মনভূম
বাজারের ব্যাগে করে টাকা! লোকটা কী অদ্ভুত আর নির্বিকার। সাদা চেক চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির বুক খোলা, সাদা, চঞ্চল রোমরাজি, একটা ফিনফিনে কিন্তু ভারি হার। সোনার। কোলের ওপরে ব্যাগটা। নিতান্ত সাধারণ বাজার করবার ব্যাগ। মিহি ফাঁকগুলো দিয়ে দেখা যাচ্ছে লাল লাল নোট। বাণ্ডিল, বাণ্ডিল।সব দুহাজারের নোট! ব্যাগের ওপর বাম হাতটি রাখা। হাতের রোম আবার কালো। আঙুলে একটা কী জানি কিসের আঙটি। বুকে ঝোলানো চশমা, দুলছে। সোনার ফ্রেম হবে। লোকটা মাড়ওয়ারি? না-ও হতে পারে। লুঙ্গি পরা তো। ব্যবসায়ী? টাকা কোনো ব্যাপার না? কিছুতেই ওর দিকে তাকানো যাবে না। তাকানো যাবে না ওই টাকার দিকেও।নিজেকে বলে অনি। কিন্তু এ তো নাক ডাকছে। পোষা ভুঁড়িটা শ্বাসের সঙ্গে ফুলছে। চুপসে যাচ্ছে। ফুলে উঠবার সময় সোজা ফুলে ওঠে। দুমড়ে যাবার সময় দুবার কাঁপে।
ওদিকে জানালা। এ বাসটা এসি। এখনও কয়েকটা চলে।আগরতলা-গৌহাটি। ট্রেনে যাওয়া যেত। অনি গেল না।বাসই ওর জন্য ঠিক, ভেবেছে ও। জানালার কাচটা ফিক্সড। আগের মতন নামিয়ে বাইরের বাতাস নেওয়া যায় না এই বাসে। পর্দা লাগানো। অত দামি বাস, অথচ পর্দাগুলো বাংলাবাজারের। অনি এটাকে একটু তুলে দিল। আবার পড়ে যায়। হাতে লাগছে। কাপড়টাতে শীত মেশানো, তবুও এর একটা নিজস্ব উত্তাপ আছে। সেটাই হাতে লাগছে। একসময় একটু সরিয়ে জানালার বাইরে তাকানো গেল। অচেনা সব গাছপালা,বাড়িঘর নেই। রাস্তাটা দারুণ মসৃণ। দূরে মাঠ। লোকে কাজ সেরে ফিরে যাচ্ছে। একটা পাওয়ার টিলারকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে একটা কাদামাখা মানুষ। দূরে। কিন্তু গাড়িটা অত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে কেন? সাঁই সাঁই করে পেছনে চলে যাচ্ছে গাছপালা…
সন্ধ্যা হল। কেমন একটা মায়াবী আলো জ্বলেছে। বাইরে ঘোর অন্ধকার। এখন পাহাড়ি রাস্তা। জানালার কাচের গায়ে বিন্দু বিন্দু জল। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। লোকটা উঠে গিয়ে আবার ফিরেছে। ওই ব্যাগটা সিটে রেখেই গিয়েছিল। একটু আগে যে এক জায়গায় দাঁড়ালো, তখনই কেবল ওই ব্যাগ নিয়ে নেমেছিল। আরেকটা ব্যাগের মধ্যে এই ব্যাগটাকে ঢুকিয়ে নিয়েছিল তখন। কিন্তু থলেটাকে নিল এমনভাবে যেন, বাজার থেকে মাছটাছ কিনে ফিরছে। এখানে একটু চা খাওয়া হল। হাল্কা রুটি আর মটরের ডাল। অনি বহুদিন পর সিগারেট খেয়েছে। লোকটা হাসিমুখে অফার করল। নীরবে। অনিও হাসল।পকেটে হাত দিয়ে দেশলাইটা ছুঁতেই ওর মুখের সামনে একটা টুংটাং আওয়াজ। বেশ সুরেলা।লোকটা লাইটার এগিয়ে দিল। কত দামি হবে এটা? বিদেশি? লোকটা চোখ দিয়ে বলল সিগারেট ধরিয়ে নিতে। অনি ধরাল। আজকে ঠিকই করেছিল কোথাও বসে একটা সিগারেট খাবে। তাই পকেটে দেশলাই নিয়েছিল। কতদিন সিগারেট খায় না। যাক,এই লোকের বদান্যে কিনতে হল না। এখন আবার ঘুমোচ্ছে, আবার সেই নাকডাকা। কোলে ব্যাগ। এখনও সাদা আরেকটা ব্যাগের মধ্যে ঢোকানোই রয়েছে।
কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছে অনিন্দ্য। গৃহত্যাগ। সোজা হিমালয়। পকেটে কিছু টাকা আর কার্ডস। আর ভালো লাগে না এই খিটিমিটি। পাঁচ বছর হয়ে গেল বিয়ের। আজ বিবাহবার্ষিকী। আজই গাড়ি কিনতে হবে। গত ছমাস ধরে এই এক চাপ। বাড়িঘর কিছু করেনি অনি।বাবার আমলের বাড়িটাই ঠিকঠাক করে আছে, বেশ। নেই গ্যারাজ, নেই প্রশস্ত রাস্তা।সরু গলির ভেতরে একতলা পুরনো বাড়ি।তাতে আবার গাড়ি? বিবাহবার্ষিকী এলেই প্রতিবছর কতকত টাকা বেরিয়ে যায়। পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়ে অনিন্দ্য আজ এই জায়গায় এসেছে। ব্যাঙ্কে খাটতেও তার ভালো লাগে। চাইলেই দারুণ একটা বাড়ি করতে পারে। গাড়ি কিনতে পারে। কিছুই করেনি অনি। সে কৃষক হতে চায়। স্বপ্ন দেখে। সন্তানের প্ল্যানও করল না তাই। কেবল জমি কিনছে। কিনে কিনে বাড়িয়ে চলেছে। আজকাল খালি জমি পাওয়া কঠিন। পুরোটা রাজ্যেই রাবার গাছ।সবাই রাবারের বন তৈরি করছে। এই জমিটা বিশাল। মালিক বাংলাদেশী। এখানে একজন আত্মীয়ার নামে কেনা। তিনি থাকেন কলকাতায়। প্রতিবার একটু করে জমি কেনে অনি। আর ওই মহিলার বায়নাক্কা সহ্য করে। আসা যাওয়ার প্লেনভাড়া, হোটেল, উপহার… অনি সহ্য করে। এই হল একটা টিলা। দক্ষিণ দিকটা খোলা। অনেকদূর অব্দি খোলা। অনি ছুটি পেলেই এখানে আসে। মাটির একটা ঘর বানানো হয়েছে। তাতে সব সুবিধা। দক্ষিণে গোল করে একটা পুকুর করেছে। পুকুর কাটায় উঠে আসা মাটিকে নানারকম ট্রিটমেন্ট করা হল। সিজন করা হল ঘর বানাতে। এই ঘর এখনও এদিকের লোকজন বানাতে শেখেনি কেউ। রুরাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করে একটা এনজিও আছে। গৌহাটি বেসড। ওদের কন্ট্রাক্ট দিয়েছিল অনি। ওরা এসে করে দিল। এর চেয়ে ইট কংক্রিটের করলে হয়তো খরচ কম পড়ত ।অনি মাটির ঘরই চেয়েছে। আর কী খাসা বানিয়েছে এরা। শীতে গরম, গরমে ঠান্ডা। আর কেমন একটা গন্ধ। গৃহপূজার দিনে স্বাতীকে এনেছিল,অনেক সাধ্যসাধনা করে। স্বাতী এসবকে পাগলামিই মনে করে। গোবরের তাল, গোহাল, পুকুরের হাঁস সবেতেই তার ঘেন্না লাগে। অথচ ঘরটির বারান্দায় ঝোলানো চেয়ারে বসে যখন দূর দক্ষিণের দিকে তাকায়, অনি কী যেন দেখতে পায়।একটা স্বপ্নকে বড়ো হতে দেখে। পার্মাকালচার করবে সে। একটা অরণ্য নির্মাণ করবে। জগতের যত পোকা, পিঁপড়ে, সাপ, প্রজাপতি সবার জন্য একটু একটু আবাস করে দেবে।বেঁচে থাকতে হলে যা যা দরকার, কিছুই কিনবে না। বাঁচাটাকে কেবল জীবনের প্রাচুর্যে ভরিয়ে তুলবে। অন্য আর কি প্রাচুর্য চাই? এরা কী সুন্দর ডিজাইন করে দিয়ে গেল।চুক্তিটাই এমন। সতীশ দত্ত নামে এক অসমীয়া যুবক এনজিওটার চেয়ারম্যান। ছেলেটা শিল্পী। কেবল স্বপ্ন দেখে। কাজের সময়ে কিছুর অভাব রাখে না। চাঁদ দেখার জন্য, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখবার জন্যও ছোটো ছোটো ঢিবি তৈরি করেছে। সবগুলোতেই আলাদা আলাদা কাঠের পাটাতন, চেয়ার বাহারি টেবিল। এখানে এলে অনিন্দ্য কেমন হয়ে যায়।