তারানাথ তান্ত্রিক

মায়াজম
0

                               মানসসরোবর-পাড়ে







সেই সিংহ বসুক জীবের হৃদয় কন্দরে, কল্মষ দ্বিরদ নাশে যাঁহার হুঙ্কারে”। মানস সরোবর একটি তীর্থের নাম। কৈলাসপর্বত পাদদেশে এই অনুপম তীর্থের স্থিতি। তবে তীর্থ নামকরণে দেয় নামটির মধ্যে বেশ মাহাত্ম্যপূর্ণ ভাব লুকায়িত আছে, কেন এমন বলছি? নামটি আমাদের মানসলোকের মানচিত্রের জীবন্ত স্মারক! আমাদের মানস জগতের সাথে বহির্জগতের এই বিখ্যাত তীর্থনামের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। 'মানস' শব্দখানি স্বীয় মনের প্রতীকি নির্দ্দেশক। আমাদের মানস জগতেও সরোবর আছে, সেখানেও তীর্থ আছে, সেখানেও শ্বেতাম্বরাচ্ছাদিত কৈলাস পর্বতটি স্বমহিমায় সুবিশাল প্রস্থসহ দণ্ডায়মান। কিন্তু যতক্ষণ না সত্যরূপ সূর্য্যোদয় মানস জগত সংলগ্ন মানস সরোবরাকাশে না হয় ততক্ষণ পর্য্যন্ত তীর্থ সৌন্দর্য্য ও মহিমা কোনকিছুই আমাদের নিকট প্রকটিত হয় না, সমস্তই যেন রাত্রি অন্ধকারে নিমীলিত থাকে। সত্য বিষয়ে আলোচনা এই মুহূর্তে, এই ক্ষণে, আমাদের অতীব দরকার, যেহেতু সত্যের সনাতন রূপ থেকে আমরা ক্রমশ বিচ্যুত হয়ে পড়ছি, নিজেকে হারিয়ে নিজেকেই খুঁজে চলেছি প্রহেলিকার ঘূর্ণিপাকে! ব্যক্তি নির্বিশেষে তা সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু সমাজের ক্রমশ অস্থিরতা, পরমত অসহিষ্ণুতা, অসন্তোষাবস্থা তাই ইঙ্গিত করে। বোধলগ্নভ্রষ্টে, মন নিখোঁজে, আমরা আমাদেরকেই ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারছি না, চিনে উঠতে পারছি না। এও হতে পারে- উপরোক্ত বক্তব্যসকল মিথ্যে হতাশার চরমতম অভিব্যক্তি, অথচ সমালোচনাগুচ্ছকে সংশোধন প্রতিমারূপে গ্রহণ করতে অসুবিধেও হবার কথা নয় কারো। মুক্তবক্তব্যের, কলম চালনায় অধিকার তো সবারই আছে। নাহয়, এই লিখিত বাক্যরাজিতেই সেই অধিকারের চর্চ্চা হোক! দুটো কথাইতো- নিজেদের মধ্যে বলা ও শোনা, যা মানবীয় সংযোগের শ্রুতিরূপ। শব্দই সমাজকে নান্দনিক গঠনশৈলীতা প্রদান করে- সুতরাং শব্দকথন ও চিন্তন মানুষের শ্রেষ্ঠতম মৌলিক অধিকার। পুরো রচনা মধ্যে যে ভাবনাশৈলী গ্রথিত তা সমাজের কোন না কোন অংশকে অবশ্যই প্রতিফলিত করে – তাই এই ভাবনার গুরুত্ব একেবারেই নেই এ’কথাও বলা যায় না।



সত্য প্রকাশে আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ক্ষণেই অন্তর্হিত হয়, সত্যরূপ সিংহের গর্জনে আমাদের মানস জগতের সমস্ত দূর্বলতার ছাপ অবলীলায় বিলীন হয়। সত্য অনুসন্ধান তথা এই অনুসন্ধিৎসা ধর্ম মানুষের স্বভাবগত যেহেতু সত্যই রহস্য- প্রসঙ্গত বেদান্ত সত্য প্রতিপাদন করে বলে-ভারতীয় বেদান্ত দর্শনকেও রহস্য বলে অভিহিত করা হয়।


