মনে থাকবে
আর কতদিন এবাড়িতে আমি থাকব জানি না। আনলক মিটে গেলেই এখানকার পাট চুকে যাবে। ফিরে যেতে হবে বাবার কাছে, আমার নিজের সেই চৌখুপি ঘরে। ফেলে-আসা দিনগুলোর ছায়ায় বসে থাকব, নিজের বৃত্তে, নিজের মতো করে, হয়তো-বা। কিংবা হয়তো শুরু হবে অন্য কোনও ভোর। আমি ঠিক জানি না, কী সেই ভবিষ্যৎ।
কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিল শিউলি। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে রাতের দিকে। বাইরের গাঢ় অন্ধকারে তার চোখ। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে আছে সে।
পাশের ঘরে ছেলেটা পড়ছে। সত্যিই পড়ছে তো? মা কাছে না-থাকলে ও পড়তেই চায় না সেভাবে। দাদার পাশে মাদুরে বসে মেয়েটা একা একাই বকবক করে চলেছে। এটা ওর স্বভাব। নিজের মতো খেলে আর কথা বলে। সব কথার অর্থ থাকে না। কিংবা হয়তো থাকে, বাকি পৃথিবী বুঝতে পারে না। ওর আধো-আধো কথা শুনতে বেশ লাগে। মেয়েটার আর পাঁচজনের মতো নয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। কখনও চুপচাপ বসে থাকে, কখনও নিজস্ব ভাষায় অনর্গল কথা বলে যায়। দেখতে দেখতে দশ বছর বয়স হয়ে গেল। কথাবার্তা আর আচরণে এখনও পুচু যেন তিন-চার বছরের মেয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে আসে শিউলির ভেতর থেকে। শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁদের ঘরে সিরিয়াল দেখছেন। দেবাশিস অনলাইনে অফিসের কাজ করে যাচ্ছে দোতলার ঘরে।
আচমকা আকাশ চিরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। এইরকমই না চিরে দিয়েছিল তার হাতটা দেবাশিস? কাচের ভাঙা গ্লাশটা দিয়ে? ঝরঝর করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছিল। বাড়িতে ফার্স্ট এইডের সব সরঞ্জামই আছে। তবু ইচ্ছে করেনি রক্ত বন্ধ করার জন্য উঠে যেতে। যন্ত্রণা গিলে শিউলি দেখে যাচ্ছিল রক্তপড়া। দেবাশিসের কি একটুও মায়া হয়নি সেসব দেখে? মনে হয় না। হলে নিশ্চয়ই কিছু একটা করত। তার বদলে বিরক্তি নিয়ে চলে গিয়েছিল জানালার দিকে। ফস করে সিগারেট ধরিয়ে নির্বিকার টেনে যাচ্ছিল। এইরকম পারে কেউ? পারা উচিত? দেবাশিসের পক্ষে অবশ্য সবই সম্ভব।
এইসব ভাবনার মধ্যেই নিজের ভেতরে রক্তক্ষরণ টের পায় শিউলি। উঠে গিয়ে দেখে আসে বাবাই একমনে বসে অঙ্ক করছে। পুচুর সামনে একটা বই খোলা। রঙিন মলাটে পশুপাখিদের নিয়ে ছড়ার বই। পড়ার বইয়ের বাইরে আর-একটা বই আছে ওর। প্রজাপতির ছবি দেওয়া সেই বইটাও পুচুর খুব প্রিয়। পুচু ওর ডাকনাম। এমনিতে কী যে প্রিয় মেয়ের, বোঝার উপায় নেই। তবু যখনতখন এই বইদুটো নিয়ে বসে পুচু। ও কি প্রজাপতি হতে চায়? নাকি পাখিদের মতো উড়ে যেতে চায় কোথাও?
পুচুর ভালো নাম সুপ্রীতি। শিউলির বাবার দেওয়া নাম। এই নিয়ে দেবাশিসের খুব আপত্তি ছিল। ছেলের নাম দেবমাল্য। নিজের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে নাম রেখেছিল। এটা নাকি ওদের বাড়ির রীতি। তাই মেয়ের নামও বাবার নামের আদ্যক্ষর দ দিয়েই রাখতে হবে।
তোমার বাবার নাম দেবতোষ, তোমার নাম দ দিয়েই রাখা। তাহলে তোমার বোনের নাম বাণী কেন?
