সেমন্তী মুখোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২২ অক্টো, ২০২০

সেমন্তী মুখোপাধ্যায়

 

ছায়াগৃহপথ






ভালোবাসা আসে আর যায়। আশ্চর্য জীবনের বাঁক। বৈচিত্র্য কোনোদিন ফুরায় না। সেই বৈচিত্র্যের নাম ভালোবাসা। ছোট্টবেলায় এক স্কুল ছিল। নামী-দামী নয়, শান্ত-স্নিগ্ধ একটা স্কুল। ইস্তিরি-হীন স্কুলের জামা, ঢিলে মোজায় গার্ডার, সস্তা রঙিন স্কুলব্যাগ। এটুকুই মনে পড়ে। পথের পাশে একটা ছোটো খাতা-বইয়ের দোকান। ধবধবে সাদা রবারের গায়ে সোনালি পাতলা প্লাস্টিক জড়ানো। বারবার খুলে দেখতাম পেন্সিল বক্স। ব্যবহার করতে ইচ্ছা করত না কিছুতেই। ক্লাসের রুটিন বুঝতাম না। প্রথম ক্লাসেই থাকত বানান লেখা। শিক্ষিকা এক মনে বলে যেতেন, আমিও এক মনে লিখে যেতাম যেন ক্লাসে আর কেউ নেই।
মস্ত বড়ো জানালার পাশে সোনা রঙের রোদ পড়ত চওড়া হয়ে। বিদিশা বারবার উঁকি মেরে আমার খাতা দেখার চেষ্টা করত। আমি কখনও বানান ভুল করতাম না। তারপর নীতিকথামূলক গল্পের ক্লাস। মনে দুঃখ ছিল যে, চাঁদমামা পড়ানোর একটা ক্লাস কী হতে পারে না?
স্কুলের পথে একজন বৃদ্ধ চট পেতে বসে ছোট্ট ছোট্ট পুতুলের চটি বানিয়ে বিক্রি করতেন। যেদিন একজোড়া কিনতে পারতাম সেদিন আনন্দের সীমা থাকত না। বাড়িতে কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো একটা পুতুলের বাড়ি ছিল। বারোটি মেয়ে পুতুল। স্টেশনের কাছের মনিহারি দোকানে এক প্যাকেটে তিনটে প্লাস্টিকের মেয়ে পুতুল পাওয়া যেত। পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেলে একটা প্যাকেট পাওয়া যেত। ছোটো বিছানা- বালিশ, রথের মেলা থেকে কেনা অনেক বাসন-কোসন সব ছিল।
মায়ের বাঁধানো উপেন্দ্রকিশোর রচনাবলী পেয়েছিলাম এক রবিবারের রাতে। আমি এক মনে গড়গড়িয়ে পড়ে যেতাম। কাউকে কখনও শব্দার্থ জিজ্ঞাসা করতাম না। নিজের মতো অর্থ বানিয়ে নিতাম। আমি যেটা পড়তাম সেটাকেই সত্যি বলে জানতাম। আজও সেই বিশ্বাস তেমনি অটুট। পুরাণ, মহাকাব্য সব সত্য, মিথ্যা তো নয়। বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝের বিভেদটা বড় ঠুনকো, কে যে কখন কার গন্ডিতে চলে যায়!
