শ্যামলী আচার্য - মায়াজম

Breaking

২২ অক্টো, ২০২০

শ্যামলী আচার্য

                                                        জানালার ছবি





কটার পর একটা রঙ চাপাচ্ছে বিতান। কেমন পাগলের মতো। পাগল? নাঃ। এই শব্দটার অভিঘাত বিরক্তিকর। সৃষ্টিশীল মানুষকে পাগল বলে দাগিয়ে দেওয়া অসহ্য প্র্যাকটিস। এত সাদামাটা বিশেষণ ভালো লাগে না।
ক্যানভাসে রঙের সমুদ্র। গ্যাদগেদে হয়ে রঙ নামছে ইজেল বেয়ে। ক্যানভাসের কাপড় টেনে নিতে পারে না। কিছু চুঁইয়ে নামে। অবয়ব গলে যায়। কিছুতেই দানা বেঁধে ওঠে না। গত এগারো দিন ধরে এই ছবিটার সঙ্গে দিনরাত কাটছে। কিছুতেই কাঙ্খিত ছবি হয়ে উঠছে না।
“ছবিটা সারিয়ে নিন স্যার। চাইলে পাল্টেও নিতে পারেন”।
বিতান চমকে তাকায়। কেউ কথা বলল? আশ্চর্য! কে কথা বলবে? এই সাড়ে আটশো স্কোয়ার ফুটের বন্ধ ফ্ল্যাটে একা বিতান। একা ওই ক্যানভাস। একা কিছু রঙ। একা তুলি। কে আসবে এখানে?
পূব-দক্ষিণ খোলা বড় ঘরটাই স্টুডিও। ভোরের রোদ অকৃপণ। হাওয়াও অবারিত। মানুষ সমান বড় জানালা। কাঁচের। তেইশতলার জানালায় শুধু আকাশের নীল ওড়না। চড়া রোদের ঝাপটা। গাছের সিল্যুয়েট। উঠে দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত চোখের নাগালে। ক্যানভাসের সামনে বেতের মোড়ায় বা কাঠের টুলে বসলে এক চিলতে রোদ বহুক্ষণ ছুঁয়ে থাকে ডানদিকের গাল। এখানে কেউ আসে না। এই নির্জন আস্তানার খোঁজ তেমন রাখে না কেউ। বিতান বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে নিজেকে। এই নতুন ঠিকানা ও আপাতত আর কোনও প্রিয়জনকে দিতে চায় না।
দুপুরে ফ্রিজে রাখা স্যান্ডউইচ বের করছিল বিতান। মাইক্রোওভেনে সেঁকে নেবে একবার। কফি আর স্যান্ডউইচ। দুপুরের জন্য ওটুকুই। ঘন্টাখানেক নিশ্চিন্ত। আবার খিদে পেলে অনলাইন অর্ডার করে নিলেই হল। একার জীবনে আর কতটুকুই বা প্রয়োজন। কলিং বেল বেজে ওঠে আচমকা। অবাক লাগে। কে আসবে? চেনা বা অচেনা যেই আসুক, নিচে কেয়ারটেকার একবার ইন্টারকমে ফোন করবেই। এখানে সুরক্ষার কড়া বলয়। তবে কি আবাসনের মধ্যেকার কেউ? সাত-পাঁচ ভেবেই দরজার আই-হোলে চোখ লাগায় বিতান। একটি ছেলে। পরিপাটি আঁচড়ানো চুল। পরিচ্ছন্ন চেহারা। এটুকুই নজরে পড়ে। বিতান কী ভেবে দরজা খুলে দেয়।
“বলুন”।
“আপনিই তো বিতান মজুমদার?”
ছেলেটির কাঁধে ব্যাগ। লাল। আজকাল কোনও যুবক এরকম সিঁদুরে লাল রঙের কাপড়ের ব্যাগ নেয় না। পরনে সবুজ শার্ট। জলপাই সবুজ। সমুদ্র-নীল জিন্স। সব মিলিয়ে অনেক রকম রঙের সমাহার।
“হ্যাঁ। কিন্তু মানে, আপনি কি এখানেই থাকেন?”
ছেলেটি হাসে। ঝকঝকে মুক্তোর মতো সাদা দাঁতের সারি। হাসলে মাড়ির কাছে গজদাঁত ঝিকিয়ে ওঠে।
“তা বলতে পারেন। আমি আপনার ছবি দেখতে এসেছি”।
“ছবি”?