ও সরস্বতী পুজোর দিন হয়েছিল বলে বাণী নাম রেখেছিলেন আমার দাদু।
তার মানে ব্রেক হল তো? আমার মেয়ের বেলায় হবে না কেন?
সবকিছু নিয়ে তুমি তর্ক করো কেন? দ দিয়ে কি ভালো নাম রাখা যায় না? হাজারটা ভালো নাম হয়।
যাবে না কেন? কিন্তু তোমার দাদুর দেওয়া নাম রাখা গেল আর পুচুর দাদুর দেওয়া নামে দোষ হয়ে গেল? সব শুনে শাশুড়ি আপত্তি করেননি। থাক না দেবা, নামটা খারাপ কি? ও যখন চাইছে…
তুমি চুপ করে থাকো। আমার মেয়ের নাম দ দিয়েই হবে। অন্যকিছু মানব না আমি।
শিউলির শাশুড়ি নিজের বাবার দেওয়া নাম রাখার ব্যাপারটা মনে করে যুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, তোর বাবা কিন্তু বাণী নামটা মেনে নিয়েছিলেন।
তাতে কী? আমাকেও মেনে নিতে হবে নাকি?
শোন দেবা, এইসব ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা করতে নেই। মেয়ে তো ওরও। শিউলি-মায়ের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিবি না? ওদের মাঝখানে ঢুকে দেবাশিসের বাবা সমাধান বের করার চেষ্টা করেছিলেন। শ্বশুরমশাই সবসময়ই শিউলি-মা বলে সম্বোধন করেন। শিউলির খুব ভালো লাগে। বুঝতে পারে ওনার পক্ষপাতিত্ব আছে বৌমার প্রতি।
বাবার কথা শুনে আর কথা বাড়ায়নি দেবাশিস। বাবার ওপর কথা বলার সাহস নেই ওর। এটাও এবাড়ির রীতি। বাড়ির কর্তা বাবা। তাঁর মুখের ওপর কথা বলা যাবে না। কিন্তু মা যেন এলেবেলে, তাঁকে উপেক্ষা করা যায়, অপদস্থও করা যায়। লক্ষ্য করে দেখেছে শিউলি। ঠিক যেমন তার কথার কোনও গুরুত্ব দিতে নারাজ দেবাশিস।
ছেলেমেয়েরা থাকুক ওদের মতো। এখন শিউলি নিজের মধ্যে সময় কাটাতে চায়। আকাশে মেঘেরা গুমগুম শব্দে একে অপরের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ চমকে উঠছে মাঝে মাঝে। তার আর দেবাশিসের মধ্যে যেমন বিদ্যুৎচমক দেখা যেত। সেসব বহুদিনই চুকেবুকে গেছে।
শমিতা নিজের বিয়ের পরেপরেই একদিন বলেছিল, জানিস শিউ, বিশ্ব যখন আমার কাছাকাছি আসে, বুকের মধ্যে কেমন যেন গুমগুম করে শব্দ হয়। আর কীরকম যেন আলো জ্বলে ওঠে। শুনে শিউলি অবাক হয়েছিল। এরকম হয় বুঝি! একটা রোমাঞ্চ তাকে ঘিরে ধরেছিল। তার বিয়ের পরে শিউলি বুঝেছে, শমিতা কথাটা ভুল বলেনি। ফুলশয্যার রাতেই সে টের পেয়েছিল, সত্যিই বুকে মধ্যে মেঘের গুরুগুরু শোনা যায়, কানে হাজার ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ বেজে চলে। অপার্থিব আলোর উপস্থিতিও অনুভব করতে পেরেছিল সেদিন।