টিফিন-টাইমে আলুকাবলি-কাকু ঝুড়ি নিয়ে আসত। ওখান থেকে খাবার কোনোদিন কিনে খাইনি, মাঝে মাঝে তেঁতুলের আচার খেয়েছি কিনে। সেই কাকু রামায়ণ-মহাভারতের ছবি আনত। পাসপোর্ট সাইজের ছবি। এক পাতায় পাঁচটা করে ছবি থাকত। পঞ্চাশ পয়সা দাম। সেই ছবি কেনার ঝোঁক শুরু হল। কী সব ছবি! বসুদেব ঝুড়িতে সদ্যোজাত কৃষ্ণকে নিয়ে যমুনা পার হচ্ছেন। মাথার উপর ছাতার মতো বাসুকির ফণা। হনুমান বুক চিরে রাম-সীতাকে দেখাচ্ছেন। গাছের নীচে রাজহাঁসকে পাশে নিয়ে লক্ষ্মীঠাকরুণ। পিছনে কোজাগরী পূর্ণিমার মস্ত বড়ো চাঁদ। পৌরাণিক ছবির প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ। ছবিগুলো যে গল্প বলে। গল্প শুরু হল এইভাবেই।
স্কুল ছুটির পর এক বুড়ো কোলকুঁজো হয়ে বসে থাকত পথের ধারে জামরুল গাছের নীচে। হাতে থাকত তুলোট কাগজের পট। ঝাপসা ঘোলাটে দৃষ্টি তার। কাঁপা কাঁপা হাত নেড়ে গাইত,
"উঠ উঠ বল্যে দেবী বলিতে লাগিল।
একে একে ছয় নৌকা ভাসিয়ে উঠিল।।
তাহা দেখি বেহুলার আনন্দিত মন।
লোটায়ে লোটায়ে ধরে মনসার চরণ।।
মনসার চরণে আমার মজ্যে গেল মন।
একে একে উঠে সব চান্দের নন্দন।।..."
কিছুই বুঝতাম না। শুধু মনসা আর বেহুলা নাম দুটো কানে আসত। বেশ কিছুদিন পর সচিত্র পদ্মপুরাণ কিনেছিলাম ট্রেন থেকে। অপুও চেয়েছিল এই বইটি। অনেক পরে এই পংক্তিগুলি খুঁজে পাই স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করতে গিয়ে। কিন্তু সেই ছেলেবেলায় শেষ দুপুরের ঝিমিয়ে পড়া রোধে জামরুল গাছের ছায়ায় একটানা সুরে গেয়ে চলা মনসামঙ্গল কোথায় যেন নিয়ে যেত আমাকে। মনসার কান্নামাখা অসহায় মুখটি বেশ দেখতে পেতাম। 'কানাকে কানা বলো না' নীতিবাক্য পড়তে গেলেই চ্যাংমুড়ি কানির কষ্ট মনে পড়ত। আজও আমি মনসা আর সাপদের বড়ো ভালোবাসি। আমাদের পৈতৃক ভিটের পাশে দুই গোখরোতে শঙ্খ লাগল। মুগ্ধ আমি তাকিয়েছিলাম বহুক্ষণ। বাড়ির পরিচারিকা এসে আমার নতুন জামা ছুঁড়ে দিল। অনেক পর গোখরো দুটো পুকুরের পাড় ধরে সুপুরিগাছগুলির গা ঘেঁষে চলে যাওয়ার পর সে জামা তুলে রাখা হল। বড়ো শুভ বস্ত্র। আজও তেমনি ভাবে রাখা আছে মনসার আশীর্বাদ।
মহাভারতের ছবি আঁকা ডায়রি দেখে মহাভারতের গল্প জানা ছিল। সারা ছোটবেলা জুড়ে ছবি জমিয়েছি। উত্তরাখন্ডের খিরসু গ্রাম থেকে রাধা-কৃষ্ণের ছবি কিনে এনেছিলাম। বড়ো প্রিয় চাঁদমামার ছবিগুলি। দক্ষিণ ভারতের সমাজের কিছুটা হলেও প্রতিফলন রয়েছে চাঁদমামার ছবিতে এবং লেখায়। চাঁদমামায় কয়েক পর্ব মহাভারত পড়েই খুব রেগে গিয়েছিলাম। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মহাভারতের সঙ্গে অনেক কিছুই মিলছে না যে! যে তরুণ ছেলেটি খবরের কাগজ দিত সে-ই প্রতি মাসে চাঁদমামা দিয়ে যেত। তাকে পাকড়াও করে ছয় বছরের আমি কড়া গলায় বলেছিলাম, "কী সব ভুল লিখছো! তুমি গল্পটা জানো না!"
