চক্রযান
আদিগঙ্গায় অস্থি ভাসিয়ে উনি খানিকটা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্মশান ও তৎসংলগ্ন ঘাটের গঠনের প্রভূত উন্নতি ঘটলেও আদিগঙ্গা আদতে পড়ে থাকে টালি নালা হয়েই। এখানে জল সরে না। তেমন স্রোতও আসে না। সন্ধ্যের অন্ধকারে জমাট কালো পাঁক-মাটি মাথা তুলে জেগে থাকে সঙ্গে যোগ হয় দুর্গন্ধ।
দিনের মধ্যে একবার আধবার অবশ্য জল বাড়ে যখন বান আসে আজকের মূল গঙ্গায়। হলুদ হলুদ মাটি, জল ঘোলা করে দু'পাড় ছাপিয়ে উঠে আসে রাজপথে।
আমি সেই ছবিও দেখেছি অনেকবার। কোনো কোনো ভরা কোটালের সময় হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে কালিঘাট অঞ্চলে হাঁটতে হাঁটতে। তখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, হ্যাঁ! এই টালি নালাই ছিল ষোড়শ শতকের মূল ভাগীরথী। এখান দিয়েই চাঁদ সওদাগর তার বানিজ্য তরণী নিয়ে চিতপুর থেকে ভেসে যেতেন কালিঘাট, গোবিন্দপুরের গা ঘেঁষে বারুইপুর, জয়নগর, ছত্রভোগ, শতমুখী হয়ে সাগর সঙ্গমে। সেসব তো অতীত ইতিহাস! সময়ের প্রবাহে গা ভাসিয়ে সেই অনাদি অতীত বিলীন হয় সাগরে। আদিগঙ্গা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে তার ঐতিহাসিক জৌলুস, কৌলিন্য হারিয়ে ফেলে অলক্ষে!
আমার কেন জানি ছেলেবেলা থেকেই এমন কোনো রিক্ত নদী দেখলেই মনে হয় ভরা বর্ষায় যদি বন্ধুরা মিলে একটা নৌকা ভাসিয়ে দেওয়া যেত তাহলে জানা যেত নদীর প্রকৃত গতিপথটি। কোথা থেকে যাত্রা শুরু করে কোথায় চলেছে তারা ভীষণ জানতে ইচ্ছা করে। যেমন আমার পিসির বাড়ির পিছন দিয়ে বয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর পরিত্যক্ত পথটির প্রতিও আমার বরাবর নজর থাকে। যতবার দেখি ততবার খুঁজে বার করতে ইচ্ছা হয় তার ভৌগলিক মানচিত্রটি। একটি ডিঙা ভাসিয়ে পাড়া গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যতে মন অনুভব করতে চায় নদীটির অতীত গৌরব গাথা।
কোলকাতায় পড়তে এসে আমি মেস জীবন শুরু করি এই কালিঘাট অঞ্চলেই। যে ঝুপড়ি হোটেলে দুবেলা খেতাম সেখানেই খেতে আসত কালিঘাটের অনেক পাণ্ডা। তাদের অনেকের সঙ্গেই বেশ আলাপ পরিচয়ও হয়েছিল সেই সময়। সেই বন্ধুত্বের সুবাদে লম্বা লাইন এড়িয়ে ফাঁকতালে মায়ের দর্শন করেছি অনেকবার। একজন পাণ্ডার সঙ্গে সম্পর্ক একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে যখন সে জানতে পারে আমি থিয়েটার করি আর আমি জানতে পারি ও ব্যাটা যাত্রার সিজনে পাণ্ডাগিরি ছেড়ে যাত্রা করতে চলে যায়! আবার খোল বাজাতে ভালো বাসতো বলে অফ টাইমে গলায় খোল ঝুলিয়ে ক্যাওড়াতলা শ্মশানে হরির নামও করে আসতো। সেখানেও দু'পয়সা অতিরিক্ত আয় হত তার। আমিও সেই লোকটার পাল্লায় পড়ে ক্যাওড়াতলায় গিয়ে বসে থাকতাম কোনো কোনো বিকেলে। দেখতাম মানুষ তার প্রিয়জন হারিয়ে কেমন বিহ্বল হয়ে যায়, কেমন করে কাঁদে। পারিপার্শ্বিক ভুলে নিজের সামাজিক অবস্থান ভুলে কেমন অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমারও চোখে জল আসত এসব দেখে। অন্যের দুঃখে কাঁদতে কেন জানি চিরকালই একটা অদ্ভুত সুখানুভূতি হয় অন্তরে। ফেরার পথে আমি আর ওই পাণ্ডা দাদা পশুপতির গরম কচুরি আর আলুর ঝোলঝোল একটা তরকারি খেতাম শালপাতায় নিয়ে।
একদিন আমায় সে বললে,
- তুমি যে বলছিলে এখানে মেসের খরচ বেশি, তা অন্য একটা মেসের সন্ধান দিলে যাবে সেখানে?
আমি বললাম
- কেন যাব না! ঠিকানা দিন একদিন গিয়ে আগে দেখে আসি।
- ওটা হল চেতলায়। আদিগঙ্গার ওপাড়ে। ঘাট পেরিয়েও যেতে পার আবার ব্রিজের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটেও যেতে পার।
- ঘাট পেরিয়ে মানে?
- তুমি জান না? কালিঘাট বলে তো একটা নৌকা পেরনোর ঘাট এখনো আছে।
- তাই নাকি!