“হ্যাঁ। আপনার আঁকা ছবি। দেখাবেন”?
বিতান দ্বিধায় পড়ে। কেয়ারটেকার ফোন করে জানায়নি তার ফ্ল্যাটে কেউ আসছে। তার মানে ছেলেটি এই আবাসনের মধ্যেই থাকে কোথাও। কিন্তু বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী বিতান মজুমদার এই ফ্ল্যাটে অজ্ঞাতবাসে রয়েছেন, এই স্কুপ নিউজ তো কারও কাছে থাকার কথা নয়। ছেলেটির স্থির চোখে চোখ রেখে বিতান জিগ্যেস করেন, “তুমি ছবি আঁকো?”
‘তুমি’ সম্বোধন যেন প্রত্যাশিতই ছিল। ছেলেটি একগাল হাসি মাখিয়েই বলে, “আঁকি না। দেখি”।
“অ। বুঝেছি। ক্রিটিক। এই বয়সেই?”
বিতান মজুমদারের এই তাচ্ছিল্যের সুরও যেন ছেলেটির পরিচিত।
“তা নয়। ভালোবেসে দেখি। বা দেখতে ভালো লাগে”।
কখনও কখনও অতিরিক্ত সারল্য অস্থির মনে প্রলেপের কাজ করে।
“তুমি ভেতরে এসো”।
দরজা খুলে দেন বিতান। ছেলেটি নিঃসঙ্কোচে ভেতরে ঢোকে।
এই ফ্ল্যাটে কোথাও কোনও ছবি নেই। কোনও রঙও নেই। গোটা ফ্ল্যাট বিবর্ণ। প্রোমোটার প্লাস্টার অফ প্যারিসের ওপর সাদা প্রাইমার লাগিয়ে জিগ্যেস করেছিল, “কী রঙ লাগাবেন স্যার? শেড কার্ড দেখে পছন্দ করুন”।
বিতান এককথায় থামিয়ে দিয়েছিল। “দরকার নেই”।
বিতান হয়ত বেরঙিন দেওয়ালে খ্যাপা তুলির টানে নতুন কিছুর পরিকল্পনা করেছিলেন। নিজে শিল্পী বলেই হয়ত। কিন্তু গত আট-ন’মাস চারপাশের দেওয়ালগুলো খাঁ খাঁ করছে। আর ইজেলগুলোতে বেলাগাম রঙের স্রোত।
ছেলেটির উৎসুক দু’চোখকে উত্তর দেন বিতান।
“এখানে ছবি নেই তেমন। পুরনো ছবি তো সব আমার সাউথ ক্যালকাটার ফ্ল্যাটে”।
“ও। আসলে আমি শুনেছি আপনার স্বপ্ন আর সুররিয়ালিজম নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা। মানে, অবচেতন নিয়ে্... অবাস্তব, ফ্যান্টাসি নিয়ে ... তাই সামনাসামনি কিছু কাজ দেখব ভাবলাম”।
“বাঃ। তুমি তো অনেক খবর রাখো। কী করো তুমি?”
জিগ্যেস করতে করতেই দুটো জানালার স্লাইডিং কাঁচ টেনে বন্ধ করে দেন বিতান। দুপুরের দিকে গরম হলকা আসে একটা। এসি চালানোই স্বস্তিদায়ক।
“আমি? আমি কিছুই করি না তেমন। টুকটাক লিখি। পড়াশোনা করি”।
“দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসো”।
বিতান তাঁর দক্ষিণ-পূর্ব খোলা বিরাট স্টুডিওর এক কোনায় মুখোমুখি দুটি বেতের চেয়ার টেনে ইশারা করে বসতে বলেন ছেলেটিকে।
“তুমি তো কিছুই বলছ না। কোথায় থাকো, কী করো...”
“ভয় পাবেন না,” ছেলেটি আবার হাসে। শরতের কাঁচা রোদমাখানো বৃষ্টিভেজা হাসি।
“আমি শুধু দেখতে এসেছি। আপনার দুঃখের ছবি”।
“দুঃখ?”
“হ্যাঁ। দুঃখ। যে দুঃখ জমিয়ে রেখেছেন এই নির্জন আস্তানায়। সেই দুঃখগুলো একটু দেখাবেন?”