দেবাশিসের অফিস থেকে ফেরার সময় হলেই কেমন একটা গন্ধ ভেসে আসত শিউলির নাকে। অস্থির হয়ে উঠত মন। দেবাশিস কাছাকাছি এলে সেই গন্ধটা আরও মিষ্টি হয়ে উঠত। তিরতির করে কেঁপে উঠত চোখের পাতা। আর বুকের মধ্যে মেঘডাকা ধ্বনি। যদিও দেবাশিসের মধ্যে তেমন কোনও ভাবান্তর লক্ষ্য করেনি শিউলি। প্রথম থেকেই কেমন যেন ছাড়া-ছাড়া ভাব। শিউলি রোমাঞ্চের কথা বললে দেবাশিস অবাক হয়ে দেখত শিউলিকে। তাই আর শিউলি বলত না তার মনের কথা। হয়তো দেবাশিসের ভালো লাগে না, বিরক্ত হয়। এসব ভেবেই সমস্ত অনুভব গিলে ফেলত। তবে প্রতিদিনই শরীরী খেলায় মেতে উঠত দুজনে। কী যে ভালো লাগত শিউলির! শমিতাকে বলেছিল সেকথা। হিহি করে হেসেছিল সে। তুই খুব লাকি শিউ। তোর বর তোকে খুব ভালোবাসে। অথচ দ্যাখ, তোর বিয়ে হয়েছে খবরের কাগজ দেখে। আর আমি প্রেম করে বিয়ে করলাম। বিশ্বটা এত ম্যাদামারা, আগে বুঝতে পারিনি রে।
মাস কয়েক পরে শিউলি বুঝতে পারে, তার শরীরটাকে যন্ত্র মনে করে দেবাশিস। কোনও আবেগ নেই, শুধুই যৌনতা। কাজ সারা হয়ে গেলে দেবাশিস পাশ ফিরে শুয়ে পড়ত। শিউলি গভীর আবেশে তার হাঁটু তুলে দিত দেবার কোমরের ওপরে। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরত। দেবা সরিয়ে দিত হাঁটু আর হাত। পরের দিকে স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ করত। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল শিউলি। অনেক আগে থেকেই অবশ্য শিউলির সব ব্যাপারে বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাত দেবাশিস। একসময় শারীরিক মিলনও আর চাইত না সে। শিউলিও স্বস্তি পেয়েছিল। যে মিলনে ভালোবাসা নেই, যন্ত্রের মতো সেই মিলন সেও চায় না আর। ততদিনে জেনে গেছে দেবাশিস অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও আছে, দেবাশিস নিজেই স্বীকার করে নিয়েছিল।
রাতের খাওয়ার পরে দেবাশিস তখন মোবাইল নিয়ে শুয়ে শুয়ে চ্যাট করছিল। কিংবা ফেসবুকে মজে ছিল। ঠিক বুঝতে পারছিল না শিউলি। মশারির ভেতর ঢোকার আগে মুখে আলতো করে নাইট ক্রিম ছুঁয়ে নেওয়া ওর অভ্যেস। সেসব শেষ হলে ড্রেসিং টেবিলের পাশে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে গলায় কিছুটা জল ঢেলে তারপর বিছানায় যায়।
আমার কী কম আছে শুনি? কেন আমার শরীর আর ভালো লাগে না? অন্য কোথাও পেয়ে গেছ বুঝি? দেবাশিসের কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল শিউলি।
আহ্, মাঝরাতে নাটক কোরো না। আমি আমার কথা স্পষ্ট করেই বলেছি।
কী কম আছে আমার শুনতে চাই! বলতেই হবে আমাকে। জেদ ধরেছিল শিউলি।
কমবেশি বুঝি না। আমাকে টানে না তোমার শরীর। ব্যস।
ও, টানে না? এখন বুঝি অন্য কেউ টানছে? শিউলি জানত দেবাশিসের সম্পর্কের কথা। তবু সরাসরি বলতে চায়নি।
হ্যাঁ টানছে। হল? ঐ তো বাদামের ঠোঙার মতো ছোট্ট ছোট্ট বুক। সরু সরু হাত। তার আবার এত বড়াই কীসের কমবেশি নিয়ে?
একটা ভয়ংকর ঝাঁকুনি খেয়েছিল শিউলি। ইউনিভার্সিটিতে বাংলার সুব্রত সবার পেছনে লাগত। একবার শিউলিকে বলেছিল, ফুলশয্যার রাতে তোর কপালে দুঃখ আছে মাইরি!
