হৃদিকমলাসনে
সেবার বৃন্দাবনে বাঁকেবিহারী মন্দিরের গলির মুখটাতেই সন্ন্যাসীদের এক জমায়েত পেয়ে গেলাম।রোদ ঝলমলে সকাল, চারিদিকে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে ওঁরা রাস্তার ওপরেই বসে আছেন।হাতে হাতে গাঁজার কল্কে ঘুরে চলেছে।মাঝেমাঝে ধ্বনি উঠছে "জয় বাঁকেবিহারীজিউ কি জয়।" আমিও গিয়ে ওঁদের কাছেই রাস্তার ওপরেই বসে পড়লাম।পরম সমাদরে ওরা আপ্যায়ন করে নিলেন "আইয়ে মহারাজ, দর্শন হুয়া না কানহাইয়ালালকি?" তারপর গাঁজার কল্কে হাতে ধরিয়ে দিলেন।আমি একটা প্রণাম করে সেই কল্কে পাশের জনের হাতে ধরিয়ে দিলাম।ওঁরা বুঝেছিলেন আমি ও রসে বঞ্চিত।নানারকম কথা শুরু হল, ওঁরা আসছেন পঞ্চকেদার থেকে।যোগের গূহ্যাতিগূহ্য তত্ত্ব নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন দেখলাম এক সন্ন্যাসী, যুবক শরীর, ছিপছিপে বলিষ্ঠ চেহারা, মাথায় পিঙ্গল জটা, বিলকূল মস্ত।হাতে ত্রিশূল আর ডমরু, দিব্যন্মাদ অবস্থা, নাচতে নাচতে ছুটে চলেছেন বাঁকেবিহারীজির মন্দিরের দিকে।মনে হল সাক্ষাৎ বিশ্বেশ্বর রাধানাথকে দর্শন করতে চলেছেন।বাঁকেবিহারীজির গলির ওই ভীড় দুপাশে সরে গিয়ে তাঁকে পথ করে দিল।আশেপাশের আশ্রম থেকে মহন্তরা বেড়িয়ে এসে হাতজোড় করে দাঁড়ালেন।ওনার পিছু নিয়েছিলাম, শেষপর্যন্ত আর খুঁজে পাইনি।
আরেকবার ভোর তিনটেয় হরিদ্বারে ব্রহ্মকুন্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ চোখে পড়ল দত্তাত্রেয় ঘাট থেকে স্নান করে উঠে আসছেন এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।অস্ফুটে বলে চলেছেন "জয় গঙ্গা মাইয়াকি জয়," "জয় গুরুমহারাজকি জয়", এসে ওই ভিজে কাপড়েই সমকায় শিরোগ্রীব হয়ে উত্তরাস্য হয়ে বসে পড়লেন।তারপর শুরু হল প্রাণায়াম।লক্ষ্য করে দেখলাম, পরিচিত প্রাণায়ামের সঙ্গে তার মিল নেই।আমিও কাছেই বসে পড়লাম।ভ্রূক্ষেপও করলেন না।যোগ এবং তন্ত্র নিয়ে আমার খুব ইন্টারেস্ট আছে।এখন শরীর ভারী হয়ে গেলেও কিছু দূরূহ আসন অবলীলায় করে ফেলতে পারি, সাপোর্ট লাগে না। তাই কৌতুহল হল।প্রাণায়াম শেষ হলে জিজ্ঞেস করলাম "মহারাজ, ইয়ে প্রাণায়াম তো পহলে কভি দেখা নহী?" উনি বলেছিলেন, তোমরা যেগুলো দেখ, তার বাইরেও সিদ্ধ গুরুপরম্পরায় বহু প্রাণায়াম লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে গেছে।গৃহীদের সব করতেও নেই।শুধুমাত্র মুসলমান ফকিরদের মধ্যেই প্রায় দুশো রকমের প্রাণায়াম থেকে গেছে।কিছু প্রাণায়াম এমনই, যে করলে সাধারণ মানুষ বুঝতেও পারবেন না যে প্রাণায়াম করা হচ্ছে।
মনে পড়ে গেল গেন্ডারিয়ায় এক ফকিরের লাঠি ঘোরানো দেখে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রিয় শিষ্য কুলদানন্দকে বলছেন, ওই ফকির এক দূরূহ প্রাণায়াম করলেন।এর ফল সুদূরপ্রসারী।
বেলার দিকে ওই সন্ন্যাসীকে দেখেছিলাম হরিদ্বারের ওই প্রবল স্রোতে, যেখানে শিকল ধরে স্নান করতে হয়, সেখানে মাঝগঙ্গায় দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে পাখির মত এক যায়গাতেই ভেসে আছেন।
তারপর আমিও চলে গেলাম লছমনঝুলার দিকে।ফিরে এসে ওনাকে আর দেখতে পাইনি।
আরেকবার কনকনে শীতের ভোরে গঙ্গাসাগর মেলায়, একটু নির্জনে এক সন্ন্যাসীকে দেখলাম।গ্রীক ভাস্কর্যের মত চেহারা, জল নিয়ে শিশুর মত খেলছেন আর হাসছেন।উঠে এসে বসলেন, আমিও গিয়ে বললাম "প্রণাম মহারাজ।" মূল গদী পাঞ্জাবে, পাঞ্জাবী শরীর, উদাসী সম্প্রদায়।বলেছিলাম "কুছ মিলা কেয়া মহারাজ?" চোখের দিকে তাকিয়ে প্রায় ভেতর ওবধি দেখে নিয়ে বলেছিলেন "সহস্রার মে ঝলক দেতা হ্যায়, নাদব্রহ্ম প্রকট হোতেঁ হ্যাঁয়।" একটু বসে আরও কিছু হদিশ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।
দিল্লিতে কুতুবমিনারের পেছনের যে তোরন, শুনেছিলাম বিকেলে এক সিদ্ধ ফকির সেখানে এসে বসেন।ওদিকে খুব কম লোকই যায়।ওনাকে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেছিলাম।দেখলাম নমাজ পড়ছেন।উজ্জ্বল গৌরবর্ণ সৌম্য চেহারা, ধবধবে সাদা চুল দাড়ি।আমি হাতজোড় করে প্রণাম করে বসলাম।নমাজ শেষ করে ওই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হেনে বলেছিলেন, আর কি জানার আছে? খুঁজলেই তাঁকে পাওয়া যায়।তারপর কিছুক্ষণ চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিলেন, ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে গেছিল।
আরেকবার তারাপীঠে সন্ধেবেলায় স্বামী অমৃতানন্দের সঙ্গে বসেছিলাম।অশীতিপর বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘের মহন্ত।ওই বয়েসেও অপূর্ব রূপবান, সুদীর্ঘ দোহারা চেহারা, তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, একটা গেরুয়া কাপড় কোমরে জড়ানো, উর্ধাঙ্গ অনাবৃত।কথা হচ্ছিল হিমালয়ের পথে ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় কোন কোন নেশায় শরীর রক্ষা পায়, ওষুধের কাজ করে, সেই নিয়ে।উনি খুব একটা নেশা করার পক্ষপাতী নন, কিন্তু তাও বলে দিচ্ছিলেন।ওই গরমে আমিও খালি গায়ে বসে পড়লাম।উনি কথা বলতে বলতে আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।সমস্ত শরীর এক আশ্চর্য স্পর্শে শীতল হয়ে যাচ্ছিল।ওরকম স্পর্শ আর কখনও পাইনি।
সুচিন্তিত মতামত দিন