নিজেকে মানুষ মনেহয়।বাকি সময়টাতে মনেহয় যন্ত্র। এখানে এলেই সে আপনি গুনগুন করে। আর নারুদের পরিবারটাও দারুণ। এরা কত খাটতে পারে, আর কী বিশ্বস্ত। নারুর বউটা খুব ভালো রান্না করতে জানে।এককালের সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবার এরা। আশির দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত হয়েছে। এখন এখানে থাকে। এরাই এইসব দেখেটেখে রাখে। যারা কাজ করে তাদের পাওনাগণ্ডা লিখে রাখে। অনিন্দ্য এলে দেখায়।বেশ আনন্দে আছে এরা এখানে।আনন্দই এদের মাসোহারা। অনেক চেয়েও একটি টাকা দিতে পারেনি অনিন্দ্য। যতটা হয়েছে এই কৃষিপৃথিবী, তাতেই এদের চলে যায়, কিছুই কিনতে হয় না।কেবল রান্নার তেলটুকু।আর জেনারেটরের ডিজেল অনিন্দ্যই নিয়ে আসে। কিন্তু ও না এলে এরা সেটা চালায় না। হ্যারিকেন দিয়েই চালিয়ে নেয়। আজকাল অনিন্দ্যও হ্যারিকেনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কী সুন্দর আলো। যতটা চাই, ততটাই, আলোর অপচয় নেই।
এইসব ভাবতে ভাবতে যেন একটু ঘুমঘুম লাগল। তড়াক করে সে দেখে নেয় ছোটো স্লিং ব্যাগটা।‘মনভূম’ সে নারুদাকে দিয়ে যাবে।নারুদা ছাড়া কে আর পারবে একে রক্ষা করতে? ছোটোবেলা থেকে এদের কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছে সে। উর্বর মাটির মতন গায়ের রং, উজ্জ্বল ফসলের মতন চেহারা। এরাই অনির স্বপ্নকে বয়ে নিতে পারবে। বলবার আগেই নারুদা আর তার বন্ধ্যা স্ত্রী বুঝে ফেলে, কী চাইছে অনি। সবকিছু অত সুন্দর করে সাজায়।এইখানে কী সুন্দর লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করে কারা? কারা প্রতিটি গাছকে এক-এক করে চেনে? এদের কাছে দেবে না তো, কাকে দেওয়া যাবে? দানসংক্রান্ত সব পেপার্স এই ব্যাগটাতে। আর এটা সে দেবে ওই এনজিও-র সঙ্গে চুক্তি করে। কাজ থামানো যাবে না।প্রজেক্ট শেষ করবার সবটা টাকাই এদের দিয়ে যাবে। আর যতটা পেনশন আসবে, তাতে ওর হয়ে যাবে। স্বাতীকেও পাঠানো যাবে। সে অন্যকিছু করে ফেললে? করুকগে। বিয়েই তো করবে, আর গাড়িবাড়ি এসব। শুধু মনভূমের জন্য মন পুড়বে, বুঝতে পারে অনি।ব্যাঙ্কও মনে পড়বে। হঠাৎ স্বেচ্ছা অবসরের চিঠি পেয়ে ব্যাঙ্ক অবাক। কতবার ফোন এল। এমনকি হেড অফিস থেকে ই-মেল এল। এসব আর এখন ভাবতে চায় না।তখন সারাদিন মনভূম নিয়েই ভাবত সে,কী নাম দেওয়া যায় এই অরণ্যের? অনেক অনেক নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছে সেই ভেবে। সতীশ একটা সাইন তৈরি করে দিয়েছিল।কাঠের। খালি রেখে গিয়েছিল। নাম ঠিক করে নিয়ে তাতে লিখবার জন্য। সেই প্রিয় মাটির ঘরে শুয়েই নামটা মনে এল একদিন। এখন তো কৃষি, পার্মাকালচার ছাড়া কিছু পড়ে না। আর খালি এ সংক্রান্ত ভিডিও দেখে নেট খুঁজে খুঁজে। কী একটা পড়তে গিয়ে মানভূম শব্দটা এল।সেটা একটা জায়গার নাম।তাকে একটু পালটেই এই মনভূম।
ঘুমঘুম ভাব। কিন্তু ঘুম আসছে না। একটু নির্ভার লাগছে বটে, কিন্তু মন শান্ত হচ্ছে না।
- কিছু দেবে না এবার?