প্রশ্ন হল- সত্য নির্ণয়ের সনাতন পন্থাটি অধুনা প্রচলিত কিনা কিংবা সত্যের প্রতি মানুষ আকর্ষিত হলেও সেই সত্যের বর্তমান প্রকাশটি কেমন? আশ্চর্য্য হলেও সত্য- মানুষ এতক্ষণে গণমতামতে বা নিজের পছন্দাধীন সত্যকে আঁকড়ে ধরতে ভালোবাসে – অভ্যাসটি পুরনো, তাই বলে সঠিক এমন ভাবার দায় নেই। সর্বদা এই অভ্যাসেই জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে এমন কোন দোহাই তো কেউ দিয়ে বসেনি আমাদের! তবে-

আমাদের মনের সমস্ত কালিমাকে নিশ্চিহ্ন করার ক্ষমতা রাখে সেরূপ সত্যের প্রতি আমাদের কেন জানি ভয় এবং অনীহা কাজ করে থাকে- সৃষ্টির আদিম কাল হতেই। উপনিষদে আখ্যান রয়েছে- প্রজাপতি ব্রহ্মা সৃষ্টি প্রাক্কালে প্রথমে ভয়ে ভীত হন, উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষের মধ্যেও এই ভয় বহমান। সমাজে আমরা যে মুখোশটি পড়ে নিশ্চিন্তে একত্রে বাস করছি সেই মুখোশটি অকস্মাৎ খুলে আসার ভয়ে হোক কিংবা যা আমরা গোপন করতে ভালোবাসি তা প্রকাশ্যে আসার ভয়ে হোক আমরা সত্য হতে দূরে থাকাটাকেই একপ্রকার জীবন উদ্দেশ্য হিসেবে বেছে নিয়েছি। জীবন অপূর্ণ- এ যেমন সত্য তেমনভাবেই- সত্যের আস্বাদে অপূর্ণতার মধ্যে আমরা পূর্ণতার স্বাদ পাই- এও সত্য। আমাদের মন নিশ্চিত হয় কখন? সত্য অনুধাবনে। হৃদয় নিশ্চিত হলেই তাতে প্রশান্তির হিল্লোল বয়ে চলে, তা যতই ক্ষণিকাবস্থা হোক না কেন, আমাদের মানতেই হয়- প্রশান্তি সত্য হতেই উদ্ভাসিত। সত্যের আনন্দরূপে প্রবাহটি লক্ষ্যণীয়। এমনকি নিজের বা প্রিয়জনের দুর্ঘট দুঃসংবাদ শ্রবণপূর্ব পর্য্যন্ত আমাদের মন অনিশ্চয়তায় দোলায়মান থাকে, কিন্তু দুঃসংবাদ যখন আমরা নিশ্চিতরূপে শ্রবণ করি- তখন আমাদের মন নিশ্চিত হয়, মন শান্ত হয়, ক্ষণিক শান্তাবস্থার পরবর্তী প্রভাবরূপে দুঃখ অনুভব হোক কিংবা সুখ, তার জন্য আমরা সদা প্রস্তুত থাকি। আমাদের মন সুখ হোক বা দুঃখের বিলাস উভয়কেই দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করে।