কেন, কেন? চোখে হাসির ঝিলিক কেটে জিজ্ঞাসা করেছিল শিউলি। কৌতুকের ইশারায় ভ্রু-যুগল উঠে গিয়েছিল ওপরে।
তোর বর সারারাত ধরে খুঁজবে। ওখানে মাংসই তো নেই। নাবাল জমি। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বে বেচারা।
দুম করে সুব্রতর পিঠে একটা কিল বসিয়ে শিউলি বলেছিল, অসভ্য ছেলে! এইসব দেখে বেড়াস? হাসিতে গড়িয়ে পড়েছিল শিউলি। সেই সঙ্গে অন্যরাও।
দেখি কি আর সাধে? তোর ভবিষ্যৎ ভেবে চিন্তা হয় বলেই দেখি। যদি চাস তো বড় বড় করে দিতে পারি। কথাটা বলেই মাঠের মধ্যে ছুটে চলে গিয়েছিল সুব্রত। শিউলিও পিছন পিছন ছুটে ধরার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। হাঁপিয়ে গিয়েছিল।
দাঁড়া, বিতস্তাকে বলছি তুই আমাকে কী বলেছিস। পিটিয়ে চামড়া গুটিয়ে দেবে তোর।
হ্যাঁ রে বলিস ওকে, প্লিজ। তাহলে বুঝবে আমার ক্ষমতা আছে বড় করার।
এই নিয়ে আরও কিছুক্ষণ হইহই মজা হয়েছিল। কিন্তু সেসব ছিল নিছক মজা। দেবাশিস তো মজা করেনি! সিরিয়াসলিই বলেছে। এটা ঠিক যে ওর স্তনের সাইজ ছোট। কিন্তু এত ছোট নয় যে ওভাবে বলতে হবে। রাগে, দুঃখে, ঘেন্নায় সারা শরীর চিড়বিড় করে উঠেছিল সেদিন। সারারাত ঘুম আসেনি। দুজনের মাঝখানে একটা পাশবালিশ এভারেস্টের উচ্চতা নিয়ে পড়েছিল।
শ্বশুর-শাশুড়ির কথা ভেবে চুপ করেই ছিল শিউলি। তবে মেয়ে জন্মানোর পরে আলাদা করে নিয়েছিল বিছানা। জায়গায় কুলোয় না বলে সহজেই সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছিল সে। আর তখন থেকেই দেবাশিসের শরীর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছিল। মন থেকে সরে গিয়েছিল অনেক আগেই।
আমার প্রতি তোমার কোনও দুর্বলতা নেই জানি। কী হবে এইরকম একটা সম্পর্ক টেনে নিয়ে গিয়ে? আমি এবার মুক্তি চাই। একদিন স্পষ্ট করে বলেছিল শিউলি।
আর ছেলেমেয়ে?
আমার কাছেই থাকবে। ওদের ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
বেশ। আমার কোনও আপত্তি নেই। সরাসরি বলে দিয়েছিল দেবাশিস। এতটা সপাট জবাব আসবে, ভাবেনি শিউলি। তাই শুনেই থামকে গিয়েছিল। ছেলেমেয়ের প্রতিও টান নেই এই লোকটার? ভেতর থেকে দলা পাকানো কান্না বেরিয়ে এসেছিল। কান্নাস্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। একসময় সেই কান্না শুকিয়েও গেল। ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল বুকে।
পরদিনই বাবাকে ফোনে বলেছে শিউলি, আর এখানে থাকা যায় না বাবা। আমি তোমার কাছে ফিরে যেতে চাই। বাবা অনেক বুঝিয়েছিলেন। শিউলির মাও বলেছিলেন মানিয়ে নিতে। শাশুড়ি, শ্বশুরও ঝামেলা মিটিয়ে নিয়ে মানিয়ে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়, জানে শিউলি। অবশ্য দেবাশিসও আর সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে রাজি নয়। মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই নেই। এই প্রথম শিউলি আর দেবাশিসের মতের মিল হল একেবারে। আর এই প্রথম দেবাশিস তার বাবার মতামত রাখবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
দেখো বউমা, অনেক চেষ্টা করলাম মিল করতে তোমাদের। হল না। যাবেই যখন, আর কিছুদিন অপেক্ষা করো। চৈত্র মাসে বিড়াল-কুকুরকেও ঘরছাড়া করতে নেই মা। এই কথাটুকু অন্তত মানো। বলেছিলেন শাশুড়ি। ব্যর্থতার যন্ত্রণা শ্বশুরমাশাইয়ের চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল। শাশুড়ি যখন এসব বলছেন, তিনি চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন শিউলির দিকে। তাঁর চোখেও ছিল অনুনয়। শিউলি তাই মেনে নিয়েছে কথাটা। কিন্তু কদিন পরেই লকডাউনের ঘোষণা।