বিতান রেগে যেতে গিয়েও কেমন স্তব্ধ হয়ে যান।
“দুঃখ আবার দেখানো যায় নাকি?”
“কেন যাবে না? আপনি... আপনারাই তো পারেন। লেখায় আঁকায় রেখায়...”
এত অকপটে যে ছেলেটি কথা বলছে, তাকে ঠিক প্রগলভ বলা চলে না। অনাবশ্যক গায়ে-পড়া কৌতুহলীও সে নয়। তবু, এমন বয়সীদের তিনি এড়িয়ে যেতে অভ্যস্ত। নিখুঁত পেশাদারিত্বের মোড়ক তাঁকে প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছে। সাফল্য যেমন সহজে উপেক্ষা করার কৌশল শিখিয়েছে। কিন্তু এই ছেলেটিকে ঠিক কীভাবে তিনি সামলাবেন, তার উপযুক্ত স্ট্র্যাটেজি খুঁজে পাচ্ছেন না কিছুতেই। এক মুহূর্তে বের করে দিতে পারেন। পারছেন না।
“আপনি বহুদিন ছবি আঁকছেন না কোনও। কেন? ব্যক্তিগত কারণ?”
ছেলেটির প্রশ্নে বিতান সপাটে উত্তর দিলেন, “কে বলেছে তোমাকে?”
“আপনি নিজেই বলছেন। আপনার ফ্যাকাশে আঙুল, ক্লান্ত হাত, গায়ের বিষণ্ণ রোম, নিরুত্তাপ চোখ, শুকনো ঠোঁট... সব মিলিয়ে আপনার এখন ছবিহীন জগত”।
“বাজে কথা। এই ফ্ল্যাটে এসে রয়েছি শুধু একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট সিরিজ আঁকব বলে। একা”।
“সেটাই স্বাভাবিক। শিল্পীরা বড় কোনও কাজের আগে নির্জনতা খুঁজে নেন। কিন্তু আপনি আঁকেননি কিছু। আঁকছেন না”।
বিতান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। ডেঁপো ছেলে। মতলবটা কি বোঝা যাচ্ছে না।
“তুমি তো দেখছি সব জেনে বসে আছ। তা এত জানলে কী করে?”
“আপনি রাগ করছেন? রেগে যাবেন না। আপনার ইজেলে রঙ গলে পড়ছে। ভাবনাগুলো নেই কোত্থাও। এই বাড়িটার মধ্যেই কিছু নেই”।
বিতান একটা চোরা দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করে বলেন, “এইরকম ব্লক হতেই পারে। লেখক আর্টিস্ট ... শিল্পীমাত্রেই এটা খুব কমন। নতুন কিছু নয়। যে ভাবনাগুলো মাথায় নিয়ে এসেছিলাম, ক্যানভাসের সামনে বসে সেই ভাবনা আর দানা বাঁধেনি। এইরকম হয়”।
“আপনার কারণ বোধহয় শুধু তা নয়। তা’ হলে এতগুলো দিন পালিয়ে বেড়াতেন না”।
বিতান উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
“পালিয়ে বেড়ানো? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই পালিয়ে বেড়ানো? আমি কি ক্রিমিনাল? লুকিয়ে রয়েছি এই আস্তানায়?”
“আপনি রেগে যাচ্ছেন” ছেলেটির গলা শান্ত। স্থির সৌম্য চোখে তাকিয়ে বলে, “আসলে আপনার ছবিগুলোর অসুখ করেছে স্যার। ওরা বেড়ে উঠছে না। গড়ে উঠছে না। ঠিক যেমন করে জলে-হাওয়ায়-পুষ্টিতে আদরে মমতায় নতুন প্রাণ জেগে ওঠে, সেই শুশ্রুষা নেই। তাই সব অসমাপ্ত”।
“শুশ্রূষা? অসুখ? কীসের অসুখ?” বিতান নিজের গলার আওয়াজ চিনতে পারেন না। ক্লান্ত অবসন্ন স্বর।
“সভ্যতার অসুখ স্যার। যেমন হয়। যেমন হয়ে এসেছে বরাবর। ধরুন, আপনার প্রিয় বন্ধু সমীর, যে আপনার চেয়েও অনেক প্রমিসিং আর্টিস্ট, তার উন্নতির পথগুলো বন্ধ করে দিলেন আপনি। অনেক সময় নিলেন। পেছন থেকে ধীরে ধীরে আপনার সেই একের পর এক ক্ষতি সে যখন টের পেল, তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। অনেকেই তো আড়ালে বলে আপনার বিখ্যাত অনেক ছবির পরিকল্পনা নাকি সমীরের কাছ থেকেই নেওয়া”।
“তারা ভুল বলে। আমি চোর নই”।
বিতানের গলায় সামান্য জোর ফিরে আসে। সমীরের নাম এখানে আসছে কেন? এই ছেলেটি কি তবে সমীরের কেউ?