অধুনা গণমতের সমর্থনে স্বেচ্ছা নির্বাচনে সত্যের নির্ধারণ হয় – পূর্বেও বলেছি। বিচারের চেয়েও বিশ্বাসে আমাদের এখন আস্থা বেশি। মানসজগতে সত্যের রূপটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হলেও বহির্জগতে সত্য স্থান কাল পাত্রের আবরণবশত স্থূল। সত্য অত্যন্ত সূক্ষ্মতর পদার্থ, কিন্তু সেই সূক্ষ্মতার দিকে ধাবিত হয় ক’জনের মন? উদাহরণ দিলে বিষয়বোধ সহজতর হবে- আমরা জানি আকাশ নীল, কিন্তু আসলেই কী আমরা আকাশের প্রকৃত রঙ সম্পর্কে অবগত? অধিকাংশই এই বক্তব্য শোনার পরেই বিশ্বাস করে নেয়, বক্তব্যের যথার্থতা বিচারে অধিকাংশের মনই অগ্রসর হয় না। কেন? কারণ আকাশকে নীল দেখা আমাদের চিরাচরিত অভ্যাস, চট্‌ করে অভ্যাস বদলে মন সায় দেয় না! যদিও আকাশ মোটেও নীল নয়, তবুও নীলপ্রভা যুক্ত আকাশের পরিবর্তন আমরা গ্রহণ করতে রাজী নই- পরিবর্তনে ভয় হোক কিংবা অস্বস্তি আমরা চাই আমাদের ধারণাবৃত্তি এভাবেই আজীবন থেকে যাক্‌। মানস জগতের নদীরূপ যে স্রোত সেই স্রোতে বাঁধ দিতে পারলেই যেন আমরা খুশি- বদ্ধ থাকতে পারাটা আমাদের কাছে শান্তির আভাস। ‘আকাশ নীল’ এই ঘটনার মানসিক অণুকরণকে আমরা সময় স্থান কাল পাত্র সহ আবদ্ধ রাখতে চাই, আমরা চাই সেই সময় স্থান পাত্র সহ নির্ম্মিত ঘটনা থেকে আমরা যাতে দূরে সরে না যাই! অনিত্যকে নিত্য করার প্রবল প্রচেষ্টাই বোধহয়! কিন্তু বাঁধ প্রদানে স্রোতধারা অবলুপ্ত হয়। মানস নদীর ধারায় বিনা অবগাহনে শুদ্ধি বা প্রশান্তভাবের উদয় কীভাবে সম্ভব? মনকে যে স্থান কাল পাত্রে আবদ্ধ করলাম, তা থেকেও বা মুক্ত হব কী করে? এই আবদ্ধ থাকার অর্থই মনের জড়াবস্থা প্রাপ্তি- আর জড় মন চিন্তার সূক্ষ্মতাকে ধরতে সক্ষম হয় না, জড়তা অন্ধকারের সামিল- ‘তমসাবৃতেন’ – অগতির গতি বা জড় মনের ঊর্ধ্বগতিই বা হবে কীকরে? ‘মন এব মনুষ্যাণাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ’। মন’ই মোক্ষ এবং বন্ধনাবস্থার কারণ। মনকে মুক্ত করার পদ্ধতিটি সত্য বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যেই লুকায়িত। সত্য স্থান কাল পাত্রের অতীত সত্ত্বা- স্থান কাল পাত্র সত্যদ্যোতক অনুষঙ্গ মাত্র। সুতরাং স্থান কাল পাত্র ইত্যাদি স্থূল বিষয় দ্বারা সত্যের প্রমাণ অনুসন্ধান আমাদের পক্ষে হিতকর নয়। উদাহরণস্বরূপ- ‘আমার তিনি অথবা তিনি আমার’ এই ভাবনাটিতে ‘তিনি’ বা ‘তিনি’র অন্তর্গত বিষয়সমূহ অনিত্য- কিন্তু বাক্যটি যে ভাবের দ্যোতক তা ‘আমার তিনি’ এই বর্তমানকালাশ্রিত চলমান ভাবনারও অতীত- তথা স্থান কাল পাত্রের অতীত ‘বোধ’ বা ‘সম্বিৎ’ স্বরূপ সত্য। যা অনুভব হলে আমাদের মন স্থির হয় একবিন্দুতে (তান্ত্রিক বিন্দু বলি বা বৈদিক ব্রহ্ম), আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব যে স্থলে সত্যের প্রকাশালোকে অন্তর্লীন হয় সেখানে যাত্রা করাটা মহাপ্রস্থান তথা অগস্ত্য যাত্রা, প্রকৃত তীর্থযাত্রা- একান্ত নিজস্ব মানস যাত্রা। যাত্রার পদ্ধতিটি আমাদের ভাবনাজগতেই লুকায়িত এবং এই যাত্রা চিরন্তন, তাই শ্রুতি নির্দ্দেশ- “চরৈবেতি”। জীবনও এরূপ চলিষ্ণু, এই নিরন্তর চলাই বৈদান্তিক বৃদ্ধির পথে অগ্রসরতা।