করোনা অতিমারির দাপটে গোটা বিশ্ব ত্রস্ত। প্রতিনিয়ত মৃত্যু আর আতঙ্কের ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে। এ দেশেও থাবা বসিয়েছে ভালোভাবেই। তাই শুরু হয়ে গিয়েছিল লকডাউন। এরপর থেকে বারবার বেড়ে গেছে লকডাউনের মেয়াদ। এর মধ্যে চৈত্র শেষ হয়ে মাস গড়িয়ে চলেছে একের পর এক। প্রতিবারই মনে হয়েছে, আর কদিন পরেই ফিরে যেতে হবে। কিন্তু তা আর হয়নি। আনলক শুরু হওয়ার পরে বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। ট্রেন চালু হয়নি। এত দূরের পথ বাসে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া যে ভিড় হচ্ছে, তাতে ওর যা খুশি হোক, ছেলেমেয়ের যদি কোনওভাবে সংক্রমণ হয়! সেই ভয়েই যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আর-একটু স্বাভাবিক হোক চারপাশ, তখন সে চলে যাবে, একেবারেই চলে যাবে। ভাবে শিউলি। যদিও এই নিয়ে দেবাশিসও আর কিছু বলেনি। তবে শিউলির কাছে অতিমারির থেকেও ভয়ংকর মনে হচ্ছে এবাড়ির বসবাস।
যখন শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে শ্রমিকেরা ফিরে যাচ্ছিল নিজস্ব ঠিকানায়, তখন শিউলির মনে হয়েছিল সেও তো আসলে শ্রমিকই। এবাড়ির নানা কাজ তাকে করে যেতে হয় শ্রমিকের মতো। এমনকি ভালোবাসাহীন, আবেগবর্জিত যৌনতাতেও সে শ্রমিকের মতোই শ্রমদান করে গেছে। কিন্তু এই যুক্তিতে তো আর শ্রমিক স্পেশালে চেপে বসা যায় না!
সারারাত বৃষ্টির পরে ভোরের দিকে থেমেছে। বৃষ্টিশেষের সকালটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দেখতে। লকডাউনের আগে রান্নার দিদি আসত সকাল-সকাল। তার আগে দিন ও রাতের রান্নার আনাজপাতি সাজিয়ে রাখতে হত। সেই অনুযায়ী রান্না করে দিয়ে যেত। সকালের টিফিন, দুপুরের খাবার আর রাতের রুটি খাওয়ার তরকারি আলাদা আলাদা পাত্রে রেখে দিতে হয়। এও এক নিয়ম এবাড়ির। লকডাউনের সময় থেকে রান্নার লোকের ছুটি। প্রথম দু-মাস মাইনে পাঠিয়ে দিয়েছিল দেবাশিস। তারপর বন্ধ করে দিয়েছে। যার মাধ্যমে রমলাদি এখানে রান্নার কাজে ঢুকেছিল, তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর রান্নার লোকের দরকার নেই। সেই থেকে শিউলিই সব কাজ করে। রান্না, বাসান মাজা, ঘর ঝাড়ামোছা, সব ধরনের কাজের লোকই ছিল, এবং এখন আর কেউ নেই শিউলি ছাড়া।
রান্নার কাজ সেরে শিউলি এক চিলতে বাগানে চলে এসেছে। অনেক যত্নে সে এই বাগানটা গড়ে তুলেছে। কাঞ্চন, আর কিছুদিন বাদেই চলে যাচ্ছি রে! ভালো থাকিস। সময়মত ফুল ফুটাবি জানি। আমার কথা মনে থাকবে তোর? কাঞ্চন গাছের পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে শিউলি। সাদা গোলাপ, বেলফুল, গন্ধরাজ গাছের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় সে। ঘরে এসে ক্যাকটাসের কাঁটায় আঙুল রাখে। এত কাঁটা নিয়ে কী করে থাকিস রে তুই? আমি পারলাম না, জানিস? ভালো থাকিস। মনে থাকবে আমার কথা? সত্যি করে বল, মনে থাকবে তো?
মনে থাকবে, মনে থাকবে, মনে থাকবে… শব্দগুচ্ছ ভেসে আসে শিউলির কানে। ক্যাকটাস বলছে! ঐ তো কাঞ্চনগাছও বলছে, সাদা গোলাপ বলছে, বেলফুল, গন্ধরাজ, ছাদে ওঠার সিঁড়ি, জানালা-দরজার পর্দা, ড্রেসিং টেবিলের আয়না… সবাই বলছে একই কথা! মনে থাকবে, মনে থাকবে, মনে থাকবে…। দলাপাকানো কান্নায় গলা বুজে আসে শিউলির। থরথর করে কেঁপে-ওঠা শরীরটাকে কোনওক্রমে টেনে নিয়ে বিছানায় আছড়ে ফেলে সে।
খুব সুন্দর
উত্তরমুছুন