“সমীরের নাম তুমি কীভাবে জানো, আমি জানি না। সমীর আমার ক্লাসমেট। একসঙ্গে আর্ট কলেজে পড়েছি। দুজনেই আঁকতাম। হ্যাঁ, ও প্রথম সারির ছাত্র। সকলেই বলতেন, ও অনেক দূর যাবে। অনেক বড় আর্টিস্ট হবে। ওইভাবে ড্রাগ না খেলে...”
“সে নেশা তো আপনিই তাকে ধরিয়েছিলেন স্যার। খুব ধীরে ধীরে। ঠিক যেভাবে আপনার সামান্য সিনিয়র রাতুলবাবুকে ফাঁসিয়ে দিলেন এক ন্যুড মডেলের স্টাডি করার সময়। ধর্ষণের একটা ফালতু অভিযোগ। মেয়েটি বেপাত্তা হয়ে যায়। রাতুলবাবু নিজের পরিবারে এই অপবাদ বা অসম্মান মেনে নিতে পারেননি। সবাই পারে না। সিম্পল সুইসাইড। কেউ কেউ বলে, ঘুমের ওষুধের বুদ্ধিটা আপনিই ওর মাথায় ঢুকিয়েছিলেন। আপনার এতবড় একটা প্ল্যান সাকসেসফুল। রাতুল চ্যাটার্জি আপনার সমসাময়িক দৌড় থেকে হারিয়ে গেলেন”।
“এই শোনো ছোকরা, তুমি কি যাত্রাদলের বিবেক? এই ভরদুপুরে জ্ঞানের বাণী শোনাতে এসেছ! কোথাকার কে হে তুমি?”
“অচিন্ত্য গোস্বামীর ঘটনাটা একটু আলাদা। ওনাকে আপনি অন্য প্যাঁচে ফেলেন। মজা হল, এই সমীর, রাতুল, অচিন্ত্য... এরা সকলেই আপনাকে অসম্ভব বিশ্বাস করত, ভালোবাসত। হারিয়ে যেতে যেতেও এরা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিল আপনাকে। কিন্তু ঈর্ষার সবুজ রঙ দিয়ে এই এতগুলো শিল্পীকে ঢেকে দিতে দিতে আপনি তো নিজের রংতুলিগুলোই হারিয়ে ফেললেন স্যার...”
“ইয়ার্কি পেয়েছ তুমি ভরদুপুরে? কী বলছ, কাকে বলছ, ভেবে বলছ? জানো, এক্ষুনি তোমাকে আমি এখান থেকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে পারি?”
প্রায় মারমুখী বিতানের সামনে ছেলেটি হাসে। স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার মতো। যে হাসিতে ব্যথার উপশম।
“আমিই চলে যাব। আপনি আমার এই ব্যাগটা রাখুন স্যার। আপনার ব্যথার ছবিগুলো আমার দেখা হয়ে গেছে। আপনি ছবিগুলো সারিয়ে নিন। পাল্টেও নিতে পারেন”।
একটু কি কেঁপে ওঠেন বিতান? এই কথাটাই কে যেন বলেছিল না একটু আগে? এই স্টুডিওতেই?
“কী আছে তোমার এই ব্যাগে?”
সিঁদুরে লাল রঙের ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলে, “ব্যথার নিদান। আশ্লেষ। জীবনকে জড়িয়ে ধরার বিশ্বাস। এতেই তো যত রঙের উচ্ছ্বাস। এগুলো আপনার বাক্সে রাখুন। যত্নে রাখবেন স্যার”।
“আচ্ছা, আমি কি সত্যিই আবার আঁকতে পারব? মনে হয় তোমার?”
অসহায় গলার আওয়াজ বিতানের নিজের কানেই ফিরে আসে। বন্ধ কাঁচের জানালার ওপারে একটা চিল। পাক খায় শূন্যে। একা। চারপাশে আর কেউ কোত্থাও নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র