- হ্যাঁ তো। মন্দিরের পশ্চিম গেট দিয়ে বেরিয়ে নাক বরাবর গেলেই তুমি ঘাটে পৌঁছে যাবে।
আমার তো শুনেই একটা উত্তেজনা শুরু হয়ে গেল। সন্ধ্যেবেলা শ্মশান ফেরত খবরটা শুনে থেকেই ইচ্ছা করতে লাগল ঘাট পেরিয়ে চেতলা যাওয়ার। পাণ্ডা দাদার থেকে ঠিকানা নিয়ে পরদিন সকাল আটটাতেই রওনা দিলাম। মেস থেকে পায়ে হেঁটে কালিঘাট মন্দিরের ভিড় ঠেলে পশ্চিম গেটের কাছে গেলাম, তারপর সেখান থেকে শাঁখা পলার দোকানের পাশ দিয়ে সিমেন্টের একটা রাস্তা ধরে এগিয়ে সত্যি সত্যিই একটা ঘাটে গিয়ে পরলাম। নোংরা জল। পাঁক পাঁক গন্ধ, তারই মধ্যে কয়েক জন ডুব দিয়ে চান করছে। একটা কালো আলকাতরা মাখানো কাঠের ডিঙি নৌকা এসে ঠেকলো এদিকের ঘাটে। কাদার মধ্যে দিয়ে ইঁট পাতা আছে। ওই ইঁটে পা দিয়ে দিয়েই উঠে পড়লাম নৌকায়। দু'হাজার এক সাল সেটা। পঁচিশ পয়সা ভাড়া দিলাম। পারানি যাকে বলে। মাঝি একজন। খাটো করে লুঙ্গি পরা, আদুর গা। তার হাতে কোনো হাল নেই আছে একটা লগার মতো লম্বা, সরু বাঁশ। বার চারেক জলের নীচের মাটিতে ওই বাঁশ দিয়ে ঠেলা মারতে না মারতেই নৌকা গিয়ে ঠেকলো ওপাড়ের চেতলার ঘাটে। আমার কালিঘাটের খেয়া পেড়নো শেষ! রোমান্টিকতার অকালমৃত্যু!
কালিঘাটের আদিগঙ্গার কাছে তাই যখনই আসি এই দৃশ্যগুলোই মনে পড়ে। আজও তাই। উনি কালো জলে অস্থি ভাসিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আমার খেয়া যাত্রার কথা মনে পড়ে গেল। উনি সম্পর্কে আমার মাসি-শাশুড়ি। আজ ভোর বেলায় হারিয়েছেন ওনার চল্লিশ বছরের সঙ্গী মানুষটিকে, মানে আমার স্ত্রীর মেসোমশাইকে। দুই ছেলে। একজন প্রায় আমারই বয়সী আর একজন বছর সাতেকের ছোট। বড়জন কর্মসূত্রে সিঙ্গাপুরে আর ছোটজন আবুধাবি। করোনা আবহে ফ্লাইট পাওয়া তো দূর আগে কোভিড টেস্ট করিয়ে নিজেদের নেগেটিভ প্রমাণ করতে হবে তবে মিলবে যাত্রার অনুমতি! আর এদিকে দেহ সংরক্ষণের বিষয়টিও বন্ধ। অগত্যা মাসিই করলেন সব কাজ। আমরা ভরসা জোগালাম। অস্থি ভাসিয়ে উনি যখন সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলেন পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললাম আমার সেই নৌকা চড়ার অভিজ্ঞতার কথা। উনিও হালকা হতে চাইলেন,
- তাই নাকি! দেখ আমরা এই কোলকাতাতেই বড় হয়েছি অথচ জানতামই না এরকম একটা ব্যাপার আছে! আসলে তুই জীবনটা কম বয়সেও অনেকটা দেখেছিস... তাই অত ভালো লিখতে পারিস।
কথাটা শুনে তো আমার খুব মজা হল...
- আপনি আমার লেখা পড়েছেন।
- হ্যাঁ পড়েছি তো। তেমন ফেসবুক না খোলা হলেও যখনই খুলি তোর পেজে যাই গিয়ে পড়ে আসি। সত্যিই খুব ভালো লাগে। তোর কবিতাগুলোর একটা বই কর।
শ্মশান ঘাটে দাঁড়িয়েও আমার লেখার সুখ্যাতি শুনে আবার নতুন করে জনজীবন দেখতে ইচ্ছা হয়। চোখে পড়ে নিতে ইচ্ছা করে গভীরে দেখার চশমা! এই এক শরৎকালীন সন্ধ্যের মুখে দাঁড়িয়ে আমি তাকাই মাসির দিকে। নিঃশব্দে জল চলে আসছে মাঝেমাঝেই ওনার দু'চোখ বেয়ে। স্বামী হারা মানুষ পাচ্ছেন না সন্তানের ভরসার হাত। তবু ধীর পায়ে ঘাট থেকে উঠে মন শক্ত করে একাকি এগোচ্ছেন বড় রাস্তার দিকে। একজন প্রৌঢ় ভিখারী আমাদের দেখে শ্মশানযাত্রী বুঝতে পেরে বসে বসে হাতের খঞ্জনি দু'টি ছন্দে ছন্দে আঘাত করে হরির নাম করতে শুরু করে। সঙ্গে যোগ হয় ঘরে ফেরা পাখির কিচিরমিচির। এক অদ্ভুত সন্ধ্যা ঘনায় চোখের সামনে।
আমি সামান্য কথক। এই দৃশ্য-কথা জুড়ে জুড়ে বর্ণনা গুছিয়ে চলি মনের মধ্যে। লেখা হয়ে গেলে আপনারা একেই হয়তো "গল্প" বলেন কিন্তু আমি বলি জীবন, অনাবিষ্কৃত নদীপথ।
আদিগঙ্গা অলক্ষে শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়। তবু বয়.... বয়ে যায়... মাটির সরা ....খুড়ি....অস্থি ... কোথায় চলেছে....?
সুচিন্তিত মতামত দিন