সত্য নির্ণয়ের বিভিন্ন পদ্ধতি আমাদের উপমহাদেশ কিংবা বিভিন্ন প্রাচীন দার্শনিক সম্প্রদায়ে বর্তমান। সত্যের অস্পষ্টাবস্থা থেকে স্পষ্টাবস্থায় উন্নীত হওয়ার যে ধাপ সকল- সেই ধাপ সকলকেই মূলত দর্শনে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। ভারতীয় মুখ্য দর্শনের মধ্যে একটি হল ‘ন্যায়’- নৈয়ায়িক দর্শনে সত্য পরীক্ষায় মন যে স্বতঃসিদ্ধ প্রক্রিয়াসমূহের অনুসরণ করে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সত্য সম্পর্কে মনের যে অস্পষ্ট অনুভূতি – সেটি সংশয়াদি অবোধ্যতা ইত্যাদি মলজন্য হয়ে থাকে, সেই মলের অপসারণ কৌশলের পারিভাষিক ও দার্শনিক আলোচনাই ‘ন্যায়’। ‘দর্শন’ আমাদের মানসযাত্রাকালে যা ঘটে তৎসমস্তের শব্দপ্রতীক এবং মানস যাত্রায় আমাদের পথ চেনাতে সাহায্য করে। কিন্তু অধুনা মানব সমাজের, মানস নেত্রে, যুক্তির প্রচলিত রূপটি আমাদের প্রচলিত পূর্বেকার প্রণালীর অনুরূপ নয়। আমরা বর্তমানে বহির্জগতের ঘটনা প্রত্যক্ষ-পরে সাধারণত কোন বিষয়-বিচারে প্রবৃত্ত হই। গাণিতিক ভাষায় একে ‘আরোহ’ পদ্ধতি বলে। উদাহরণে বিষয়টির সরলীকরণ হবে- উচ্চস্থান হতে ভূমিতে বিভিন্ন বস্তুর পতন দেখে আমরা নিশ্চিত হই যে এমন কোন শক্তি এই জগতে ক্রিয়াশীল যা উচ্চে নিক্ষিপ্ত বস্তুর ভূমিতে পতনের জন্য দায়ী। জগতের সর্বত্রই অনুরূপ ঘটনা ঘটে কিনা সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নাহলেও- এরকম বহু ঘটনার (কার্য্যকারণ যাতে অনুসৃত) প্রত্যক্ষকরণ দ্বারা মধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব বিষয়ক সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হয়েছি। আমরা জানিনা- মহাবিশ্বের সর্বাবস্থায় ঠিক এমনটাই ঘটে কিনা অর্থাৎ বস্তু মাত্রই ভূমিতে পতিত হয় কিনা বা ভূমি সন্নিকটস্থ হয় কিনা- কিন্তু বহুতর ঘটনার পর্য্যবেক্ষণে এরূপ অনুমান বর্তমান বিজ্ঞান সিদ্ধ। কিন্তু এ ধরণের অনুমান পশ্চাতে আমাদের মন যেসকল সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করে থাকে সেটি অধিকাংশ মানুষেরই ধরাছোঁয়ার বাইরে- ঠিক সেই কৌশলগুলোকেই 'অবরোহ' পদ্ধতিতে পর্য্যবেক্ষণ 'নৈয়ায়িক'; শুধু 'ন্যায়'-ই নয়, সকল দর্শনেরই লক্ষ্য । ইদানীং লোকের অনেকাংশই তৎকালীন পদ্ধতির সঙ্গে অভ্যস্ত নয় বিধায় সূক্ষ্ম যুক্তি-তর্ক বিষয়ে ততটা আগ্রহীও নয় এবং অনভ্যাসে মনও সহসা যুক্তির কষাঘাত গ্রহণে তৈরী থাকে না, হয়তো বর্তমান যুক্তির নিয়মানুসারে যৌক্তিক বিচারে মন সমর্থন দিলেও সূক্ষ্ম যে বিচার প্রণালী- তাকে কোন প্রকারেই গ্রহণ করতে চায় না। আর স্থূল বিচার প্রণালীতে নিত্য অভ্যস্ত হতে থাকলে মনের সূক্ষ্ম ভাবজগতে বিচরণ ক্ষমতা হ্রাস পায়- সুদূরপ্রসারী ফলাফলস্বরূপ পরমত অসহিষ্ণুতার ক্রমশ উদ্ভব হয় ও ধীরে-ধীরে তা অসন্তোষের বিষবৃক্ষরূপে পরিণত হয়। মনের বিচরণ ক্ষমতার হ্রাসই মূলত বদ্ধাবস্থা, আর এই বদ্ধাবস্থাই- একে অপরের প্রতি দ্বেষ ক্ষোভের মূল কারণ, কেননা খাঁচাবদ্ধ থাকলে ঝগড়া হবেই! মন যুক্তি বা সত্য নির্ণয়ের পদ্ধতি সঙ্গে ক্রমশ অনভ্যস্ত হওয়ায় সত্য ধারণের জন্য তার যে উপযুক্ততা তা নষ্ট হয়ে পড়ে। আর দ্বিধাগ্রস্তযুক্ত মন স্ব ও অন্যের অশান্তিসমূহের কারণ। ফলস্বরূপ সামাজিক অশান্তিসমূহ লাঘবের জন্য দেশকর্তাগণ দিন দিন বিভিন্ন নিয়ম বা বন্ধনসূত্র সকলকে একে একে শিথিল করতে বাধ্য হন। বর্তমান আইন ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমনঃ পূর্বে খাদ্যাখাদ্য গ্রহণ বিচার সমষ্টিসাপেক্ষ ছিল বর্তমানে তা ব্যক্তিসাপেক্ষ।