এই ঘটনার পর থেকে আমার ধারণা হয়েছিল, "ছেলেদের মহাভারত" একমাত্র আমার-ই আছে। ঐ বয়সেই 'বল্লালী বালাই' খুললাম একদিন। কাশীদাসী মহাভারত? সেটা পড়ে অপু যুদ্ধের কল্পনা করে? সেটা কেমন মহাভারত? মহাভারত কি তাহলে অনেকগুলি? কোথায় পাওয়া যায় সেসব?
পৈতৃক বাড়ির পিছনে দরমা-ঘেরা মাটির উঠোনওয়ালা রান্নাঘর। সারা সকাল মাটি-জল ছেনে ছেনে অনেক ঘুঁটে দরমার বেড়ায় লাগিয়ে দিতাম শুকোবে বলে। বিকাল নেমে এলে সব ঘুঁটে তুলে জড়ো করে রাখতাম সন্ধ্যামালতী গাছের পাশের তকতকে নিকানো কোণে। মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতাম কলাবতী গাছের চারা আর লাল-সবুজ-কমলা ছোট্ট ছোট্ট বুনো ফল জোগাড় করতে। ফলগুলি দিয়ে রান্নাবাটিতে রান্না হত। সুপুরিগাছের ধার দিয়ে বিভিন্ন রঙের ফুলের কলাবতী গাছ লাগিয়ে রেখেছিলাম।
রূপকথা-পঞ্চতন্ত্র-মহাভারত-পুরাণ-চাঁদমামার সবকিছু আমি আমার চারপাশে দেখতে পেতাম। কলাবতী গাছের পাশে পুকুরঘাটে থাকত দুয়োরানি আর তার বানর। কতদিন আমি দেখেছি, দুয়োরানি বসে বসে মতিচুরের লাড্ডু বানাচ্ছে। আলপনা দেওয়া উঠোন, দোরের কাছে পিঁড়ি পাতা। একপাশে শুকোচ্ছে ডালের বড়ি।
কোপাইয়ের ধারে এক বিকালে বসেছিলাম। দূরে দূরে গাছের পাতায় লেগেছে চৈত্রের শুকনো বাতাস। তিরতির করে জল বইছে। ওপারে কয়েকটা গোরু চরছে, টিংটিং করে এক গ্রাম্য কিশোর সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। হঠাৎ দেখি কালো মেঘ মাথায় নিয়ে একতারা বাজিয়ে আসছেন তিনি। আগেরবার দত্তদের কালীবাড়িতে দেখা হয়েছিল। বললাম, "তুমি না শাক্ত?" দাড়ি নেড়ে বললেন, "কী জানি! সেদিন কালী বেটিকে দেখতে ইচ্ছা করছিল, আজ যাচ্ছি রাধারানিকে দেখতে।"
-"কোথায় যাচ্ছো?"
-"সিদ্ধাসনে গিয়ে উঠোনে দুই দিন থাকব রে মা!"
তিনি চলে গেলেন। আমি কোপাইয়ের ধারে বসে দেখতেই থাকলাম অজয়ের তীরে গাছের ছায়ায় জয়দেবের সিদ্ধাসন। সন্ধ্যা নামার দেরি নেই। ওপারে ইছাই ঘোষের শিবমন্দিরে ঘন্টা বাজবে। গড়জঙ্গলে ভবানী মন্দিরে আরতি হবে। ইছাই ঘোষের গড়ে কেঁদে কেঁদে ফিরবে ছায়াশরীরেরা। আরও অনেকদূরে দত্ত কালীবাড়ি ছাড়িয়ে গাছগাছালির ফাঁকে আশ্রমের উঠোনে বসেছে কীর্তনের দল। সন্ধ্যামালতী আর চাঁপাফুলের আলগা সৌরভ। কুয়োপার দিয়ে সরসর করে হেলে সাপ ঢুকে যায় কামিনীর ঝোপে। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় পথ দেখে কারা কারা যেন এসে চুপচাপ বসে যায় ফরাসের পিছনে। লম্বা ছায়াগুলি জড়াজড়ি করে থাকে।
