাবে তৈরি খাড়াই 'সী ক্লিফ' যেখানে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা সামুদ্রিক পাখীর দল। আমাজন পৃথিবীর প্রায় একতৃতীয়াংশ প্রাণীর স্বাভাবিক আবাসস্থল। ডিসেম্বর থেকে মে-ভরা বর্ষায় আমাজনের এক রূপ, আগস্ট থেকে নভেম্বর শুষ্ক আমাজনের রূপ অন্যরকম...উভয় রূপ প্রত্যক্ষ করারই সুযোগ আছে এখানে! নীচে জলের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো ‘ডিসকাস’,’জায়ান্ট সাউথ আমেরিকান রিভার টার্টল’ যেমন রয়েছে, আছে গাছের ডালে উড়ে বেড়ানো ‘রেড উইঙ্গড ব্ল্যাকবার্ড’,‘অরিওল’! পঞ্চম লেভেলে 'আপল্যান্ড ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট' ক্রান্তীয় অঞ্চলের বহুবিধ দুষ্প্রাপ্য গাছ ও বিপন্ন প্রাণীর বাসভূমি। রয়েছে বিপদগ্রস্ত ‘গোল্ডেন লায়ন ট্যামারিন’,‘বিষাক্ত ব্লু পয়জন-ডার্ট ফ্রগ’, ‘ভয়ঙ্কর ট্যারেন্টুলা’ও! এছাড়া 'আটলান্টিক কোরাল রীফ',আর 'শার্ক অ্যালি'র আকর্ষণও কিন্তু অদম্য!
এই বিল্ডিংটির সঙ্গে যুক্ত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র 'পিয়ার ফোর প্যাভিলয়নে’ রয়েছে 'ডলফিন ডিসকভারি'। সুবিশাল নীল জলাধারে ক্রীড়ারত ছয়টি আটলান্টিক ডলফিন,‘মেরিন ম্যামল এক্সপার্ট’দের সঙ্গে কথা বলে এদের সম্বন্ধে যে কোন কৌতূহল নিরসন করার সুযোগ আছে। দিনে চারবার ডলফিন শো হয়,প্রবেশমূল্যের সঙ্গেই বাড়তি তিন ডলার যোগ করে নিতে হয়। ‘জেলিস ইনভেজনে’ জলের গভীরে ফুলের মতো ভাসতে থাকা ‘আপসাইড ডাউন জেলি’,বটের ঝুরির মতো দীর্ঘ্তম শুঁড়ওলা ‘লায়ন’স মেন জেলি’ বা আলোকপ্রবাহী ‘মুন জেলি’ ছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রজাতির রহস্যময়, প্রাগৈতিহাসিক জেলিফিশের আশ্চর্য সুন্দর উপস্থিতি।
অ্যাকোয়ারিয়ামের মোম পিছলানো দেওয়ালে চোখে পড়ল বিখ্যাত আমেরিকান নৃতত্ববিদ লোরেন আইজলির কয়েকটা কথা-'if there is magic on this planet, it is contained in water'......হ্যাঁ, সেই জাদুদুনিয়ার উজ্জ্বল স্মৃতি নিয়েই এবার ফিরে আসা বাস্তবে...
----------------------------
সুচিন্তিত মতামত দিন