- কোনবার দিই না?
- সোজা করে কথা বলতে পারো না?
- সরি, কী দিতে হবে বল
- টয়োটা ফর্চুনা
- সে আবার কী?
- ওই দেখ, গাড়ি আরকি। কী সুন্দর পুরুষালী, মাসকুলার
- গাড়িরও মাসল?
- সে তুমি বুঝবে না
- হুম
- কী হুম?
- কত?
- বেসিকটা আঠাশ আর সুপারটা চৌত্রিশ।
লাফ দিয়ে উঠে বসে অনি, ‘চৌত্রিশ লাখ’?
- আমার জন্য যেটা রেখেছিলে, সেটা ম্যাচিউর করেছে। তুলে এনেছি। দশ ওখানে হয়ে যাবে। বাকিটা ফিনান্স করিয়ে নেবে। একটু একটু করে ইএমআই ।
- মানে? লোন নিতে বলছ?
- সবাই তা করে, পুরো টাকা দিয়ে গাড়ি কে কেনে?
- টাকাটা তুলে নিয়ে চলে এলে?
- সেটা তো আমার
- তোমার? তো, তাতেই তো একটা গাড়ি হয়ে যায়। চৌত্রিশ কেন? আর আমি তো ওই টাকা রেখেছিলাম, মনভূমে একটা গোটারি করব বলে।
- এই তো চাষার ছেলে বেরিয়ে এল। গরুছাগল ছাড়া মাথায় কিছু থাকে না।আসেও না। সারাক্ষণ গায়ে ওসবের গন্ধ।
চুপ হয়ে যায় অনি। এই খোঁটাটা খেতে খেতে সত্যিই রোগগ্রস্ত হয়ে গেল সে। কতরকমের এসেন্স, কত বডি স্প্রে, স্নানের জলে মেশানোর সুগন্ধি যে সে কেনে। বস এলে, কাস্টমার এলে, কোনো মহিলার কাছাকাছি গেলে নিজের নাকে নিজের গন্ধ পায়। কুঁকড়ে যায় ভেতর থেকে। সবচেয়ে অসুবিধে হয় মিটিঙের সময়।
ধীরে উঠে চলে যায় এখন। স্টাডিতে চলে আসে। বসে থাকে। একটু হুইস্কি বানিয়ে খায়। মাথা ভোঁ ভোঁ করে।
এঘরেই উঠে এল স্বাতী
- আমি সবাইকে বলে দিয়েছি। আর ওদের সেলসেও কথা বলেছি।কালকে একজন আসবে। কী কী লাগবে সব নিয়ে যাবে। গুছিয়ে রেখো। কালই যেন দিয়ে দেওয়া যায়। ওরাই সবটা প্রসেস করবে।
- আই হেট লোন। তুমি জান, কত লোক সর্বস্বান্ত হয়ে যায় শখের জন্য ঋণ করে? হয় দশের মধ্যে কোনো গাড়ি কিনে ফেল, নাহয় ওই টাকা আমাকে দাও। গোটারিটা দরকার।
- মানে? ছাগল হল নেসেসিটি আর গাড়ি শখ? থাকো তুমি ছাগল নিয়ে, সকালেই আমি যাচ্ছি।
আরেকটু মদ খেয়ে নেয় অনি, ‘আচ্ছা’
- হোয়াট ডু ইয়ু মিন, আচ্ছা?