মানুষের মন যখন অন্তর্মুখের শান্তি হতে বিচ্যুত তখন সে বহির্মুখে শান্তির প্রতি লালায়িত হবে- এই’ই স্বাভাবিক। সুতরাং যেসকল বিষয় মানব সমাজে এক সময় নিষেধ ছিল তাও এখন বিধিরূপে গণিত হচ্ছে। কারণ বহু বিষয় মানুষের সামনে উন্মুক্ত নাহলে তাঁর মন নানা বিষয়ে ছোটাছুটির অবসরটি পাবে না – ছোটাছুটি বন্ধ হলেই মনকে একঘেয়েমি পেয়ে বসবে, সুতরাং মন ক্লান্ত এবং অবসন্ন হয়ে পড়বে। সূক্ষ্মতা থেকে স্থূলতার যাত্রাটি আমাদের কাছে নিজেকে ভুলে থাকার একটি উপায় হলেও তা সামাজিক অবসন্নতার কারণ। নিরন্তর ছোটাছুটি স্বাভাবিক ভাবেই মনকে ক্লান্ত করে তোলে। বিশ্রামের স্থল সত্য সাক্ষাৎ অথচ তদ্বিপরীতে ক্লান্তি চিরনিদ্রাকেই আহ্বান করে। বিষয় সমুদ্রে ডুবে থাকা মন সহসা বিষয় থেকে মাথা উত্তোলন করতে অক্ষম। সুতরাং সত্য থেকে দূরে সরার প্রবণতা এবং সত্যাগ্রহণের যে নিরন্তর অভ্যাস তা আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে কী- আমরা জানি না। মনের অবশতা, বিষয়াপেক্ষাই মানবের প্রেতাবস্থা। এই প্রেতসমাজ আমাদের দৃষ্টিতে অশুভ কিছু না হলেও – মানুষ তাঁর যথাবিহিত স্বভাবসুলভ সহজাবস্থায় বা মানুষ সংজ্ঞায় আদৌ থাকছে কিনা; বিশাল প্রশ্ন? কারণ আমাদের মন আর আমাদের নেই, সে মানস সরোবর হতে অনেক দূরে- মুঠোআলাপনীর বোতামে কিংবা কোন পছন্দের দ্রব্যের অন্বেষণ ইত্যাদি কর্মব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে। আমাদের মনের আরো উচ্চতর যে ভূমিসকল রয়েছে ভাবনারাজ্যে- সেস্থল হতে আমরা বিচ্যুত হয়ে চলেছি, ভাবনারস আস্বাদনে আমরা নিরন্তর বঞ্চিত- সবার প্রেক্ষিতে তা সত্য নাহলেও অধিকাংশ জন্য তাই বাস্তবতা। যে জীবনদর্শনে মানসলোকে বিচরণারম্ভ হয়, তাই আজ শেকড় বিস্মৃতির ফলে চরশেকলে আটক। আমরা উপরোক্ত বক্তব্যমালাকে অভিযোগরূপে গ্রহণ না করে যদি চিন্তাপূর্বক ভেবে দেখি তাহলে এ পর্য্যন্ত বলা বক্তব্যেসমূহের ভাবনামূল অবগত হতে পারব।
প্রশ্ন- প্রাসঙ্গিক ভাবনা ও বিচার করার উপায় কী? উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ভয়কে অভয়পদে পরিণত করি কীরূপে? কীভাবে সত্যমূলে আমরা পৌঁছুতে পারি? কীভাবে স্থান কালাদির স্থূল সিন্দুক হতে আমরা মানস বোধ ভূমিতে উত্তরণ করব? মহাজনেরা সূত্র দিয়েছেন- ‘ভাবো, ভাবা অভ্যাস কর’। যতক্ষণ না এই বাণীর মর্মার্থ অভ্যাসের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে গেঁথে না যায় ততক্ষণ পর্য্যন্ত আমাদের নিকট সত্য অনুধাবনের পথখানি প্রশস্ত হবে না। মনকে এক জায়গায় বদ্ধ করে রাখাটা অন্যায়- অন্তত মানুষ হিসেবে নিজের মনের সাথে এই অবিচার করা যায় না। মনকে অগ্রসর হতে দেওয়া, তাকে চলতে দেওয়া- মানুষ মাত্রেরই কর্ত্তব্য। নিরন্তর জিজ্ঞাসা, জিজ্ঞাসার পশ্চাৎ যে প্রেরণা তাকে অনুভবের চেষ্টা আমাদেরকে অবশ্যই একধাপ সত্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সন্দেহ নেই। স্থান কাল পাত্র – এসব তো মনের মধ্যে ঘটনার ছাপ বিশেষ, ছাপগুলোকে আমরা অতিক্রম করব কী করে? প্রশ্ন করে, ছাপগুলো কী করে মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে সে সম্পর্কে সচেতন হয়ে। নিজের ভাবনাগুলো সম্পর্কেই যদি সচেতন না হই তবে আমাদের মনে ভাবনালোক দ্বারা উৎসারিত সত্যপ্রজ্ঞার অনুসন্ধান পাব কী করে? সত্যালোক মানসজগতে চিরবিরাজমান- শুধু মেঘাচ্ছন্ন। অচেতনতার মেঘগুলোকে সরিয়ে নেওয়া, ভাবনারাজ্যে নিরন্তর সচেতন থাকা- আমাদের উদ্ধারের পথ, আমাদের মহাযাত্রার সূচনা। প্রকৃত মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠা, পশুরাজ্য থেকে উৎক্রমণ- একমাত্র ভাবনাস্তরের উৎকর্ষ দ্বারাই ঘটে থাকে। সূক্ষ্মতার পরাভূমিতো আমাদের মাঝেই অন্তর্নিহিত অতএব, স্থূল বিষয়কে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে, বিষয়সমূহকেই একমাত্র সত্যমূর্ত্তিরূপে পরিগণন করে, নিজেকে একধাপ পশ্চাতাভিমুখে ঠেলে দেওয়াটা আত্মপ্রবঞ্চণা। বাস্তব জীবনের সমস্যা থাকবে- অনাহার, অনিদ্রা, অপ্রাপ্তি আমাদের নিত্য সঙ্গী কিন্তু এসবের সম্মিলিত সংজ্ঞা মাত্রই মানব নয়- আমরা ‘কিছু’তে অতিরিক্ত, অন্তত 'ভিন্ন', সেই সাথে অত্যন্ত ভিন্ন। সেই ভিন্নতা ও অতিরিক্ত বস্তুই ঋত ও সত্য। তাঁকে ঘিরেই মনুষ্যত্বের অপূর্ব সৌন্দর্য্যের বিলাসভূমি রচিত হয়। যা সত্য শিবম্‌ এবং সুন্দরম্‌ - তা থেকে বঞ্চিত হব কেন আমরা? এই বহির্জগত তো আমাদের চিত্তালোকেই আলোকিত- সুতরাং চিত্তালোকের উৎসস্থল তথা ‘ভর্গ’ জ্যোতির ধ্যান থেকে আমাদের বিমুখ হওয়া সাজে না।