তখন বান্ধবগড় পাহাড়ে তালাওয়ের পাশে মন্দির তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে। বহুদিন কেউ পুজো দেয়নি। মাটির প্রদীপ কবেই গড়াগড়ি গেছে! ভাঙা প্রাচীর আর ভগ্নপ্রাসাদের জমাট অন্ধকারে চামচিকের ভ্যাপসা গন্ধ। তালাওয়ের পাশে মাটিতে অর্ধপ্রোথিত হরিণের মাথার কঙ্কাল! টলটলে জলে জ্যোৎস্না। বুড়ো বাঘটা টেনে টেনে উঠে আসে মন্দিরের ভাঙা সিঁড়িতে। বাতাসে যেন বৃদ্ধ পুরোহিতের গায়ের গন্ধ। চারবছর আগে মরজগৎ ছেড়ে দিলেও অপার্থিব জগতে গভীর রাতে যে তাঁকে আসতেই হয়। হাজার বছরের পুরনো মন্দির তাঁকে ডাকে, বুনো পোষ্যর দীর্ঘশ্বাসে মিশে থাকা কান্না তাঁকে ডাকে।
বড়ো ডোবার পাশে বিন্তিদের বাড়ি। প্রতিদিন সেখানে শাকচুন্নি লেবু পাড়তে আসে। আগে দুবার ধরা পড়েছে। এখন আর কেউ কিছু বলে না ওকে। ছেঁড়া আঁচলে কোনোমতে দুটো লেবু বেঁধে নিয়ে যায়। চুলে কতোদিন তেল পড়েনি কে জানে! বাড়ুজ্জেদের পোড়ো বাড়ির একতলার কুঠুরিঘরে থাকে ও। হাঁপানিতে কষ্ট পায় ওর বর। আমানিতে পাতিলেবু মিশিয়ে খেয়ে নেয় দুজন। তারপর ঘুমের ঘোরে শোনে বাড়িময় কুলদেবী কালী খাঁড়া হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আমি একা কোপাইয়ের ধারে বসে থাকি। জীবনের কথকতা করি। এমন ভাবেই সন্ধ্যা গড়ায়। দূরে চায়ের দোকানে কেরোসিনের লম্ফ জ্বলে। বর্ণপরিচয় নিয়ে বসে দোকানির ছোট ছেলেটা। অনেক দূরে স্কুলের ঘরে জানালার পাশে বসে থাকা একটা বাচ্চা পঞ্চতন্ত্রের গল্প রিডিং পড়ে। তারপর কবেই সে কীর্তন গেয়ে পথে নেমে পড়ে। বুকের ভিতরে কান পাতলেই এখনও জামরুলগাছের নীচে বসে থাকা পোটো বুড়োর গলার সুর ভেসে আসে। অবিরাম সে পড়েই চলেছে। সে সুর পাহাড়িপথ বেয়ে রাতচরা পেঁচাদের ডানায় ভর দিয়ে রুদ্রনাথের গুহায় ভেসে যায়।
রুদ্রনাথ ধীরে ধীরে অলঙ্কার খুলে রাখেন একে একে। গানের সুরে ঘুমিয়ে পড়েন। বাঁশবাগানের ধারে আশ্রমে কীর্তন সাঙ্গ হয়। আরও তীব্র হয় স্বর্ণচাঁপার গন্ধ। আলের পথে হ্যারিকেন দুলিয়ে ছায়াশরীররা ঘরে ফেরে।
আমার ফেরা হয় না।

৬টি মন্তব্য:

  1. অসাধারণ। প্রতিটি পঙক্তি থেকে ঝরে পড়ছে স্মৃতিমেদুরতা।

    উত্তরমুছুন
  2. বেশ লাগল।' বাতাসে পুরোহিতের গায়ের গন্ধ ' চমৎকার।

    উত্তরমুছুন
  3. প্রতিটা বাক্যকে ভালোবেসে ফেললাম!

    উত্তরমুছুন
  4. প্রতিটা বাক্যকে ভালোবেসে ফেললাম!

    উত্তরমুছুন
  5. প্রতিটা বাক্যকে ভালোবেসে ফেললাম!

    উত্তরমুছুন
  6. বাহ, বড় ভাল লেখা। কেমন আচ্ছন্ন করে দেয়।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র