- যেও
ধুপধাপ করে বেরিয়ে যায় স্বাতী। কী যেন ভাঙছে। কাচের কিছু হবে। ইস পা কাটবে… কাটুকগে। আজ আর যায় না ও-ঘরে।এসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে অনি। বরং একটা স্প্রে বের করে সারা শরীরে মেখে নেয়। মাথা ঝিমঝিম। তার মধ্যেই সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলে। চলে যাবে সে।
মুখটা তেতো লাগছে। এখন রাত। বাসের বাতি জ্বলেছে। খুব খেটে খেটে যাচ্ছে বাসটা। রাস্তা খুবই খারাপ। মাঝে মাঝে অবশ্য স্পিডও দিচ্ছে। লোকটা ঘুমোচ্ছে, নাক ডাকছে। এভাবে যাচ্ছে কেন বাসটা? যেন উড়ছে। সকলে ঘুমোচ্ছে আর বাস যেন উড়ছে। এক মুহূর্ত পরেই বুঝে ফেলে অনি, গাড়িটা পড়ে যাচ্ছে। কত গভীর খাদ কে জানে। চোখ বন্ধ করে রাখে সে। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করছে।আর্ত। লোকটা ঘুমোচ্ছে পাশে। দুবার ঠেলল, আর তখুনি হুড়মুড় করে গাড়িটা মাটিতে পড়ল। অন্ধকার হয়ে গেল সব।
কী অন্ধকার, কী অন্ধকার! বাইরে বৃষ্টির ছাঁট এসে চোখেমুখে লাগছে। কেউ কি বেঁচে আছে? নিজেকে হাতড়ে দেখে অনি। কিছুই হল না তার? এমনকি চশমাটাও অক্ষত, মোবাইলটাও ঠিকঠাক। জ্বালে সেটাকে। কী বীভৎসভাবে পড়ে আছে লোকটা, টাকার ব্যাগটা সিটে। সেখানেই তার একটা পা। বাকি শরীরটা কেমন বেঁকিয়ে গিয়ে সামনের সিটের হেলানের ওপরে… রক্ত রক্ত… কী করবে ভাবতেই মাথাটা ঘুরে গেল অনির। তড়াক করে টাকার ব্যাগটা হাতে নেয়। লাথি মেরে মেরে জানালার কাচ ভেঙেই ফেলে। কিন্তু বেরোতে পারছে না। কোনওমতে শরীরের ওপরটা বের করে আনে অনি। বাইরে থেকে কে যেন খুব জোরে টান দেয় ওর দুহাত ধরে। বেরিয়ে আসে সে। সামনে সেই বামনটা।
একটা মাঝবয়সী মানুষ। তিনফুট হবে? কিন্তু ওর শরীরে অত শক্তি? অনিকে বের করে বামনটা সেই টাকাওয়ালা লোকের শরীর ধরে টানাটানি করছে। সারাক্ষণ ওই লোকটার সঙ্গেই ছিল। খাবার সময়েও।জল এনে দিচ্ছে। একটু খইনি ডলে দিচ্ছে। সে ছিল আইলের অন্যদিকের সিটে, ওদের পাশেই। এখন কী করা যায়? ভিজে একসা হয়ে গেছে। মোবাইলটা নিভিয়ে দেয়। হাতে টাকার ব্যাগ। অনি একটা অন্ধকারের দিকেই হাঁটতে শুরু করে দিল।
কী একটা লেগেছে পায়ে, চিনচিন করছে। কিন্তু তেমন কিছু নয়। অনি হেঁটেই চলেছে। বৃষ্টি হচ্ছে অবিরাম। কত লোক মরে গেল? কত যেন ব্যথায় কাতরাচ্ছে। কাউকে ফোন করা যায়? ফোন বার করে। আলো। কিন্তু টাওয়ার নেই। ফোন পকেটে রাখতে গিয়েই আবার দেখল ওই সাদা পোশাকের বামনটাকে। নীরবে পিছু নিয়েছে সে। টাকার ব্যাগটা আরও শক্ত করে ধরে অনি। হাঁটে। বামনের কি পায়ের শব্দ হয় না? অত নিঃশব্দে সারাটা পথ ফলো করে আসছে? এখন তো প্রায় দুমিটার দূরত্ব রেখে হেঁটে চলেছে। কিছু বলছেও না। কেবল ফলো করছে। পেচ্ছাপ পায় অনির। সারা শরীর ভেজা। বৃষ্টিও। অনি দাঁড়ায় না। হাল্কা করে দেয় নিজেকে। পা বেয়ে নেমে যাচ্ছে জল। হাঁটা বন্ধ করে না।