সর্বাগ্রে সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরী করাই আমাদের কর্তব্য। যেন আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ সত্যকে বাধিত না করে, ক্ষণিকের ফুসরত যেন আমাদের অমৃতের যাত্রা থেকে বিচ্যুত না করে। সত্যাচরণই আমাদের পাথেয় হোক- সত্যাচরণ কী? নিজ মনে আসা সত্যের বোধটিকে পূর্ণাঙ্গরূপে অপরের মনে ফুটিয়ে তোলার জন্য যে আচরণ বিশেষ তাই সত্যাচরণ- প্রকৃত পরোপকার। নিজের মনের অনুভবই যদি কালিমাযুক্ত হয় তবে অপরকে সেই কালিমা দ্বারা আচ্ছন্ন করা কী অন্যায় নয়? সত্যাচরণের তিরোধানই আমাদের সামাজিক বা সামষ্টিক অশান্তিসমূহের মূল। আনন্দে থাকার অধিকার সকল মানুষের- কিন্তু প্রেতাবস্থা প্রাপ্ত অন্ধকার মানসজগতের অধিকারীগণ আনন্দ অন্বেষণেই দিনাতিপাত করে বটে, আনন্দে থাকার জন্য যে মানসভূমি দরকার তা তার কদাপিও হয় না।