কতটা হেঁটেছে ওরা? বামনটা সামনে আসে না। কিছু বলেও না, নীরবে আসছে। একটা সাদা রং আছে পেছনে। বোঝা যাচ্ছে। অনি পেছনে না তাকিয়েও দেখতে পায়। ও কি ভাগ চাইবে টাকার? নাকি ওর কোমরে গোঁজা আছে পিস্তল? ওরা কোনো গ্যাঙের নয় তো? অনি ভাবে না। সে কেবল অন্ধকারে একটা পেশল গাড়িকে দেখতে পায়। সকাল হলেই ফিরে যাবে। সব টাকা স্বাতীর কাছে দিয়ে চিরকালের জন্য মনভূমে। একটা ডিভোর্সের ছোটো মামলা করতে হবে খালি। কিন্তু এমন দুর্বল লাগছে কেন? আর প্রস্রাবও থামছে না। অত জল কোথা হতে এল শরীরে? বৃষ্টি বলে? অনি ফোনটা জ্বালে। দেখে। জল নয় বেরিয়ে যাচ্ছে রক্ত। কোনো ব্যথা নেই, কিছু নেই। কেবল অনর্গল রক্ত বয়ে চলেছে। এই জায়গাটা সমতল। একটা টিলার ওপরে। অনি বসে, ক্লান্তি বেড়ে যায় অনেক। কেমন তেষ্টা পাচ্ছে। টাকার ব্যাগটা পাশে মাটিতে রেখে মাটিতেই বসে পড়ে।ছোটো ছোটো উলুখাগড়া।খোঁচা লাগল। গা করে না।একটু দূরে ওই সাদা বামনটাও বসেছে।নাকি শুয়ে পড়ল? নাকি ঠাস করে পড়ে গেল মাটিতে? মাথা ঝিমঝিম করছে। টাকাগুলো ভিজে গেল? কিন্তু এটা ঠিক কেমন অনুভূতি? অজ্ঞান হয়ে যাবে? কেমন শীত লাগছে তার। একটু জল আর উত্তাপ চাই। কেউ কি নেই কোথাও? বামনটাকে বললে রক্ত বন্ধ করতে পারবে? সবগুলো টাকা দিয়ে দিলে করে দেবে না? কিন্তু ও কেন এমন করে শুয়ে পড়ল? মরে গেল না তো? দূর দূর কোথাও কোনো আলো নেই। এটা কি আসামের জঙ্গল নাকি মেঘালয়ে? কেমন যেন একটা বমি ভাব। নিজের লিঙ্গটিকে চেপে ধরে অনি। একটা পেশল গাড়ি, একটা নিজের গড়া অরণ্য, একটা সুন্দর সম্পন্ন কৃষিজীবন সব ঘোলাটে হয়ে যায়। এ রক্ত থামবার নয়? কী যেন মনে হতে পকেটে হাত দেয় অনি। দেশলাইটা বার করে। সবটা ভেজেনি, তবে অনেকটাই ভিজেছে। সাদা একটা টাকাভর্তি ব্যাগ, একটু দূরে সাদা একটা বেঁটে লোক আর পায়ের পথ ধরে গলগল রক্ত।গাড়িটা পড়ার সময় কোথায় লেগেছিল? তলপেটে নাকি ওইখানে? এখন আর কিছু ভাবতেই পারছে না। কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে সব। তবু, অনি চেষ্টা করে… একবার দুবার… জ্বলল। হাতের আড়াল করে সাদা ব্যাগটাতে আগুনটা ছোঁয়ায়। ব্যাগটা প্লাস্টিকের। প্রথমে জ্বলতে চায়নি। কয়েকবারের চেষ্টায় জ্বলে উঠল। বৃষ্টিও এখন কম। কেবল রক্তটাই বন্ধ হচ্ছে না। ঘুম আসছে, ঘুম।
এ গল্পের ঘোর সহজে কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।
উত্তরমুছুন