এখন, আমি- “আমাদের” শব্দএকক এর উচ্ছেদ করতে চাই, নিজস্ব কিছু কথা বলার আছে। আমার অন্তরাত্মার মানুষ, আমাকে যিনি আলোকে চালিত করেছেন তিনি ব্যাঙ্গাত্মক আক্ষেপের সুরে প্রায়শই বলতেন- “বিচার তোলা থাক, মুড়ির ঠোঙা সামনে রাখ্‌”- কাওকে অজ্ঞানতার উল্লাসে মেতে উঠতে দেখলেই তিনি এভাবে রসালো আক্ষেপ ছুঁড়ে দিতেন। বিচার বিবেকপ্রসূত- মনকে উচ্চতরভূমিতে উৎক্ষেপণ জন্য যে শক্তির অপেক্ষা আছে তা বিচার থেকেই প্রাপ্ত হতে হয়, নচেৎ মন উৎকর্ষ বেগ প্রাপ্ত হয় না। ‘সত্য’ বিচারবৃক্ষের অমৃতফল বিশেষ-জীব যাঁর আস্বাদ গ্রহণে পরমতত্ত্বের সমতা লাভ করে। সুতরাং বিচার থেকে মনকে বিরত রাখা আর মনকে হত্যা- এক কথা। মননের অধিকার প্রাপ্ত বলেই মনুর সন্তান মানব, সেই মনকেই যদি বিচারচ্যুত করে বসি তবে মানবহত্যার পাপে দায়ী হব।


মানস সরোবরে যাত্রা, সেখানে কৈলাস শিখরোচ্চে উদিত সূর্য্যের কোমল আভা উপভোগ- ভোরালোকের স্নিগ্ধতার পরশজনিত আনন্দে; মানসপন্থাগামী পথিকেরই অধিকার। যাত্রাকালে যাত্রাপথ অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকুক কিংবা অস্পষ্ট সূর্য্যালোকে অবচ্ছিন্ন হোক অন্তত সেখানে দাঁড়িয়ে বিচ্ছুরিত অনুপম সৌন্দর্য্যপ্রভার অবলোকন ও আস্বাদন শেষে স্মিত হাসি, সে হাসি থেকেই জীবনের উদযাপন! মানসযাত্রা মঙ্গল প্রসাদে যে প্রাপ্তি তাই শিব স্বরূপ- শিবসাযুজ্য। মানস সরোবর তীরে অবগাহন ও সত্যস্নাত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের অধিকার মানুষ ব্যতীত কারো নেই- এই অধিকার অনুশীলনের চরমাবস্থাই- ‘মনুর্ভব’ আর ‘মনুর্ভব’ পদের স্থিতি- “অমৃতস্য পুত্রা’য়”। যেখানে পরিক্রমা ও প্রাপ্তি সমার্থক সেখানে আজীবন পথ চলাই লক্ষ্য।

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে”॥

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)